বাংলাদেশ একটি নদীমাতৃক দেশ। ছোটবেলায় এটা শিখে শিখে নদীর প্রতি কেমন যেন আলাদা একটা ভালবাসা তৈরি হয়েছিল। যদিও আমি সাঁতার না জানা, দূরন্তপনায় নদীতে ঝাঁপ না দেয়া ছেলে; তবু নদীর প্রতি একটা টান আছে। নদীতে জ্যোত্স্না দেখা, সূর্যাস্ত দেখা, এসব সাগরের থেকে নদীতে দেখতেই বেশি ভাল লাগে। ছোটবেলায় রঙ তুলি দিয়ে অনেক এঁকেছি নদীর ছবি। নদীর পাশে কাশবনের ছবি। নদীতে নৌকার ছবি। বড় হয়ে হুমায়ূন আহমেদের হিমুর সব উপন্যাসে ময়ুরাক্ষী নদীর মোহনায় হয়েছি আরও বেশি মোহিত। ভাবতাম “আমার একটা নদী ছিল জানতো না তো কেউ”। আমার ইচ্ছা সময় সুযোগ হলে দেশের সব নদী ভ্রমণে বের হবো। শুধু নদী ভ্রমণ। আমার অফিসের টেবিলের ছোট দিনপঞ্জিতে ১২টা নদীর ছবি এবং বর্ণনা আছে। কাজ না থাকলে মাস উল্টিয়ে উল্টিয়ে নদীর ছবি দেখি। ভাল লাগে।
এখন কষ্টের কথা বলি। মনে হয় একসময় বলতে হবে শুধু “আমার একটা নদী ছিল” কারণ সব অতীত হয়ে যাবে। থাকবে না কোন নদী এই নদীমাতৃক বাংলাদেশে। নদীকে মেরে ফেলা হচ্ছে দিনে দিনে। কত নদী এখন আর নেই। শুধু ধু ধু বালুচর। সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকে নদীর এই বেহাল অবস্থা নিয়ে একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। দেখে আমি আঁতকে উঠেছি। মহাকবি মাইকেল মধুসূধনের কপোতাক্ষ নদ এখন মৃত প্রায়। দখল, চাষাবাদ, এমনকি কয়েক স্থানে বহুতল ভবন নির্মাণ করে কপোতাক্ষ এখন প্রভাবশালীদের দখলে। অস্তিত্ব সংকটে করতোয়া, ইছামতি। ভাবতে অবাক লাগে আমাদের দেশে এমন এক নদী ছিল যার ছিল বিদেশি দ্বীপের সাগরের মত স্বচ্ছ নীল পানি। পানির ভিতর দিয়ে মাছ দেখা যেত। পর্যটকদের ভিড় থাকতো দেখার জন্য। অসংখ্য চলচ্চিত্রের শ্যুটিং হয়েছিল এই ভারত এর মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশ ঘেঁষে যাওয়া এই পিয়াইন নদী। সিলেটের সেই জাফলং নদী এখন শুধুই মরুভূমি। অপরিকল্পিতভাবে পাথর উত্তোলন আর উজান থেকে নেমে আসা বালুর কারণে এই নদী নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। এক সময় যে পুনর্ভবা নদীতে বার মাসই স্রোত থাকতো এখন কোন রকমে সে তার স্মৃতি বহন করে চলছে। নওগাঁর এই নদী এখন সরু খাল। নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে প্রয়োজন ড্রেসিং। ভারতীয় অংশে ভারতীয় সরকারের বাঁধ নির্মাণের কারণে নদী হারিয়ে ফেলছে তার নাব্যতা। ভূমি দস্যুরা ইচ্ছা মত দখল করছে। একবার নদী অচল করা গেলে লাভ দখলদারদের। একবার নদী ভরাট করতে পারলে পাওয়া যায় জমি। জমির লোভ, কোটি কোটি টাকা, দখল, আর সেই সাথে প্রশাসনের ভ্রূক্ষেপ না করা। নদীর উন্নয়নে কোন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না। প্রশাসনের এই দিকে তো নজর নেই বরং তিতাস নদীর পোস্টমর্টাম করে তার উপর মাটি ফেলে বাংলাদেশের আখাউড়া ভারতের আগরতলা রেলওয়ে নির্মাণ কাজ চলছে। তিস্তা নদীতে মাটি ফেলে আড়াআড়ি করে ত্রিপুরায় নেয়া হচ্ছে বিদ্যুত্ কেন্দ্রের যন্ত্র। চিনা কোম্পানি কে পিডিবি নির্মাণে যন্ত্রপাতি যাতায়াতের সুবিধার্থে ভরাট করা হয়েছে হবিগঞ্জের খোয়াই নদী। বিদ্যুত্ দরকার জানি কিন্তু তাই বলে প্রকৃতির সর্বনাশ করে? কিন্তু কিছু আসে যায় না কারও।
ঢাকার বেশিরভাগ নদী রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় দখল হয়ে যাচ্ছে। দিনের পর দিন দখল হতে হতে এখন নদী পরিণত হচ্ছে খালে। প্রতি বছরই একটা দুইটা করে নদী শুকিয়ে যাচ্ছে। নানা রকম দূষণের কারণে নদীর অস্তিত্ব দিনের পর দিন সংকটে। নদী দখল করে ভূমি দস্যুদের ইমারত নির্মাণের প্রতিবাদে পাবনায় ইছামতি নদীকে নিয়ে হয়ে গেল প্রতিবাদ সমাবেশ। প্রশাসনের কি আরও গভীরভাবে নজর দেয়া উচিত নয়? বগুড়ায় বাঙালি নদী দখল করে ইট ভাটার জায়গা করা হয়েছে সম্প্রসারণ। অনেক গ্রামে বা উপজেলায় নদী দখল করে বাঁধ দিয়ে পুকুর নির্মাণ করে বাণিজ্যিকভাবে মাছ চাষ শুরু করাতে নদীর জীবন হুমকির সম্মুখীন। নেত্রকোনায় কেন্দুয়া উপজেলায় এভাবেই নদীতে বাঁধ দিয়ে পুকুর নির্মাণ করা হয়েছে। করতোয়া নদী তো দূষণে দূষণে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। এক সময়ের খরস্রোতা করতোয়া নদী এখন বগুড়া শহরের ময়লা আবর্জনার নর্দমায় পরিণত হয়েছে। দাম আছে এসবের? টাকার অঙ্কের কাছে কিছুই না এসব। প্রকৃতির সর্বনাশে দানবদের কিছু আসে যায় না; শুধু তাদের অশ্লীল উল্লাস দেখা যায়।
শুধু আফসোস হয় একসময় হয়তো আমার পরের প্রজন্ম বা আমার নিজের সন্তান হয়তো যখন রবীন্দ্রনাথের ছড়া “আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে, বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে” পড়বে তখন হয়তো শুনে শুনে আফসোস করবো, আর মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলবো, আমার একটা নদী ছিল। প্রশাসনের কাছে, বাংলাদেশ সরকারের কাছে আকুল আবেদন যে, এই সুজলা, সুফলা, শস্য-শ্যামলা নদীমাতৃক বাংলাদেশের চিরায়িত রূপ ফিরিয়ে আনতে সময় থাকতে উদ্যোগ গ্রহণ করুন। আমরা সবাই ডিজিটাল বাংলাদেশ চাই অবশ্যই কিন্তু সেই ডিজিটাল করতে গিয়ে যেন আবহমান বাংলার সৌন্দর্য বিলীনে আমরা উদাসীন না হয়ে পড়ি।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে জুন, ২০১৫ দুপুর ২:১১