somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ধারাবাহিক গল্পঃ রিপোস্টঃ হরিদাসের রমজান মাস ৪র্থ পর্বঃ

১৪ ই জুলাই, ২০১৫ রাত ১:৩০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



ইতিহাসে ময়লা ভাসে বলে নিন্দুকেরা বলে বেড়ায়। আসলেই মিথ্যা নয়, ময়লা ভাসে। ওমর সেই ময়লা নিয়ে আজ হরিদাসের দোকানের সামনে। দেশ ভাগের আগে সোমেন দত্তের ছেলে নরেন দত্ত পাশের গ্রামের এক মুসলমান মেয়েকে বিয়ে করে মুসলমান হয়, কেউ বলে ইসলাম ধর্মের গুণাবলীতে আকৃষ্ট হয়ে মুসলমান হয় এবং চল্লিশ দিনের চিল্লায় যায়। নিন্দুকেরা বলে, চিল্লা নয়, মাইয়া নিয়া ভাগা দিছে। তারপর পদ্মার শাখা নদীতে অনেক ঘোলা পানি গড়িয়েছে। হরিদাসের বাবা হরি আনন্দ নরেনকে অনেক বুঝিয়েছে। না, সে লতীফাকে ত্যাগ করতে পারবে না। তারপর প্রায় দশ-বারো বছর নরেন কোথায় ছিল, কেউ জানে না। এর মধ্যে আরেক ঘটনা ঘটে। কে বা কারা যেন নরেনের বোনটাকে রাতের আধারে নিয়ে গেছে। সোমেন দত্ত হরির বাবাকে সাথে নিয়ে যাতে থানা-পুলিশের জামেলা না করে, তাই গ্রামের দুইটি ছেলে ঘটনার একদির পর হরিআনন্দের বরাবর লেখা নরেনের বোন লাকীর একটা চিঠি আর দেলোয়ারকে লেখা কিছু প্রেমপত্র দিয়ে যায়। পুত্র-কন্যা শোকে নরেনের মা মারা যায়। দেশ ভাগের পরে সোমেন তার সব সম্পত্তি হরির বাবার কাছে বিক্রি করে। তবে হরি আনন্দ মারা যাওয়ার আগে হরিকে বলে গেছে সোমেনকে দেওয়া তার শপদ, ‘তোমার জমি আমি কিনলাম, কিন্তু তোমাকে কথা দিলাম, তোমার পুত্র-কন্যা যদি নিজ ধর্মে ফিরে আসে, অথবা নরেন যদি কাগজে কলমে লিখে দেয়, সে তার বাপদাদার মন্দির, মঠ ধ্বংশ করবে না বা কারো কাছে এই জমি বিক্রি করবে না, তবে আমি সব ফেরত দিব।’ ‘ দাদা, যদি নরেন নিজ ধর্মে ফিরে আসে, আমি তোমার সব টাকা ফেরত দিব।’ নরেন ছিল সোমেনের একমাত্র জীবিত পুত্র, আরো তিন পুত্র নানা রোগে মারা গেছে। সোমেন নরেনকে খুবই ভালোবাসত। হরি বাবার কাছে শুনেছে, সোমেন স্বদেশী আন্দোলনে যুক্ত ছিল, তার দেশ প্রেম হরি আনন্দর চেয়ে কম ছিল না। কিন্তু স্ত্রী শোক, পুত্র-কন্যার কাহিনী তাকে দেশ ত্যাগে বাধ্য করেছে। তারপর গ্রামের মানুষের কাছে শুনা গেল, নিজ ধর্মে ফিরে আসতে চেয়েছে বলে নরেনকে কারা যেন মেরে ফেলেছে, আবার এও শুনা গেল লাকী আত্নহত্যা করেছে, কেউ বলে ভাই-বোন এক জায়গায়ই থাকে। কোন কথা সত্য, তা বুঝার উপায় নেই। তবে বর্তমান চেয়ারম্যানের বাবা রফিক শেখ হরি আনন্দকে বলেছে, দাদা, লাকী মেয়েটি সত্যিই আত্নহত্যা করেছে, নরেনের কোন হদিস আমরা জানি না।

হরি আনন্দ বি. এ পাশ ছিল। টাকা-পয়সা-জমি-জমা বিষয়াদি ভালো বুঝত। কিন্তু নানা জামেলায় হরিদাস ছয়-সাত ক্লাশের বেশি লেখাপড়া করতে পারেনি। বাপ-দাদা আর সমাজ থেকে সে যা শিখার শিখেছে। তবে সে বেশ ঠান্ডা মাথার লোক। ওমরকে বলে দিয়েছে, তোমার বাবা কোথায় আছে, তাকে আসতে বলো। তার সাথে কথা হবে।

ঘটনা সত্যি। একদিন রাতের বেলা এক মৌলভী উঠানে নয়, ঘরের এক কোনে দাঁড়িয়ে আছে, একা। কে একজন বলল, উনি হরি বাবুর সাথে কথা বলতে চায়। রমজানের দশ এগারো রোজা শেষ হয়েছে। মূল রাস্তায় মুসল্লীরা তারাবী পড়ে যে যার বাড়ি যাচ্ছে। হরি মৌলভীর সামনে দাঁড়ায়, দাদা--
--বখতিয়ার!
--আমি নরেন। আমাকে নরেন বলবেন

নরেন অনেকক্ষণ মা-বাবার স্মৃতি নিয়ে কাঁদল। হরি বাড়ির সবাইকে ঘরে চলে যেতে বলল। পুকুরের পাড় দিয়ে হেঁটে গল্প করতে করতে হরি নরেনকে নিয়ে তার জন্ম ভিটায় এলো। কেউ বসবাস করে না বলে জঙ্গলে ভরে গেছে ওদের উঠান। মোহন বলে, জঙ্গলেভরা ভাঙ্গা ঘরে সাপ আছে। মোহন বাজার থেকে বাড়ি গিয়ে সব শুনে এখানে চলে। ওদের পূর্বপুরুষের মঠ, মন্দিরে গিয়ে নরের চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। কান্নার আওয়াজ অনেকদূর চলে গেছে। সকালে হয়তো হরিকে এ কান্নার আওয়াজ নিয়ে কেউ কেউ প্রশ্ন করতে পারে।

মোহন আর নরেন সমবয়সী, এক সাথে স্কুলে যেত, খেলত, নৌকা চড়ে অনেকদূর চলে যেত। মোহন আসাতে সে তার কান্না কিছুতেই থামাতে পারছে না। মায়ের চিতা মন্দিরে বসে আবার কাঁদতে লাগল, মা তুমি আমার জন্য মরেছ, আমার পাপের শেষ নাই। রাত প্রায় ভোর হয়ে এলো।
মোহন বলছে, নরেন, সেহেরীর সময় হয়েছে।
--আমার বোন নিজ ধর্মে, মা-বাবার কাছে চলে আসতে চেয়েছে বলে ওর জামাই ওকে ফাঁসি দিয়ে মেরেছে। আমিও বার কয়েক চেষ্টা করেছি...। আমি তো লতিফাকে ভালবেসেছি, ধর্মকে নয়।
--তবে আগে আসনি কেন?
-- মোহন, আমি কোন ধর্মে বিশ্বাসী ছিলাম না। আমার বাবাও না। ধর্ম বিশ্বাস করতে গিয়ে, খোদাকে খুঁজতে গিয়ে কিছুই পাইনি। মা-বাবাকে কষ্ট দিয়ে, মাকে, হত্যাই বলব, আমিই তো মেরেছি, যে পাপ আমি করেছি, কোন ধর্ম চর্চা করে তার মোচন হবে, তা আমি চাই না। আমি প্রায়শ্চিত্ত চাই।
--কবে তোর এরকম উপলব্দি হল, আগে জানালি না কেন?
-- হরিদা, ঈশ্বর-আল্লাহ-ভগবান সব একই । আমি তোমাদের মাঝে, তোমার মাঝে যে ঈশ্বর থাকে, তাকে বাদ দিয়ে, নিজ ভাষার, নিজ জাতের, নিজের সমাজের ঈশ্বর বাদ দিয়ে একবারে আলাদা জাতের বিদেশী ঈশ্বর, বিদেশী ধর্ম নিয়ে কোন শান্তি পাইনি। আমার মন সর্বদা এই মন্দিরে পড়ে থাকত। বড় হুজুরকে বললে, বলত, খোদাকে ডাক সব ঠিক হয়ে যাবে। একদিন আমার মত ধর্মান্তরিত এক হুজুর বলল, ফিরে যা, দশ পনের বছরে যখন হল না, ফিরে যা। সমাজ গ্রহণ না করলে, আর তুই না পারলে, কোন মাজারে পড়ে থাকিস। কারণ ওখানে সব ধর্মের মানুষ প্রার্থণা করে, হয়তো অনেকটা স্বস্তি পাবি ।
--নরেন, নিজ ধর্মে ফিরে এলে তোকে ধর্মান্ধরা মেরে ফেলবে।
--আমার ছেলেই কথিত মহৎ কাজটি সবার আগে করবে। সে আমাকে কাফের মনে করে। আফগানিস্তানে কারা যেন তাকে নিয়ে গেছে, ফিরেছে দুই বছর পর। আরো কোথায় কোথায় যেন গিয়ে সে ট্রেনিং দিয়ে এসেছে। ওর মার কাছে শুনলাম, কারা যেন ওর মাকে বলে গেছে, তোমার ছেলে জামাতী ইসলামী পাকিস্তানে নাম লিখিয়েছে। কেউ বলে সে জঙ্গি হয়ে গেছে।
--বাবা বলেছে, তুমি ফিরে আসলে, সব যেন তোমাকে ফিরিয়ে দেই।
--না, এ সম্পত্তির মর্যাদা আমার মরার পরে থাকবে না। আমার দূরসম্পর্কের এক ভাই আছে, খুব কষ্টে আছে, পরিবার নিয়ে প্রায়ই মাজারে যায়। যদি বলেন, ওকে আপনার কাছে আসতে বলি।
--নরেন আমাদের বিশাল সম্পদ, তোমার বাবা এ সম্পত্তি আমার বাবাকে উইল কইরা দিয়ে গেছে। জমিদারী প্রথা নেই, মানুষের আচার আচরণে মনে হয়, আমরা হইয়া গেছি এ দেশের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক। এত সম্পদ আমাদের জন্য বোঝা । তোমারটা তোমার কাছে দিতে পারলে বোঝা কমে, অন্যকে দিলে বোঝা কমবে না, শান্তি পাব না।
--আপনারা যত দিন জীবিত আছেন, আপনাদের জিম্মায় থাকবে। দূর সম্পর্কের আত্নীয়কে শুধু বসবাস করতে দিবেন। আর একটা অনুরোধ, জঙ্গলে ভরে আছে, দয়া করে, বাবা-মা বেঁচে থাকতে যা যা করেছে, আমার আত্নীয়কে দিয়ে তা করাবেন। যখন আপনারা থাকবেন না বা জমি নিয়ে যদি কোন জামেলা হয়, তাহলে আমি যদি না থাকি, ওমরের মাকে নিয়ে স্কুল অথবা দুরের কলেজকে সব দান করবেন। হ্যাঁ, ওমরের মা বলবে, এ জমির উপর নরেন ওরফে বখতিয়ারের কোন দাবী নাই।
(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই জুলাই, ২০১৫ রাত ১:৩২
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

গণতন্ত্র আর বাক-স্বাধীনতার আলাপসালাপ

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:২৩


একাত্তর সালে আওয়ামী লীগের লোকজন আর হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা ছিল পাকবাহিনীর প্রধান টার্গেট। যদিও সর্বস্তরের মানুষের ওপর নিপীড়ন অব্যাহত ছিল। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধা আর তাদের পরিবারের... ...বাকিটুকু পড়ুন

কাফের কুফফারদের দেশে বাস করা হারাম।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:১৩

ফেসবুকে বাঙালিদের মধ্যে ইদানিং নতুন এক ফতোয়া চালু হয়েছে, এবং তা হচ্ছে "দাওয়াতের নিয়্যত ছাড়া কাফের কুফফারদের দেশে বাস করা হারাম।"
সমস্যা হচ্ছে বাঙালি ফতোয়া শুনেই লাফাতে শুরু করে, এবং কোন... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধাদের মুমিনী চেহারা ও পোশাক দেখে শান্তি পেলাম

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:৫৮



স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে স্টেজে উঠেছেন বত্রিশ মুক্তিযোদ্ধা তাঁদের চব্বিশ জনের দাঁড়ি, টুপি ও পাজামা-পাঞ্জাবী ছিলো। এমন দৃশ্য দেখে আত্মায় খুব শান্তি পেলাম। মনে হলো আমাদের মুক্তিযোদ্ধা আমাদের মুমিনদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দুই টাকার জ্ঞানী বনাম তিনশো মিলিয়নের জ্ঞানী!

লিখেছেন সাহাদাত উদরাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ২:৫৯

বিশ্বের নামীদামী অমুসলিমদের মুসলিম হয়ে যাওয়াটা আমার কাছে তেমন কোন বিষয় মনে হত না বা বলা চলে এদের নিয়ে আমার কোন আগ্রহ ছিল না। কিন্তু আজ অষ্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত ডিজাইনার মিঃ... ...বাকিটুকু পড়ুন

×