somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

‎"একাত্তরের সেই বিদেশি বন্ধুদের জন্য এবার সম্মানসূচক নাগরিকত্ব।" চমৎকার সংবাদ দিয়ে দিনের সূচনা। :)

০৫ ই আগস্ট, ২০১০ সকাল ১১:৫১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সূএঃ- কালের কন্ঠ
'আমি চিনি গো চিনি তোমারে ওগো বিদেশিনী'_বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর এ গানের নায়িকা আর্জেন্টাইন বান্ধবী ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর সঙ্গে চিঠি দেওয়া-নেওয়া করেছেন দীর্ঘ ১৫ বছর। কিন্তু দুঃখের বিষয়, ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও শারীরিক অসুস্থতার কারণে কোনো দিন ভারতে আসতে পারেননি ওকাম্পো। অথচ সেই ওকাম্পোই ৮১ বছর বয়সে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের নিরস্ত্র জনগণের ওপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হামলার খবর শুনে ঘরে বসে থাকতে পারেননি। প্রতিবাদে আর্জেন্টিনার রাস্তায় নেমে বাংলাদেশের পক্ষে মিছিলে নেতৃত্বও দিয়েছিলেন।
একাত্তরে যুক্তরাষ্ট্রের রিচার্ড টেলর শুনেছিলেন পাকিস্তানের জাহাজ গেছে তাঁর দেশ থেকে অস্ত্র নিতে। ওই অস্ত্র মুক্তিকামী মানুষের ওপর ব্যবহার করা হবে_সেটা কোনোভাবেই মানতে পারেননি তিনি। তাই শান্তিকামী একদল মানুষকে নিয়ে পাঁচ দিন ধরে ঘিরে রেখেছিলেন বাল্টিমোরের সমুদ্রবন্দর।
বাংলাদেশের শিশুরা না খেয়ে মারা যাচ্ছে_লোকমুখে এ কথা শুনে স্থির থাকতে পারেননি ভারতের সংগীতশিল্পী লতা মুঙ্গেশকর। তাৎক্ষণিকভাবে এক লাখ রুপি দিয়েছিলেন শিশুদের জন্য। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের পুরো ৯ মাস গান গাওয়ার মাধ্যমে তাঁর আয়ের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ জমা দিয়েছেন বাংলাদেশের জন্য তহবিলে।
'বাংলাদেশ, আমায় মনে রেখো' (বাংলাদেশ, রিমেম্বার মি) গ্রন্থের মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অবদানের কথা মনে রাখার আকুতি জানিয়েছিলেন সাবেক সোভিয়েত নৌবাহিনীর কর্মকর্তা অ্যাডমিরাল জুয়েনকা। চট্টগ্রাম বন্দরে মাইন অপসারণকারী দলের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় আহত হয়েছিলেন তিনি। দেশে ফিরে গিয়ে চাকরি থেকে অব্যাহতি পান বাংলাদেশের জনগণের অকৃত্রিম এ বন্ধু। যে বাংলাদেশে মাইন অপসারণ করতে গিয়ে তিনি শারীরিকভাবে অক্ষম হয়ে পড়েছিলেন, নিজের দুর্দিনে সে দেশের সরকারের কাছে সাহায্যের আশায় হাত বাড়িয়েছিলেন। বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার 'কোনো বিদেশিকে সাহায্য দেওয়ার মতো তহবিল নেই' অজুহাতে সেই আবেদন প্রত্যাখ্যান করেছিল। শেষ পর্যন্ত বিনা চিকিৎসায় মরতে হয়েছে তাঁকে।
তাঁদের মতো আরো অনেক বিদেশি নাগরিক একাত্তরে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পাশে দাঁড়িয়েছিলেন বাংলাদেশের জনগণের।
মহান মুক্তিযুদ্ধে অবিস্মরণীয় অবদানের কৃতজ্ঞতাস্বরূপ স্বাধীনতার প্রায় ৪০ বছর পর বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনায়ক, রাজনীতিবিদ, দার্শনিক, লেখক, বিশিষ্ট নাগরিক, শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক ও সাংবাদিকদের সম্মানসূচক নাগরিকত্ব দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পররাষ্ট্র ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা এবং বিশিষ্ট নাগরিকদের সমন্বয়ে গঠিত বিশেষ জাতীয় কমিটির চূড়ান্ত করা গাইডলাইনে (দিকনির্দেশনা) মুক্তিযুদ্ধের সময় এ দেশের জনগণের পাশে দাঁড়ানো বিদেশি বন্ধুদের সম্মানসূচক নাগরিকত্ব, স্বর্ণপদক ও সম্মাননাপত্র দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। প্রস্তাব করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বিভিন্ন সংগঠনকেও সম্মাননা দেওয়ার।
কমিটি সূত্রে জানা গেছে, তাদের চূড়ান্ত করা গাইডলাইন এবং বিদেশি ব্যক্তি ও সংগঠনের তালিকা মন্ত্রিসভার বৈঠকে উত্থাপন করা হবে। এদিকে দেরিতে হলেও মুক্তিযুদ্ধে বিদেশিদের অবদানের কথা মনে রেখে রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মান জানানোর উদ্যোগ নেওয়ার খবর পেয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন রিচার্ড টেলরসহ অনেকে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও জাতীয় কমিটি সূত্রে জানা গেছে, মহান মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ অবদান আছে এমন বিদেশিদের সম্মান জানানোর জন্য গাইডলাইন চূড়ান্ত করার পর এখন বিদেশে বাংলাদেশ মিশন ও দেশের বিশিষ্ট নাগরিকদের মাধ্যমে বিদেশি নাগরিক ও সংস্থার নাম তালিকাভুক্ত করার প্রক্রিয়া চলছে। গত ১৮ জুলাই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত জাতীয় কমিটির বৈঠক শেষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি সম্মাননা প্রদানের গাইডলাইন চূড়ান্ত করার কথা সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন। জানা গেছে, সেই গাইডলাইনেই বিদেশি বন্ধুদের সম্মানসূচক নাগরিকত্ব, স্বাধীনতা পদকের সমমানের সোনার পদক ও সম্মাননা দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে।
কমিটির সদস্য মেজর (অব.) এ এস এম সামছুল আরেফিন গতকাল বুধবার কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আগামী সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাস নাগাদ চূড়ান্ত হবে বিষয়টি। মুক্তিযুদ্ধে বিদেশিদের অবদান বিবেচনা করে তাঁদের সম্মানসূচক নাগরিকত্ব প্রদানের বিষয়টি ঠিক করা হবে। কমিটির সুপারিশের আলোকে এ ব্যাপারে মন্ত্রিসভা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে।'
কমিটি সূত্রে জানা গেছে, মুক্তিযুদ্ধে অসাধারণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা হিসেবে কয়েকজনকে সম্মানসূচক নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। তবে সম্মান জানানো হবে মুক্তিযুদ্ধে অবদান আছে এমন সব বিদেশিকে। এ ব্যাপারে সরকারের শীর্ষ পর্যায়েরও সম্মতি রয়েছে।
কমিটির সদস্য সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির কালের কণ্ঠকে বলেন, '১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে বিভিন্ন দেশের বরেণ্য রাষ্ট্রনায়ক, রাজনীতিবিদ, দার্শনিক, লেখক, বিশিষ্ট নাগরিক, শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক, সংগঠন (অর্গানাইজেশন), সাংবাদিক, প্রচারমাধ্যম যাঁরা অবিস্মরণীয় অবদান রেখেছেন, তাঁদের সম্মাননা দেওয়ার জন্য একটি গাইডলাইন তৈরি হয়েছে। এই সম্মাননা দেওয়ার জন্য কেবল বিদেশি ব্যক্তি বা সংগঠনই বিবেচিত হবে। স্বাধীনতা পদকের সমমানের পদক, বাংলাদেশের সম্মানসূচক নাগরিকত্ব দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে।'
সূত্রমতে, মুক্তিযুদ্ধে নিহত ভারতীয় সেনাদের স্মরণে, চট্টগ্রাম বন্দরে মাইন অপসারণ করতে গিয়ে নিহত তৎকালীন সোভিয়েত সেনাদের জন্য ঢাকায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আলাদা স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ এবং ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নামে ঢাকার একটি গুরুত্বপূর্ণ সড়কের নামকরণ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
শাহরিয়ার কবির বলেন, 'নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি। তারা জানে না, মুক্তিযুদ্ধ কিভাবে বিশ্ববাসীর সশ্রদ্ধ মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল। যাঁরা লড়াই করেছেন, তাঁরা অস্ত্রের দিক দিয়ে দুর্বল ছিলেন। এটা সবলের বিরুদ্ধে দুর্বলের লড়াই হলেও মানসিকভাবে মুক্তিযোদ্ধারা দুর্বল ছিলেন না। এ কারণে তাঁরা সারা বিশ্বের কাছে শ্রদ্ধা, সম্ভ্রম পেয়েছেন। সারা বিশ্বের খবরের কাগজে মুক্তিযুদ্ধের সময় এ দেশের মানুষের খবর, দুর্দশা, প্রতিরোধের খবর প্রকাশিত হয়েছে। এমনকি মার্কিন সরকার আমাদের বিপক্ষে থাকলেও দেশটির জনগণ, গণমাধ্যম ও জনপ্রতিনিধিদের একটি বড় অংশ আমাদের পক্ষে দাঁড়িয়েছিল। এর ফলে বাংলাদেশের বিজয় ত্বরান্বিত হয়েছে। ওরা না থাকলে আমরা এত দ্রুত স্বাধীনতা অর্জন করতে পারতাম না। সেটা আজকের প্রজন্মের জানা উচিত।'
শাহরিয়ার কবির বলেন, 'আমরা আমাদের স্বাধীনতার জন্য লড়ব_এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ১৮ হাজার থেকে ২০ হাজার ভারতীয় সেনাও বাংলাদেশ স্বাধীন করার জন্য জীবন দিয়েছেন। আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর এত সংখ্যক সদস্য কিন্তু জীবন দেননি।' তিনি আরো বলেন, "স্পেনের গৃহযুদ্ধে লড়াই করেছিলেন আঁদ্রে মালরো। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর বয়স ৬০ বছরের ওপর। ১৯৭১ সালে তিনি ভারতে এসে বলেছিলেন, 'বাংলাদেশ চাইলে আমরা এখনো লড়াই করার জন্য প্রস্তুত আছি। আমি রণাঙ্গনে গিয়ে লড়াই করব বাংলাদেশের জনগণের পক্ষে।' যুক্তরাষ্ট্রের রিচার্ড টেলরের নেতৃত্বে শান্তির পক্ষে একদল মানুষ পাকিস্তানি জাহাজে অস্ত্র বোঝাই করা ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্রে একটি সমুদ্রবন্দর ঘিরে ফেলেছিল। তারা বলেছিল, এই অস্ত্র তারা বাংলাদেশের জনগণের ওপর ব্যবহার হতে দেবে না। এখন তিনি বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণের অপেক্ষায় আছেন। দুই বছর আগে তিনি আমাকে বলেছিলেন, 'আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের কোনো সরকার আমাদের স্মরণ করল না।"
ওই মানুষগুলো এ দেশের মানুষের দুর্দিনে চুপ করে বসে থাকতে পারেননি। বাংলাদেশ সরকার অনেক দেরিতে হলেও তাঁদের সম্মাননা জানানোর উদ্যোগ নিয়েছে।
কমিটির আরেক সদস্য চিত্রশিল্পী অধ্যাপক হাশেম খান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা এ বছরই বিজয় দিবসে আনুষ্ঠানিকভাবে এ সম্মাননার বিষয়টি ঘোষণা করার জন্য প্রস্তাব করেছি। আগামী বছর ২৬ মার্চ, আমাদের ৪০তম স্বাধীনতা দিবসে আনুষ্ঠানিকভাবে ঢাকায় সম্মাননা দেওয়ার পরিকল্পনা চলছে।'
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি গত ১৮ জুলাই সাংবাদিকদের বলেন, অসুস্থতা বা বয়সের কারণে যাঁরা আসতে পারবেন না তাঁদের সংশ্লিষ্ট দেশে বাংলাদেশ মিশনের উদ্যোগে আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। তবে কমিটির সদস্যরা মনে করেন, কৃতজ্ঞতা ও সম্মাননা জানাতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বা পররাষ্ট্রমন্ত্রীরই যাওয়া উচিত।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র ও কমিটি সংশ্লিষ্টরা জানান, ব্যক্তিপর্যায়ে সম্মাননা দেওয়ার জন্য তালিকায় প্রায় ১৫০ জনের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে আছেন ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের কাউন্সিল অব মিনিস্টার্সের চেয়ারম্যান আলেক্সি কোসিগিন, যুগোশ্লাভিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট জোসেফ টিটো, কিউবার সাবেক প্রেসিডেন্ট ফিদেল কাস্ত্রো, তখনকার ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হ্যারল্ড উইলসন, জার্মানির চ্যান্সেলর উইলি গ্রান্ট, ভারতের সাবেক সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল স্যাম মানেকশ, ভারতের সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় ফ্রন্টের সাবেক কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা, ভারতের নেতা জয় প্রকাশ নারায়ণ, মাদার তেরেসা, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর তখনকার মুখ্যসচিব পিএন হাকসার ও উপদেষ্টা ডিপি ধর, পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শংকর রায় ও জ্যোতি বসু, ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) সাবেক প্রধান রস্তম জি, ফ্রান্সের সাবেক সংস্কৃতিমন্ত্রী, সাহিত্যিক ও দার্শনিক আঁদ্রে মালরো, সাবেক মার্কিন সিনেটর অ্যাডওয়ার্ড কেনেডি, কংগ্রেসম্যান গালাগার, সিনেটর ফ্র্যাঙ্ক চার্চ, সিনেটর চার্লস পার্সি, মার্কিন গায়ক জর্জ হ্যারিসন, বব ডিলান, ভারতীয় সেতারবাদক পণ্ডিত রবি শংকর, সংগীতশিল্পী জোয়ান বায়েজ, মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকায় মার্কিন কনসাল জেনারেল আর্চার কেন্ট ব্লাড, মার্কিন নাগরিক রিচার্ড টেলর, অস্ট্রেলিয়ার এ এস ওডারল্যান্ড (বীর প্রতীক), জাপানের তাকাশি হায়াকাওয়া, সুইডেনের এমপি লার্জ লিজন বর্গ, প্রফেসর রবার্ট রাইমস, পাকিস্তানের রাজনীতিক এয়ার মার্শাল আসগর খান, খান আবদুল ওয়ালি খান, কবি আহমদ সালিম, মানবাধিকার নেত্রী নাসিম আখতার, মানবাধিকার নেত্রী আসমা জাহাঙ্গীর, কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ, নেপালের প্রেসিডেন্ট ডা. রামবরণ যাদব, ভারতীয় সংগীতশিল্পী লতা মঙ্গেশকার, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সলিল চৌধুরী, অভিনয় শিল্পী ওয়াহিদা রেহমান, কবি কাইফি আজমি, শিল্পী মকবুল ফিদা হুসেন, বিপ্লবী পান্নালাল দাশগুপ্ত, টিএন কউল, ত্রিপুরার সাবেক মুখ্যমন্ত্রী শচীন্দ্র লাল সিংহ, ভারতীয় সাংবাদিক অনিল ভট্টাচার্য, দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, গীতিকার গোবিন্দ হালদার, সংগীতশিল্পী ভূপেন হাজারিকা, লেখক দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, চলচ্চিত্র নির্মাতা ঋতি্বক ঘটক, প্রিন্স সদরুদ্দিন আগা খান, শিল্পী গণেশ পাইন, বিকাশ ভট্টাচার্য, প্রকাশ কর্মকার, নেপালের সাবেক প্রধানমন্ত্রী গিরিজা প্রসাদ কৈরালা, কানাডার সাবেক প্রধানমন্ত্রী পিয়েরে ট্রুডো, শ্রীলঙ্কার সাবেক প্রেসিডেন্ট শ্রীমাভো বন্দরনায়েকে, সাংবাদিক সাইমন ড্রিং, মার্ক টালি, বব ডিলান, ভারতের বর্তমান অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি, সাবেক সোভিয়েত নৌবাহিনীর অ্যাডমিরাল জুয়েনকো, জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব উথান্ট, উপেন তরফদার, প্রণবেশ সেন, অন্নদা শংকর রায়, ভিক্টোরিয়া ওকোম্পো প্রমুখ।
সংগঠন হিসেবে সম্মাননার জন্য প্রস্তাবিত নামের তালিকায় বিশ্ব শান্তি পরিষদ, আন্তর্জাতিক রেডক্রস সোসাইটি, জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার, মাদার তেরেসার সংগঠন মিশনারিজ অব চ্যারিটিজ রয়েছে বলে জানা গেছে।
জানা গেছে, বোম্বের বিখ্যাত নায়িকা ওয়াহিদা রেহমান মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর সব 'সাইনিং মানি' দিয়েছিলেন বাংলাদেশের মানুষের জন্য। বাংলাদেশের দুর্দশার ছবি এঁকে ট্রাকে করে সারা দিন বোম্বের (মুম্বাই) রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেছেন মকবুল ফিদা হুসেন। সেই ছবি দেখে গৃহবধূরা কেউ সিকি, কেউবা আধুলি দিয়েও সাহায্য করেছেন। এ সিকি-আধুলিই দিনের শেষে হাজার রুপি ছাড়িয়ে কখনো কখনো লাখ হয়ে জমা হতো বাংলাদেশ তহবিলে।
এদিকে প্রায় ৪০ বছর পর বাংলাদেশের পক্ষ থেকে খোঁজ নেওয়ায় আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়ছেন বিদেশি বন্ধুরা। জাতীয় কমিটির সদস্য ইতিহাসবিদ ড. মুনতাসীর মামুন গত ২১ জুলাই জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ড. এ কে আবদুল মোমেনকে সঙ্গে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ায় রিচার্ড টেলরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মাননা জানানোর পরিকল্পনার কথা জানান। এতে আবেগাপ্লুত হয়ে তিনি জানান, সরকার আমন্ত্রণ জানালে অন্তত একবারের জন্য হলেও বাংলাদেশে আসতে চান তিনি।
পাকিস্তানের মানবাধিকার নেত্রী নাসিম আখতার রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মাননা দেওয়ার প্রক্রিয়ার খবর বাংলাদেশের বিশিষ্টজনদের মুখে শুনে আবেগে প্রায় কেঁদে ফেলেন। তিনি অবাক হয়ে বলেন, 'বাংলাদেশের মানুষ এখনো আমাদের মনে রেখেছে!'
জানা গেছে, মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের জনগণের পাশে দাঁড়ানো ব্যক্তিদের কৃতজ্ঞতা জানানো দূরের কথা, গত সরকারগুলোর আমলে তাঁদের সাহায্যের আবেদন পর্যন্ত মঞ্জুর হয়নি। বিশেষ করে গত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে অ্যাডমিরাল জুয়েনকো তাঁর দুর্দশার কথা জানিয়ে সাহায্যের আবেদন করেছিলেন, কিন্তু কোনো বিদেশিকে সাহায্য দেওয়ার বিধান নেই বলে জানিয়ে ওই আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হয়। শাহরিয়ার কবির জানান, রাশিয়ায় বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা অর্থ সাহায্য তুলে তাঁর বাড়িতে দিয়ে এসেছিল। বাংলাদেশ সরকার তাঁর কোনো খোঁজ নেয়নি।
উল্লেখ্য, গত মার্চে ৩৩ বিদেশি নাগরিক ও একটি সংগঠনকে সম্মাননা জানানোর প্রস্তাব মন্ত্রিসভা থেকে ফেরত পাঠানো হয়। এরপর আরো বড় পরিসরে সম্মাননা দেওয়ার জন্য গঠিত হয় জাতীয় কমিটি। এ কমিটিই সরকারের কাছে সুপারিশ পাঠাবে।
'আমি চিনি গো চিনি তোমারে ওগো বিদেশিনী'_বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর এ গানের নায়িকা আর্জেন্টাইন বান্ধবী ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর সঙ্গে চিঠি দেওয়া-নেওয়া করেছেন দীর্ঘ ১৫ বছর। কিন্তু দুঃখের বিষয়, ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও শারীরিক অসুস্থতার কারণে কোনো দিন ভারতে আসতে পারেননি ওকাম্পো। অথচ সেই ওকাম্পোই ৮১ বছর বয়সে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের নিরস্ত্র জনগণের ওপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হামলার খবর শুনে ঘরে বসে থাকতে পারেননি। প্রতিবাদে আর্জেন্টিনার রাস্তায় নেমে বাংলাদেশের পক্ষে মিছিলে নেতৃত্বও দিয়েছিলেন।
একাত্তরে যুক্তরাষ্ট্রের রিচার্ড টেলর শুনেছিলেন পাকিস্তানের জাহাজ গেছে তাঁর দেশ থেকে অস্ত্র নিতে। ওই অস্ত্র মুক্তিকামী মানুষের ওপর ব্যবহার করা হবে_সেটা কোনোভাবেই মানতে পারেননি তিনি। তাই শান্তিকামী একদল মানুষকে নিয়ে পাঁচ দিন ধরে ঘিরে রেখেছিলেন বাল্টিমোরের সমুদ্রবন্দর।
বাংলাদেশের শিশুরা না খেয়ে মারা যাচ্ছে_লোকমুখে এ কথা শুনে স্থির থাকতে পারেননি ভারতের সংগীতশিল্পী লতা মুঙ্গেশকর। তাৎক্ষণিকভাবে এক লাখ রুপি দিয়েছিলেন শিশুদের জন্য। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের পুরো ৯ মাস গান গাওয়ার মাধ্যমে তাঁর আয়ের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ জমা দিয়েছেন বাংলাদেশের জন্য তহবিলে।
'বাংলাদেশ, আমায় মনে রেখো' (বাংলাদেশ, রিমেম্বার মি) গ্রন্থের মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অবদানের কথা মনে রাখার আকুতি জানিয়েছিলেন সাবেক সোভিয়েত নৌবাহিনীর কর্মকর্তা অ্যাডমিরাল জুয়েনকা। চট্টগ্রাম বন্দরে মাইন অপসারণকারী দলের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় আহত হয়েছিলেন তিনি। দেশে ফিরে গিয়ে চাকরি থেকে অব্যাহতি পান বাংলাদেশের জনগণের অকৃত্রিম এ বন্ধু। যে বাংলাদেশে মাইন অপসারণ করতে গিয়ে তিনি শারীরিকভাবে অক্ষম হয়ে পড়েছিলেন, নিজের দুর্দিনে সে দেশের সরকারের কাছে সাহায্যের আশায় হাত বাড়িয়েছিলেন। বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার 'কোনো বিদেশিকে সাহায্য দেওয়ার মতো তহবিল নেই' অজুহাতে সেই আবেদন প্রত্যাখ্যান করেছিল। শেষ পর্যন্ত বিনা চিকিৎসায় মরতে হয়েছে তাঁকে।
তাঁদের মতো আরো অনেক বিদেশি নাগরিক একাত্তরে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পাশে দাঁড়িয়েছিলেন বাংলাদেশের জনগণের।
মহান মুক্তিযুদ্ধে অবিস্মরণীয় অবদানের কৃতজ্ঞতাস্বরূপ স্বাধীনতার প্রায় ৪০ বছর পর বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনায়ক, রাজনীতিবিদ, দার্শনিক, লেখক, বিশিষ্ট নাগরিক, শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক ও সাংবাদিকদের সম্মানসূচক নাগরিকত্ব দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পররাষ্ট্র ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা এবং বিশিষ্ট নাগরিকদের সমন্বয়ে গঠিত বিশেষ জাতীয় কমিটির চূড়ান্ত করা গাইডলাইনে (দিকনির্দেশনা) মুক্তিযুদ্ধের সময় এ দেশের জনগণের পাশে দাঁড়ানো বিদেশি বন্ধুদের সম্মানসূচক নাগরিকত্ব, স্বর্ণপদক ও সম্মাননাপত্র দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। প্রস্তাব করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বিভিন্ন সংগঠনকেও সম্মাননা দেওয়ার।
কমিটি সূত্রে জানা গেছে, তাদের চূড়ান্ত করা গাইডলাইন এবং বিদেশি ব্যক্তি ও সংগঠনের তালিকা মন্ত্রিসভার বৈঠকে উত্থাপন করা হবে। এদিকে দেরিতে হলেও মুক্তিযুদ্ধে বিদেশিদের অবদানের কথা মনে রেখে রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মান জানানোর উদ্যোগ নেওয়ার খবর পেয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন রিচার্ড টেলরসহ অনেকে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও জাতীয় কমিটি সূত্রে জানা গেছে, মহান মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ অবদান আছে এমন বিদেশিদের সম্মান জানানোর জন্য গাইডলাইন চূড়ান্ত করার পর এখন বিদেশে বাংলাদেশ মিশন ও দেশের বিশিষ্ট নাগরিকদের মাধ্যমে বিদেশি নাগরিক ও সংস্থার নাম তালিকাভুক্ত করার প্রক্রিয়া চলছে। গত ১৮ জুলাই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত জাতীয় কমিটির বৈঠক শেষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি সম্মাননা প্রদানের গাইডলাইন চূড়ান্ত করার কথা সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন। জানা গেছে, সেই গাইডলাইনেই বিদেশি বন্ধুদের সম্মানসূচক নাগরিকত্ব, স্বাধীনতা পদকের সমমানের সোনার পদক ও সম্মাননা দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে।
কমিটির সদস্য মেজর (অব.) এ এস এম সামছুল আরেফিন গতকাল বুধবার কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আগামী সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাস নাগাদ চূড়ান্ত হবে বিষয়টি। মুক্তিযুদ্ধে বিদেশিদের অবদান বিবেচনা করে তাঁদের সম্মানসূচক নাগরিকত্ব প্রদানের বিষয়টি ঠিক করা হবে। কমিটির সুপারিশের আলোকে এ ব্যাপারে মন্ত্রিসভা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে।'
কমিটি সূত্রে জানা গেছে, মুক্তিযুদ্ধে অসাধারণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা হিসেবে কয়েকজনকে সম্মানসূচক নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। তবে সম্মান জানানো হবে মুক্তিযুদ্ধে অবদান আছে এমন সব বিদেশিকে। এ ব্যাপারে সরকারের শীর্ষ পর্যায়েরও সম্মতি রয়েছে।
কমিটির সদস্য সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির কালের কণ্ঠকে বলেন, '১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে বিভিন্ন দেশের বরেণ্য রাষ্ট্রনায়ক, রাজনীতিবিদ, দার্শনিক, লেখক, বিশিষ্ট নাগরিক, শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক, সংগঠন (অর্গানাইজেশন), সাংবাদিক, প্রচারমাধ্যম যাঁরা অবিস্মরণীয় অবদান রেখেছেন, তাঁদের সম্মাননা দেওয়ার জন্য একটি গাইডলাইন তৈরি হয়েছে। এই সম্মাননা দেওয়ার জন্য কেবল বিদেশি ব্যক্তি বা সংগঠনই বিবেচিত হবে। স্বাধীনতা পদকের সমমানের পদক, বাংলাদেশের সম্মানসূচক নাগরিকত্ব দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে।'
সূত্রমতে, মুক্তিযুদ্ধে নিহত ভারতীয় সেনাদের স্মরণে, চট্টগ্রাম বন্দরে মাইন অপসারণ করতে গিয়ে নিহত তৎকালীন সোভিয়েত সেনাদের জন্য ঢাকায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আলাদা স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ এবং ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নামে ঢাকার একটি গুরুত্বপূর্ণ সড়কের নামকরণ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
শাহরিয়ার কবির বলেন, 'নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি। তারা জানে না, মুক্তিযুদ্ধ কিভাবে বিশ্ববাসীর সশ্রদ্ধ মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল। যাঁরা লড়াই করেছেন, তাঁরা অস্ত্রের দিক দিয়ে দুর্বল ছিলেন। এটা সবলের বিরুদ্ধে দুর্বলের লড়াই হলেও মানসিকভাবে মুক্তিযোদ্ধারা দুর্বল ছিলেন না। এ কারণে তাঁরা সারা বিশ্বের কাছে শ্রদ্ধা, সম্ভ্রম পেয়েছেন। সারা বিশ্বের খবরের কাগজে মুক্তিযুদ্ধের সময় এ দেশের মানুষের খবর, দুর্দশা, প্রতিরোধের খবর প্রকাশিত হয়েছে। এমনকি মার্কিন সরকার আমাদের বিপক্ষে থাকলেও দেশটির জনগণ, গণমাধ্যম ও জনপ্রতিনিধিদের একটি বড় অংশ আমাদের পক্ষে দাঁড়িয়েছিল। এর ফলে বাংলাদেশের বিজয় ত্বরান্বিত হয়েছে। ওরা না থাকলে আমরা এত দ্রুত স্বাধীনতা অর্জন করতে পারতাম না। সেটা আজকের প্রজন্মের জানা উচিত।'
শাহরিয়ার কবির বলেন, 'আমরা আমাদের স্বাধীনতার জন্য লড়ব_এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ১৮ হাজার থেকে ২০ হাজার ভারতীয় সেনাও বাংলাদেশ স্বাধীন করার জন্য জীবন দিয়েছেন। আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর এত সংখ্যক সদস্য কিন্তু জীবন দেননি।' তিনি আরো বলেন, "স্পেনের গৃহযুদ্ধে লড়াই করেছিলেন আঁদ্রে মালরো। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর বয়স ৬০ বছরের ওপর। ১৯৭১ সালে তিনি ভারতে এসে বলেছিলেন, 'বাংলাদেশ চাইলে আমরা এখনো লড়াই করার জন্য প্রস্তুত আছি। আমি রণাঙ্গনে গিয়ে লড়াই করব বাংলাদেশের জনগণের পক্ষে।' যুক্তরাষ্ট্রের রিচার্ড টেলরের নেতৃত্বে শান্তির পক্ষে একদল মানুষ পাকিস্তানি জাহাজে অস্ত্র বোঝাই করা ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্রে একটি সমুদ্রবন্দর ঘিরে ফেলেছিল। তারা বলেছিল, এই অস্ত্র তারা বাংলাদেশের জনগণের ওপর ব্যবহার হতে দেবে না। এখন তিনি বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণের অপেক্ষায় আছেন। দুই বছর আগে তিনি আমাকে বলেছিলেন, 'আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের কোনো সরকার আমাদের স্মরণ করল না।"
ওই মানুষগুলো এ দেশের মানুষের দুর্দিনে চুপ করে বসে থাকতে পারেননি। বাংলাদেশ সরকার অনেক দেরিতে হলেও তাঁদের সম্মাননা জানানোর উদ্যোগ নিয়েছে।
কমিটির আরেক সদস্য চিত্রশিল্পী অধ্যাপক হাশেম খান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা এ বছরই বিজয় দিবসে আনুষ্ঠানিকভাবে এ সম্মাননার বিষয়টি ঘোষণা করার জন্য প্রস্তাব করেছি। আগামী বছর ২৬ মার্চ, আমাদের ৪০তম স্বাধীনতা দিবসে আনুষ্ঠানিকভাবে ঢাকায় সম্মাননা দেওয়ার পরিকল্পনা চলছে।'
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি গত ১৮ জুলাই সাংবাদিকদের বলেন, অসুস্থতা বা বয়সের কারণে যাঁরা আসতে পারবেন না তাঁদের সংশ্লিষ্ট দেশে বাংলাদেশ মিশনের উদ্যোগে আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। তবে কমিটির সদস্যরা মনে করেন, কৃতজ্ঞতা ও সম্মাননা জানাতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বা পররাষ্ট্রমন্ত্রীরই যাওয়া উচিত।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র ও কমিটি সংশ্লিষ্টরা জানান, ব্যক্তিপর্যায়ে সম্মাননা দেওয়ার জন্য তালিকায় প্রায় ১৫০ জনের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে আছেন ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের কাউন্সিল অব মিনিস্টার্সের চেয়ারম্যান আলেক্সি কোসিগিন, যুগোশ্লাভিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট জোসেফ টিটো, কিউবার সাবেক প্রেসিডেন্ট ফিদেল কাস্ত্রো, তখনকার ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হ্যারল্ড উইলসন, জার্মানির চ্যান্সেলর উইলি গ্রান্ট, ভারতের সাবেক সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল স্যাম মানেকশ, ভারতের সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় ফ্রন্টের সাবেক কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা, ভারতের নেতা জয় প্রকাশ নারায়ণ, মাদার তেরেসা, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর তখনকার মুখ্যসচিব পিএন হাকসার ও উপদেষ্টা ডিপি ধর, পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শংকর রায় ও জ্যোতি বসু, ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) সাবেক প্রধান রস্তম জি, ফ্রান্সের সাবেক সংস্কৃতিমন্ত্রী, সাহিত্যিক ও দার্শনিক আঁদ্রে মালরো, সাবেক মার্কিন সিনেটর অ্যাডওয়ার্ড কেনেডি, কংগ্রেসম্যান গালাগার, সিনেটর ফ্র্যাঙ্ক চার্চ, সিনেটর চার্লস পার্সি, মার্কিন গায়ক জর্জ হ্যারিসন, বব ডিলান, ভারতীয় সেতারবাদক পণ্ডিত রবি শংকর, সংগীতশিল্পী জোয়ান বায়েজ, মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকায় মার্কিন কনসাল জেনারেল আর্চার কেন্ট ব্লাড, মার্কিন নাগরিক রিচার্ড টেলর, অস্ট্রেলিয়ার এ এস ওডারল্যান্ড (বীর প্রতীক), জাপানের তাকাশি হায়াকাওয়া, সুইডেনের এমপি লার্জ লিজন বর্গ, প্রফেসর রবার্ট রাইমস, পাকিস্তানের রাজনীতিক এয়ার মার্শাল আসগর খান, খান আবদুল ওয়ালি খান, কবি আহমদ সালিম, মানবাধিকার নেত্রী নাসিম আখতার, মানবাধিকার নেত্রী আসমা জাহাঙ্গীর, কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ, নেপালের প্রেসিডেন্ট ডা. রামবরণ যাদব, ভারতীয় সংগীতশিল্পী লতা মঙ্গেশকার, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সলিল চৌধুরী, অভিনয় শিল্পী ওয়াহিদা রেহমান, কবি কাইফি আজমি, শিল্পী মকবুল ফিদা হুসেন, বিপ্লবী পান্নালাল দাশগুপ্ত, টিএন কউল, ত্রিপুরার সাবেক মুখ্যমন্ত্রী শচীন্দ্র লাল সিংহ, ভারতীয় সাংবাদিক অনিল ভট্টাচার্য, দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, গীতিকার গোবিন্দ হালদার, সংগীতশিল্পী ভূপেন হাজারিকা, লেখক দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, চলচ্চিত্র নির্মাতা ঋতি্বক ঘটক, প্রিন্স সদরুদ্দিন আগা খান, শিল্পী গণেশ পাইন, বিকাশ ভট্টাচার্য, প্রকাশ কর্মকার, নেপালের সাবেক প্রধানমন্ত্রী গিরিজা প্রসাদ কৈরালা, কানাডার সাবেক প্রধানমন্ত্রী পিয়েরে ট্রুডো, শ্রীলঙ্কার সাবেক প্রেসিডেন্ট শ্রীমাভো বন্দরনায়েকে, সাংবাদিক সাইমন ড্রিং, মার্ক টালি, বব ডিলান, ভারতের বর্তমান অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি, সাবেক সোভিয়েত নৌবাহিনীর অ্যাডমিরাল জুয়েনকো, জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব উথান্ট, উপেন তরফদার, প্রণবেশ সেন, অন্নদা শংকর রায়, ভিক্টোরিয়া ওকোম্পো প্রমুখ।
সংগঠন হিসেবে সম্মাননার জন্য প্রস্তাবিত নামের তালিকায় বিশ্ব শান্তি পরিষদ, আন্তর্জাতিক রেডক্রস সোসাইটি, জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার, মাদার তেরেসার সংগঠন মিশনারিজ অব চ্যারিটিজ রয়েছে বলে জানা গেছে।
জানা গেছে, বোম্বের বিখ্যাত নায়িকা ওয়াহিদা রেহমান মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর সব 'সাইনিং মানি' দিয়েছিলেন বাংলাদেশের মানুষের জন্য। বাংলাদেশের দুর্দশার ছবি এঁকে ট্রাকে করে সারা দিন বোম্বের (মুম্বাই) রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেছেন মকবুল ফিদা হুসেন। সেই ছবি দেখে গৃহবধূরা কেউ সিকি, কেউবা আধুলি দিয়েও সাহায্য করেছেন। এ সিকি-আধুলিই দিনের শেষে হাজার রুপি ছাড়িয়ে কখনো কখনো লাখ হয়ে জমা হতো বাংলাদেশ তহবিলে।
এদিকে প্রায় ৪০ বছর পর বাংলাদেশের পক্ষ থেকে খোঁজ নেওয়ায় আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়ছেন বিদেশি বন্ধুরা। জাতীয় কমিটির সদস্য ইতিহাসবিদ ড. মুনতাসীর মামুন গত ২১ জুলাই জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ড. এ কে আবদুল মোমেনকে সঙ্গে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ায় রিচার্ড টেলরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মাননা জানানোর পরিকল্পনার কথা জানান। এতে আবেগাপ্লুত হয়ে তিনি জানান, সরকার আমন্ত্রণ জানালে অন্তত একবারের জন্য হলেও বাংলাদেশে আসতে চান তিনি।
পাকিস্তানের মানবাধিকার নেত্রী নাসিম আখতার রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মাননা দেওয়ার প্রক্রিয়ার খবর বাংলাদেশের বিশিষ্টজনদের মুখে শুনে আবেগে প্রায় কেঁদে ফেলেন। তিনি অবাক হয়ে বলেন, 'বাংলাদেশের মানুষ এখনো আমাদের মনে রেখেছে!'
জানা গেছে, মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের জনগণের পাশে দাঁড়ানো ব্যক্তিদের কৃতজ্ঞতা জানানো দূরের কথা, গত সরকারগুলোর আমলে তাঁদের সাহায্যের আবেদন পর্যন্ত মঞ্জুর হয়নি। বিশেষ করে গত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে অ্যাডমিরাল জুয়েনকো তাঁর দুর্দশার কথা জানিয়ে সাহায্যের আবেদন করেছিলেন, কিন্তু কোনো বিদেশিকে সাহায্য দেওয়ার বিধান নেই বলে জানিয়ে ওই আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হয়। শাহরিয়ার কবির জানান, রাশিয়ায় বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা অর্থ সাহায্য তুলে তাঁর বাড়িতে দিয়ে এসেছিল। বাংলাদেশ সরকার তাঁর কোনো খোঁজ নেয়নি।
উল্লেখ্য, গত মার্চে ৩৩ বিদেশি নাগরিক ও একটি সংগঠনকে সম্মাননা জানানোর প্রস্তাব মন্ত্রিসভা থেকে ফেরত পাঠানো হয়। এরপর আরো বড় পরিসরে সম্মাননা দেওয়ার জন্য গঠিত হয় জাতীয় কমিটি। এ কমিটিই সরকারের কাছে সুপারিশ পাঠাবে।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই আগস্ট, ২০১০ দুপুর ১২:৩২
১৫টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×