ভর ভর সন্ধ্যা । মাগরিবের নামাজ পড়ে বসে পড়লাম টেবিলে। হাত দুটো উপরে রেখে শুরু করলাম ভাবনা।
চিন্তাটা মাথায় ঘুর ঘুর করেছে সারাটা দিন। চিন্তা নয় বরং দুশ্চিন্তা বলাই ভাল।লোকটা যেভাবে ভাল মানুষের মতটা কথা টা বলেছিল তাতে খারাপ কিছু ছিল বলে মনে হয় না।
অবচেতনে শুরু হয়ে গেল ফ্ল্যাশ ব্যাক।দোতলা ভবনের একটা দালানে ঢুকেই দেখা গেল দুই জন লোক কাচুমাচু হয়ে বসে আছে একটা অফিস ডেস্কের বাম পাশ ঘেষে।এস আই সাহেবের চোখে চোখ পড়তেই বলে উঠলেন আসুন আসুন বসুন। একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসতেই দেখা গেল মহামান্য এস আই সাহেব কিছু লিখছেন।এই ব্যাটা চাইলে আমারে এই মুহূর্তে চিরস্থায়ী হাজত বাসী করে দিতে পারে,কিংবা রিমান্ডে নিয়ে চোখ বেধে উলটা করে ঝুলিয়ে...... নাহ থাক এর সাথে চালাকি করার সাহস আমার নাই। বললাম আঙ্কেল জ্যামে ছিলাম এজন্য দেরী হয়ে গেল।সাথে সাথে চোখ বুলিয়ে হাল্কা করে দেখে নিলাম কি লিখা আছে কাগজে।নিজের নেগোসিয়েশন এফেক্ট টা কাজে লাগালাম।দুই প্রতিপক্ষ কে কুশল জিজ্ঞাসা করলাম। মনে মনে কি আছে তা শুধু আমরা দুই পক্ষই জানি।উপরে উপরে কুশল বিনিময় হলে ভেতরের ভাবনা কিন্তু অন্য।
আরো কিছুক্ষণ কলম ঘষে এস আই তাকাল বেয়াদব ম্যানেজার এর দিকে। ম্যানেজার লোকটা নিজের স্বার্থ ছাড়া কিছুই বূঝতে চায়না।মনে মনে ভাবলাম বড় বড় কথা সবাই বলে ।এখন বুঝবা কত ধানে কত চাল।কলমের ডগা কাগজে ছুঁইয়ে হিসাব নিতে শুরু করলেন এস আই। ম্যানেজার এর সাথে মলিন মুখে বসে আছেন এম ডি সাহেব। তার চোখের তলে কালি পরিষ্কার দেখা গেল। ম্যানেজার তখন ও হাসছে মিটিমিটি। “তো আপনি বলেছেন আপনার কোম্পানী জমির বিনিময়ে টাকার নিয়েছে কিন্তু বুঝিয়ে দেননি” আগ্রহ ভরে এম ডি কে বললেন এস আই ।অনেকটা ধমকের সুরে তাগাদা লাগালেন আর কোনা চোখে তাকালেন আমার দিকে।ভাবটা এমন যেন কেমন দিলাম !
এস আইঃ লাখ লাখ টাকা নিয়ে ঘুরাতে ভালবাসেন, টাকা ফেরত দিতে মন চায়না, তাইনা ?
ম্যানেজারঃ কই নাতো,এইযে দেখুন কত জমি রেজিস্ট্রি দিয়েছি আমরা।
এস আইঃ বাদী পক্ষ টাকা ফেরত চায় বুচ্ছেন ? আপনার ধানাই পানাই ছাড়েন, নাইলে হাজতে ভরে দিব (আবার কোনা চোখে তাকালেন)
ম্যানেজারঃএই পঞ্চাশ হাজার টাকা আমাকে দেয়নাই দিয়েছে অন্য লোক কে।
এস আইঃ এর দায় কে নিবে?(এম ডি কে)
এম ডিঃ আমি নিব না।
আমি বলতে শুরু করলাম দেখুন ...আপনার লোক কে ফোন করুন । এক মিনিট আমি বলি, আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন এস আই ।
দেনা পাওনার হিসাব আবার শুরু করলেন হাল্কা মোটা-তাজা আইনের ভক্ষণকারী-রক্ষক।
**
আধ ঘন্টা পরে সাব্যস্ত হল-দশ পারসেন্ট টাকা ফেরত দিবেন তারা। বাকি টা চার কিস্তি তে ফেরত দিতে হবে।মোটেও খুশি হতে পারলাম না আমি।
ম্যানেজার তো পারছেনা ধেঈ ধেঈ করে নাচে, গোমড়া ভাব দেখিয়ে বলল- আমাদের কি মেরে ফেলবেন?
সাথে সাথে গর্জে উঠলেন এস আই-আপনি আপনার কাছে যে পাওনা আছে তা কবে দিবেন? বিশ তারিখে টাকা টা ফেরত দিবেন। আর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন এই কাগজে আপনার বাবার স্বাক্ষর নিবেন তারপর টাকা নিবেন। এস আই এর কন্ঠ পুরো পালটে গেছে। এতক্ষন যোগ বিয়োগ করে মেজাজ চড়ে গেছে স্পষ্টই বোঝা যায়।হলুদ, সরকারী একটা লম্বাটে মার্জিন বরাবর ভাজ করা কাগজ দিয়েই বললেন আপনি আসুন। নিশ্চল হয়ে বসে রইল বিবাদি লোক দুটো।
আমি একটু না বোঝার ভান করে তাকাতেই আমাকে কথা গুলো আবার বললেন।ধমক টা আমাকে চাইলেই দিতে পারতেন কিন্তু লাখ দুই পেটে চালান হয়ে আছে তাই হয়ত দিলেন না।গুটিগুটি পায়ে দোতলা থেকে বেড়িয়ে আমি চিন্তা করলাম আমার পেছনে গুপ্ত ঘাতক লেলিয়ে দিলে এখনই বেড়িয়ে যাওয়াটা হবে চরম বোকামি। গিয়ে বসে রইলাম ক্যান্টিনে।
দূর থেকে লক্ষ্য রাখতে সুবিধে হবে ভেবে নিশ্চিন্ত হলাম আমি।চায়ের অর্ডার দিলাম আর একটা চিপস নিয়ে মুখে আর দাঁতে সদ্বব্যাবহার করা শুরু করলাম।মনে মনে একটা অঙ্ক কষলাম। ম্যানেজার আর এমডি মিলে কি করতে পারে , যদি পরিকল্পনা করে মামলা থেকে নিস্তার পেতে চায় তাইলে কথা বার্তায় অনেক সময় যাবে।আর বিকল্প উপায় মানে টেবিলের তলে লেনদেন হলে বেশি দেরী হবেনা। আজকাল টাকায় থানা-আদালত সব কিনে নেয়া যায় এটা শিশুও জানে। আমার মতো আনাড়ী ও যখন বোঝে !
ভাবতে ভাবতে মিনিট দশেক পরে খেয়াল করলাম আমার শত্রুরা অর্থাৎ বিবাদীরা এদিকেই আসছে। পালাতে ইচ্ছা করল আমার, কিন্তু ধরা পড়ে গেছি বুঝতে পারলাম।
এমডি লোকটা দাত কেলিয়ে জিজ্ঞেস করল চা খাচ্ছ ? কোনমতে আমি বললাম হ্যা ।
অনেক তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যাবার কারণটা বুঝতে পারলাম অতি চালাক এসআই সাহেব বিশ্বাস ঘাতকতা করেছেন আমার সাথে।টাকা খাচ্ছেন দুই পক্ষের থেকে।
তখনি আমি সিরিয়াস হতে শুরু করলাম।ভাবলাম –নাহ খেলোয়াড় আমি একাই নই। সেই সাথে এমডি সাহেব ১৪ তারিখে মেয়ের বিয়েতে যেভাবে দাওয়াত দিলেন তা ভাবতে শুরু করলাম। যাব কি যাব না। বাবা-মা হজ্ব করতে চলে গেছেন মক্কায়। খাপে খাপে মিলিয়ে ফেললাম আমি। আসলে ফাঁদ পাতার আয়োজন হয়ে গেছে।
****
ফ্ল্যাশব্যাক থেকে ফিরে এলাম বাস্তবে।বার বার করে ভাবলাম আমার বর্তমান অবস্থায় আমি কতটা অনিরাপদ।কখনও শুনিনি যার সাথে জমি সংক্রান্ত মামলা চলমান তার মেয়ের বিয়েতে দাওয়াতে গেছে কোন আহাম্মক , আমাকে ছাড়া।
দিনকাল বড়ই খারাপ , পাওনা টাকার কথা বলে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে খুন করেছে এগুলো মোটেই বিরল ঘটনা নয়।আজকের ঘটনা কোন দিকে যাচ্ছে ভেবে আবার আমি শঙ্কিত হলাম।আচ্ছা কোন লোক যদি আমার সাথে থাকে তবে কেমন হয়?
(বাকিটা আগামী পর্বে সমাপ্য)
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫ দুপুর ২:৩১