somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মারবেল ফলের মওসুমে কবির সাথে ঘুরাফিরা

০২ রা জুন, ২০১১ রাত ১০:৫৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

এককালে কবি হওয়ার বেজায় শখ ছিল, এবং নানান প্রয়াশে নিজেরে কবি গণ্য করেই আমোদ পাইতাম। কবি হওয়ার এই শখ এখনো মরে নাই, তবে এর বেঁচে থাকা এখন নেহায়েতই কোনরকমে। এর কারন আছে। একটা কারন হইতে পারে যে, সুপ্রিয় কবি ব্লগার “আমি উঠে এসেছি সৎকারবিহীন" যদিও একদা অভিযোগ করেছিলেন যে আমি নাকি আমার কাব্যচর্চারে আন্ডাররেটেড গণ্য করি। অভিযোগ সত্য হইতে পারে। কিন্তু আমার কাব্যচর্চা যে অন্যদের কাছেও আন্ডাররেটেড তাতে কোন সন্দেহ নাই। তা না হইলে ব্লগে কবিতা তো নেহায়েত কম পোস্ট করলাম না, কেনো প্রতিবারই কেউ না কেউ আইসা বলে “ভাই, আপনে কবিতাও লেখেন?” হয়তো এইখানে রেটিংএর কোন সমস্যা নাই, কবিতা যেমন রেটিংও তেমন। আমার তাই এই নিয়া বড় একটা খেদ নাই।

কবি হই বা না হই কাব্য সমালোচনা বরাবরি করতে ইচ্ছা করে। বিশেষ করে এইক্ষেত্রে খানিকটা নাক উচাইয়া ঘুরাফিরা করাই আমার স্বভাব। কথায় কথায় শূন্য দশকের কবিদের যাবতীয় উৎপাদন ‘শূন্য' বলে ঘোষণা করার স্বভাব যে আমার আছে তা আমার ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি মাত্রই মালুম। মাঝে মাঝে যে এইনিয়া কিঞ্চিত বাড়াবাড়ি করি তা স্বিকার করেও বলতে হয়যে, সমসাময়িক কবিতার এহেন নেতিবাচক সমালোচনা নেহায়েতই উন্নাসিকতাপ্রসূত না, এর পেছনে বিশেষকিছু খেদ জড়িত আছে, সেইসাথে জড়িত আছে কবিতা নিয়া আমার ভাবনা চিন্তা। একজন কবির কবিতা পড়ার সময় সেই কবির সাথে আমার যোগাযোগটা জরুরী, সেইসাথে আমার বাসনা থাকে কবির কবিতা পড়তে পড়তে তার সাথে খানিকটা ঘুরাফিরা করে আসার, তার জগতে। অত্যন্ত দুঃখের সাথে বলতে হয়যে নব্বই থেকে এই দুই হাজার এগার পর্যন্ত সময়কালের যেই কাব্যচর্চা তাতে অল্প কিছু ব্যতিক্রম বাদে বেশিরভাগ কবি পাঠককে নিজের সাথে এই ঘুরাফিরা করার সুযোগটা ঠিক মতো দিছেন কিনা এই নিয়া সৎ সাহস সহকারে সন্দেহ করা যায়। পরীক্ষা নিরীক্ষা নেহায়েত কম হয় নাই। কিন্তু আধুনিকতার বিরোধিতা করে স্রেফ তত্ত্ব মাইনা কাব্যচর্চা করে যে এলিট কবির সিংহাসন ছেড়ে পাঠকের লগে খালি পায়ে ধুলার রাস্তায় ঘুরাফিরা করা যায়না এইটা এখন প্রমানিত সত্য। ফর্ম ভাঙা, প্রথা বিরোধিতা, আধুনিকতার ভাষা ও শব্দগুচ্ছ বিরোধিতা ইত্যাদিতে বেশ উন্মাদনা জাগলেও প্রকৃত সৃষ্টিশীল কাজের জন্য যেই পরিমাণ যত্ন, পরিশ্রম, সাধনা আর পরিশীলতার দরকার আছে তার অভাবই আমাদের সময়ের কবিদের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা বলে গণ্য করি।

তো যার কবিতা পড়ে এই লেখাটা লিখতে বসলাম, ‘সেই পিয়াস মজিদ’কে আর যাই হোউক কাব্য চর্চায় অযত্ন অবহেলার দোষে অভিযুক্ত করার উপায় নাই। আমাদের প্রজন্মের বেশিরভাগই যেইখানে কবিতা বলতেই পূর্বজদের বিরোধিতা, ধুম ধারাক্কা ভাঙচুর, নৈরাজ্য আর পরীক্ষা নিরীক্ষা বুঝে থাকি, এখন সেই ধ্বংসের মাঝখান থেকে কিছু গড় উঠলো কিনা প্রায়ই খবর নেইনা, সেইখানে পিয়াস মজিদ খানিকটা ব্যাতিক্রম ভাবেই পূর্বজদের পথের বেশ দক্ষ অনুসরণকারী, এবং প্রগার যত্ন এবং পরিশ্রম নিয়াই গত বছর দশেক যাবৎ কবিতার নির্মাণ করে যাচ্ছেন। এই বছরের বইমেলাতেই আসা তার বই “মারবেল ফলের মওসুম পড়ে এই ধারণা আরো প্রবল হলো। তবে ঠিক যেই কারনে এই বই নিয়া লিখতে বসে গেলাম, তা কিঞ্চিত ভিন্ন। এমনিতে কবিতা নিয়া আমার যেই আকাঙ্ক্ষা পিয়স মজিদ তা পুরাপুরি পূরণ করেন না, তার লেখার ধরণ তেমন না। কিন্তু তিনি আমাকে আশাহতও করেন নাই, বরং একটা কবিতার বই পাঠের সফল সুযোগ করে দিয়েছেন। ঘটনা হচ্ছে যে দীর্ঘদিন পরে একটা কবিতার বই পড়তে গিয়ে কবির সাথে বেশ ঘুরাফিরা করে আসা গেলো। আর সেই ঘুরাফিরার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়াই এই লেখাখানি লিখতে বসলাম।
বইটা যারা ইতিমধ্যে হাতে পেয়েছেন “মারবেল ফলের মওসুম নাম নিয়া তাদের অনেকেরই বোধহয় প্রশ্ন জেগে থাকবে। আমারও যে জাগে নাই তা না, যেহেতু মারবেল ফল নামক কোন ফলের খবর আগে শুনিনাই। তবে এই কৌতুহল নিবারণ করে দিছেন কবি একেবারে বইয়ের শুরুতেই কয়েকটা লাইনে –
“মারবেল ফল ঋতুহীন।
স্বপ্নে ফলে।
স্বপ্নেই এর জন্ম, বিকাশ, পরিণাম।
তবে স্বপ্নপ্রসূ বলে তা অলীক নয়।
কারণ স্বপ্নও তো এক ভীষণ বাস্তবতা”।

তা কৌতুহল খানিকটা নিবৃত হইলেও মার্বেল ফল বিষয়ক এহেন ঘোষণা কিঞ্চিত শঙ্কারও জন্ম দেয় বৈকি। স্বপ্ন যখন ভীষণ বাস্তব হয়ে বাস্তবতা আর স্বপ্নের এলাকা চুরমার করে একাকার হয়, তখন যার জন্ম হয় সেই ‘পরাবাস্তবতা’ বিষয়ে আমার শঙ্কা দীর্ঘদিনের। কাব্যচর্চায় যখন পরাবাস্তবতা চর্চিত হয় তখন উৎপাদিত পরাবস্তব কবিতা পাঠে আমি মাঝেমাঝেই আমোদ পাই বটে, কিন্তু পরাবাস্তব কবিতা কখনোই আমার সরল ‘বাস্তবতা’ বিলাসী মগজে বিশেষ ভালোবাসার জন্ম দিতে পারেনাই, বরং এই শিল্প প্রয়াসের অর্থময়তা আর যথার্থতা নিয়া আমি বরাবরি সন্দিহান। পরাবাস্তব উপমা আর ভাবের আড়ালে যদি নিখাদ বাস্তবতা আর সমসামিয়কতা ধরা না পরে তখন কবির কাব্যচর্চার আদতেই কোন অর্থ হয় কিনা তা নিয়া আমার সন্দেহ আছে। তবে সুখের বিষয় এইযে বাঙলা কবিতায় ৮০র দশকে পরাবস্তব কাব্যচর্চার আবির্ভাব বেশ ঢাকঢোল পিটিয়ে হলেও সমসাময়িকতাকে এড়িয়ে যাওয়া এই কাব্যচর্চার পক্ষে কখনোই পুরাপুরি সম্ভব হয় নাই, অটোমেশন আর শিল্পকলার বিমানবিকিকরণের আড়ালে চাপা পরে কখনোই বাঙলা কবিতা মানবিকতা বিবর্জিত হয়নাই পুরাপুরি। আর এর কারণ হয়তো স্বঘোষিত পরাবস্তবতার পূজারি নেতৃস্থানীয় বাঙালি কবিরা পরাবাস্তবতায় নিমজ্জিত হয়েও স্বপ্ন আর বাস্তবের যেই জগৎ নির্মান করেছেন সেই বাস্তবতা খেটে খাওয়া বাঙালির সমসাময়িকতা অস্বীকার করতে পারেনাই। আর এই কারণেই বোধহয় বাঙলা পরাবাস্তব কবিতার অন্যতম নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ‘আবদুল মান্নান সৈয়দ’ যিনি কিনা পরাবস্তবতার ঢাকঢোল পিটিয়ে এককালে বাঙলা কবিতার জগতে সাড়া ফেলে দিছিলেন, তারেও শিল্প সমালোচকরা শুদ্ধ পরাবাস্তব কবি বলতে দ্বিধাবোধ করে। আবদুল মান্নান সৈয়দ গত হয়েছেন গেলো বছরের সেপ্টেম্বর মাসের ৫ তারিখে। এর মাত্র পাঁচ মাস পরেই পিয়াস মজিদের ‘মার্বেল ফলের মওসুমে’র ‘গ্রীনরোড’ শিরনামে একেবারে শেষ কবিতাটা যখন বাঙলা কবিতায় ঘোষনা দিয়ে স্বপ্ন আর বাস্তবতার সীমারেখা চূর্ণ করা এই কবির উদ্দেশ্যে নিবেদিত হয় তখন একে অনেকের কাছে শ্রেফ একজন সদ্য বিদায়ী পূর্বজের স্মরণ বলে মনে হলেও আমার কাছে তারচেয়ে বেশিকিছুই মনে হয়েছে।“স্বপ্নও তো এক ভীষন বাস্তবতা” ঘোষনা দিয়ে মারবেল ফলের মওসুমের যেই বর্ণনা পিয়াস দিয়ে গেছেন তাতে ঘুরেফিরা করে শুধু আবদুল মান্নান সৈয়দ না বরং পুরো আধুনিক বাঙলা কবিতার প্রতিটা গোলি ঘুপচির প্রতি কবির প্রগার ভালোবাসাই বেশ স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। তারচেয়েও বড় কথা, স্বপ্ন আর বাস্তবতার এলাকা এক করে ফেলার ঘোষনা দিয়েও পিয়াস যে আধুনিক বাঙালি কবিদের যোগ্য উত্তরসূরী হিসাবেই সমসাময়িক বাস্তবতাকে যত্নের সাথে ধারণ করেছেন, তাতে তিনি শুধু আমার শংকাই দূর করেননাই, আমার পক্ষ থেকে খানিক প্রশংসাও কামাই করে ফেলেছেন।

তবে এইসব প্রশংসার আগে কবির সাথে ঘুরাফিরার কাহিনীটা বর্ণনা করা দরকার। পিয়াস মজিদ বরাবরি নিজের কবিতায় নিবিষ্ট কবি, ধ্যানী। তার কাব্যচর্চায় তিনি নিজের এবং কবিতার সম্পর্ক নিয়া বারবার মাথা ঘামান। একজন কবি হিসাবে স্বপ্ন আর বাস্তবতায় মাখামাখি যেই জগতে তিনি বিচরণ করেন তা তিনি শব্দগুচ্ছে প্রকাশ করতে পারছেন কিনা এই নিয়া তার মাথাব্যাথা আছে। আর এই প্রশ্নের মোকাবিলা না করে তিনি সামনে আগাতে চান নাই। এইকারনেই বোধহয় বইয়ের প্রথম কবিতা হিসাবে ‘কবি’ কবিতাটা নির্বাচন করেছেন। এই কবিতায় কবি’র যেই রূপ তিনি একেছেন তা যেমন শ্বাসত কবিসত্ত্বা বলতে তিনি যা বোঝেন তেমনি তার নিজের সত্ত্বার প্রতিফলন বলে মনে করেন নির্ঘাৎ। এই কবি বড়ই কৌতুহলী, সদা ঘুরাফিরা রত, বুঝার চেষ্টায়, প্রকাশের চেষ্টায় কখনো শংকিত, কখনো আনন্দিত, কখনো ব্যাথিত। শব্দগুচ্ছে নিজের জানা সৌন্দর্যময় সত্যকে প্রকাশ করতে পারছেন কিনা এই নিয়া তিনি চিন্তিত, নিজেকে ভাবছেন নিরক্ষর। জগৎকে এর পুরাদোস্তুর সৌন্দর্য, স্বপ্ন আর বাস্তবতা সহ ধারণ করতে গিয়ে তিনি নিহত হচ্ছেন, আবার নিজেই নিজের জন্য শোক করছেন। সবশেষে কবি বলতে তিনি যা বোঝেন তাকে সোজাসাপ্টা ভাষায় নাম দিচ্ছেন ‘ব্যথা’। জগৎকে শব্দের ভেতরে বন্দি করার মতো বেদনাদায়ক কাজ নিতান্তই আনন্দ সহকারে যিনি করে যান সেই ‘কবি’কে তিনি অবশ্য ‘ব্যথা’ নাম দিতেই পারেন।
প্রথম কবিতাটা যথার্থ বলেই পুরা বইয়ে কবির সাথে ঘুরাফিরা করাটা আমার জন্য সহজ ও আনন্দদায়ক হয়েছে। এই যে কবির যেই জগৎ, যেই জগৎ তিনি অবগাহন করেন, শব্দগুচ্ছে ধারণ করেন, সেই ধারণ করা এবং ধারণ করতে গিয়ে কবির যাবতিয় অবিমিশ্র আবেগ অনুভুতিই বোধহয় মারবেল ফলের মওসুমের সবচেয়ে চোখে পরার মতো বিষয়। যেমন ‘শিল্পকলা’ কবিতায়-

‘আমাকে বধির করে
বাগিচায় জন্ম নেয়
সহশ্রে শিমুল আর
পলাশভাষা’।

অথবা

‘তোমার গিলোটিনে’ কবিতায়-
‘তারপর বনভূমির সবুজ মোহর
এবং কালো কোয়েলিয়া সাথে নিয়ে
আমি যাবো তোমার গিলোটিনে।
হব বসন্তবলি’।

সব কবিতা ধরে ধরে আলোচনা না করা সম্ভব না। তবে বইয়ের বেশিরভাগ কবিতাতেই নিজের জগৎকে শব্দগুচ্ছে প্রকাশ করা এবং সেই প্রচেষ্টার অবিমিশ্র অনুভুতিগুলা পিয়াস লিপিবদ্ধ করেছেন বলে আমার মনে হয়েছে। এইসব অবিমিশ্র অনুভুতির মাঝে যেই অনুভুতি সবচেয়ে বেশি চোখে পরে তা হলো কবির শংকা। যেমন তিনি ‘মায়াপাখি’ কবিতায় বলেন-

“আমি ধরতে গেলেই
এতসব দৃশ্যের খাঁচা ভেদ করে
দ্রুত মিলিয়ে যাও
সাতসন্ধ্যার
কমলা
ঝোপঝাড়ে”।

একজন কবি হিসাবে স্বপ্ন আর বাস্তবতার মিলঝুলে যেইসব দৃশ্য তিনি দেখেন শব্দগুচ্ছে তা ধরতে পারছেন কিনা এই নিয়া শংকা তার প্রবল। এই শংকা সত্ত্বেও দৃশ্যের ভেতরে নিজেকে বিলিয়ে দেয়া এবং দৃশ্যকে অর্থাৎ স্বপ্ন বলি বা বাস্তবতা এই পুরাটাকেই বাস্তবতা ধরে নিয়ে সেই বাস্তবতায় অবগাহন করায় তার প্রবল আগ্রহ। এই কাজ তিনি করে গেছেন একের পর এক কবিতায়। এই কারনেই তিনি কখনো বসন্তবলি হতে চান, কখনো তারাবীথি ধরে ঝুলে থাকেন আবার কখনো বা চাঁদের বুড়ির সেলাই করা সমুদ্রে ডুব দিতে চান। কবির সাথে মিলে এইসব শংকাময় ঘুরাফিরায় অংশগ্রহণ করে তাই যেই কাব্য পাওয়া যায় তাতে রস এবং আমোদ এই দুইয়েরই কমতি নেহায়েত কম নাই। এই বই পাঠের পর আমি অন্তত ঠিক কবির মতোই বলতে পেরেছি-

“আমি; বাস্তব ও স্বপ্নে মার খাওয়া মানুষ
এই প্রভা এবং সুরশক্তির পায়ে
উপাচার হিসাবে ঢালের মতো
ঢেলে দিতে পারি
আমার
একবিন্দু
অশ্রুকুমকুম।

তবে এইসবই সবনা। এইসবই যদি সব হতো তাহলে এই বই পাঠ শেষে কিঞ্চিত আমোদ লাভ করেও কবিকে নেহায়েত একজন স্বার্থপর ভাবুক বলেই অভিযুক্ত করতাম। আগেই বলেছি যে পিয়াস মজিদ একজন যত্নবান আধুনিক কবি, যত্নবান বাঙালি আধুনিক কবি যারে বলা যায়। সেই কারণেই কিনা, অথবা অটোমেশনের প্রবল প্রভাব সত্ত্বেও সুগঠিত শরীর সর্বস্ব এবং পরিশিলীত কবিতা লেখার প্রতিভা আছে বলেই হয়তো এইসব আত্ম নিবিষ্ট ভাবুকতাও সমসাময়িক বাস্তবতা বিবর্জিত হয় নাই। আর এইখানেই ‘মার্বেল ফলের মওসুম’ নামটাকে নিয়া আমি ভাবতে বাধ্য হয়েছি। মার্বেল ফল জিনিসটা কেমন? এই ফল কোন প্রাকৃতিক খাদ্যবস্তু, না কি নেহায়েত শোভাবর্ধনকারী কৃত্তিম কিছু এই বিষয়টা আমার কাছে পরিস্কার না। অবশ্য এই বিষয়টা খোদ কবির কাছেই পরিস্কার কি না তা নিয়াও আমার সন্দেহ আছে। আর তাছাড়া তার বইয়ে মারবেল ফলের চেয়ে ফলের মওসুম নিয়াই আলোচনা, মাথাব্যাথা এইসব বেশি। স্বপ্ন আর বাস্তবতার এই মওসুমের যেই বর্ণনা তিনি দিয়েছেন তা নেহায়েত নৈসর্গিক সৌন্দর্যের প্রকাশ না এবং তাতে শ্রেফ জাগতিক নিয়ম শৃঙ্খলার আলোচনাই হয় নাই। বরং আমরা দেখিযে এই পরাবাস্তবতার জগতে শৃঙ্খলা আর সৌন্দর্যের পাশেই বিরাজমান বিশৃঙ্খলা আর বিভৎসতা। কবির এই জগৎ তাই সোজাসাপ্টা বাস্তবতার চেয়ে খুব বেশি আলাদা কিছুনা, হয়তো পরাবাস্তবতার রূপকাশ্রয়ি রূপায়ন মাত্র। বিশেষ করে এই বইয়ের বেশিরভাগ কবিতাতেই কবির আকাঙ্খা আর অবগাহন ‘মিমাংশা’র চেয়ে অমিমাংশিত হয়ে শেষ হওয়া বা অপূর্ণ হিসাবে ফুটে ওঠাটা যেমন প্রবল তাতে আমাদের বর্তমান অস্থির সময় আর অমিমাংশায় বসবাসের অনুভিতির বেশ প্রবল প্রতিরূপ বলেই মনে হয়। কোথাও কোথাও কবির এই বোধ বেশ প্রবল।

‘সন্ধ্যায় কুরুক্ষেত্র অস্ত গেছে
তবু বাগানে বদ্ধভূমির ঘ্রাণ”।

অথবা

“আমি সমুদ্র এক
বুক ভরে জমা রাখি
লাশের কল্লোল”

কবির জগতে এইসব নিদারুন অনুধাবন আমার কাছে নেহায়েত আনন্দদায়ক কিছু মনে হয় নাই, বরং পরাবাস্তবতার মাঝেও আমাদের সময়কার বাস্তবতার হতাশার বেশ প্রচ্ছন্ন প্রকাশ বলেই মনে হয়েছে। মারবেল ফলের মওসুম আরো বেশি বেশি আমাদের সময়ের প্রতিচ্ছবি হয়ে ওঠে যখন কবি ‘জীবনযাপন’ কবিতায় প্রকাশ করেন-

একদিন ওয়ান ইলেভেন।
আরেকদিন
চাকমা বান্ধবীর গোপন বিষাদ।
সকালে কালো কফি।
সারারাত জৈবিক ভুগোল।

অথবা,

আর তুমি
পেনড্রাইভে
ভরে ফেলছ
এমনকি
সন্ধ্যার
সমস্ত
মাধুরী

এমনকি গোলাপে, মাংসে কবিতায় মারবেল ফলের মওসুমের ভাবজগতে একেবারে তেড়েফুড়েই ঢুকে গেছে পূজিবাদী দুনিয়ার বাজার বাস্তবতার প্রতি কবির নিদারুন বিদ্বেষ।

“যেদিকে কসাইখানা,
সেদিকেই ফুলার বাজার।
রক্ত আর পাপড়ির পাহার।
প্রতিদিন ওদিকে যাই।
ব্যাগ ভরে কিনে আনি
মাংস ও গোলাপ”।

বিশেষ করে কবিতার একেবারে শেষভাগে যখন বেশ বিদ্রুপের সাথেই উচ্চারণ করেন

“মাংসে-গোলাপে সফল হচ্ছে
মানুষজীবন”।
তখন মারবেল ফলের মওসুমে কবির সাথে আমার ঘুরাফিরা বেশ অর্থবোধক হয়ে ওঠে আমার কাছে।

পিয়াস মজিদ তরুন কবি, একেবারেই আমাদের প্রজন্মের মানুষ। এরিমাঝে আমাদের প্রজন্মের অন্যতম প্রতিশ্রুতিশীল একজন কবি হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন তিনি। প্রতিভা, যত্ন আর ধ্যান মিলিয়ে তিনি অনেকদুর যাবেন বলেই আমার বিশ্বাস। আর তাই ইতিবাচক সমালোচনার সাথে সাথে কিছু খুৎ খুঁজে বের করার চেষ্টাও পিয়াস মজিদের ডালপালা মেলে দিয়ে আরো বড় হয়ে ওঠার জন্য জরুরি মনে করি। পূর্বজদের প্রতি এবং আধুনিক কবিতার প্রতি পিয়াস মজিদের যেই প্রগাড় ভালোবাসা তা যেমন তার শক্তি তেমনি অন্যতম দুর্বলতা বলে গণ্য করি। এই ভালোবাসায় কিঞ্চিত ফাটল না ধরাতে পারলে একেবারেই নতুনত্বের জন্ম দেয়া এবং আলাদা ভাবে আমাদের সময়ের কবি হিসাবে ইতিহাসে নিজের স্থান করে নেয়া তার জন্যে কঠিন হবে বলে মনে করি। সেই সাথে গত শতকের শিল্পকলার বিমানবিকিকরণের পথে সমাজ এবং মানুষ থেকে বিচ্ছিন্নতাবাদী কবিদের ভাবালুতা অনেকক্ষানি ত্যাগ করে একেবারেই বাস্তব রাজনৈতিক কারণে এখন আমাদের সময় হয়েছে বাস্তবের সাথে এবং মানুষের সাথে কবি এবং কবিতার প্রবল বস্তুনিষ্ঠ রাজনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলার। সেই আকাঙ্খা এবং প্রতিভা তার আছে। এই কারণেই হয়তো ‘হিন্দোল’ কবিতায় পিয়াস বলেন-

পায় না সবাই প্রেতসংকেত। ওরা
যত পরিলিপ্ত। আমি মায়ের জঠর
থেকে সরাসরি ক্ষুধার ভেলায় চড়ে,
অরূপের রেখা ধরে এসেছি এই
দাবদাহকূলে। ওগো অস্তমিত প্রেম,
শোনো- দক্ষিণে জখমি ঝড়নার
গান, চুম্বনঝরোকার রেশমি বিলাপ।
তোমার প্রবেশ তোরণ ঘুমিয়ে গেলে
আমি মরবো কোথায়?

গ্রীনরোড কবিতায় আবদুল মান্নান সৈয়দকে স্মরণ করতে গিয়ে পিয়াস ঘোষনা করেন, “অমরতার জন্যে একমাত্র মৃত্যুই আশ্রয় নিয়েছিল তার নিঃসঙ্গ কাননে”। প্রেম যদি অস্তমিত হয়, দক্ষিনের ঝড়না যদি হয় জখম তাহলে পিয়াস মজিদের মতো কবিদের আসলেই মরবার জায়গা হবেনা। প্রেম আর দক্ষিনের ঝড়নার টিকে থাকার জন্য যেই লড়াইটা দরকার, ক্ষুতমুক্ত হয়ে এবং নিজগুনে নিজ সময়ের প্রতিনিধী হয়ে উঠলে পিয়াস মজিদের মরার জায়গা নিয়া চিন্তা করতে হবেনা, বরং ভবিষ্যতের কোন তরুন কবির ঘোষনায় মৃত্যুই অমরতার জন্য তার কাননে আশ্রয় নেবে।



সর্বশেষ এডিট : ০২ রা জুন, ২০১১ রাত ১১:০২
৬টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্মৃতিপুড়া ঘরে

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৩০



বাড়ির সামনে লম্বা বাঁধ
তবু চোখের কান্না থামেনি
বালিশ ভেজা নীরব রাত;
ওরা বুঝতেই পারেনি-
মা গো তোমার কথা, মনে পরেছে
এই কাঠফাটা বৈশাখে।

দাবদাহে পুড়ে যাচ্ছে
মা গো এই সময়ের ঘরে
তালপাতার পাখাটাও আজ ভিন্নসুর
খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯




মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজীব নূর কোথায়?

লিখেছেন অধীতি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪

আমি ব্লগে আসার পর প্রথম যাদের মন্তব্য পাই এবং যাদেরকে ব্লগে নিয়মিত দেখি তাদের মধ্যে রাজীব নূর অন্যতম। ব্যস্ততার মধ্যে ব্লগে কম আসা হয় তাই খোঁজ-খবর জানিনা। হঠাৎ দু'একদিন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×