somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নয়া মহাখেলার ময়দান বাংলাদেশ! আমরা কি প্রস্তুত? পর্ব -২

১৮ ই অক্টোবর, ২০১২ সন্ধ্যা ৭:১২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


বাংলাদেশ কিভাবে এই আন্তর্জাতিক মহাখেলার ময়দান হয়ে উঠলে সে বিষয়ে এবার আলোচনা করা যাক। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে ভ্রুন অবস্থাতেই, পূর্ব পাকিস্তানে যখন আওয়ামীলীগএর নেতৃত্বে ছয় দফা আন্দোলন শুরু হয়। ভারত তখনো আঞ্চলিক সুপার পাওয়ার হয়ে ওঠে নাই। আর বাংলাদেশ তখন প্রচুর পরিমান পাট রপ্তানি করতো বিদেশে। পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক সায়ত্ত্বশাসন প্রতিষ্ঠিত হলে ভারতএর গুরুত্বপূর্ণ চট শিল্প বাচানোর মতো বানিজ্যিক সুবিধা পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। বাংলাদেশের ছয় দফা আন্দোলনকে তাই ভারতিয় মিডিয়া জোর দিয়ে প্রচার করেছে এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতএর অর্থনৈতিক স্বার্থ ছিলো বাংলাদেশের সাথে কয়লা ও পাট বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ বানিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করা। রাজনৈতিক স্বার্থ ছিল পাকিস্তানের ভাঙন এবং দ্বিজাতিতত্ত্বের পরাজয় ঘোষনা। কিন্তু সেটাকে একজাতিত্ত্বের বিজয় ঘোষনা করার অবকাশ ছিলোনা। কারন বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিলো ভাষা ভিত্তিক জাতিসত্ত্বার ধারণায়। একে সমর্থন দিলে আসাম, অরুনাচল, নাগাল্যান্ড, কাস্মিরএর স্বাধীনতা সংগ্রামকে স্বিকৃতী দিতে হয়। ভারত সেই সময় নিজের দেশের বিচ্ছিন্নতাবাদী মুক্তিযোদ্ধাদের সামলাতেই যথেষ্ট বিপদের মধ্যে ছিলো। বাংলাদেশকে স্বিকৃতী দিতে তাই ভারত অনেক সময় নিয়েছে। এ বিষয়ে আহমদ ছফা তার বাংলাদেশের রাজনৈতিক জটিলতা নামক প্রবন্ধ বা বইএ বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। এর প্রাসঙ্গিক আলোচনা এই লেখার পরবর্তি কোন এক সময়ে আবার আলোচনা করা হবে।

বাংলাদেশের পাটশিল্প অনেক আগেই তার অর্থনৈতিক গুরুত্ব হাড়িয়েছে, ভারতিয় আধিপত্ত্ববাদ ও ষড়যন্ত্রে বাংলাদেশের পাটশিল্পের ধুকে ধুকে মৃত্যু হয়েছে আর ভারত নিজেই বাংলাদেশের অবস্থানটা দখল করে নিয়েছে।

আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠাটা কারন দুইটা। এক, মধ্য এশিয়ার মহা খেলায় গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় হিসাবে চীনের আবির্ভুত হওয়া। দুই, জ্বালানী সম্পদএর প্রাচুর্যের কারনে এবং ভৌগলিক রাজনৈতিক গুরুত্বের দিক দিয়ে বাংলাদেশ ও বঙ্গপোসাগরএর গুরুত্ব বেরে যাওয়া।


চীন মধ্য এশিয় মহাখেলার অপেক্ষাকৃত তরুন খেলোয়াড়। কিন্তু এরি মধ্যে চীন খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ইইউ বারো বছরে যা করতে পারেনাই, চীন মাত্র তিন বছরে তা করে দেখিয়েছে। আগের পর্বেই আলোচনা করেছি মধ্য এশিয়ার জ্বালানী সম্পদ এর নিয়ন্ত্রন দীর্ঘদিন ধরেই রাশিয়ার হাতে। এই নিয়ন্ত্রন হয় পাইপ লাইনএর মাধ্যমে। কাজাকিস্থান, তুর্কমেনিস্থান আর কাস্পিয়ান সাগর থেকে যে পাইপলাইনগুলো তেল ও গ্যাস এর সর্বরাহ করে তার নিয়ন্ত্রন যার হাতে তার হাতেই থাকে এই তেল ও গ্যাসএর নিয়ন্ত্রন। নিয়ন্ত্রনটা একচ্ছত্র রাশিয়ার ছিলো। পাইপলাইনগুলো সব গিয়ে শেষ হয়েছে রাশিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে, আন্তর্জাতিক মার্কেটে মধ্য এশিয়ার গ্যাস এবং তেল উন্মুক্ত হচ্ছেই রাশিয়ার মাটিতে। মধ্য এশিয়ার জ্বালানী সম্পদএ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একমাত্র লিংক হোল আফগানিস্তান। ইসলামিস্ট জঙ্গীদের অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে সহায়তা করে সোভিয়েত ইউনিয়নকে আফগানিস্তানের মাটি ছাড়া করার পর থেকেই আফগানিস্তানের মাধ্যমে মধ্য এশিয়ায় নিজেদের নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তৎপর ছিলো। সেই লক্ষে আফগানিস্তানে সামরিক অভিযান চালানোর আগেই মধ্য এশিয়ার উজবেগিস্তান এবং কিরগিজস্তানে সামরিক ঘাটি স্থাপন করে মধ্য এশিয়ায় নিজেদের সামরিক উপস্থিতি তৈরি করে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু এর মাধ্যমে মধ্য এশিয়ার জ্বালানী সম্পদএর উপর এখনো উল্লেখযোগ্য কোন নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়নি যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি মধ্য এশিয়ার ফ্রন্টিয়ারে পিছু হটার ঘোষনা দিয়েছে। এডিবির মাধ্যমে প্রস্তাব করেছে টাপি পাইপলাইন তৈরি করার। টাপি(তুর্কমেনিস্তান, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ইন্ডিয়া) পাইপলাইনএর একমাথা তুর্কিমিনিস্তানে এবং আরেকমাথা ইন্ডিয়ায়। তারমানে তুর্কমিনিস্তানের জ্বালানি আফগানিস্তান, পাকিস্তান এবং ইন্ডিয়ার মাধ্যমে বিশ্ব বাজারে উন্মুক্ত হবে। এই পাইপলাইনকে বলা হচ্ছে একবিংশ শতকএর সিল্ক রুট। প্রজেক্ট স্পন্সরদের আকৃষ্ট করার জন্যে সম্প্রতি নিউয়র্ক, লন্ডন এবং সিঙ্গাপুরে চার দেশের প্রতিনিধীদের উপস্থিতিতে রোড শো অনুষ্ঠিত হয় এই বছরের গোড়ার দিকে। আফগানিস্তানে এবং পাকিস্তানে মার্কিন নেতৃত্ব শতভাগ প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু ইন্ডিয়ার সাথে বন্ধুত্ব এবং ঐক্য জোরদার করা এই কারনে আমেরিকার জন্যে জরুরি। টাপি পাইপলাইনএ যুক্ত হওয়ার জন্যে ভারতকে ইরানএর সাথে জ্বালানি সম্পর্কের সম্ভাবনা পুরাপুরি ছিন্ন করতে হয়েছে। ইরানকে চাপে রাখাটা টাপি পাইপলাইনএর অন্যতম রাজনৈতিক গুরুত্ব। উল্লেখ্য, সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার টাপি পাইপলাইনএর সাথে যুক্ত হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে।


যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে মধ্য এশিয়ার জ্বালানি সম্পদএর উপর নিয়ন্ত্রনের প্রক্রিয়া অত্যন্ত জটিল হলেও চীনএর জন্যে খুব সরল সোজা। চীনএর রাষ্ট্রায়ত্ত্ব জ্বালানী কোম্পানি সিএনপিসি ২০০৫ সালে কানাডিয়ান কোম্পানি পেট্রোকাজাকিস্তান কিনে নিয়ে মধ্য এশিয়ায় তাদের উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। অবশ্য ১৯৯৭ সালেই কাজাখ সরকারএর সাথে মিলে যৌথ মালিকানাধীন সাইনো-কাজাখ পাইপলাইন তৈরি শুরু করে চীন। এই পাইপলাইনএর
একমাথা কাস্পিয়ান সাগরে আরেক মাথা চীনে। ২০০৫ সালে এই পাইপলাইনের মাধ্যমেই মধ্য এশিয়া থেকে সরাসরি চীনের বুকে জ্বালানী সরবরাহ শুরু হয়। চীনকে মিনমিনে সূরে ভবিষ্যতএর সুপার পাওয়ার বলতে শোনা যাচ্ছিল দীর্ঘদিন ধরেই, সেটা মূলত তাদের অর্থনৈতিক উন্নতিকে গণ্য করে। কিন্তু সাম্প্রতিক মহাখেলাকে কেন্দ্র করে আরেকটা সুপার পাওয়ার হিসাবেই আবির্ভুত হয়েছে চীন, রাশিয়া যেখানে চীনের সামনে খানিকটা ক্ষিয়মান এবং যুক্তরাষ্ট্র যেখানে মধ্য এশিয়ার ফ্রন্টে খুব বেশি সুবিধা করতে পারছেনা। মধ্য এশিয়ার সাথে চীনের সিমান্তবর্তি অঞ্চলগুলোতে নানান বিদ্রোহ দমন করতে গিয়ে সামরিক উপস্থিতি বারানো মধ্য এশিয়ায় চীনএর সামরিক প্রভাব বারানোর তৎপরতার শুরু মাত্র।

চীন একসময় জ্বালানী নিতো শুধুমাত্র মধ্যপ্রাচ্য থেকে। এখন নেয় মধ্য এশিয়া থেকেও, এবং ভবিষ্যতের জন্যে বিকল্প পথ ও সোর্স তারা তৈরি করছে। এতো জ্বালানী চীনএর কেনো দরকার প্রশ্ন উঠতে পারে। উল্লেখ্য, চীন বর্তমানে বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ জ্বালানী আমদানিকারী রাষ্ট্র। এক নম্বরে আছে যুক্তরাষ্ট্র। চীনএর বর্ধিষ্ণু অর্থনীতিতে এই জ্বালানী চাহিদা এতো দ্রুত বারছে যে অদূর ভবিষ্যতে তা যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে যাবে। ২০৩৫ সাল নাগাদ চীনএর জ্বালানী চাহিদা হবে আমেরিকার চেয়ে ৬৮ শতাংস বেশি। চীনকে এই কারনে বিশ্বের সবচেয়ে জ্বালানীভূক (Energy Hungry) রাষ্ট্র বলা হচ্ছে। উদিয়মান জ্বালানীভূক হিসাবে এর পরেই যার নাম আসবে সে হচ্ছে ইন্ডিয়া। ২০৩৫ সাল নাগাদ বিশ্বের ৩১ শতাংস জ্বালানী চাহিদা হবে চীন আর ইন্ডিয়ার। ২০৩৫ সালএর সীমা ধরে এই ভবিষ্যৎবানী করেছে ইআইএ(এনার্জি ইনফর্মেশন এডমিনিস্ট্রেশন)।


মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনএর এই উত্থানকে ঠেকাতে সর্বোচ্চ জোর দিচ্ছে সম্প্রতি। মধ্য এশিয়ার মহাখেলার দক্ষিন এশিয়ায় আগমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চীন বিরোধী তৎপরতার মাধ্যমেই দক্ষিন এশিয়ায় চলে এসেছে। আগে একবার উল্লেখিত টাপি পাইপলাইনএর মাধ্যমে মধ্য এশিয়ার জ্বালানীর সাথে যুক্ত হতে যাচ্ছে পাকিস্তান ও ইন্ডিয়া। ইন্ডিয়ার গুরুত্ব তাই যুক্তরাষ্ট্রের কাছে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এছারাও তার আছে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থ। অবশ্য এইখাত্রে রাজনৈতিক স্বার্থটা ভারতএর জন্যেও খুব গুরুত্বপূর্ণ। সোজাসাপ্টা বলতে গেলে দুই রাষ্ট্রের রাজনৈতিক স্বার্থ চীনএর বিপরীতে সমান্তরালে চলে এসেছে। ইন্ডিয়ার অবস্থান থেকে তার রাজনৈতিক স্বার্থ বিবেচনা করা যাক। জন্মের পর থেকে এই রাষ্ট্রের প্রধান শত্রু পাকিস্তান এবং চীন। ইন্ডিয়ার বিপক্ষে চীনএর সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তুলেছে পাকিস্তান। ভারতএর ঝুকি তখন আরো বেরেছে। পাকিস্তানএর প্রত্যক্ষ সহায়তায় কাস্মিরে বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগ্রাম হয়। নাগাল্যান্ডএ হয়েছে চীনএর সহায়তায়। ইন্ডিয়াকে তাই খুব দ্রুত সামরিকভাবে শক্তিশালী হতে হয়েছে। সেটা হতে গিয়ে দেশের অর্থনীতির ক্ষতি করেছে। বাংলাদেশের আশেপাশের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনগুলো আরো জোড়দার হয়েছে। সেই ক্ষতি সামাল দিতে ইন্ডিয়া আঞ্চলিকভাবে আগ্রাসী রাজনৈতিক এবং মার্কিনপন্থী অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথ বেছে নিয়েছে।

চীনএর বিপক্ষে ইন্ডিয়ার একটা ট্রাম কার্ড আছে। কৌশলগতভাবে চীনএর জ্বালানী পথএর উপর ইন্ডিয়া হুমকিস্বরূপ। চীন মধ্য এশিয়া থেকে জ্বালানী নিচ্ছে অল্পকিছুদিন হয়। কিন্তু প্রথম থেকে এখন পর্যন্ত চীনএর সবচেয়ে বড় জ্বালানীর উৎস হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্য। মধ্যপ্রাচ্যের হরমুজ প্রণালী এবং গালফ অব ইডেন থেকে প্রতিদিন মিলিয়ন মিলিয়ন ব্যারেল জ্বালানী সমুদ্র যাত্রা শুরু করে ভারত মহাসাগরএর দীর্ঘপথ পাড় হয়ে প্রশান্ত মহাসাগর হয়ে চীনে পৌছায়। এই জ্বালানী পথএর মাঝখানে ইন্ডিয়ার দুই দুইটা শক্তিশালী এবং গুরুত্বপূর্ণ নৌ ও বিমানঘাটি আছে। একটা হচ্ছে লক্ষ্ণদ্বীপ দ্বীপপুঞ্জ এবং অপরটি বঙ্গপোসাগরএ অবস্থিত ইন্ডিয়ান উপনিবেশ আন্দামান নিকোবার দ্বীপপুঞ্জ। চীনএর সাথে যুদ্ধাবস্থা তৈরি হলে বা চীনএর পক্ষ থেকে স্থলভাগে কোন হুমকির সম্মুখিন হলে মধ্যপ্রাচ্য থেকে চীনএর জ্বালানী পথ বন্ধ করে দেয়ার ক্ষমতা রাখে ইন্ডিয়া। আর এইখানেই ইন্ডিয়া এবং গোটা দক্ষিন এশিয়ার রাজনৈতিক গুরুত্ব বেরে গেছে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে। মধ্য এশিয়ায় চীনএর উত্থানকে সামাল দিতে দক্ষিন এশিয়ায় অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক আধিপত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করে ক্ষমতার ব্যালান্স করতে চাইছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মধ্য এশিয়ার মহাখেলার ময়দান চীনের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পালটা তৎপরতায় বিস্তার লাভ করেছে দক্ষিন এশিয়ায়।


এইক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বক্তব্য ও অবস্থান পুরাপুরি পরিস্কার। এবছরের জানুয়ারী মাসে পেন্টাগন থেকে “Sustaining Global Leadership: Priorities for Twenty First Century” নামে একটি প্রতিরক্ষা কৌশলপত্র প্রকাশিত হয়। গ্লোবাল লিডার শব্দটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ব্যাবহার করে সম্রাট অর্থে আর গ্লোবাল লিডারশিপ মানে সাম্রাজ্য। একবিংশ শতকে এই গ্লোবাল লিডারশিপ বা সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখতে গেলে যুক্তরাষ্ট্রকে অবশ্যই এশিয়া পেসিফিক অঞ্চলে চীনএর বিপরীতে ক্ষমতার পূনর্বিন্যাস বা ব্যালান্স করতে হবে এইটা হোল কৌশলপত্রের মূল কথা। সেইটা কিভাবে? প্রশান্ত মহাসাগর আর তার সাথে যুক্ত এশিয়া অঞ্চলকে মূলত এশিয়া পেসিফিক অঞ্চল বলা হয়। এই অঞ্চলে মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোটে এক ছাতার নিচে কাজ করে জাপান, দক্ষিন কোরিয়া এবং অস্ট্রেলিয়া। কিন্তু মজার বিষয় হচ্ছে এই কৌশলপত্রে ইন্ডিয়া তথা দক্ষিন এশিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা এবং দক্ষিন এশিয়াকে এশিয়া পেসিফিকএর মার্কিন নেতৃত্বাধীন ছাতার নিচে আনার প্রতি জোড় দেয়া হয়েছে। এইটা সম্ভব হলে রাজনৈতিকভাবে চীন বিশেষ চাপের মুখে থাকবে এবং বিশ্বনেতা বা সম্রাট হিসাবে যুক্তরাষ্ট্র তার অবস্থান টিকিয়ে রাখতে সম্ভব হবে। গত বছরএর নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক এক প্রবন্ধে স্টেট সেক্রেটারি হিলারী ক্লিন্টন এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলকে সংজ্ঞায়িত করেছেন এইভাবে, “ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে শুরু করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম উপকূল পর্যন্ত অঞ্চল”। এবছরএর মে মাসে আরেক গুরুত্বপূর্ণ মার্কিন কূটনীতিক দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী লিও পেনেটা ইন্ডিয়া সফরকালে সরাসরিই ইন্ডিয়াকে যুক্ররাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা কৌশলএর ‘লিঞ্চপিন’ বলে দাবি করেন। চীনএর বিপরীত যুক্তরাষ্ট্র আর ইন্ডিয়ার অবস্থান তাই সমস্বার্থের। যুক্তরাষ্ট্র তাই চেষ্টা করছে ইন্ডিয়ার সাথে শুধু অর্থনৈতিক এবং কৌশলগতই না বরং একটা সামরিক ঐক্য গড়ে তোলার। যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য ইন্ডিয়ায় এমন একটা সেনাবাহিনী গড়ে তোলা যা এই অঞ্চলে মার্কিন সেনাবাহিনীর সাথে যৌথ স্বার্থে একযোগে সামরিক অভিযান চালাতে সক্ষম। সেই লক্ষে ২০০৫ সালেই ইন্ডিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মা্ঝে প্রথমবারের মতো একটি চুক্তি সাক্ষরিত হয়, যে চুক্তিতে দুই রাষ্ট্রের ‘যৌথ জাতীয় স্বার্থ’কে প্রাধান্য দেয়ার ঘোষনা করা হয়। যুক্তরাষ্ট্র ইন্ডিয়াকে পরমানু শক্তিধর রাষ্ট্র হিসাবে স্বিকৃতী দেয়ার পর ২০০৭ সালে দুই দেশের মাঝে একের পর এক প্রতিরক্ষা চুক্তি সাক্ষরিত হয়। দুই দেশের মাঝে প্রস্তাবিত বহু চুক্তি এখন পর্যন্ত ইন্ডিয়ার পক্ষ থেকে বিলম্বের কারনে বাস্তবায়িত না হলেও গত পাঁচ বছরে ইন্ডিয়ার কাছে ৮ বিলিয়ন ডলারএর যুদ্ধাস্ত্র বিক্রি করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। গত সাত বছরে ইন্ডিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র অংশ গ্রহন করেছে ৫০টির বেশি যৌথ সামরিক অভিযানে। এসব যৌথ অভিযানএর বেশিরভাগই দুই দেশের নৌ বাহিনীর মাঝে সীমাবদ্ধ।


চীন এই পরিস্থিতির মোকাবেলা করছে কিভাবে? চীন যেভাবে মোকাবেলা করছে তাতেই বাংলাদেশের ভৌগলিক গুরুত্ব বেরে গেছে এই মহাখেলায়। অবশ্য বাংলাদেশের নিজস্ব জ্বালানী সম্পদ এবং বঙ্গপোসাগরএ সাম্প্রতিক সময়ে মায়ানমারএর সাথে সমুদ্রসীমা বিজয়ও এর জন্যে দায়ি। প্রশান্ত মহাসাগর আর ভারত মহাসাগরএর সংযোগস্থল হলো দক্ষিন চীন সাগর। এই অঞ্চলের দেশগুলোর মাঝে সমুদ্রসীমা এখন পর্যন্ত সূনির্দীষ্ট না। দক্ষিন চীন সাগরএর বড় অংশের দাবিদার চীন। এই দক্ষিন চীন সাগরকে চীন গন্য করছে তাদের জ্বালানী ক্ষুধা মেটাবার আরেক বিকল্প উৎস হিসাবে। এই সাগর যেমন গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক মাছএর উৎস তেমনি এর তলদেশে ২০ থেকে ৩০ বিলিয়ন ব্যারেল তেল পাওয়া যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। এই অঞ্চলের সমুদ্রসীমা বিষয়ক বিরোধ মেটানোর লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন দেশগুলো কূটনৈতিক তৎপরতা চালাচ্ছে চীনএর বিপরীতে অন্যান্য রাষ্ট্রগুলোকে এই অঞ্চলের সমুদ্রসীমার ভাগিদার হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে। এই হুমকি সামাল দিতে চীন এরিমাঝে দক্ষীন চীন সাগরে শক্তিশালী নৌ বহর গড়ে তুলেছে। কিন্তু দক্ষীন চীন সাগরএর জ্বালানী উত্তলন অনেক পরের বিষয়। তারও আগে বিকল্প জ্বালানীর উৎস এবং বিকল্প জ্বালানী পথ হিসাবে বঙ্গপোসাগর হয়ে উঠেছে চীনএর কাছে গুরুত্বপূর্ণ। বঙ্গপোসাগরএ মায়ানমারএর সমুদ্রসীমায় অবস্থিত স্যু গ্যাস ফিল্ড থেকে গ্যাস কেনার চুক্তি করে চীন মায়ানমারের সাথে ২০০৮ সালে। একি বছর চীন ও মায়ানমার আরকান প্রদেশএর কিউকফ্যু নামক বন্দর থেকে চীনএর ইউনান প্রোদেশএর কুনমিং পর্যন্ত একটি পাইপলাইন তৈরির স্বিদ্ধান্ত নেয়। ৭৭১ কিলোমিটার লম্বা এই পাইপলাইনএর শুরু বঙ্গপোসাগরএ এবং মায়ানমারএর বুকের উপর দিয়ে গিয়ে এর শেষ খোদ চীনা ভুখন্ডে। পরবর্তিতে ২০০৯ সালের মার্চ মাসে চীন ও মায়ানমারএর মধ্যে একটি গ্যাসএর পাইপলাইন এবং একিবছর অক্টোবর মাসে একটি তেলএর পাইপলাইন তৈরির চুক্তি সাক্ষরিত হয়। বর্তমানে সাইনো-বার্মান পাইপলাইন বলে পরিচিত এই দুই পাইপলাইন তৈরির কাজ চলছে এবং ২০১৩ সাল নাগাদ শেষ হওয়ার কথা। এই পাইপলাইন চালু হলে তা হবে চীনএর জন্যে একটা বিজয়। বঙ্গপোসাগর জ্বালানীর গুরুত্বপূর্ণ উৎস। স্যু গ্যাসফিল্ড শুরু মাত্র। এখনো বঙ্গপোসাগরএর বড় অংশেই অনুসন্ধান সম্পন্ন হয়নাই। বেশ কিছু গ্যাস ব্লক পাওয়া গেছে, তেল পাওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে। সাইনো-বার্মান পাইপলাইনের মাধ্যমে শুধু বঙ্গপোসাগরএর জ্বালানী সম্পদএ চীনএর নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠার বড় ধরণের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে তাই না, তেলএর পাইপলাইনএর কারনে মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকা থেকে চীনএ জ্বালানী পৌছানোর সময় এবং অর্থ এই দুইএরই ব্যাপক সংকুলান হবে। আগেই বলেছ, চীনকে এখন মধ্যপ্রাচ্য থেকে ভারত সাগর হয়ে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের পরে মালাগা প্রনালী পার হয়ে দক্ষিন চীন সাগরএর মধ্য দিয়ে প্রশান্ত মহাসাগরে ঢুকতে হয়, তারপরেই জ্বালানী চীনের স্থলভাগে পৌছাতে পারে। কিন্তু এই পাইপলাইন চালু হলে বঙ্গপোসাগর পর্যন্তই হবে চীনা জ্বালানী বহনকারী জাহাজগুলার যাত্রা। বঙ্গপোসাগর থেকে পাইপলাইনে তেল চলে যাবে সরাসরি চীনে। ফলে সময় বাচবে, অর্থ সংকুলান হবে, আবার মালাগা প্রণালী পাড় হতে না হওয়ায় আন্দামান নিকোবার দ্বীপপুঞ্জে অবস্থিত ইন্ডিয়ার সামরিক ঘাটি তার পথরোধ করতেও পারবেনা। আবার এই পাইপলাইনএর নিরাপত্ত্বার খাতিরে মায়ানমার ও বঙ্গপোসাগরএ সামরিক উপস্থিতি তৈরি করার অযুহাত পাবে চীন। সবমিলিয়ে এই একটা পাইপলাইন মার্কিন-ভারত উইংএর তৎপরতার বিরুদ্ধে চীনএর অবস্থানটা অনেক শক্তিশালী করে তুলবে।


বাংলাদেশের জন্যে পরিস্থিতি আরো পালটে গেছে সাম্প্রতিক সমুদ্র বিজয়এর পরে। বঙ্গপোসাগরএর একটা বড় অংশের উপর মায়ানমারএর বদলে বাংলাদেশের ন্যাজ্যতা তৈরি হয়েছে। এইসব অঞ্চলের জ্বালানী সম্পদএর ব্লকগুলোর দিকেও তাই আছে চীনএর নজর। বাংলাদশের ভুখন্ডে প্রতিযোগীতায় অবশ্য এখন পর্যন্ত এগিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। চট্টগ্রাম বন্দরএ নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা, বঙ্গপোসাগরএর জ্বালানি সম্পদএর উপর নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠা এবং কৌশলগত কারনে বঙ্গপোসাগরএ সামরিক উপস্থিতির ধান্ধা এই মুহুর্তে মার্কিন এবং চীন এই দুই পরাশক্তিরই। এইটা এখন আর শ্রেফ ভারতিয় উপমহাদেশ বিষয়ে এই দুই পরাশক্তির রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক লড়াইএর ময়দান না, বরং একবিংশ শতকের গ্লোবাল লিডার বা সম্রাট হয়ে ওঠার ফ্রন্টিয়ার।
মায়ানমারএর আরকান রাজ্যে সাম্র্রদায়িক সহিংসতা থেকে শুরু করে রামুর বৌদ্ধ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়এর উপর সাম্প্রতিক হামলা, তার সূত্র ধরে
মায়ানমার ও শ্রীলঙ্কায় সাম্প্রদায়িক সম্পৃতি হুমকির মুখে পরা, ইসলামিস্টদের চাপে ইউটিউব বন্ধ করা এবং সবশেষে বাংলাদেশী তরুনকে নিউয়র্কের ফেডারেল ভবন উড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনার অভিযোগে গ্রেফতার করাসহ যেসব ঘটনা প্রবাহের মধ্য দিয়া আমরা যাচ্ছি তার সাথে এই আন্তর্জাতিক মহাখেলার আদৌ কোন সম্পর্ক থাকার সম্ভাবনা আছে কিনা, থাকলে সেই সম্ভাবনা কতোটুকু এবং তার ভবিষ্যত গতি প্রকৃতি কেমন হতে পারে তা নিয়া আমরা পরবর্তি পর্বে আলোচনা করবো। সেই আলোচনায় বাংলাদেশকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ইন্ডিয়া, রাশিয়া ইত্যাদি রাষ্ট্রের কূটনৈতিক তৎপরতাকে বিশ্লেষন করা হবে।

(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে অক্টোবর, ২০১২ রাত ১২:০৯
৩৮টি মন্তব্য ২১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমরা কেন এমন হলাম না!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৪ ই মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪১


জাপানের আইচি প্রদেশের নাগোইয়া শহর থেকে ফিরছি৷ গন্তব্য হোক্কাইদো প্রদেশের সাপ্পোরো৷ সাপ্পোরো থেকেই নাগোইয়া এসেছিলাম৷ দুইটা কারণে নাগোইয়া ভালো লেগেছিল৷ সাপ্পোরোতে তখন বিশ ফুটের বেশি পুরু বরফের ম্তুপ৷ পৃথিবীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অভিমানের দেয়াল

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ১৪ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:২৪




অভিমানের পাহাড় জমেছে তোমার বুকে, বলোনিতো আগে
হাসিমুখ দিয়ে যতনে লুকিয়ে রেখেছো সব বিষাদ, বুঝিনি তা
একবার যদি জানতাম তোমার অন্তরটাকে ভুল দূর হতো চোখের পলকে
দিলেনা সুযোগ, জ্বলে পুড়ে বুক, জড়িয়ে ধরেছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি

লিখেছেন প্রামানিক, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১



২৬শে মার্চের পরে গাইবান্ধা কলেজ মাঠে মুক্তিযুদ্ধের উপর ট্রেনিং শুরু হয়। আমার বড় ভাই তখন ওই কলেজের বিএসসি সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র ছিলেন। কলেজে থাকা অবস্থায় তিনি রোভার স্কাউটে নাম... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিকেল বেলা লাস ভেগাস – ছবি ব্লগ ১

লিখেছেন শোভন শামস, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৪৫


তিনটার সময় হোটেল সার্কাস সার্কাসের রিসিপশনে আসলাম, ১৬ তালায় আমাদের হোটেল রুম। বিকেলে গাড়িতে করে শহর দেখতে রওয়ানা হলাম, এম জি এম হোটেলের পার্কিং এ গাড়ি রেখে হেঁটে শহরটা ঘুরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

One lost eye will open thousands of Muslims' blind eyes

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ২:২৭



শিরোনাম'টি একজনের কমেন্ট থেকে ধার করা। Mar Mari Emmanuel যিনি অস্ট্রেলীয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের একটি চার্চের একজন যাজক; খুবই নিরীহ এবং গোবেচারা টাইপের বয়স্ক এই লোকটি যে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×