ইসলামের একটা মজার জিনিস হচ্ছে যে ইসলাম আল্লাহ আর মানুষের মাঝখানে কোন পুরোতের দরকার মনে করেনাই, কিন্তু এই ধর্মে একটা খুবি শক্তিশালী পুরোততন্ত্র ও পুরোতশ্রেণী গড়ে উঠেছে। ইসলামে ইমামের যে কনসেপ্ট সেটা কোন পুরোত শ্রেণীর কনসেপ্ট না। ইমাম একজন সামাজিক ও রাজনৈতিক নেতা। নেতৃত্বের দায়িত্ব হিসাবে তিনি সামাজিক নামাজেও নেতৃত্ব দেন। যে কেউ মুসলমান হতে পারে, এইক্ষেত্রে কোন জাত গোত্রের বাছবিছার নাই। যে কেউ চাইলে সরাসরি আল্লাহর ইবাদত করতে পারেন, তার কিতাব পড়তে পারেন, মাঝখানে কোন পুরোতের দরকার নাই। মুসার ঐতিহ্য নিয়া পাতার পর পাতা কিতাব লিখে ইহুদি পুরোততন্ত্র গড়ে উঠেছিলো। এই পুরোততন্ত্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেই ঈসা ধর্ম প্রচার করেছেন। তবে তার অনুসারীরা চার্চ নামক পুরোততন্ত্রকে মানুষ এবং আল্লাহের মাঝখানে স্থাপন করেছে, ঈসার সাথে নিজেদের সম্পর্কের দাবিতে। মধ্যযুগীয় ইউরোপে এরা এমনকি টাকার বিনিময়ে মরা মানুষকে দোয়া করার বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে পরিণত করেছে চার্চকে। মোহাম্মদ এইরকম কোন পুরোতশ্রেণী তৈরি করতে চান নাই এটা পরিস্কার। পাদ্রী চান নাই, ব্রাহ্মনের তো প্রশ্নই ওঠেনা। এটা তিনি নিজে দাবি করেছেন। কোরানে স্পষ্টভাবে অর্থের বিনিময়ে পুরোতগিরীর প্রতি নিষেধাজ্ঞা আছে। মোহাম্মদ নিজের মৃত্যুর সময় নিজের জায়গায় কাউরে নির্বাচিত করেন নাই। কি পদ্ধতিতে নেতা নির্বাচন করতে হবে তাও বলে দিয়ে যান নাই। আইনের কোন বই লিখে দিয়ে যান নাই। আইনের বইগুলো লেখা হয়েছে পরে। এগুলো লিখতে লিখতে ইসলামী পুরোতশ্রেণী তৈরি হয়েছে। আবু বকর এবং ওমরের খেলাফত ছিলো একরকম, ওসমানের আরেক রকম, আলীর আবার খুবি ভিন্ন রকম। এই ভিন্নতায় যুদ্ধ হয়েছে, রক্ত হয়েছে। এখনকার মুসলমানদের কাছে গড়পরতা ইসলাম যেমন একটা পুরো দোস্তুর প্যাকেজ আইটেম, তখনকার সময়ে সেটা ছিলনা, ইসলাম ছিলো বিভিন্ন জনের বিভিন্ন রকম দৃষ্টিভঙ্গী, আইন ও রাজ্য শাষন নিয়ে যেখানে আলাদা আলাদা মতামত আছে, কিন্তু একটা জায়গায় মোটামুটি এক যে মানুষ আর আল্লাহর মাঝে কোন দালালের দরকার নাই। খেলাফত নিয়া আলী আর মুয়াবিয়ার বিরোধীতা যখন তুঙ্গে তখন এই 'খেলাফত' জিনিসটা দালালীতে পরিণত হচ্ছে অভিযোগ তুলে খারিজীরা নিজেদের আলাদা করেছে। উমাইয়ারা ক্ষমতা গ্রহণের পরে নিজেদেরকে সরাসরি আল্লাহর সাথে যুক্ত বলে গন্য করেছে, এবং ইসলাম, কোরান সবকিছুকে নিজের মতো সাজিয়ে এবং বানিয়ে নিয়েছে। সেই সুবাদে কারো উপর অত্যাচার করলেও দাবি করেছে, আল্লাহর আদেশ ছাড়া গাছের পাতাও নড়েনা, আমরা নিজেরা কিছু করিনা, যা কিছু আল্লাহ করান আমরা তাই করি। আল্লাহর এই থিওরিটা কাদরিয়াদের পছন্দ হলোনা, তারা দেখলো যে এতে আল্লাহর নামে অন্যায় বৃদ্ধি পাবে। তাই তারা আল্লাহকে ন্যায়বান দাবি করলেন, দাবি করলেন মানুষের স্বাধীন ইছা শক্তি আছে। একারনে উমাইয়াদের হাতে মরলেন, মরতে মরতে বিদ্রোহ করলেন। কাদরিয়াদের বিবর্তনে মুতাজিলারা আসলো। তাদের বিদ্রোহের সমান্তরালে হলো আব্বাসিয় খেলাফতের উত্থান। আব্বাসিয়রা আল্লাহকে নিজেদের মতো করে বুঝলেন। মুতাজিলারা যেভাবে আল্লাহ এবং ইসলামের সুন্দর সুন্দর যুক্তিবাদী ব্যাখ্যা দিলেন, সেগুলার মাধ্যমে অন্য ধর্মের ধর্মতাত্বিকদের বিতর্কে হাড়ালেন সেসব যুক্তি দিয়া আব্বাসিয়রা ইসলামকে বুঝতো। সেটা ছিলো ইসলামে ধর্মতাত্ত্বিকদের যুগ, তার সূত্র ধরে ইসলামী দর্শনের যুগ, জ্ঞান বিজ্ঞান সংস্কৃতিতে সেটা ছিলো আরবদের স্বর্ণযুগ। ইসলামী পুরোততন্ত্রের যুগ আরো পরে এসেছে। আসার সময় একে ইসলামী ধর্মতত্ত্ব এবং ইসলামী দর্শনের সাথে লড়াই করে জিততে হয়েছে। আশারিকে এসে খলিফার দরবারে নিজের জামা ছিড়তে হয়েছে, আর বলতে হয়েছে লজিকের মায়রে বাপ, ইসলাম বিষয়ে লজিকরে আমি এই জামার মতো টুকরা টুকরা কইরা ছিড়া ফালাইলাম। নবী আমারে স্বপ্নে দেখা দিছেন, মুতাযিলাদের একটা হ্যাস্তন্যাস্ত করতে তিনি আমারে নির্দেশ দিয়া গেছেন। আরো পরে হাম্বলিকে এসে বলতে হয়েছে ইসলামী আইনে যুক্তি তর্কের বালাই থাকা চলবেনা। অমুকের বর্ননায় তমুকের সূত্র ধরে অমুক বলেছে নবী একদা এমন বলেছিলেন এইটাকেই ইসলামী আইনের একমাত্র সূত্র মানতে হবে, বাকি সব বাতিল। এই হাম্বলিবাদ মাথায় করে ইসলামী পুরুততন্ত্রের উত্থান। এই পুরোতশ্রেনী ব্রাহ্মনদের স্লোক মুখস্ত করার মতো হাদিসের ইসনাদ মুখস্ত করে আর বিষয়বস্তুর বদলে ধারাভাষ্যের চেইন যাচাই করে হাদিসের সত্যাসত্য যাচাই করে। এদের হাতে ইসলামী ধর্মতত্ত্ব, দর্শন এবং আইনশাস্ত্রের মৃত্যু হয়েছে। অবশ্য এদের নিজেদের মধ্যেও বিরোধ কম ছিলনা। সেই বিরোধ সিকেয় তুলে যাতে তারা শান্তিতে পুরোতগিড়ি করতে পারেন সেই বৈধতা দিয়ে গেছেন সুলতান বাবের। এই পুরৎতন্ত্র টিকিয়ে রাখতে এরা হাদিস বানিয়েছে, হাদিসের বই বানিয়েছে, হাদিসের ব্যাখ্যা বানিয়েছে, তাবিজ কবজের বই বানিয়েছে। এবং সেসব হাদিসে নিজেদের বৈধতাও আদাই করে নিয়েছে। এই ধারাবাহিকতা হাম্বলি থেকে সালাফি, সালাফি থেকে ওয়াহাবী পর্যন্ত জারি আছে। বাঙলায় ইসলাম এসেছিলো সুফিদের হাত ধরে। সুফিবাদের উথান ইসলামি পুরোততন্ত্রের উত্থানের পরের ঘটনা, কিন্তু ইসলামী পুরোততন্ত্রের শক্তিশালী প্রতিপক্ষ হিসাবে এর বিকাশ হয়েছে। আর সুফিবাদের জণপ্রিয়তা বেশি হয়েছে মূল আরব ভুখন্ডের বাইরে। বাঙলা এক্ষেত্রে অবশ্যই বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বাঙলায় ব্রাহ্মন্যবাদনির্ভর শ্রেণীভেদ প্রথার বিরুদ্ধে সব মানুষকে এক আল্লাহর সামনে সমান হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার বাসনায় ইসলাম জণপ্রিয় হয়েছে, ইশ্বর আর মানুষের মাঝে পুরোততন্ত্র বিনাশ করা এর অন্যতম লক্ষ্য ছিলো। সেটা এখন খাদেমতন্ত্র হয়ে গেছে। ব্রিটিশ আমল থেকে বাঙলায় ইসলামী পুরোততন্ত্র শক্তিশালী হতে হতে এখন ইসলামী পুরোততান্ত্রিক রাজনৈতিক দল হয়েছে অনেক। এমনকি সেকুলার, গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলাও প্রায়ই পুরোততন্ত্রের জয়গান গেয়ে ভোট আদায় করে নিতে চায়। এদের ক্লিন শেভড অথবা মেকাপ সর্বস্ব নেতা নেত্রিরাও পুরোতগিরির প্রতিযোগিতায় নামেন দাড়ি টুপিওয়ালা পুরোতদের সাথে।
এই পুরোততন্ত্রে থেকে না বের হওয়া পর্যন্ত বাঙালি মুসলমানের আগানো কষ্টকর হবে।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই জানুয়ারি, ২০১৩ সকাল ১০:২৬

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



