অবদমিত মনের ইচ্ছেগুলোকে একপাশে সরিয়ে রাখতে রাখতে জীবন কখনো কখনো এমন পর্যায়ে উপনীত হয়। যেখান থেকে সামনে এগোনোর রাস্তা বার করা বেশ কঠিন হয়ে পড়ে।
সমাজের অবদমন, পরিবারের অবদমন, অর্থনীতিক অবদমন, শারীরিক অবদমন, মানসিক অবদমন। অবদমন আছে অনেক রকমের। তবে সবগুলোর শেষ ঠিকানা মাথার ভেতরের প্রকোষ্ঠে অবিরত ডানা ঝাপটানো। আর তাতে তিক্ত হয় সময়। তিক্ত হয় জীবন। বিষাক্ত হয়ে ওঠে প্রিয় সব মূহুর্তগুলো।
অবদমিত মন নিয়ে চলতে গিয়ে ভুল হয় নিয়মিত। ছোটো ছোটো ভুলের মাশুল হয়ত খুব একটা গুণতে হয় না। তবে বড়োগুলো কখনো ছেড়ে কথা বলে না। ঘাড়ের ওপর সিনবাদে ভূতের মত দীর্ঘকাল সওয়ার হয়ে থাকে। কখনো কখনো সেটা পুরো একটা জীবন বয়ে বেড়াতে হয়।
অবদমিত মন কে চাইলেই ছুঁড়ে ফেলা যায় না। লগ আউট বা সুইচ অফ করে রিস্টার্ট দেয়া যায় না। হৃদপিন্ডের সাথে রক্তের যেরকম সম্বন্ধ এর বেলায় ঠিক সেরকমটাই হয়। কেউ কাউকে ছাড়ে না। ছাড়বার সুযোগটাই তো থাকে না।
এই অবদমনের সবচেয়ে ভয়ংকর দিক হলো অনেকে জানেই না এটা কী। অনেকে আবার বোঝে না এটা তার মধ্যে আছে কি নেই। অনেকের আবার এ নিয়ে মাথা ব্যাথা নেই কিন্তু জীবনের টিকটিক করে চলা ঘড়িটাতে মাঝে মাঝে ঠিক ঠিক করেই সে তার নিজের ডানা মেলে জানান দেয়- ‘আছি রে পাগলা, আমি তোর মাঝেও আছি’।
অথচ আমরা এই অবদমিত মনের তাড়নায় কতসব কেচ্ছা কাহিনী করে বেড়াচ্ছি দরজার এপাশ থেকে ওপাশ অব্দি। সে খোঁজ রাখার কোনো তাগিদ অনুভব করছি না।
যে ছেলেটা এক ডজন মেয়ের সাথে প্রেম করে বেড়াচ্ছে। তার পূর্ব পূরুষের সকলকেই নাঙ্গা মুখে উদ্ধার করছি। কিন্তু, একটিবার জানতেও চাইছি না, ছেলেটার মনে কোনো জ্বালা আছে কি না। সে কি কারো প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে প্রতিশোধের পথ বেছে নিয়েছে নিজের মত করে।
যে পুরুষটা অন্য মেয়ের সাথে রোজ রাতে শোয়। অথচ ঘরে সুন্দরী স্ত্রী আছে। জানছি না লোকটার শারীরিক সমস্যার কারণে সুন্দরী স্ত্রীটি প্রতি রাতেই নাক সিঁটকোয়।
মেয়েটা এলোমেলো কাপড় পরে ঘুরে বেড়ায়। একে ওকে খিস্তি করে। রাতের বেলা ফেরে না ঘরে। চোখদুটো হররোজ ঘোলাটে থাকে। অস্ফুটে তাকে বেশ্যা বলে গালি দিয়ে ফেলছি। অথচ ঐ মেয়েটার ঘর ছিলো। টেবিলের সফেদ চাদরের ওপর ঘন সবুজ রঙের ফুলদানিতে ছিলো লাল টুকটুকে ফুল। ছোট্ট ভাইটির সাথে সারাদিন হৈ হল্লা করে কাটত। অমাবস্যার রাতে কোনো নিকৃষ্ট অসুরের দ্বারা ওর জীবনে নেমে এসেছে অমানিশার অন্ধকার। সে আজ ক্ষোভের আগুনে জ্বলছে।
মেয়েটা ঈশ্বরের বিষেদ্গার করে অজস্র কবিতা লেখে, নালিশ করে অজস্রবার। প্রশ্ন করে বারবার- ‘সেদিন ছিলো কোথায় তোমাদের ঈশ্বর, যেদিন ভরদুপুরে আমার স্বামী-শশুর-শাশুড়ি-দেবরকে বেঁধে রেখে আমার ওপর চালিয়েছে পাশবিক নির্যাতন। তোমাদের সমাজ আমাকে বার করে দিয়েছে। আমি নাকি অস্পৃশ্য, পতিত’। কোনোদিন ঐ মেয়েটার কাছে জানতেও চাইনি, ভগ্নি কিসের এত বিরাগ তোমার। সে এখন কলম তুলে নিয়েছে। লড়ছে কলমে বানানো তলোয়ার নিয়ে।
অবদমনের এরকম অসংখ্য রূপ আছে। প্রকাশ্য এবং গোপন। কেউ নিজের গল্প নিজের ভেতর রেখে দেয়, আর নিজের মত করে আগামির গল্প সাজায়, শোধের মঞ্চে জল্লাদ সাজে, বিচারক সেজে সব ক’টা পশুকে মৃত্যুদন্ড দেয়।
কেউ পুরো দুনিয়াকে দেখায়, দেখো, এতকিছুর পরেও আমি পরাজিত হইনি। আমি বীরাঙ্গনা। এবার এসেছে সময় আমার, এবার আমি সব অসুরের রক্তে স্নান করে পবিত্র করে যাবো এই বধ্যভূমি। এই বেলা বিজয়ের মঞ্চ শুধু আমার। ওইসব বিকৃত মনের পশুবৃত্তির কুরবানি হবে উন্মুক্ত প্রান্তরে।
এভাবে কেউ আগলে রাখে নিজের ভেতর নিজেকে। কেউ হয়ে ওঠে বিদ্রোহী। অবদমিত মনের দ্রোহের প্রকাশ একেকজন একেকভাবে করে।
দিনশেষে সময় তাদের সবাইকে মনে রাখে না। সময় অনেক কিছুর ইতিহাস ঠিকমত তুলে ধরে না। তাই সহস্র বছর পরেও ‘দ্য জাভু’ হয়। আবার কোনো সুপ্ত অগ্নিগিরির লাভা ছড়ায়। পৃথিবীর বুকে জ্বলে ওঠে দ্রোহের আগুন। বেজে ওঠে ক্ষোভের রণ সঙ্গীত।