মুক্তিযুদ্ধে আস্তিকদের অবদান নিয়া অনেকেই উল্লোসিত। কারণ সেই সময়ে কোন নাস্তিকের অবদান তারা দেখেন নি। যদিও এ দেশের স্বাধীকার আন্দোলনে ধর্মের ভুমিকা মোটেই অনুকুল ছিল না। বরং ধর্মের দোহাই দিয়েই শকুনের চেয়েও অধম একদল নরপশু অপকর্ম করে দিয়েছে। এ দেশের মানুষ ধর্মমত নির্বিশেষে নিজেদের অধীকার রক্ষায় কাধে কাধ মিলিয়ে লড়াই করে দিয়েছে। যুদ্ধে হয়ত কোন ধর্মপ্রাণ নামাজ আদায় করছে, তার পাশেই সহযোদ্ধারা নানান বাদ্য বাজিয়ে উৎসাহমুলক গান গেয়ে চলেছে। সেখানে ধর্মের চেয়ে অধীকার রক্ষাই ছিল মুল লক্ষ্য।
আমার জন্ম স্বাধীনতার প্রায় ১০ পনেরো বছর পর (সঠিক সময়টা উল্লেখ করতে চাচ্ছি না)। সুতরাং সেই সময়ে কোন অবদান রাখতে পারার কথাই না। হ্যা তবে আমি ছয় সাত বছর মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে অবদান রেখেছি একজন ধার্মিক মুসলিম হিসেবে। জানেন তো একজন শিবির সাথী হতে হলে ৩ মাস কোন নামাজ কাযা থাকা যাবে না, কুরান হাদিস পাঠ করতে হবে। সদস্য প্রার্থী হলে ছয় মাস নামাজ কাযা করা যাবে না। এমন একটি আল্লা ওয়ালা দলের বিরুদ্ধে রয়েছে স্বাধীনতার সময়ে অন্যায় কর্মের অভিযোগ। আর এ অভিযোগ থেকে নিজেদের ডিফেন্ড করতে আমরা নানান কুযুক্তির আশ্রয় নিতাম।
আমার মনে আছে, একবার আল ফালাহ এ শিক্ষা শিবিরের আয়োজন করা হয়, দুদিন ব্যপি এ শিক্ষা শিবিরের সর্বশেষ আকর্ষণ ছিল গোলাম আযম। প্রোগ্রামে প্রশ্নত্তর পর্বের পুর্বে প্রশ্নের জন্যে যখন কাগজ দেয়া হয়, তখন দায়িত্বশীলরা আমাদের কানে কানে বলে যান যে কোন বিব্রতকর প্রশ্ন যেন না করি। যদিও প্রশ্ন লিখার পর সেগুলো জমা নিয়ে নির্বাচিত প্রশ্নই তাকে করা হবে, তবুও যখন সম্পুরক প্রশ্ন করার সুযোগ পাওয়া যাবে, তখন যেন কেউ তাকে বিব্রতকর প্রশ্ন না করে, সেই জন্যে এই সতর্কীকরণ। সেদিন তাকে প্রশ্ন করার আমার সুযোগ হয়নি, তবে দু’ একজন তাকে স্বাধীনতার সময়কার ভুমিকা নিয়ে প্রশ্ন করলে দায়িত্বশীলরা মুখে আঙ্গুল দেখিয়ে চুপ করতে বলেছিলেন।
সেদিন গো আযম আমাদের মগজ ধোলাই করেছিলেন এই বলে যে, দেশের স্বাধীনতা থেকে ইসলামী আন্দোলন অনেক বড়, দুনিয়াবী লোভ লালসা ইত্যাদি মানুষকে শয়তানের পথে নিয়ে যায়, দেশের প্রতি ভাল বাসা, পরিবারের প্রতি ভালবাসা ইত্যাদির দরকার আছে, তবে এসকল বিষয় যখন দ্বীনের চেয়ে বড় হয়ে যায়, তখন তা অবশ্যই পরিত্যাজ্য। একাত্তরুরের “গন্ডোগোলে” দেশের চেয়ে দ্বীনের প্রয়োজন আমাদের কাছে বড় ছিল, ইসলামী মুলক থেকে এ দেশ আলাদা হলে তা ভাই এর থেকে ভাই এর আলাদা হবার শামিল। এই অবস্থায় মালাউন (সে ভারত বলেছিল) শক্তি আমাদের দ্বীনের কর্মকান্ডকে পিছিয়ে দিবে এমন ধারণাই আমাদের ছিল এবং তা সত্য হয়েছে। তবে সকল ষড়যন্ত্র ছিন্ন করে আমি এ দেশের নাগরিকত্ব পেয়েছি, এবং আমাদের দল কাজ করে যাচ্ছে। জামাত চারটি সমাজে কাজ করে, ছাত্র সমাজ সেদিক থেকে সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ। তাই তোমাদেরকে অপপ্রচারের বিপরীতে দাঁড়িয়ে দ্বীনের রজ্জু আকরে ধরতে হবে। কারণ আমাদের সকলেরই লক্ষ্য পরকালীন মুক্তি।
তারপর থেকে এ ধোলাই ওয়ালা মগজ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে কাজ করে গিয়েছি। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের নেতাদের কাছে গন্ডগোল ছাড়া আর কিছুই না। আমাদের এলাকার আরেক জামাতী নেতা যিনি আব্বুরে রুকন বানানোর প্রানপণ চেষ্টা করে চলেছেন, তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম কেন মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল? সে ভ্রু কুচকে কিছুক্ষন আমাকে দেখে বলল, বাংলাদেশ ছিল সতী নারী, সতী নারীর দোয়া কবুল হয়, তাই পাকিস্তান আর পুর্ব পাকিস্তান মিলে যখন উন্নতি করতে লাগল, তখন ভারতের তা সহ্য হল না, তাই তারা বন্ধু সেজে এদেশের সতীত্ব নষ্ট করল। আজকে বাংলাদেশ পাকিস্তানের সাথে থাকলে কত উন্নত হত!
তখনও আমার মাথা পরিস্কার হয়নি, আমার বন্ধুরা জামাত-শিবিরকে নানাভাবে আঘাতের চেষ্টা করত মুক্তিযুদ্ধের তাদের ভুমিকা নিয়ে। আমি তাদেরকে বলতাম, দেখ, পার্বত্য চট্ট্রগ্রাম যদি স্বাধীন হতে চায়, তাহলে তুমি কার পক্ষে থাকবা? সে উত্তর দিত দেশের পক্ষে, তখন আমি বলতাম তাহলে তুমি পার্বত্য চট্ট্রগ্রামবাসীর কাছে রাজাকার। তাই না? জামাতিরাও তাই। তারপর তারা সেই সময়ে অন্যায় কর্মকান্ডের কথা বললে আমি বলতাম যে যারা বিদ্রোহী এবং বিদ্রোহের আশ্রয়দাতা ছিল, তারা সকলেই অপরাধী, অতএব সরকার বা সরকার অনুমোদিত সংস্থা বিদ্রোহ দমনে পদক্ষেপ নিলে কিছু ভুলত্রুটি হতে পারে!
এভাবেই আমি আচ্ছন্ন ছিলাম, ধর্ম রাজ্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে, ন্যায় ভিত্তিক শোষণ মুক্ত সমাজের স্বপ্ন আমি ইসলামের মধ্য দিয়ে দেখেছিলাম। আমার সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথ ভেবেছিলাম স্বাধীনতা বিরোধী এ শক্তিকে, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে এদের মুখোশ আমার সামনে পরিস্কার হয়ে পড়ে, আমি বুঝতে পারি এরা মানুষের সেবা করে না, করে নিজের সেবা। এরা মোটেও পরার্থবাদী নয়, বরং চরম স্বার্থবাদী, এরা ক্রিমিনাল। ধর্ম এদের হাতিয়ার।
বটম লাইন… "Religion is an insult to human dignity. Without it, you'd have good people doing good things and evil people doing evil things. For a good person to do evil, it takes religion." - Stephen Weinberg (sc)
এরকম একটা এলমেল লেখায় এত দামী উক্তি না দেয়ায় ভাল ছিল। যাহোক, এসব এখন ঘটে চলেছে।