১.
আমার একটা পার্ট টাইম বন্ধু আছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। পার্ট টাইম বন্ধু ...কারণ আমরা দুজনেই দুজনকে খুঁজি যখন আশেপাশে আর কারো খোঁজ পাওয়া যায় না তখন। যেমন কোনও একটা কাজে যাব ...সাথে কাউকে নেওয়া দরকার। আমার ছোট্র লিস্টের কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না, ঠিকাছে ...দাও জনি কে ফোন। খুব কম দরকার পড়ত ...তাই আমার অনেক অনুরোধেই জনি ঢেকি গিলেছে। একই অবস্থা জনির জন্যও।
জনি আবার ফ্রিল্যান্স লেখালেখি (সাংবাদিকতা বলা যায়) করে বিভিন্ন পত্রিকায়। ওর এসাইনমেন্টের সুবাদে কয়েকটি অন্যরকম অভিজ্ঞতার সঙ্গি হয়েছি কয়েকবার।
একবার সম্ভবত শিশু দিবস এর আগে আগে জনির একটা এসাইনমেন্ট এর জন্য সাথে গিয়েছিলাম তেঁজগা রেলস্টেশনের সাথের এক বস্তিতে।
সাবজেক্ট বস্তির শিশুরা। ...বড় বড় কথা ...আর নাগরিক অনুভুতির কোমল জায়গার মোলায়েম খোঁচা দিয়ে খুব সাময়িক দুঃখ্য বিলাস তৈরি করতে হবে।
যে লেখা পড়ে আমরা সকাল বেলার আলসেমির সাথে সাথে একটা দুঃখ্য দুঃখ্য ভাব করে রাস্তায় বের হয়ে সিগন্যালের কুৎসিত মানুষের ছানার গাড়ির কাচ ছোয়ার মত মহা অপরাধে অমৃতবাণী বর্ষন করব। ....সেই রকম একটা কড়া লেখা দিতে হবে জনিকে। আর সাথে আসার জন্য আমি পাব ফুলপেট বিরিয়ানি।
বস্তিতে এক ধরণের মহাজন টাইপ মা দেখলাম। তার নিজের কোন সন্তান নেই (অথবা কোন এককালে ছিল)। তার পেশা হচ্ছে ছোট বাচ্চাদের মা হওয়া। তার জিম্মায় অনেক রকম আর সাইজের বাচ্চা আছে। এদের দিয়ে ভিক্ষা করিয়ে বা অন্য কোন কাজ করিয়ে তার আয় হয়।
আমরা গিয়েছিলাম সন্ধার পরে... ...তার সন্তানদের ছবি তুলতে চাইলে দিলেন না। অনেক দয়া করে কথা বলার অনুমতি দিলেন। জনির টেপরেকর্ডার আর কৌশলি কথার ফাঁক কেটে আমার নজর পড়ল কিছুটা দুরে বসা নায়ক রুবেলের উপর। একমনে মার্বেল নিয়ে ব্যাস্ত। আধো অন্ধকারে চেহারা-সুরত বেশ ভালই মনে হল। তার চিড়িং-বিড়িং স্বভাবের কারণে ভাইবোনের কাছে তার নাম "নায়ক রুবেল"। "এফডিসিতে যাও নাকি?" ...জিজ্ঞেস করতেই ছেড়া স্যান্ডো গেন্জি পরা রুবেল ফোকলা মুখে একটা মুচকি হাসি দেয়। পাশ থেকে আরেক পিচ্চি জবাব দেয় "...যায়না আবার ...কাম কাইজ ফালাইয়া ছবির পুস্টার দেইখ্যা ব্যাড়ায়।"
কথায় কথায় জানলাম... এই পরিবারে রুবেলের জন্ম কমলাপুর রেল স্টেশন থেকে। আসল বাবা-মা কে ...কেউ জানে না।
কথায় কথায় মুখ ফসকে জনি জিজ্ঞেস করে ফেলে
"...রুবেল ...আসল বাপ মার কথা মনে পড়ে না?"
হাস্যমুখি খুদে নায়ক সাথে সাথে চেহারায় সন্ধার কালো আকাশ নিয়ে আসে। চোখ দুটোকে জমজ সন্ধাতারা করে আস্তে আস্তে উত্তর দেয় "...কুনো মা-বাপ নাইক্যা। আমি রাস্তার।"
উত্তরের এমন কাঠিন্যের জন্য প্রস্তুত ছিলাম না।
হয়ত ভাল কোন টিভি সাংবাদিক উপস্থিত থাকলে এমন একটা পরিস্থিতি নিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় জমজমাট কমেন্ট করতেন ....
....দেখুন দর্শক ৭ বা ৮ বছরের এই ছোট্র শিশু জনি ...জানে না কে তার মা-বাবা। আমরা তাকে জিজ্ঞেস করতে পারিনি কখনো কি সে মমতা বলে কোন অনুভূতির দেখা পেয়েছে কিনা? ...মা নামের কিছু কি তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বাপধন বলে কপালে চুমে খেয়েছে কিনা? আজ শিশু দিবসে কি আমরা এই শিশুগুলোর কথা মনে রাখব?
....আমরা দুই খোড়া মস্তিস্কের মানুষ আর কথা না বাড়িয়ে ফিরে এসেছিলাম। কিছু বাস্তব আড়ালে থাকাই আমাদের মত সভ্যদের(!) জন্য স্বস্তিদায়ক।
২.
গাবতলি বাসস্ট্যন্ড থেকে আমার নিজের শহরে (হোম টাউন এর ভাল বাংলা কি?) ফেরার বাসে উঠতে হয়। বাসে ওঠার পর থেকে বাস ছাড়ার আগে পর্যন্ত নানা ধরণের বাণিজ্যর মুখোমুখি হতে হয়। রকমারি হকার ...আর ততোধিক রকমারি পণ্য। ...একবার এরকম ইন-হাউস হলিডে মার্কেটে বসে বাস ছাড়ার অপেক্ষায় আছি... তখন হাতে কয়েক রঙের টুথব্রাস নিয়ে এক কিশোরের উপস্থিতি। বেশ ভাল করে সিঁথি কাটা চুল। একহারা গড়ন। লজ্জা লজ্জা ভাব নিয়ে বিভিন্ন সিটের পাশে দাড়িয়ে ক্ষিণ গলায় টুথব্রাস নেওয়ার কথা বলছে। একেবারেই হকারদের প্রফেশনাল চটপটে ভাব নেই।
গায়ে পড়ে কথা বলার মত সামাজিক কোন কালেই ছিলাম না। আমার পাশের সিটে বসে ছিলেন এক ভদ্রলোক। আমাদের সিটের পাশে আসতেই তিনি জিজ্ঞাসা করে বসলেন ... "কিরে মিন মিন করিস কেন, তোকে দেখে তো হকার মনে হয় না। ব্যাপার কি?"
বেচারা টুথব্রাস-বালক পারলে সংকোচে নিজের ভেতর সেধিয়ে যায়। মৃদস্বরে যা বলল ...তার মর্মার্থ হচ্ছে... তার ছোটবেলায় মা মারা যাবার পর থেকেই এতিমখানায় মানুষ। পড়ালেখা শিখছিল ওখানে, কোনমতে দিন কাটছিল। বাবার ২য় বিয়ের পর তার ২য় মায়ের মাথায় এতদিন পর কন্ডোলিৎসা চাল(বাজ) এর মত বুদ্ধি আসে ...এটাকে খাটালে কিছু পয়সা পাওয়া যাবে। তাই এতিমখানা থেকে এনে হকারিতে ঢুকিয়েছে। আজকে ২য় দিন।
গতকাল তার রোজগার দেখে সৎমা কর্পোরেট হুমকি দিয়েছে। আজকে সেলস টার্গেট ফুলফিল না হলে ...বাবার হোটেল বন্ধ।
...আমি কিছু না বলে চুপ করে শুনছিলাম। পাশের ভদ্রলোক এবার ধমক দিয়ে উঠলেন... বাংলাসিনেমার গল্প.... না? ঝেড়ে কাশ। আমি কিছু বলার আগেই... বেচারা কিছু না বলে এক সেকেন্ডের একটা একটা আহত দৃষ্টি দিয়ে সামনে চলে যায়। ...নামটাও জানা হল না।
...আহ দুনিয়া ...বেশ তার মানুষগুলো।
৩.
সন্ধায় ক্লাস বা ল্যাব থাকলে গর্তে ঢোকার আগে চা খেয়ে যাই। যেখানে চা খাই (ভদ্র ভাবে ...পান করি) ...সেই ২ ইট (৩স্টার এর মত, ইটালিয়ানের ২ ইট সমমানের) চাশালায় কামলা খাটে এক পিচ্চি। ওকে কখনো শিশু বা কিশোর ভেবেছি... মনে পড়ে না। ও সব সময়ই পিচ্চি। একটু পরিচিত হয়ে নাম জেনেছিলাম আকবর। ...বাদশা আকবর আমাদের খুব প্রিয় টি-সার্ভার। সবার পছন্দ মনে রেখে ঠিক ঠিক কাপ হাতে দেয়।
বাদশা আকবরের গল্পটা আরো ভয়াবহ। আকবরের বাড়ী ছিল ফরিদপুরের কোন এক চরে। বাবা কৃষক ছিল। আকবর যতদূর মনে করতে পারে বেশ ভালই ছিল তারা। সব হারানোর খেলাটা শুরু করে প্রমত্তা পদ্মা নদী। ...সেই পুরনো গল্প... পদ্মার ভাঙনে কৃষক সর্বশান্ত। ...অতঃপর হতাশ কৃষকের অকাল মরন। পুরো পরিবারের পথে বসা। ...তারপর বিচ্ছিন্নতা। পেটের টানে আকবর ছয় বা সাত বয়েসে ঢাকা আসে। ....তারপর থেকে আকবরের গল্পটা সবার প্রতিদিন বহুবার দেখা সেই বিরক্তিকর গল্প।
গল্প শেষ। এবার কিছু অনুভূতিতে খোঁচানোর চেষ্টা করব।
বেশকিছুদিন আগে প্রথম আলোর শনিবারের সাপ্লিমেন্ট "ছুটির দিনে" একটা পাতা থাকত।
"ঘর নেই" (ঠিক বললাম তো?) ...খুব মনোযোগ দিয়ে পাতাটা পড়তাম। কলেজ জীবণে তখন মনে মনে অনেক স্বপ্ন। পড়তাম আর মনে মনে নোনা জল ফেলে ভাবতাম ...একদিন ...একদিন.. সব পাল্টে দেব। .....কিচ্ছু করি নাই। কিচ্ছু না।
রোজ ভালবাসা খুঁজেফিরি আমরা। একবুক ...কিংবা... এক সাগর, মহাসাগর ভালবাসা নিয়ে অপেক্ষায় থাকি। আফসোসে মনে মনে তড়পাই... কেউ ভালবাসা চাইল না। কেউ কি নেই??
কিংবা বসে বসে দুজনে ফ্রেন্চফ্রাইগুলোকে ভালবাসার সসে মাখিয়ে খাই। রাতভর সেলফোনের নেটওয়ার্কগুলো আমাদের ভালবাসার উপচে পড়া রসে যান্ত্রিক ক্লান্তিতে ভেঙ্গে পড়তে চায়। আজকাল ফ্লেক্সিলোডেও তো ভালবাসা পাঠাই আমরা। ফেব্র্রুয়ারির ১৪ তারিখে তো আমাদের ভালবাসাগুলো উপচে পড়ে চারিদিকে ভাসিয়ে দেয়। পদ্মা নদীটাও মনে হয় জন্মের পর থেকে এত উৎসরণ ঘটায়নি। আহারে.... বুড়ো পৃথিবীটা এত ভালবাসার ভার কেমন করে সহ্য করে??
...এত ভালবাসার ঠিকানা হয়না শুধু আসলেই যারা ভালবাসা খুঁজেফেরে তাদের হৃদয়ের আলিন্দ-নিলয়ের কোন এক গুমরে কাঁদা প্রকোষ্ঠের দিকে।
আমি নিজেও একটা ভন্ড। পেইনকিলার কিনতে গিয়ে পান্থপথের ফুটপাথে কুৎসিত মানুষের ছানাগুলোকে স্র্রেফ একটা পাতলা চটগায়ে শুয়ে থাকতে দেখে আবেগের তোড়ে এই আবর্জনা লিখলাম। ....আজকে রাতের চমৎকার একটা ঘুমের পর এইসব আবেগ কোথায় যে ধুয়েমুছে যাবে ...স্বয়ং ইশ্বরও বলতে পারবেন না।
শুধু নায়ক রুবেল, টুথব্রাশ-বয় বা বাদশা আকবরদের পুরো পৃথিবীর উপর অভিমান ...হয়ত কখনো পরিবর্তন হবে না। ...কারণ ...আমাদের সস্তা ভালবাসাগুলোর শুদ্ধতম এইসব হৃদয় ছোয়ার কোন সাহস... কোনদিনই হবে না।
শিরোনামের আমরা বলতে ...আমরা ভন্ডরা না।
যাদের গল্পগুলো আমার এই আবর্জনায় শোনানোর মত সাহস করেছি ...তারা।
ব্যবহৃত ছবিটি শ্রদ্ধেয় রফিকুন নবীর "টোকাই"
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই জানুয়ারি, ২০০৯ রাত ২:৩৯