বাংলা ব্লগ কি আমাদেরকে পত্রিকাবিমুখ করে তুলছে ?
প্রশ্নটা প্রথমে আমি নিজকে করেছি। উত্তর দিতে গিয়ে দেখি হ্যাঁ কিংবা না বলে সংক্ষিপ্ত উত্তর দিয়ে পাড় পাব এমন প্রশ্ন এটা নয়। কাজেই বসতে হলো আলোচনার বৈঠকে নিজের সাথে। সেখানে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে আমি আরও একটা জিজ্ঞাসার সম্মুখীন হয়েছি। সেটা হলো ব্লগে কারা আছেন বা ব্লগার কারা ? অনেকে হয়তো আমার এই প্রশ্ন দেখে ভাববেন আমি নিজে একজন ব্লগার হয়ে এই প্রশ্ন কি করে করলাম সেটাই এখানে একটু পরিস্কার করতে চাই। এই জিজ্ঞাসা আমার মাথায় আসার কারণ হলো, ব্লগারদের মধ্যে এমন অনেকেই আছেন যারা শুধুই ব্লগিং করেন। আবার এমন অনেকে আছেন যারা পত্র-পত্রিকায় লেখালেখিতে অভ্যস্থ এবং বইও প্রকাশ করেছেন। এই লেখার শিরোনামে যে প্রশ্নটা উঠে এসেছে সেটা মূলত এই শ্রেণীর ব্লগারদের নিয়ে। অর্থাৎ যারা পত্র-পত্রিকায় লেখালেখিতে অভ্যস্থ এবং পাশাপাশি ব্লগিংএও নিয়মিত তাদের কথা ভেবেই এই লেখার অবতারণা।
বাংলা ব্লগ আমাদেরকে অর্থাৎ ব্লগারদেরকে পত্রিকাবিমুখ করে তুলছে কি-না, ব্লগার লেখক-লেখিকারা নিজেদের মধ্যে এর উত্তর সহজে খুঁজে পাবেন বলে আমি আশা করছি। এ প্রসঙ্গে আমার পর্যবেক্ষণে যা উঠে এসেছে তা হলো সম্পূর্ণভাবে না হলেও আংশিকভাবে বা খন্ডিতভাবে বাংলা ব্লগ ব্লগার লেখক-লেখিকাদরকে পত্রিকাবিমুখ করে তুলছে বা তুলেছে। এই যেমন ধরুন লেখক মাত্রেরই আকাংখা থাকে তার লেখা পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হোক। সেজন্য পত্রিকায় একটা লেখা পাঠিয়ে দিয়ে মাসের পর মাস অপেক্ষা কতে হয় সেটা প্রকাশের জন্য মনোনিত হলো কি-না তা জানার জন্য। আমরা যারা পত্রিকায় কোন না কোন সময় লেখা পাঠিয়েছি বা এখনও পাঠাচ্ছি তারা জানি একটা লেখা পাঠানোর পর চার মাসের মধ্যে প্রকাশিত না হলে ধরে নিতে হয় যে লেখাটা মনোনিত হয়নি। নিজের একটা লেখা ছাপার অক্ষরে পত্রিকায় দেখতে পেলে সেই লেখকের লেখার আগ্রহ অনেকগুণে বেড়ে যায়, যা তাকে আরও অধিকতর মানসম্পন্ন লেখায় উৎসাহিত করে। কিন্তু চার মাস অপেক্ষা করার পরও যখন লেখাটা প্রকাশ না পায় তখন সেই লেখকের মনটা হতাশায় নুয়ে পড়ে।
এর বিপরীতে আমরা যারা ব্লগিং করছি তারা একটা লেখা তৈরী করে সাথে সাথে ব্লগে প্রকাশ করতে পারছি এবং ফিডব্যাকও পাচ্ছি। স্বাভাবিকভাবে পরবর্তী আর একটা লেখা তৈরী করার জন্য মনটা ছনমন করতে থাকে। আমি বোধহয় আগেও একটা লেখায় বলেছিলাম যে ব্লগ হচ্ছে নাটকের মঞ্চের মতো। প্রত্যেক অভিনেতা-অভিনেত্রী মঞ্চনাটকে কাজ করতে বেশী আগ্রহী। কারণ, নিজের কাজের ফিডব্যাকটা সাথে সাথে পেয়ে অভিনয়ের ভুল-ত্রুটি সংশোধন করে নেয়ার সুবর্ণ সুযোগ রয়েছে এখানে। তেমনি ব্লগেও ব্লগার-পাঠকদের মন্তব্যের ভিত্তিতে নিজের লেখার ভুলত্রুটি সংশোধন করে নিয়ে আরও উচ্চ গুণসম্পন লেখা তৈরির আগ্রহ সৃষ্টি হয়। যেহেতু দ্রুত সময়ের মধ্যে এই ফিডব্যাকটা পাওয়া যায় সেহেতু ব্লগে লেখা প্রকাশের আগ্রহ বেড়ে যায় উত্তরোত্তর। যার ফলে গুণসম্পন্ন লেখার পরিমাণও বৃদ্ধি পায়।
আমি অন্তত আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে নিসঙ্কোচে এটা স্বীকার করছি যে ব্লগে রেজিষ্ট্রেশন করার পর থেকে পত্রিকায় লেখা পাঠানোর ব্যাপারে আমার আগ্রহ অনেকখানি কমে গেছে। পেশাগত জীবনের ব্যস্ততার ফাঁক-ফোকড় গলিয়ে একটা লেখা তৈরি করার পর সেটা পত্রিকায় পাঠিয়ে দিয়ে মাসের পর মাস অপেক্ষা করব এমন ধৈর্য যেন এখন আর নেই। তার চেয়ে এই ভাল। ব্লগে দিয়ে দিই, ব্লগার-পাঠকদের সরাসরি মতামত জানতে পারি, নিজকে সংশোধন করে নিতে পারি। আমি জানিনা আমার সাথে এক্ষেত্রে ব্লগার বন্ধুরা একমত হবেন কি-না।
প্রসঙ্গক্রমে আরও একটা কথা বলার প্রয়োজন বোধ করছি এখানে। কেউ কেউ ভাবতে পারেন লেখা মানসম্পন্ন না হলে পত্রিকা সেগুলো ছাপবে কেন ? একথা আমি অস্বীকার করছিনা। কিন্তু এর বিপরীতে আমারও একটা জিজ্ঞাসা আছে। সেটা হলো, ব্লগে আমরা যে লেখাগুলো প্রকাশ করি সেগুলো কি একেবারেই মানহীন ? এই ব্লগে এমন অনেক ব্লগার আছেন যাদের লেখা সকল মানদন্ডের উপরে উঠে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্যতার দাবী রাখে। তাছাড়া কিছু কিছু লেখা সময়ের প্রাসঙ্গিকতায় যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যবাহী এবং প্রয়োজনীয়ও বটে। এসব লেখা পড়ে মানুষ উপকৃত হয় তাৎক্ষণিকভাবে। এসব লেখা পত্রিকায় প্রকাশের অপেক্ষায় থাকলে অনেকক্ষেত্রে সময়ের প্রশ্নে গ্রহণযোগ্যতা হারায়।
ঠিক এই জায়গায় দাঁড়িয়ে আমি মনে করি বাংলা ব্লগ হচ্ছে একটি উন্মুক্ত স্বচ্ছ মাধ্যম, এটা লেখালেখিতে আগ্রহীদেরকে উৎসাহিত করছে প্রতিনিয়ত। আর একারণেই আমরা নিজের লেখা পত্রিকায় পাঠানোর ব্যাপারে কিঞ্চিৎ হলেও অনাগ্রহী হয়ে পড়েছি। এক্ষেত্রে আমি সরাসরি বলবনা যে বাংলা ব্লগ আমাদেরকে পত্রিকাবিমুখ করে তুলেছে বা তুলছে। বরং আমি বলব বাংলা ব্লগসমূহে স্বচ্ছতার সাথে অবারিত প্রবেশের সুবিধা থাকার কারণে আমরা অনাগ্রহী হয়ে পড়ছি পত্রিকায় লেখা পাঠানোর ব্যাপারে। এটাকে বাংলা ব্লগের নেতিবাচক দিক হিসেবে না দেখে ইতিবাচক দিক হিসেবে দেখতেই আমি বেশী পছন্দ করি।