![]()
সবাইকে উপেক্ষা করে বিয়ে করেছিলেন ভিন দেশি এক মুসলিম যুবককে। বিশ্বাস করে পাড়ি দিয়েছিলেন শ্বশুরবাড়ি সুদূর আফগানিস্থান। সেখানে গিয়ে বুঝলেন এরা ভন্ড, ধর্মান্ধ। ওই দেশে একবার কেউ ঢুকলে আর বেরোতে পারেনা। লেখিকাও তাই বন্দি হলেন শ্বশুর বাড়ি নামের সেন্ট্রাল জেলে। যার হাত ধরে গিয়েছিলেন, সেই স্বামীও ফেলে রেখে পালিয়ে এলেন ভারত। নিজের বলতে কেউ নেই। চললো নির্যাতন। অসহনীয় অত্যাচার। মন তখন স্বদেশে ফেরার জন্য ব্যাকুল।
"কাবুলিওয়ালার বাঙালি বউ" উপন্যাসে এভাবেই সাবলীল বর্ননার মধ্য দিয়ে পুরো গল্পতে লেখিকা সুস্মিতা বন্দপাধ্যায় তুলে এনেছেন নিজের বাস্তব জীবনের ভয়ার্ত করুণ কাহিনী ।কিন্তু এটাই যে তাঁর জীবনের কাল হয়ে দাড়াবে তা কোন ভাবেই কল্পনায় ছিলনা লেখিকার। ৫ সেপ্টম্বর ভোরে তাকে হত্যার আগে আফগানিস্তানে সন্দেহভাজন তালেবান জঙ্গিরা হুংকার ছেড়ে বলে, "আমাদের বিরুদ্ধে ফিল্ম বানিয়েছো, কিতাব লিখছো।"
স্রেফ ফ্লিম বানানো, বই লেখা বা ব্লগে লেখালেখি করার জন্য তাহলে মরতে হবে?
ধর্মান্ধদের নিষ্ঠুরতা নিয়ে কোন গল্প লেখা যাবেনা?
আসলেই কি গল্প লেখার জন্যে তাঁর এই মৃত্যু? নাকি অন্যকোন রহস্য লুকিয়ে আছে কাবুলে?
"কাবুলিওয়ালার বাঙালি বউ" উপন্যাসের ২য় খন্ড লেখার কাজ শুরু করতেই নাকি আবারও সুস্মিতা ছুটে যান আফগানিস্থান। ভারতীয় পত্রপত্রিকায় এমন খবর এসেছে হত্যাকান্ডের পর।
রাতের অন্ধকারে জঙ্গিরা সারা বাড়ি ঘেড়াও করে তাকে দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলে। এরপর মারতে মারতে তাকে টেনে হিচড়ে নিয়ে যায় এবং বুলেটে ঝাঁঝরা করে দেয়া হয় তার দেহ। এ কে ৪৭ রাইফেলের কুড়িটি গুলির আঘাতে কুকড়ে নিস্তেজ হয়ে যায় সাহসী সাহিত্য যোদ্ধা সুস্মিতা বন্দ্যোপাধ্যায়।যদিও এ হত্যাকান্ডের দায় অস্বিকার করেছে তালেবান। তবে সুস্মিতার স্বামী আহত জানবাজ খান এবং তাঁর দেবর জার খানের বর্ণনা মতে সেদিনের হত্যাকান্ড তালেবানরা ঘটিয়েছে বলে প্রতিয়মান হয়। ঘটনার পর লেখিকার স্বামী কলকাতার প্রভাবশালী দৈনিক আনন্দবাজারকে জানায়, “মেরা পাগলিকো (সুস্মিতাকে) মার দিয়ে তালিবান লোগোঁ নে।”
ভারতের বিভিন্ন পত্রপত্রিকা তাঁর দেবর জার খানের উদ্বৃত্তি দিয়ে জানায়, বুধবার রাত দেড়টা নাগাদ ৩০-৩৫ জন লোক জোর করে ঘরে ঢুকে জানবাজ ও সুস্মিতাকে বেধড়ক মারতে থাকে। তার পরে দু’জনের চোখ ও হাত বেঁধে নিয়ে যায়। হুমকি দেয়, “আরও চেঁচালে গুলি করে দেব।” আততায়ীরা দু’জনকে দু’দিকে নিয়ে চলে যায়। সকাল হতেই জানবাজ-সুস্মিতাকে খুঁজতে বেরিয়েছিলেন পরিবারের সকলে। বাড়ির কাছেই ঝোপের মধ্যে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় জানবাজকে পাওয়া যায়। কিন্তু সুস্মিতাকে তখন পাওয়া যায়নি। জার খানের কথায়, “খানিক পর গ্রামের কিছু লোক বলল, দু’কিলোমিটার আগে এক অউরতের বডি পড়ে আছে।” তাঁরা গিয়ে দেখেন এটাই ‘সাহাবকামাল’ সুস্মিতার দেহ। তত ক্ষণে জানবাজকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে হাসপাতালে। যাওয়ার পথে জানবাজ বারবার জানতে চাইছিলেন, “পাগলি কা হাল ক্যা হ্যায়, পাগলি কঁহা হ্যায় (পাগলি এখন কেমন আছে, ওর কী হয়েছে)?”
কেন এমন হল?
জার খানের উত্তরে উঠে এসেছে ভারতের মাওবাদী আর আল কায়দার সঙ্গে তালিবানের তুলনা। তিনি বলেছেন, বললেন, " তালিবান লোগ আপ লোগোকা মাওবাদী জ্যায়সা হ্যায়। ওরা কোথায় থাকে, কী ভাবে অ্যাকশন করে, জানি না। কারও উপরে রাগ হলে তাকে রাস্তাতেই গুলি করে দেয়। আল কায়দা জ্যায়সা।” কিন্তু এদিকে সুস্মিতার বন্ধু শালিনী নস্করের বক্তব্য থেকে পাওয়া গেছে রহস্যের গন্ধ। তাঁর দাবি, এটি পরিকল্পিত হত্যাকান্ড এবং সন্দেহর তির সুস্মিতার স্বামীর দিকে।
৯ সেপ্টম্বর কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, গত এক মাস ধরে ফেসবুকের মাধ্যমে সুস্মিতার সাথে কিছু কথাবার্তা হয়েছিল বন্ধু শালিনীর। সেই কথার উপর ভিত্তি করেই শালিনীর দাবি, গত এক মাস ধরে জানবাজ খানের সঙ্গে সুস্মিতার সম্পর্ক ভাল যাচ্ছিল না। এ দিন কসবায় নিজের ফ্ল্যাটে বসে শালিনী জানান, ৫ সেপ্টেম্বর সুস্মিতার দিল্লির জন্য রওনা হওয়ার কথা ছিল।
শালিনী সংবাদমাধ্যমকে ফেসবুকের ওই বার্তাগুলিও দেখিয়েছেন। সেখানে চার সেপ্টেম্বর সকাল ন’টা নাগাদ যে কথাবার্তা হয়, তাতে সুস্মিতা জানান, ফেরার জন্য তাঁর ব্যাগ গোছানো শেষ। সেই রাতেই খুন হন তিনি। এর পিছনে সত্যিই তালিবান রয়েছে কি না তা নিয়ে পূর্ণাঙ্গ তদন্তের দাবি করেছেন শালিনী।
শালিনীর দাবি, সুস্মিতা তাঁকে জানিয়েছিলেন, জানবাজের সঙ্গে তাঁর ঝগড়া হচ্ছে। দেওর মুশার স্ত্রীর সঙ্গে জানবাজের বিয়ের কথাবার্তা চলছে বলেও সুস্মিতা লিখেছিলেন। মুশা বছরখানেক আগে কলকাতায় একটি দুর্ঘটনায় মারা যান। পাশাপাশি শালিনীর দাবি, গত এক মাসে সুস্মিতার সঙ্গে দিল্লির বাসিন্দা দীপক কুমার নামে এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে ফেসবুকের মাধ্যমে বন্ধুত্ব হয়। দীপক কুমারের সঙ্গে আনন্দবাজার পত্রিকার সাংবাদিক ফোনে যোগাযোগ করলে দীপক সুস্মিতার সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের কথা স্বীকার করে বলেন, “আমরা বিয়ে করে একসঙ্গে জীবন কাটাব বলে স্থির করেছিলাম।”
দীপক নিজে অবশ্য বিবাহিত, তাঁর তিনটি সন্তানও রয়েছে। এ দিন কাবুলে জানবাজদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলে দেখা যায়, ফোন বন্ধ। সুস্মিতার দাদা গোপালবাবু ও তাঁর স্ত্রী দেবলীনা অবশ্য সুস্মিতার সঙ্গে জানবাজের সম্পর্কের অবনতির কথা জানতেন না বলে জানিয়েছেন। তবে দেবলীনারও প্রশ্ন, “সুস্মিতার রওনা হওয়ার আগের রাতেই তার উপর হামলা হল কেন?” দেবলীনা ও গোপালবাবুর দাবি, সব রহস্য সমাধান হওয়ার জন্যই সুস্মিতার দেহ দেশে আনা দরকার।
সুস্মিতা হত্যার ঘটনায় শোক প্রকাশ করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ বলেছেন, "মর্মান্তিক ঘটনা। সুস্মিতা অনেক দিন আফগানিস্তানে ছিলেন। সমাজসেবার কাজ করছিলেন। এই রকম এক জন মানুষকে তালিবান রোষের শিকার হতে হলো, তাতে আমি খুবই কষ্ট পেয়েছি। আফগানিস্তানের মানুষ আর প্রশাসনকেই ঠিক করতে হবে, তালিবান দর্শন তাঁদের জীবনকে চালনা করবে কি না।" এদিকে তালিবান মুখপাত্র দৌলত খান জাদরান সংবাদ সংস্থা এএফপি-র কাছে দাবি করেছেন, “আমরা ওই ভারতীয় মহিলাকে মারিনি। এটা মুজাহিদিনদের গায়ে কালি লেপার জন্য সরকারের অপপ্রচার।” কাবুলের সরকারি সূত্র অবশ্য বলছে, ২০০১ সাল থেকে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত তালিবান সাধারণ ভাবে কোনও মহিলাকে হত্যার দায় স্বীকার করে না।
একজন সাহসী সাহিত্য সৈনিক চলে গেলেন। তাঁর বুকের তাজা রক্তে সিক্ত হলো ধর্মান্ধদের জমিন। ধর্মান্ধদের নিষ্ঠুরতার লাগাম টানতে যুগে যুগে ফিরে আসুক কাবুলিওয়ালার বাঙালি বউ সুস্মিতা ।
সুস্মিতাকে নিয়ে সর্বশেষ খবর জানতে ক্লিক করুণ : স্বামীর হাতেই কি খুন হলেন কাবুলিওয়ালার বাঙালি বউ সুস্মিতা : নয়া রহস্য ফেসবুকে
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৩ বিকাল ৪:২৩

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




