somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শ্যামনগরের চন্দ্রিকা দিদি

০৫ ই জানুয়ারি, ২০১৩ বিকাল ৪:৫৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সুন্দরবনসংলগ্ন প্রত্যন্ত জনপদ। মানুষজনের বেশির ভাগই অভাবী। সত্যিকার অর্থে নুন আনতে পান্তা ফুরোয় তাঁদের। নিজেরা বিদ্যালয়মুখী হননি। সন্তানদেরও পড়ালেখা করানোর ইচ্ছা বা সামর্থ্য—কোনোটাই ছিল না। এভাবেই পার হচ্ছিল বছরের পর বছর। একদিন চন্দ্রিকা ব্যানার্জি নামের এক গৃহবধূ উদ্যোগ নিলেন এই অবস্থার পরিবর্তনে। বিদ্যালয়ে যখন পাঠদান চলছে, তখন রাস্তার পাশে খেত-খামারে ছোট ছোট শিশুকে কাজ করতে দেখে তাঁর ভালো লাগেনি। শুরু করলেন ‘ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর’ কাজ। সে দুই দশক আগের কথা। সেই থেকে তিনি সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার বুড়িগোয়ালিনী ও মুন্সিগঞ্জ এলাকার বাসিন্দাদের কাছে ‘চন্দ্রিকা দিদি’। নিজ ঘরের বারান্দায় হয়েছিল সূচনা। এখন চন্দ্রিকা দিদির পাঠশালার সংখ্যা ১৭। মোট শিক্ষার্থী ৫১০ জন। বলার অপেক্ষা রাখে না, দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুরাই চন্দ্রিকা দিদির পাঠশালায় আসে। এই শিশুরাই শিক্ষিত হয়ে একদিন নিজেদের অধিকার আদায়ের পাশাপাশি সমাজের নেতৃত্ব দিতে পারবে—এমনটাই বিশ্বাস চন্দ্রিকার। চন্দ্রিকার বিশ্বাস কিছুটা ফলতেও শুরু করেছে। কারণ, পাঠশালার প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের অনেকেই এখন সমাজ ও কর্মক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। গল্পের মতো শুরু: উচ্চমাধ্যমিক পাস করার আগেই পরিবারের অমতে বিয়ে করেন চন্দ্রিকা। সদ্য কৈশোর পেরোনো অবস্থায় উপজেলার ঈশ্বরীপুরে শ্বশুরবাড়িতেও প্রত্যাশিত মর্যাদা না পেয়ে তিনি মুষড়ে পড়েছিলেন। স্বামী স্বল্প আয়ের চাকরি করেন। তিনি অফিসে চলে যাওয়ার পরের সময়টা প্রতিবেশীদের বাড়ি বাড়ি ঘুরে কাটাতেন চন্দ্রিকা। সুযোগের অভাবে অনেক শিশুর শিক্ষাবঞ্চিত থাকার বিষয়টি এ সময় তাঁর নজরে আসে। বিষয়টি তাঁকে ভাবিয়ে তোলে। তিনি স্বামীর সঙ্গে পরামর্শ করে ওই শিশুদের পরিবারের সঙ্গে আলোচনা করেন এবং তাদের পড়াশোনায় ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেন। চন্দ্রিকা তখন থেকেই শুরু করেন বিনা পারিশ্রমিকে পাঠদান কার্যক্রম। চন্দ্রিকা ব্যানার্জির শয়নকক্ষের বারান্দায় পাঠশালার যাত্রা শুরু হয় ১৯৯২ সালে। পাশের বাড়ির ছেলে জিল্লুর রহমান, বাপ্পী মালো, মনিরুজ্জামানসহ আরও কয়েকজন শিশু সেখানে প্রথম পড়তে এসেছিল। চন্দ্রিকার বাড়ির আঙিনায় পর্যায়ক্রমে আরও শিশু ও কয়েকজন নারী শিক্ষার্থী জড়ো হয় অক্ষরজ্ঞান লাভের আশায়। এভাবে বাড়তে থাকে শিক্ষার্থীর সংখ্যা। চন্দ্রিকার পরিবারের সদস্যদের মধ্যেও অসন্তোষ দেখা দেয়। তাঁদের কাছে চন্দ্রিকার কার্যক্রম ছিল ‘ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর’ সমতুল্য। কিন্তু বঞ্চিত শিশু ও নারীদের নিয়ে চন্দ্রিকার স্বপ্ন তত দিনে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। তাই সব বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে তিনি লক্ষ্যে অবিচল থাকেন এবং ধীরে ধীরে জাবাখালী, গুচ্ছগ্রামসহ আরও কয়েকটি স্থানে তাঁর কার্যক্রম ছড়িয়ে দেন। প্রতিদিন সকালে স্বামী অফিসে রওনা হলে চন্দ্রিকাও বেরিয়ে পড়তেন নিজ হাতে গড়া পাঠশালার উদ্দেশে। প্রতিটি কেন্দ্রে দুই ঘণ্টা করে পড়িয়ে বিকেলে বাসায় ফিরতেন। এভাবে কয়েক বছরে তাঁর কার্যক্রমের পরিসর বাড়ে। স্থান সংকুলানের অভাবে তিনি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সম্মেলনকক্ষ ব্যবহারের অনুমতি নেন। শিক্ষার্থীর সংখ্যা আরও বাড়ার পর তিনি নতুন চার-পাঁচটি স্থানে কার্যক্রম শুরু করেন। অনেকের সহযোগিতায় তিনি অভাবী শিশুদের বইপত্র ও কাগজ-কলমেরও ব্যবস্থা করেন। অধিকারবঞ্চিত নারীদের অধিকার ও আত্মসচেতন করে তুলতে চন্দ্রিকা ব্যানার্জির উদ্যোগে ১৯৯৩ সালে ‘নকশী কাঁথা’ নামের একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়। পরে ওই সংগঠনের সঙ্গে পাঠশালাভিত্তিক কার্যক্রম সংযুক্ত করেন চন্দ্রিকা। নকশী কাঁথার উদ্যোগে তিনি উপকূলবর্তী প্রত্যন্ত অঞ্চল বুড়িগোয়ালিনী, কাশিমারী, মুন্সিগঞ্জসহ কয়েকটি স্থানে মোট ১৭টি বিদ্যালয় গড়ে তোলেন। এক দিন পাঠশালায়: সম্প্রতি এক সকালে বুড়িগোয়ালিনী গ্রামে চন্দ্রিকা দিদিকে সঙ্গে নিয়ে তাঁর পাঠশালায় গিয়ে দেখা যায়, ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা চাটাইয়ে বসে খুব মনোযোগের সঙ্গে লেখাপড়া করছে। চন্দ্রিকাকে দেখেই ছেলেমেয়েরা দিদি বলে সালাম দিল। একটি ঘর নিয়েই এই পাঠশালা। কাঠের বেড়া, ওপরে গোলপাতার ছাউনি। শিক্ষক জানালেন, পাঠশালায় প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ানো হয়। ছেলেমেয়ে ৪০ জনের মতো। চন্দ্রিকার ১৭টি পাঠশালায় ১৭ জন শিক্ষক আছেন। তাঁদের মাসে কিছু ভাতা দেওয়া হয়। দরিদ্র শিশুদের দিতে হয় শিক্ষা উপকরণ। যারা পরীক্ষায় ভালো ফল করে, তাদের বৃত্তি দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। খরচ কুলিয়ে উঠতে না পারায় ২০০৩ সাল থেকে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সহায়তা নিচ্ছেন তিনি। তবে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছাত্র সংগ্রহ, পাঠশালার যাবতীয় দেখভাল—সবই করেন তিনি। চেষ্টা করেন সপ্তাহে একবার হলেও পাঠশালাগুলো ঘুরে দেখতে। ‘বুড়িগোয়ালিনী উপানুষ্ঠানিক বিদ্যালয়ে’র তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র রাসেল কিছুদিন আগেও বাবার সঙ্গে নদীতে জাল টানতে যেত। কিন্তু চন্দ্রিকা দিদির পরামর্শে সে আবার স্কুলে পড়াশোনার অনুমতি পেয়েছে। ভ্যানচালক ইব্রাহিম গাজীর মেয়ে সালমা আগে মায়ের সঙ্গে চিংড়িঘেরে শামুক কুড়াত। কিন্তু বাড়ির পাশের স্কুলে ভর্তি হয়ে পড়াশোনায় এখন সে বেশ ভালো করছে। সাফল্য ও কৃতজ্ঞতা: চন্দ্রিকার বারান্দায় প্রথম পাঠ গ্রহণকারী সেই শিশুদের কয়েকজন এখন সমাজে প্রতিষ্ঠিত। সেই বাপ্পী মালো ও জিল্লুর রহমান এখন পৃথক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। দরিদ্র পরিবারের মেয়ে মিলি খাতুন পড়েন খুলনা মেডিকেল কলেজে। তিনিও চন্দ্রিকার পাঠশালার ছাত্রী ছিলেন। জিল্লুরের বাবা শেখ নূর আলী, মিলির মা নুরুন্নাহার, বাপ্পীর বাবা খোকন মালোসহ অন্য অভিভাবকেরা নিজ নিজ সন্তানের প্রতিষ্ঠার পেছনে চন্দ্রিকার অবদান কৃতজ্ঞতাভরে স্বীকার করেন। চন্দ্রিকা নিজ জীবন থেকে অর্জিত শিক্ষাকে শক্তিতে পরিণত করে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন—এ মন্তব্য করেছেন শ্যামনগর আতরজান মহিলা মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ আশেক-ই-এলাহী। তিনি মনে করেন, চন্দ্রিকার প্রচেষ্টা সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে আরও এগিয়ে যাবে। সব শিশুকে বিদ্যালয়ে আনতে সরকারি উদ্যোগ সত্ত্বেও প্রতিবছর অনেক শিশু শিক্ষা কার্যক্রম থেকে ঝরে পড়ছে। আর সেই শিশুদেরই বিদ্যালয়মুখী করতে চন্দ্রিকা সরকারকে সহযোগিতা করছেন—মন্তব্য শ্যামনগর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আবদুল হাকিমের। তাই চন্দ্রিকার উদ্যোগ প্রশংসার দাবি রাখে। স্বপ্ন সীমাহীন: চন্দ্রিকা বলেন, তাঁর এলাকা সুন্দরবনসংলগ্ন শ্যামনগর উপজেলাসহ উপকূলজুড়ে বহু শিশু প্রতিবছর বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়ছে। তাঁর অভিজ্ঞতামতে, বাড়ি থেকে বিদ্যালয়ের দূরত্ব, মা-বাবার অসচেতনতা ও দারিদ্র্যই ঝরে পড়ার মূল কারণ। চন্দ্রিকা বিশ্বাস করেন, বঞ্চিত শিশু ও নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় তাঁর সংগ্রাম এখনো অসমাপ্ত রয়ে গেছে। চন্দ্রিকা তাই স্বপ্ন দেখেন নিরন্তর।

দৃষ্টি আকর্ষণ: তথ্যসূত্রে: প্রথম আলো। এ ধরনের সুন্দর সুন্দর সব ফিচার/প্রতিবেদন সম্বলিত বিশাল এক আর্কাইভ পেজ সংগ্রহে রাখতে এখানে ক্লিক করতে পারেন
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ মিসড কল

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হিটস্ট্রোক - লক্ষণ ও তাৎক্ষণিক করণীয়

লিখেছেন ঢাকার লোক, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:০৭

সাধারণত গরমে পরিশ্রম করার ফলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। এতে দেহের তাপমাত্রা অতি দ্রুত বেড়ে ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা তারও বেশি হয়ে যেতে পারে।

হিটস্ট্রোক জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। চিকিৎসা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহকে অবিশ্বাস করার সংগত কোন কারণ নাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩



সব কিছু এমনি এমনি হতে পারলে আল্লাহ এমনি এমনি হতে সমস্যা নাই। বীগ ব্যাং এ সব কিছু হতে পারলে আল্লাহও হতে পারেন। সব কিছুর প্রথম ঈশ্বর কণা হতে পারলে আল্লাহও... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে ইসরাইল বিরোধী প্রতিবাদ বিক্ষোভ

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ০৩ রা মে, ২০২৪ সকাল ৮:০২

গাজায় হামাস উচ্ছেদ অতি সন্নিকটে হওয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিউইয়র্ক ও লসএঞ্জেলসে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পরেছিল। আস্তে আস্তে নিউ ইয়র্ক ও অন্যান্ন ইউনিভার্সিটিতে বিক্ষোভকারীরা রীতিমত তাঁবু টানিয়ে সেখানে অবস্থান নিয়েছিল।


... ...বাকিটুকু পড়ুন

৫০১–এর মুক্তিতে অনেকেই আলহামদুলিল্লাহ বলছে…

লিখেছেন বিচার মানি তালগাছ আমার, ০৩ রা মে, ২০২৪ বিকাল ৩:০০



১. মামুনুল হক কোন সময় ৫০১-এ ধরা পড়েছিলেন? যে সময় অনেক মাদ্রাসা ছাত্র রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিল। দেশ তখন উত্তাল। ঐ সময় তার মত পরিচিত একজন লোকের কীভাবে মাথায় আসলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

×