১.
দাদী ,,, ক্ষুদা লাগজে।
বিছানায় শুয়ে অস্পষ্ট কন্ঠে বললো সোনাই। আস্তে আস্তে চোখ মেলে চাইলো রাহেলা বেগমের দিকে। হাতের ঘটিটা রেখে বিছানার দিকে এগিয়ে এলেন রাহেলা বেগম। আজ ২ দিন পর কিছু খেতে চাইলো সোনাই। তিন দিন হয়েছে সোনাইয়ের প্রচন্ড জ্বর। আজ সকাল থেকে জ্বরটা একটু কমে গেছে। চোখ মেলে দাদীর দিকে তাকিয়ে আছে সোনাই। রাহেলা বেগমের চোখ ছলছল করছে। ঘরে একটা দানা পর্যন্ত নেই। কিন্তু এই অবুঝ শিশুটাকে তা বলার দুঃসাহস নেই তার। সোনাইয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, তুই একডু ঘুমা। দাদী খাওয়া কিন্না আনি। জ্বরডা কমছে। আউজগা আর পান্তা খাওন লাগদোনা। আমি আইতাছি। ঘুমা। এই বলে লাঠিটা নিয়ে বেড়িয়ে পড়লেন রাহেলা বেগম।
রাহেলা বেগম একজন নিঃস্ব বিধবা। বয়স প্রায় সত্তর। এই পৃথিবীতে সোনাই ছাড়া তার আর কেউ নেই। সোনাই তার একমাত্র নাতি। রাহেলা বেগমের ছেলে বিজয়ের ছেলে সোনাই। তিন বছর আগে বিজয় মারা গেছে। রেখে গেছে একমাত্র স্মৃতি। রাহেলা বেগমের পূত্রবধু সোনাইয়ের মা মারা গেছে তার জন্মের সময়। তখন থেকেই সোনাইকে বাবা অর দাদী কেউই মায়ের অভাব বুঝতে দেননি। গরীবের সংসারে সব কিছুর কমতি থাকলেও ভালোবাসার কোনও কমতি থাকেনা। কারন পৃথিবীতে এটাই একটা সম্পদ যা কিনতে বা বিলোতে কোনও টাকা লাগেনা। রাহেলা বেগমের পরিপূর্ন সংসার ছিলো। কিন্তু সেটা এখন শুধুই অতীত। এমন আরও ভয়ঙ্কর অতীত আছে রাহেলা বেগমের জীবনে। যা মনে পড়লে তিনি এখনও শিউরে উঠেন। তার শিরদাড়া ঠান্ডা হয়ে জমে যায়। ৪৪ বছর আগেই সেই ভয়ঙ্কর রাত এখনও তাড়া করে বেড়ায় তাকে। সেই ভয়াবহ দৃশ্যগুলো প্রতিদিন খুন করে রাহেলা বেগমকে। সেই চিৎকার, সেই আর্তনাদ এখনও মনে পড়ে যায় তার।
শীতের সকালের মিষ্টি সূর্যটা আলো ছড়াতে শুরু করেছে। লাঠিতে ভর করে হাটছে রাহেলা বেগম। সড়কের পাশে ব্রিজের নিচে কিছু বোতল দেখা যাচ্ছে। কিন্তু রাতে কুয়াশায় শিশির জমে ভিজে গেছে জায়গাটা। নিচে নামার সাহস হলোনা তার। ঠায় দাড়িয়ে রইলেন। কি করবেন বুছতে পারছেন না। তবে পাঠকদের হয়তো বুঝতে সমস্যা হচ্ছে না রাহেলা বেগম কি চান? হ্যা। তিনি বোতলগুলো কুড়াতে এসেছেন। এটাই তার পেশা। আজ তিন বছর হলো এই কাজটি করেই কোনওরকমে একবেলা খেয়ে বেচে আছেন রাহেলা বেগম। ফেলে দেয়া বোতল-পলিথিন বা প্লাস্টিকের জিনিষ কুড়িয়ে সেগুলো গায়ের ভাঙারীর দোকানে বিক্রি করেন তিনি। দোকানদার জলিল মিঞা রাহেলা বেগমকে একটু বেশি টাকাই ধরিয়ে দেন। একমাত্র মেয়ে রাশেদার মৃত্যুর পরে কিছুদিন গ্রামের লোকেরা কিছুটা সহযোগিতা করলেও ধীরে ধীরে সবাই নিজেদের সরিয়ে নিয়েছে। তাতে কোনও দুঃখ নেই তার। পৃথিবীটা বড্ড কঠিন সেটা তিনি সবচাইতে ভালো জানেন। তার ছেলে বিজয় মারা যাবার পর একমাত্র মেয়ে রাশেদাই ছিলো তার সংসারের হাল ধরা ব্যক্তি। একটি এনজিওতে বুয়ার কাজ করে কষ্টের সংসারটা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলো রাশেদা। কিন্তু ভাগ্য রাহেলা বেগমকে নিঃস্ব করার সব পরিকল্পনাই করে রেখেছিলো। দুই বছর আগে হঠাৎ একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখলেন বাড়ির আমগাছটার সাথে ঝুলে আছে রাশেদার শরীরটা। এই দৃশ্য দেখেই জ্ঞান হারিয়েছিলেন তিনি। যখন জ্ঞান ফিরেছে তখন আর রাশেদা তার কাছে নেই। রাহেলা বেগম জানেন কেন তার মেয়ে তাদের ফেলে এইভাবে একাই পালিয়ে গেল। কোন লজ্জায় সে এই একলা বৃদ্ধা মানুষটিকে রেখেই চলে গেল না ফেরার দেশে। রাশেদা অনেকবার অফিস থেকে বাসায় ফিরে একলা ঘরে বসে কাদতো। তাকে সান্তনা দেবার সাহস রাহেলা বেগমের ছিলো না। তবে বুঝতে পারতেন জালিম এই পৃথিবীতে একটা মেয়ের একলা ঘরে কাদার কারনটা কি হতে পারে। তিনি নিজেও অনেকবার চাকরীটা ছেড়ে দিতে বলেছিলেন রাশেদাকে। কিন্তু এই চাকরীটা ছাড়লে একেবারেই না খেয়ে থাকতে হবে। একমাত্র সোনাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে হাজারো কষ্ট সহ্য করে কাজটা করে যাচ্ছিলো রাশেদা। তবে শেষ পর্যন্ত জীবনের কাছে হার মানতে হলো তাকেও।
দাড়িয়ে আছেন রাহেলা বেগম। বুঝতে পারছেন না কি করবেন। চোখের সামনে আবারও সেই স্মৃতির পাতাগুলো ভেসে উঠছে। আজ তার জীবনের গল্পটা অন্যরকম হতে পারতো। কিন্তু সেই একটি রাত তার জীবনের সব হিসেব পাল্টে দিলো। সেই দুর্বিষহ কালো রাত।
২.
দেশে তখন মুক্তিযুদ্ধ চলছে। ১৯৭১ সালের ২৫শে নভেম্বর। কুমিল্লার দাউদকান্দি থানার একটি গ্রাম। নাম পুটিয়া। গ্রামের লোকজন লোকাল ভাষায় পুইট্টা বলেই ডাকে। সারাদেশে মুক্তিবাহিনীর আগ্রাসনে কোনঠাসা হয়ে পড়েছে পাকিস্তানি দোসরারা। পরাজয় নিশ্চিত জেনে শেষ ছোবল মারার পরিকল্পনা করছে তারা। সেই বিষাক্ত ছোবলের বিষে ছেয়ে গেল এই ছোট্র গ্রামটিও। এ গ্রামেই রাহেলা বেগমের শ্বশুর বাড়ি। স্বামী-শ্বশুর অার ছেলে-মেয়ে নিয়ে সুখের সংসার রাহেলা বেগমের। সেদিন রাতে নাওয়া-খাওয়ার পর অনেক গল্প গুজবে মেতে উঠেছিলো রাহেলা বেগমের পরিবার। রাহেলা বেগমের দুই ভাই বেড়াতে এসেছে বোনের শ্বশুরবাড়িতে। মামাদের কাছে পেয়ে বিজয় আর রাশেদা ছিলো দারুন প্রানোচ্ছল। সবাই মিলে অনেক রাত পর্যন্ত গল্প গুজব করে ঘুমাতে গেল। রাহেলা বেগম তখনও রান্নাঘরে। কিছু কাজ বাকী ছিলো। সেগুলো গুছিয়ে ঘরে ঢুকবে এমন সময় চোখ পড়লো উঠোনের শেষ কোনায়। কোনও একটা ছায়া দেখতে পেল রাহেলা। এতো রাতে কে এসেছে !! ভাবলেন ঘরে গিয়ে স্বামীকে ডেকে পাঠাবেন। কিন্তু হঠাৎ কি ভেবে একটু এগিয়ে গেলেন। দু পা এগোতেই বুঝতে পারলেন একজন নয়। সেখানে কয়েকজনের ছায়া। বুঝতে দেরি হলোনা তার। দৌড়ে ঘরের দিকে এগুতেই পেছন থেকে থেকে গুলির শব্দ। সাথে সাথে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। গুলিটা তার পায়ে লেগেছিলো। গুলির শব্দে ঘরের সবাই ছুটে বেড়িয়ে এলেন। আর তখনই শুরু হলো বর্বর হত্যাযজ্ঞ। একের পর এক গুলিতে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন রাহেলার স্বামী, দুই ভাই আর শ্বশুর মাহাতাব আলী। মাহাতাব আলী গ্রামের স্কুল শিক্ষক। সবচাইতে বড় পরিচয় তিনি গ্রামের মুক্তিবাহিনীর একজন সংগঠক। মুলত তাকে হত্যা করতেই গভীর রাতের এই নৃশংস আক্রমন।
গুলিতে মাটিতে শুয়ে কাতরাচ্ছে রাহেলা। তার মাথার একটু সামনেই মাটিতে পড়ে আছে তার স্বামীর নিথর দেহ। দুই হাতে ভর করে হামাগুড়ি দিয়ে স্বামীর দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলো রাহেলা। কিন্তু তখনও তার জন্য যে ভয়ানক কিছু অপেক্ষা করছে সেটা হয়তো তার ধারনায় ছিলো না। পেছনে থেকে তার পা টেনে উঠোনের শেষ কোনায় জবা গাছটির তলায় আনা হলো তাকে। তারপর ক্ষুধার্ত হিংস্র জানোয়ারের মতো ঝাপিয়ে পড়া হলো তার উপরে। চোখের সামনে সোনার সংসারের সবাই নিথর হয়ে পড়ে আছে। আর হায়েনার মতো একের পর এক অস্ত্রধারী পাকিস্তানী জানোয়ারগুলো চিড়ে চিড়ে খেতে লাগলো তাকে। তার গগনবিদারী চিৎকারে কেপে উঠলো আকাশ-বাতাস। সেই ভয়াবহ আর্তনাদে এগিয়ে আসার মতো কেউ ছিলোনা। কারন ততক্ষনে আশেপাশের সব বাড়িতেই ধ্বংসযজ্ঞ শুরু করে দিয়েছে হানাদারেরা। মূহুর্তেই রক্তে লাল হয়ে গেল গ্রামটি। রাহেলার মতোই আরও ছয়জনকে জ্ঞান হারানো অবস্থায় পাওয়া গেল পরের দিন। জ্ঞান ফেরার পর চোখ মেলে দু সন্তানকে পাশে দেখতে পেল রাহেলা। বিজয় আর রাশেদা। সেদিন গুলির শব্দে ভয়ে চৌকির নিচে লুকিয়ে পড়েছিলো তারা। আর বেরোয়নি। হানাদার বাহিনী চলে যাবার পর ঘর থেকে বেড়িয়ে মায়ের নগ্ন শরীরটা কাপড় দিয়ে ঢেকে দিয়েছিলো রাহেলার শেষ সম্বল এই নয়নের মনি দুজন। সেদিন থেকে তাদের আকড়ে ধরেই বেচেছিলো রাহেলা।
১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হবার পর গ্রামের নতুন চেয়ারম্যানের কল্যানে একটি চাকরী জুটে যায় তার। ইলিয়টগঞ্জ বাজারে একটি টেইলার্সে কাপড় সেলাইয়ের কাজ। অনেক কষ্ট করে বিজয় আর রাশেদাকে মানুষ করেছে রাহেলা। বুকের সব ব্যথা ভুলে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দুই সন্তানকে দু-বেলা দু মুঠো খাবার তুলে দিতে পেরেছে সে। তারপর বিজয় ঢাকায় চলে আসে একটি গার্মেন্টসে চাকরী পেয়ে। ধীরে ধীরে সুদিন ফিরছেলো রাহেলার। তবে বেশিদিনের জন্য নয়। কোনও এক রোজার ঈদে বাড়ি ফেরার পথে গাড়ি দুর্ঘটনায় চিরদিনের জন্য হারিয়ে যায় বিজয়। শুরু হয় রাহেলার জীবনের আরও এক ভয়াবহ অধ্যায় যা নতুন মোড় নেয়ে মাত্র এক বছরের মাথায় তার মেয়ে রাশেদার মৃত্যুতে। মাঝখানে কয়েকবার সরকারী লোকজন কিছু কাগজপত্র নিয়ে গ্রামে এসেছিলো। সাথে টিভি চ্যানেলের লোকজনও ছিলো। বীরাঙ্গনা মায়েদের নিয়ে অনেক রকম অনুষ্ঠান করতে দেখেছে রাহেলা। দু’বার তার কাছ থেকেও অনেক গল্প শুনে গেছে। সেই ভয়ানক স্মৃতিগুলো পুনরায় মনে করিয়ে দিয়ে ভরসা দিয়ে গেছে কিছু পাবার।জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্মান, বীরাঙ্গনার স্বীকৃতি। তবে কোনও স্বীকৃতি কিংবা কিছু পাবার আশায় বসে থাকে নি রাহেলা। জীবন সংগ্রামে এগিয়ে গিয়েছে সময়ের তালে তালে। টিকে আছে অনেক কষ্টে। তবে আর হয়তো বেশিদিন নয়। মনের জোর এখনো সেই ২৫ বছরের রাহেলার মতোই। কিন্তু শরীর যে আর সঙ্গ দিচ্ছেনা তার !!
৩.
প্রায় দুপুর হয়ে গেছে। এখনও ঠায় দাড়িয়ে আছেন রাহেলা বেগম। নাহ্। আজ আর সাহস হলোনা নিচে নামার। ধীরে ধীরে লাঠিতে ভর করে বাড়ির পথে এগিয়ে যাচ্ছেন রাহেলা বেগম। সোনাইয়ের মুখটা মনে পড়তেই কান্নার কালো মেঘে এসে ভিড় করলো তার চোখে। চোখ বুলাচ্ছে রাস্তার এপাশে-ওপাশে। যদি দু-একটা বোতল বা প্লাস্টিকের কিছু জুটে যায়!! কিন্তু নাহ্। কিছুই চোখে পড়ছেনা। এখন চোখেও খুব একটা কিছু দেখেনা। অস্পষ্ট। হঠাৎ একত্রিত কিছু কন্ঠের চিৎকারে পেছনে ফিরে তাকায় রাহেলা বেগম। গ্রামের কিশোর-কিশোরীর একটা দল মিছিল করতে করতে আসছে। তাদের হাতে লাল-সবুজের পতাকা। সকলের মুখে শ্লোগান,,
আমার দেশ তোমার দেশ,
বাংলাদেশ, বাংলাদেশ
স্বাধীন দেশ, স্বাধীন দেশ
বাংলাদেশ, বাংলাদেশ………
আজ ১৬ ডিসেম্বর। বিজয় দিবস। দেখতে দেখতে বিজয়ের ৪৪ বছর হয়ে গেছে। লাল সবুজের পতাকায় চোখ পড়তেই রাহেলা বেগমের চোখজোড়া আনন্দে অশ্রুশিক্ত হয়ে পড়লো। মনের অজান্তেই নিজেও ঠোট মেলাতে লাগলেন তাদের সাথে। অামার দেশ, তোমার দেশ- বাংলাদেশ, বাংলাদেশ......রাহেলা বেগমকে পেছনে ফেলে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে বিজয় মিছিল। কান্নাভেজা চোখে লাল-সবুজের পতাকার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে রাহেলা…....
[গল্পটি সম্পূর্ন কাল্পনিক। স্বাধীনতার দৃশ্যপটে লেখা এই গল্পের সাথে কোনও বীরাঙ্গনা মায়ের নাম বা ঘটনার মিল থাকলে আমাকে ক্ষমা করবেন। এই স্বাধীন বাংলাদেশে এখনও এমন অনেক রাহেলা রয়েছে যারা জীবনের সাথে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে যাচ্ছে। সেই সকল মায়েদের প্রতি রইলো গভীর শ্রদ্ধা। ভালো থাকুক বীরাঙ্গনারা। চিরজীবি হোক বাংলাদেশ]
গল্প : শঙ্খনীল দেব