হঠাৎ পাওয়া চিঠি
গতকাল থেকে মনটা বিশেষ ভাল নেই, ফেলে আসা এক বন্ধুর কথা বার বার মনে পড়ছে। বিগত দিনের স্মৃতি গুলো মনে করলে নিজেকে খুব অপরাধী মনে হয়। কেন জানিনা মনে হয় আমি জেন সবকিছুকে সহজ করে গ্রহণ করতে পারি না। হঠাৎ করে বন্ধুটির কথা মনে পড়ার একটা কারণ আছে। গতকালকে পুরানো ফাইল পত্র গোছাতে গোছাতে হঠাৎ একাটা চিঠি আমার নজরে আসে। চিঠিটা হাতে নিয়ে আমি দেখি, এটি আমার সব চেয়ে কাছের বন্ধুর কাছ থেকে পাওয়া একটি চিঠি। চিঠিটা মনযোগ সহকারে পড়লাম এবং পড়ে আমি আর আমার কান্না থামাতে পারলাম না। আমি আমার এই বন্ধুটাকে সব চেয়ে বেশি ভালবাসতাম, ও আমার প্রাণের বন্ধু ছিল। আজকে খুব বেশি অপরাধবোধ হচ্ছে সেদিনের সেই ছোট্ট ভুলের কথা মনে করে। আমি আর আমার বন্ধু, ছোটবেলায় একই স্কুলে পড়তাম। বলতে গেলে ছোটবেলা থেকেই আমদের বন্ধুত্ব। এটা ঠিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার সময়কার ঘটনা। আমাদের আরো চার-পাঁচ জন বন্ধুদের সাথে মনের অবচেতনে কি নিয়ে জানি একটু দুরত্ব তৈরি হয়েছিল। হয়তো কিছুই ছিল না, সবই ভুল ছিল। কিন্তু আমি বিষয়টা এতটা সিরিয়াসলি চিন্তা করিনি। আমার বন্ধু ছিল কঠোর ব্যক্তিত্ব সম্পূর্ণ এক জন মানুষ। সবকিছুকে সুন্দর মনের অনুভুতি দিয়ে দেখতো সে। তাইতো আমার মনে হয় সে খুব কষ্ট পেয়েছিল মনে মনে আর তাই তার মনের না বলা কথা গুলো, অনুভুতিগুলো, চিঠির মাধ্যমে প্রকাশ করেছিল, আর যা আমি আমার বন্ধুর শেষ স্মৃতি হিসেবে আজও সংরক্ষণ করছি।
আমার বন্ধুর লেখা সেই চেঠিখানা আমি এখানে উদ্ধৃত করলাম।
বন্ধু,
ক্ষত যত সহজে সৃষ্টি হয়, তত সহজে নিবারণ হয় না। আঘাত করলেই ক্ষত সৃষ্টি করা যায় কিন্তু এন্টিবায়োটিক দিলেই ক্ষত সেরে উঠে না। জানিনা কোন সে কারন, যা সবকিছু উলট-পালট করে দিল, জানিনা- তবে যতটুকু জানতে পেরেছি তা হল এ সবের জন্য দায়ি আমি নিজেই। বন্ধু, আমি মুখে যাই বলি আচারণে যাই প্রকাশ করি না কেন, আমার নিজের মনের কাছে প্রশ্ন করে জানি আমি কখনো হিসাব করে ভালবাসিনি - মনের থেকে কারো সাথে দূরত্ব রেখে চলিনি। আর সবচেয়ে ব্যর্থতা-যে, আমি সম্পর্কের দূরত্ব রেখে চলতে পারিনি, চলতে পারিনি হিসাব মিলিয়ে। কি ঘটেছে? কেন ঘটেছে? আজ কিছুই বলব না। হয়তো বলতেও পারব না; হয়তো কিছুই হয়নি। হয়তো সবই আমার মনের ভুল, সবই আমার অন্যায় আবদার; তবে কেন জানিনা মনের গভিরে একটা সূক্ষ্ম বেদনা জন্মে উঠেছে। জানিনা কেন? হয়তো আমার অসঙ্গত দাবির কারনে। তবুও কেন জানিনা একটা সূক্ষ্ম ব্যাথা। আমি নানা সময়ে নানা প্রমাণ পেয়েছি। নানা ঘটনাতেই জন্মেছে এই ব্যথার পাহাড়। কাউকে দোষারোপ করব না, কাউকেই না; সব দোষ আমার, কারন অপরাধতত্ত্ব বলে, “অপরাধ করলেই অপরাধী শাস্তি ভোগ করবে, বিচারক নয়, অপরাধই অপরাধীকে শাস্তি দেয়”।
হয়তো কোনবড়অপরাধ করেছি, তাই এই শাস্তি ভোগ। কষ্টের পাহাড় বিবেচনায় বুঝতে পারছি যে, আমার অনেক অপরাধ সঞ্চিত হয়েছে। চন্দন, দাদু একদিন কানাই এর সাথে বলেছিল যে, বাবা-মা এর পরে সে একজনকেই ভালবাসে, সে নাকি আমি। সেদিনের অনুভূতিটা আমি কাউকে বুঝাতে পারব না; বন্ধুরে, আমি যে আর কিছুই চাইনি, এই ভালবাসা টুকু অটুট রাখতে চেয়েছিলাম। হয়তো সবাই পেরেছে, আমি পারিনি, সেটা আমারই অযোগ্যতা। কানাইকে কেন জানি সেই প্রথম থেকেই আমার আপন বোন মনে হয়। এই সম্পর্কের বাঁধনের কোন ভিত্তি নেই, নেই কোন স্বীকৃতি তবু কেন জানি অনেককেই এই ভালবাসার বাঁধনে বেঁধে ফেলেছি, তাদের নাম ধরে বলব না, শুধু বলব তারা কেউ আমাকে কোন কষ্ট দেয়নি, বরং আমি আমার কথা দিয়ে আমার জিদ দিয়ে নানা কারনে তাদের কষ্টের কারণ হয়েছি। কথায় বলে না, “সুখে থাকতে ভূতে কিলায়” তো, আমাকে মনে হয় সেই সুখের ভূতে কিলাচ্ছে। সবার কাছে একটা অনুরোধ রাখব, জানিনা অন্যায় আবদার হবে কিনা? অতীত দিনের কথা গুলো একটু মনে করিস, একটু খোলা চোখে বিশ্লেষণ করিস। বন্ধুত্বে কখনও অগ্র-পশ্চাত ভাবিনি, ভাবিনি এ সম্পর্কেও ফরমালিটি মেনে চলতে হয়। হয়তো ভুল করেছি, ভাবিনি কারো কষ্টের কারণ হব। তাই নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে। বন্ধু, তোদের জড়িয়ে ধরে যদি কাঁদতে পারতাম, তবে বুকের পাথরটা হয়তো নামতো। আমি তো আর কিছুই চাইনি, চেয়েছিলাম আমরা এই কয়েকটা বন্ধু-বান্ধবী অভিন্ন সত্বার হয়ে বেঁচে থাকতে, কিন্তু তা ভেঙে গেল আমারই ভুলে, আমারই দোষে। এক বুক কষ্ট নিয়ে ঢাকা থেকে ফিরেছিলাম আবার বুক ভরা কষ্ট নিয়ে ফিরে যাচ্ছি। তোদের কারো কোন দোষ নেই, দোষ শুধু আমার, শুধু আমারই।
‘আমি তো চাই সব দুঃখ ভুলে যেতে, চেষ্টাও করেছি অনেক, হয়তো পারব, যদি সবাইকে পাই আবার আগের মতই;
শিশু মনে কাদা ছোড়াছুড়ি করেও, আবার একসাথে কাদাতে গড়াগড়ি দিতে, পারব গলা ধরাধরি করে বেড়াতে ততই”।