somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বসন্তের বর্ষন বেলা-১

১৫ ই মার্চ, ২০১৪ রাত ১০:১৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


কলিংবেল চাপার পরেও বেশ কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থাকতে হলো,কিছুটা বিরক্ত হলাম!আরেকবার চাপতে যাবো তখনই দেখি মা দরজা খুললেন। সালাম দিয়ে কিছু বলতে যেয়েও বলতে পারলাম না,তার আগেই মা যেনো ঝাড়ি দিয়ে বললেন,

-এতো বার বেল টেপার কি আছে?আমাদের কি কান নেই?বাহিরে কেবল তুই একাই থাকিস বলে মনে হয়!

আমি কপাল কুঁচকে তাকিয়ে রইলাম মায়ের দিকে,আজকাল কি হয়েছে মায়ের কে জানে,সারাক্ষনই কেমন রেগে রেগে থাকেন!কিছু একটা হলেই রাগ ঝাড়েন। মাঝে মাঝে মনে হয়েছে,সারাদিন বাসায় একা থাকেন বলেই হয়তো মেজাজ তেতো হয়ে থাকে,আবার মনে হয়েছে,বয়সও তো হয়েছে,তার উপর ডায়াবেটিকসের রোগী,মেজাজের ভারসাম্য একটু এলোমেলোই হয়তো তাই।

আমি আর কোন কথা না বলে,চুপচাপ হাত-মুখ ধুয়ে খেতে বসলাম। খাবারের মেনু দেখে আরেকবার দীর্ঘশ্বাস ফেললাম! আজকাল পরীক্ষা-ক্লাসের ঝামেলায় রান্না ঘরে ঢুকার সময় পাইনা,আর মা ও আগের মতো মজা করে রান্না করেন না,যেদিন যা ইচ্ছে হয় কোন রকম তৈরী করে রাখেন। মা এসে আমার পাশের চেয়ারে বসলেন,

-মিতুর সাথে কি তোর আজকাল কথা হয়েছে কোন?

আমি প্লেটে ডাল ঢালতে ঢালতে মাথা নাড়ালাম।

-ওর সাথে কথা হয় না তো এতো সময় কম্পিউটারে বসে কি করিস?

-কেন?কি হয়েছে?

-তুই আজই ওর সাথে কথা বলবি,মোবাইলে টাকা না থাকলে আমার কাছ থেকে টাকা নিয়ে যাবি।

আমি আগের মতোই চুপ করে রইলাম।মা উঠে চলে গেলেন। প্লেট ধুতে ধুতে চিন্তায় ডুব দিলাম! মা হঠাত করে মিতু আপুর সাথে কথা বলতে বলছেন কেন?!

সন্ধ্যায় ছাত্রী পড়িয়ে বাসায় ফিরে,কফির মগ নিয়ে পিসির সামনে বসলাম। স্যার এর লেকচার ডাউনলোড করা হয়নি,আর অনেকদিন হয়ে গেলো মেইল গুলোও চেক করা হয়নি। মেইল বক্সে মিতু'পুর একটা নতুন মেইল পেলাম।

মেইলটা এসেছে গত পরশু,প্রায় চার মাস পর। এই চারমাসে আমার মুপ্পু মানে মিতু'পুর সাথে কোন কথা বা যোগাযোগ হয়নি,ফেইসবুক,স্কাইপি কিংবা ইয়াহু কোথাও না। অথচ একটা সময় ছিলো,এই মিতু আপুই আমার সব ছিলো,আমার ভাই-বোন,বন্ধু,টিচার সব কিছু।

ছোট বেলায় আমার খুব মনে হতো,বাবা আমার চাইতে মুপ্পুকেই বেশি আদর করেন!আর আমি?সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতাম বাবাকে,এখনো বাসি। মুপ্পুর জন্মদিনের একদিন আগে ছিলো বাবার জন্মদিন,ওর প্রতি জন্মদিনে বাবা বলতেন,

-ইশরে মা,আল্লাহ তোকে কেন যে একদিন আগে পাঠালেন না!কি মজাই না হতো তাহলে,আমাদের বাপ-বেটির আনন্দের দিনটা একই হয়ে যেতো!

শুনে মুপ্পুও আফসোস করতো,আর আমি গাল ফুলাতাম! কিন্তু কে জানতো,বাবা চলে যাওয়ার সাথে সাথে মুপ্পুর জন্মদিনটাই আমাদের জন্য সবচেয়ে দুঃসহ হয়ে যাবে!বাপ-মেয়ে জন্ম তারিখ একই দিনে না হলেও,জন্ম-মৃত্যুর তারিখটা একই দিনে হয়েছিলো! এরপর সব কিছুই বদলে গিয়েছিলো,সব...

বাবার হঠাত চলে যাওয়ার পর সংসারের হাল ধরেছিলো আমার সদ্য কলেজ পেরোনো বোনটি,মা-আমি,বাসা ভাড়া,বাজার খরচ,আমার স্কুল মায়ের ঔষধ সব কিছুর জন্য রাত-দিন এক করে দিয়েছিলো মিতু আপু। যেখানে আত্নীয়-স্বজনরা বাবা চলে যাওয়া মাত্রই আপুর জন্য একের পর এক বিয়ের প্রস্তাব আনতে আনতে বিরক্ত হচ্ছিলো,সংসারের চিন্তা,বাবা চলে যাওয়ার কষ্টে মা প্রায় বিছানা নিয়েছিলো,সেখানে তখন রান্না থেকে শুরু করে বাজার-ইনকাম সব কিছু সামলাচ্ছিলো মিতু আপু।

মাস্টার্স শেষ করে আপুর বিয়ে হয় ওদের ভার্সিটিরই দু'ব্যাচ সিনিয়র মুহিন ভাইয়ের সাথে। তখন আমি ক্লাস নাইনে পড়ি। বিয়ের খরচ,শপিং,আত্নীয়-স্বজন আপ্যায়ন সব কিছুই এক হাতে সামলেছিলো মুপ্পু। বিয়ের দু'বছরের মাথায় উচ্চ শিক্ষার জন্য দু'জনেই চলে যায় সুদূর টোকিও তে। ব্যাস,সেই থেকে দীর্ঘ ৬বছর যাবত এমন একঘেয়ে,একই রুটিনের দিন কাটাচ্ছি আমি আর মা। প্রথম প্রথম আপুর সাথে নিয়মিতই যোগাযোগ ছিলো,বাট গত এক বছর যাবত আপুই আমাদের সাথে যোগাযোগ করা কমিয়ে দিয়েছে কেন জানি! ফোন করে না,এসএমএস এর তেমন রিপ্লাই দেয় না,মেইলও করে না।

সেখানে আজ এতো দিন পর আপুর মেইল দেখে আমার কেমন জানি ভয় ভয়ই লাগছে!

রাত থেকে আমি স্ট্যাচুর মতো বসে আছি,ওদিকে ঘড়ির কাঁটা সকাল ৮টার ঘর পেরুচ্ছে!আজ জরুরী একটা ক্লাসও আছে। কিন্তু আমার রেডি হওয়ার কোন লক্ষণ নেই!মা একবার আমার রুমের সামনে দিয়ে চলে গেলেন,কিছু বললেন না। আমি সারাদিন অনেকটা ওভাবেই রুমে পড়ে রইলাম। দেড়টার দিকে কলিংবেল বেজে উঠলো,অনেক ক্ষন পর মা গেট খুলে দিতেই দৌড়ে আমার রুমে আসল সোমা। আমার বহু পুরনো বান্ধবি। এসেই হৈ চৈ শুরু করলো,

-কিরে তুই আজ ক্লাসে গেলি না কেন?আজ স্যার নতুন শীট ও দিলো,আর তুই ফোন ধরিস না কেন?কত্ত বার ফোন দিয়েছি তোকে?কই তোর ফোন কই?

বলেই ও আমার ফোন খুঁজতে লাগল। আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপচাপ ওয়াশরুমে ঢুকলাম। হাত-মুখ ধুয়ে এসে দেখি সোমা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে,আমি কিছু বলছিনা দেখে ও বলল,

-নিতু,এতো সিরিয়াস ঝামেলা আর তুই আমাকে একটা ম্যাসেজও করলি না?করলে তো আমি আরো আগেই চলে আসতাম।

আমি তোয়ালেতে মুখ মুছতে মুছতে বললাম,

-আমি জানলাম কাল রাতে,আর মা জানতো গত সাত দিন ধরেই!

-কি করবি?কিছু ভেবেছিস?

আমি স্বাভাবিক কন্ঠেই বললাম,

-মুপ্পুর সাথে কথা বলতে হবে,আগে জানতে হবে ও কি চায়?ও যদি বলে আমি স্বেচ্ছায় তাই করবো,আর যদি না করে তাহলে বিষ খাবো তবুও এই প্রস্তাবে রাজী হবো না।

সোমা আর কিছু বলল না। কিছুক্ষন পর আবার বলল,

-তুই খুব শকড হয়েছিস তাই না?

আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম,

-আমার জায়গায় না থাকলে বুঝতে পারবি না!আসলে আমাদের দু'বোনের জীবনটাই এমনরে!জীবনে যা কিছু আনন্দ-ভালোবাসা পেয়েছি তা মনে হয় ঋন হিসেবেই পেয়েছিলাম,আর তাই যা পেয়েছিলাম,তারচেয়ে দ্বিগুণ কষ্ট হাসিমুখে মেনে নিয়ে সুখের ঋন শোধ করতে হচ্ছে আমাদেরকে,বাবা চলে যাওয়ার পর মুপ্পু করেছিলো,তারপর কিছুদিন যাও সুখ পেয়েছিলো এখন আবার তার ঋন শোধ করছে,এবার আমাকেও করতে হবে হয়তো!

বলতে বলতে কন্ঠ ধরে আসলো আমার!হাতে ধরা তোয়ালেটার উপর ফোঁটায় ফোঁটায় অশ্রু পড়তে লাগল।

চলবে......
৫টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শ্রমিক সংঘ অটুট থাকুক

লিখেছেন হীসান হক, ০১ লা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৮

আপনারা যখন কাব্য চর্চায় ব্যস্ত
অধিক নিরস একটি বিষয় শান্তি ও যুদ্ধ নিয়ে
আমি তখন নিরেট অলস ব্যক্তি মেধাহীনতা নিয়ে
মে দিবসের কবিতা লিখি।

“শ্রমিকের জয় হোক, শ্রমিক ঐক্য অটুট থাকুক
দুনিয়ার মজদুর, এক হও,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কিভাবে বুঝবেন ভুল নারীর পিছনে জীবন নষ্ট করছেন? - ফ্রি এটেনশন ও বেটা অরবিটাল এর আসল রহস্য

লিখেছেন সাজ্জাদ হোসেন বাংলাদেশ, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪

ফ্রি এটেনশন না দেয়া এবং বেটা অরবিটার


(ভার্সিটির দ্বিতীয়-চতুর্থ বর্ষের ছেলেরা যেসব প্রবলেম নিয়ে টেক্সট দেয়, তার মধ্যে এই সমস্যা খুব বেশী থাকে। গত বছর থেকে এখন পর্যন্ত কমসে কম... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতিদিন একটি করে গল্প তৈরি হয়-৩৭

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৫১




ছবি-মেয়ে ও পাশের জন আমার ভাই এর ছোট ছেলে। আমার মেয়ে যেখাবে যাবে যা করবে ভাইপোরও তাই করতে হবে।


এখন সবখানে শুধু গাছ নিয়ে আলোচনা। ট্রেনিং আসছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

একাত্তরের এই দিনে

লিখেছেন প্রামানিক, ০১ লা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৬


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

আজ মে মাসের এক তারিখ অর্থাৎ মে দিবস। ১৯৭১ সালের মে মাসের এই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে। এই দিনে আমার গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে

লিখেছেন মিশু মিলন, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ৯:২০



তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×