somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

চলে যাওয়া,চলে যায়!

১০ ই জুন, ২০১৪ সন্ধ্যা ৬:২৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


আল্লাহ কতো ভাবে মানুষের সময় গুলো কে বদলে দেন!! অথচ এই সময় গুলো নিয়ে,আমরা কতো রকমের পরিকল্পনাই না করে থাকি!কিন্তু কেই কি আন্দাজ করতে পারি?কখন কিভাবে সব বদলে যাবে…
ছোট বেলায় আমার পুতুল খেলতে ভালো লাগতো না খুব,স্পেশালি পুতুল বিয়ে! আমার সেন্সটা ছিলো,
‘আমার পুতুল আমার কাছেই থাকবে,আরেকজন কে দিবো ক্যান?ও যদি আমার পুতুলটাকে হারায় ফেলে?!’ তাই পুতুল সাজিয়ে রাখার শখ ছিলো,ঠিক বইয়ের ছবির মতো। কিন্তু বড় হওয়ার পর বুঝেছি,পুতুল আসলে চিরদিন নিজের কাছে রেখে দেয়ার মতো জিনিস না,অন্য কেউ সেটা হারিয়ে ফেলুক কি ভেঙ্গে ফেলুক,পুতুলকে চিরদিন নিজের কাছে রাখা যায় না! আমার নানু খুব সৌখিন মানুষ, ছিলেন বলতে চাই না,আমাকে ভালোবাসার-আদর করার মানুষ গুলো আমার জন্য সব সময়ই আছেন। নানুর প্রথম নাতনী ছিলাম আমি। শুধু তাই না, আমার মা তাদের মামা-খালাদের প্রথম ভাগ্নি ছিলেন,আর সেদিক থেকেও ছিলাম প্রথম নাতনী,জীবনে তাই বড় হবার সাজা,মজা দুটোই পেয়েছি। আমি শুধুমাত্র আমার নানুদের মেয়েদের খেলনা গুলোই পেয়েছিলাম তা না,বরং তাদের ছোট বেলার কয়েকটা পুতুলও আমাকে দিয়েছিলেন। আমি সেগুলো অনেক বছর যত্ন করে রেখেছিলাম,খেলতাম না ওগুলো দিয়ে,যদি নষ্ট হয়ে যায় এই ভয়ে!
আজ অনেক দিন পর আমার খুব ইচ্ছে করছে,আমার ওই মানুষ গুলোর কাছে যেয়ে,আরো ক’টা পুতুল আবদার করতে! কে জানে,হয়তো পুতুল বানিয়ে দেয়ার উসিলায় আল্লাহ মানুষ গুলোকে আরো ক’টা দিন আমার সাথে থাকার সুযোগ দিবেন!আরো ক’টা দিন আমার আবদারের যন্ত্রণায় বিরক্ত হয়ে তাদেরকে বলা সুযোগ দিবেন,
‘বুবুরে বড় হবি কবে?কবে বুঝ-বুদ্ধি হবেরে?তুই বড় না?তুই যদি বুঝিস,দেখবি বাকী গুলোও বুঝবে,মায়ের কষ্ট কম হবে!নিজের ভালো বুঝবি যেদিন,দেখবি সব কাজ ঠিক মতো হবে!’
কিংবা শাহানা মামীর মতো বলবে,
-মেয়ের মা আল্লাহ বানায় নাই বলে কি,তুই মেয়ের আদর সব নিয়ে যাবি?!

এই এক বছরের মধ্যে পরিবার থেকে ৩ জন মুরুব্বী কে হারালাম!বিশ্বাসই হয় না এখনো! মনে হয়,আছেন উনারা এখনো,এই তো ও বাসায় গেলেই দেখতে পাবো বুঝি!আমার ঈদের সালামী,রকমারী পিঠা,আমসত্ত্ব-আচার,ঠিক মতো না খাওয়ার জন্য বকা,পরীক্ষার জন্য দোয়া সবই আগের মতোই পাবো!
আমি সব সময় বলি,আমি ভাগ্যবতী যে আমি তিন তিনটা মা পেয়েছি। আমার মা,মায়ের মা,নানুর মা। মজা করে বলতাম,আগের দিনে বাচ্চা বয়সে বিয়ে দেয়ার এডভান্টেজ স্বরুপ আল্লাহ বুঝি,আমাকে তিন তিনটা মায়ের আদর পাওয়ার সৌভাগ্য দিয়েছিলেন! অনার্সে পড়া অবস্থায় বিয়ে হয়েছিলো আম্মুর,আব্বু তখন ছাত্র জীবন শেষ করি করি অবস্থায়,ছোট একটা চাকরী আর ভাই-বোন,সংসারের দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে যেনো অথৈ সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছিলেন। আর আম্মুর তখন পড়াশুনা,সংসারের প্রয়োজনে চাকরী,দায়িত্ব সব মিলিয়ে আরো করুন অবস্থা! সেই সময় আমার এই মায়েরা আমাকে যে পরিমাণ আদর-শাসন,যত্নের সাথে পালতেন,যে দিন শেষ আমার আর আব্বুর সাথে বাসায় ফেরার ইচ্ছে হতো না। আমার স্কুল কেন নানু বাসার কাছে ছিলো না,কেনো আমাকে মিরপুর থেকে প্রতিদিন নানু বাসায় কেউ নিয়ে আসে না,সেই আফসোসে স্কুলে বসে বালিকা বেলায় খাতায় বড় বড় অক্ষরে লিখে কূল পেতাম না,
‘আমাকে কেউ আদর করে না,শুধু নানু আর বড় আম্মু আদর করে!’
বড় হয়ে নিজের সেই সময়কার কীর্তি গুলো ভেবে লজ্জা পেয়ে হাসতাম,কিন্তু এখন আর হাঁসি আসে না!এখন চোখ ভিজে উঠে শুধু!বুকটা খাঁ খাঁ করে উঠে… আমার সেই মানুষ গুলো কই এখন?আমার সেই বেণী গেঁথে দেয়ার মানুষ গুলো,ফুল তোলা ফ্রক বানিয়ে দেয়ার মানুষ গুলোকে আমি তো এখন আর ডাকলেও পাই না!এখনতো আর খাওয়া নিয়ে হাজারো নাক করলেও কেউ বকা দিয়ে ভাতের লোকমা মুখের সামনে এনে ধরে বলে না,
-নে ধর,বুবু মাখায় দিছি!বেত্তুমিজ!না খেয়ে খেয়ে কি হইতেছিস দিন দিন খবর আছে?

২দিন আগে এলাকার এক চাচা মারা গেলেন,মারা যাওয়ার আগের রাতে ছেলেকে বলে গিয়েছিলেন,”বাবা,আমি যে তোমাকে মাঝে মাঝে বকা দেই,তুমি কি কষ্ট পাও?কষ্ট পেয়ো না কিন্তু!আমি ভালোর জন্যই বকি!’ সেই বাবা,সকালে নাশতার টেবিলে ‘ভালো লাগছেনা’বলতে বলতে চলে গেলেন চিরদিনের জন্য! কবরস্থানের পাশে বাড়ি করেছিলেন,আব্বু জিজ্ঞেস করেছিলেন একবার,
-কি ভাই?বাড়ি যে করলেন একদম কবরস্থানের গা ঘেঁষে?
হেসে বলেছিলেন,
-একটু আগায়ে থাকলামরে ভাই!কষ্ট কম হয় যাতে!যেতে তো হবে ঐখানেই তাই না?
উনি ঠিকই বুঝেছিলেন হয়তো,যে বড় তিন ভাই,বৃদ্ধ শ্বশুড়,বাবা কে রেখে উনাকেই আগে যেতে হবে!তাই সবার যাতে কষ্ট কম হয় সেই জন্য নিজের পার্মানেন্ট বাড়িটার কথা আগে ভেবেছিলেন!

পরিবারের বড় সন্তান হিসেবে,আমার মুরুব্বীদের সাথে সম্পর্কটা খুব বেশি,উনাদের ভালোবাসা,আদর পেয়েছি বেশি,উনাদের সাথের স্মৃতিও অন্য ভাই-বোনদের তুলনায় অনেক বেশি,এতো বেশি যে,এখন এই স্মৃতি গুলোই আমার জন্য সবচেয়ে বেশি কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে! এখনো আমি আমার সামনের কোন দিনের পরিকল্পনা করতে গেলে,উনাদেরকে ছাড়া,উনাদের দোয়া ছাড়া ভাবতে পারি না!আমি পরীক্ষা দিতে যাবো আর আমার মাথায় হাত দিয়ে কেউ দোয়া পড়ে ফুঁ দিয়ে দিবেনা,আমের সিজন চলে যাচ্ছে,কেউ আমার জন্য আম সত্ত্ব বানিয়ে পাঠাবে না আর, এই সত্যি গুলোর সাথে আমি এখনো অভ্যস্থ হতে পারছি না!
আমি এখনো এই বাস্তবতা গুলোর অভ্যস্থ হতে পারিনি,যে একে একে আমার নানুবুবুদের মধ্যে থেকে আজ সকালেও আমি একজন কে বিদায় দিয়ে এসেছি! যখন বাসার সবাই আমরা ধীরে ধীরে প্রস্তুতি নিচ্ছি,হসপিটাল থেকে ফেরত আসা,আমার নানু চলে যাবেন ভেবে তখনই হুট করে কাল রাতে চলে গেলেন আমার আরেক নানু! (আম্মুর সেঝ খালা) খুব যে অসূস্থ ছিলেন তা না,অন্তত বড় বোনের মতো বিছানায় সেন্সলেস অবস্থায় শুয়ে থাকার মতো তো না ই। কিন্তু সেই মানুষটাই যে আগে চলে যাবেন,কে ভেবেছিল?!
চলে গেলেন মানুষটা! ছেলে-মেয়েরা কাঁদে,মা বুঝি আমাদের সাথে রাগ করে চলে গেলেন!তাই সেবা করার সুযোগও পেলাম না! ভাই-বোনরা কাঁদেন,বছরের শুরুতে মা চলে গেলেন,আর সাথে সাথে দেখি একে একে সব ভাই-বোনেরাই চলে যাচ্ছে!

কিন্তু এই চলে যাওয়াটাই যে সত্য,সেটা মেনে নিতে সবারই খুব কষ্ট!কেউ হুট করে চলে যায়,কেউ অনেকদিন সময় নিয়ে আপনজনদেরকে প্রস্তুত করে যায়,কিন্তু চলে যায়। সবাইকেই যেতে হয়। তাই আজকাল এই ‘চলে যাওয়া’ শব্দটাই বেশি কানে বাজে! আর মনের ভেতর শুধু আনচান করে,এরপর কে যাবে????!!!
আজকাল প্রিয় মুখ গুলোর দিকে তাকাতে ভয় করে,মনে হয়,বুঝি আর সামলাতে পারবো না নিজেকে!মুখ দেখলেই বোধহয় মায়া বেড়ে যাবে!কিন্তু কাউকেই তো আটকে রাখতে পারবো না। ছেড়ে তো চলে যাবে সবাই…এমনকি আমিও! মাঝে মাঝে মনে হয়,চারপাশে কতো মানুষ আছে,যারা নাকি কোনদিন,দাদী-দাদা,নানা-নানি,মুরুব্বীদের আদর কি জিনিস পাই নাই!এমন হলেই বুঝি ভালো হতো! অন্তত উনাদের চলে যাওয়ার কষ্টটা থেকে বুঝি রেহাই পেতাম!
বাদ ফজর আব্বু আমাদেরকে স্বান্তনা দেবার জন্য সূরা ইমরান এর ওই আয়াতটা শোনাচ্ছিলেন,
”অবশেষে প্রত্যেক ব্যক্তিকে মরতে হবে এবং তোমরা সবাই কিয়ামতের দিন নিজেদের পূর্ণ প্রতিদান লাভ করবে। একমাত্র সেই ব্যক্তিই সফলকাম হবে, যে সেখানে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা পাবে এবং যাকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে। আর এ দুনিয়াটা তো নিছক একটা বাহ্যিক প্রতারণার বস্তু ছাড়া আর কিছুই নয়। ” [সূরা আল ইমরানঃ ১৮৫]
আর বলছিলেন,
‘অনেক তো একসাথে থাকা হলো আমাদের সবার,এবার একলা থাকার অভ্যাস শুরু করো সবাই!কারণ,কষ্টের পরেই তো আল্লাহ সুখ দিবেন,এরপর যেনো আল্লাহ সবাইকে আবার একসাথে,পরম সুখের জান্নাতে থাকার তাওফিক দেন তাই।এই দুনিয়াটা কিছু নারে মা,খালি ক’টা দিন থাকার জায়গা,আসল বাড়ি তো ঐটা,চেষ্টা করো যেনো ঐ বাড়িটাতে আল্লাহ একসাথে থাকার যোগ্যতা সবাইকে দেন!’ আমীন।
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

খুলনায় বসবাসরত কোন ব্লগার আছেন?

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:৩২

খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় তথা কুয়েট-এ অধ্যয়নরত কিংবা ঐ এলাকায় বসবাসরত কোন ব্লগার কি সামুতে আছেন? একটি দরিদ্র পরিবারকে সহযোগীতার জন্য মূলত কিছু তথ্য প্রয়োজন।

পরিবারটির কর্তা ব্যক্তি পেশায় একজন ভ্যান চালক... ...বাকিটুকু পড়ুন

একমাত্র আল্লাহর ইবাদত হবে আল্লাহ, রাসূল (সা.) ও আমিরের ইতায়াতে ওলামা তরিকায়

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৬:১০



সূরাঃ ১ ফাতিহা, ৪ নং আয়াতের অনুবাদ-
৪। আমরা আপনার ইবাদত করি এবং আপনার কাছে সাহায্য চাই।

সূরাঃ ৪ নিসার ৫৯ নং আয়াতের অনুবাদ-
৫৯। হে মুমিনগণ! যদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

×