somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গার্হস্থ্য নীতি (গল্প)

২৭ শে জানুয়ারি, ২০১৪ সকাল ৭:৩৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

গার্হস্থ্য নীতি

১.
পুরো বাড়ি-ঘরময় চুনের কাঁচা গন্ধ। আমার মাথা ঘুরে ওঠে। কোনো গন্ধই সহ্য হয় না আমার। আর এ তো চুনের গন্ধ! এই রোগের শুরু বছর দেড়েক আগে। প্রথম দিকে তো গন্ধযুক্ত জিনিসের গন্ধ সহ্য হত না। কিন্তু ক্রমাগত বেড়েই চলছে এই অদ্ভুত গন্ধরোগ। এখনতো গৃহস্থালি গন্ধহীন জিনিসের গন্ধময়তাও আমাকে প্রচণ্ডভাবে আক্রান্ত করে। সেই সাথে খাবার-দাবার আরও অসহনীয় হয়ে উঠছে। কখনো কখনো ডায়নিং টেবিল থেকে ছুটে গিয়ে বমি করে আসতে হয়। মাছের ঝোল খেতে গেলে কাঁচা মাছের গন্ধ পাই। মুরগির তরকারি থেকে পালকের নোংরা গন্ধ নাকে উঠে আসে। নিহাল প্রথম দিকে চিন্তায় পড়ে গিয়েছিল। প্রেগনেন্সির স্ট্রিপ টেস্ট করেছে বেশ কয়েকবার। এখন ও আমার সাথে খেতেই বসে না। শুধু খাওয়া না, দাঁত ব্রাশ করাও আমার জন্য কঠিন হয়ে পড়ছে। প্রায় দিনই দাঁত ব্রাশ করতে করতে বেসিনে হড়হড় করে বমি করে দেই। সুগন্ধী সাবান, তেল, ক্রিম গায়ে মাখতে পারি না। শরীরের ত্বক কেমন খসখসে হয়ে গেছে। ওজন কমেছে এগারো কেজি। তবু খাচ্ছি-দাচ্ছি। শুচ্ছি। দিনও কেটে যাচ্ছে। নিহালও দিন দিন আমার গন্ধরোগে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে।

যদিও নিহাল জানে যে আমার গন্ধ সহ্য হয় না। তবু এসময় বাসায় চুন করানো শুরু করেছে। এই বছর না করালে কী এমন আসত-যেত? অনেক কিছুই আসত-যেত। নিয়মের ব্যত্যয় ঘটানো নিহালের পছন্দ না। যেমন আজকাল সবাই ডিস্টেম্পার করায় আর নিহাল নিয়ম করে বছর বছর চুনকাম করায়। ঘরের দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়ালেই সাদা চুন জামা-কাপড়ে লেগে যায়। হাত দিয়ে ছুঁতেই আঙুলে উঠে আসে সাদা রঙ। সেদিন বড় বুবু বেড়াতে এসে বসার ঘরের শোকেজের পাশের দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়াতেই ওর যশোর স্টিচের নকশাদার কালো শাড়িতে সাদা সাদা ছোপ লেগে গেল। বুবুর সে কী বিরক্তি!
-তোর জামাই ফকির নাকি রে? কয় টাকা লাগেরে ডিস্টেম্পার করতে? বাড়ি করবি তো জীবনে একবারই। ফ্লোরে টাইলসও দেয় নাই। সিমেন্টের মাটি ভাঙছে! চিপ্পুর চিপ্পু!

বুবুর ব্যবহৃত অর্থহীন শব্দ চিপ্পুর চিপ্পু আমার কাছে কোনো অর্থ বহন করে না। তার কারণটা সঙ্গত। উত্তরা আর বনশ্রীতে দু’টো ফ্লাটের মালিক হওয়া সত্বেও দুলাভাইকে ঘুমোবার আগে অন্তত পাঁচবার এই গালি খেয়ে শুতে হয়। আর আমার ব্যবসায়ী স্বামী যে কিনা চেপে চেপে জীবনের রসদ খরচ করে সে তো বুবুর কাছে এই গালি শুনবেই। নিহাল যেমন গালি শোনে তেমন দেয়ও। দুলাভাইয়ের ঠিকাদারীর ফাঁকফোঁকড় দিয়ে কীভাবে টাকা আসে যায় সেসব গল্প নিহালের জানা। যেগুলো শোনাতে গিয়ে অহেতুক কিছু গালি মুখ দিয়ে বের করতে সেও কোনো কার্পণ্য করে না।

আজ সাথীর মাকে সকাল সকাল ছেড়ে দিয়েছি। রঙের ঝামেলার জন্য নিহাল বাইরে থেকে প্যাকেট বিরিয়ানি এনেছে। এক প্যাকেটই এনেছে। নিহাল জানে এসব আমি খেতে পারি না। আমি ভেবেছি রুটি চিনি দিয়ে খেয়ে নিব। চিড়াও খাওয়া যায়। আজ খাবার দেবার তাড়া নেই। নিহাল খেয়ে নিয়েছে। সাথীর মাকে বিকালে আসতে বলেছি। রঙ করা শেষ হবার পরেই ঘরে আসল কাজ শুরু। আমার সাজানো গোছানো সংসার আজ এলোমেলো। প্রতি ঘরভর্তি আবর্জনার স্তূপ। সকাল থেকে এসবের মধ্যে থেকে থেকে নিজেকেই এখন আমার আবর্জনা বলে মনে হচ্ছে। দুই ইউনিটের দোতলা বাড়িতে একটা ফ্লাটে আমরা থাকি। আর তিনটাতে তিনজন ভাড়াটিয়া। ধাপে ধাপে সব ফ্লাটেই রঙ করা হবে। নিহালের দু’দিন বাইরে কাজ নেই তাই আমাদেরটা দিয়েই শুরু।

একজন রঙমিস্ত্রী চুনের বালতি হাতে করে শোবার ঘরে ঢুকে পড়েছে। নিহাল খাটে বসে পায়ের নখ কাটছে। আমাকে একবার কেটে দিতে বলে নিজেই কাটা শুরু করেছে। আমি হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছি। নতুবা আরও ক্ষানিকক্ষণ ওর নখের কুৎসিত কানি পচা গন্ধ সহ্য করতে হত। তার চেয়ে ভাল আমি পাশে বসে দেখছি ওর আগাছা ছাঁটা। আগাছা ছাঁটলে জঙ্গল আর কতদিন পরিষ্কার থাকে? আবারও আগাছা বাড়ে। আমি নিরাপদ দূরত্বে বসেছি তবু নিহালের শরীরের ঘামের গন্ধ আমার নাকের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে। আমি উঠবার প্রস্তুতি নিচ্ছি তখনই আবার চুনের গন্ধে আমার গা গুলিয়ে আসে।

-ওই ব্যাটা আওয়াজ নাই গলায়? শোয়ার ঘরে আওয়াজ না দিয়া ঢুকছোস! সম্বুন্ধির পুত, ঘরে ম্যায়া ছাওয়াল আছে না?
দরজার সামনে দাঁড়ানো মিস্ত্রীকে রঙ-চুন মাখা মুখের রঙের আড়ালে একটুও বিব্রত মনে হয় না। বরং ওর কদর্য কন্ঠ নিহালের মুখে সিরিশ কাগজ ঘষে দেয়,
-বইয়া থাকুমনি। নয় জাইগ্যা। আপনে বউ লইয়া হোতান!
উল্টো ঝাড়ি খেয়ে নিহাল কেঁচোর মত গর্তে ঢুকে যায়। আমার বেশ মজা লাগে। বাহবা দিতে হয় ব্যাটাকে। নিহালের মুখের সাথে পাল্লা দেবার মত লোক বটে! আমার হাসিমুখ দেখে নিহালের রাগ স্থান পরিবর্তন করে,
-বইসা রইছ ক্যান? সব ফার্নিচার ঢাকন লাগব তো? না সঙ দেখলেই চলব?

রঙমিস্ত্রীর বালতি থেকে চুনের উৎকট গন্ধ আসছে। সেই গন্ধে প্রেগনেন্ট মহিলার মত আমার মাথা ঘুরতে থাকে। খারাপ লাগা এড়াতে আমি হাত চালু করি। খাটের ওপর পুরনো চাদর পেতে দেই। আস্তে আস্তে ড্রেসিং টেবিল, ওয়ারড্রোব, টিভি-ট্রলি চাদর, ওড়না দিয়ে ঢাকতে থাকি। যেভাবে প্রতিদিন নিজেকে পরিপাটি ঢেকে রাখি গার্হস্থ্য নীতির আড়ালে।

২.
আমার ডান হাতের মুঠোতে একগাদা ঘুমের ওষুধ। রিভোট্রিল, সেডিল। সিক্সটি, টুয়েন্টি ফাইভ এমজি। ঠিক ক’টা ওষুধ আছে আমি বলতে পারছি না। মা-বাবার ওষুধের কৌটা থেকে হঠাৎ গায়েব হওয়া ওষুধ এগুলো। বাবা-মা থাকে উত্তর বাড্ডা। যখনই ওখানে যাই আমার একমাত্র অনুমোদিত বেড়ানোর স্থানের সদ্ব্যবহার করি। ওষুধগুলো যোগাড় করতে আমার খানিকটা সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়েছে বলে সংখ্যার দিকটা গুনে দেখার সুযোগ হয়নি। গোটা ত্রিশেক হবে। কমও হতে পারে। খুব বেশিদিন হয়নি এগুলো জমানো শুরু করেছি। এক বছর হবে হয়তো। গন্ধরোগের তীব্রতার শুরু যখন থেকে তখন থেকেই বোধহয়। বাবার ওখানে বেড়াতে গেলেই ছুতো করে ওষুধের বাকসোটা আমার ধরা চাই।

ওষুধগুলোর আকার বেশ ছোট। তাই এক মুঠোতে দিব্যি এটে গেছে। আমার ঘরের দেয়াল আলমারির একেবারে নিচে যেই গোপন কুঠুরি আছে সেটার মধ্যে একটা কালো রংয়ের প্লাস্টিকের কৌটোতে ওষুধগুলো জমিয়েছি। এটাই আমার সংগ্রহশালা। ঘুমের ওষুধের সংগ্রহশালা। এক সময় খুব ঘুমাতাম। বিয়ের আগে পরে সন্ধ্যে লাগতে না লাগতেই দু’চোখের পাতা লেগে আসতে চাইত। আর ঘুম ফুরাতে না ফুরাতে রাত্রি ফুরিয়ে যেত। আর এখন আমি ঘুমের ওষুধ জমাচ্ছি। এটা একটা পিলে চমকানোর মত ঘটনা। বাবা-মার কানে গেলে তাদের ব্লাড-প্রেসার এমন হাই হবে, হয়তো আর হাই পাওয়ারের ঘুমের ওষুধ লাগবেই না তাদের!

মজার ব্যাপার হচ্ছে, আমি একগাদা ঘুমের ওষুধ জমিয়েছি আর রাজ্যের মানুষ তাদের সংগ্রহশালায় জমায় দেশ-বিদেশের ডাকটিকেট, মুদ্রা, কলম, চাবির রিং, অর্কিড, ক্যাকটাস, বনসাই। আরও কত অদ্ভুত জিনিস যে মানুষ জমাতে পারে! আমার ছোট চাচার ছেলে অপু কোক, সেভেন আপ, পেপসির খালি প্লাস্টিকের বোতল দিয়ে তার পড়ার ঘর ভরে ফেলেছে। আর তনুশ্রীর বড় চাচা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সয়েল সায়েন্স ডির্পাটমেন্টের টিচার, তারও একটা মজার শখ আছে। তিনি সংগ্রহ করেন পাথর। ইয়া বড় সেন্টার টেবিল সাইজের পাথর থেকে মশুর ডালের সাইজ, লাল, সবুজ, হলুদ, কমলা কত না রঙ বেরঙয়ের পাথর যে ইরফান চাচার কাছে আছে!

ভার্সিটি থেকে ফেরার পথে তনুশ্রী একদিন তার মগবাজারের সংগ্রহশালায় নিয়ে গিয়েছিল। বিরাট হল রুমের ছোট-বড় টেবিলের ওপর নানান রঙের নানান সাইজের পাথর দেখতে দেখতে আমার মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। শখ! আমারও তো গোপন শখ আছে! ইস্ কিসের সাথে কিসের তুলনা করছি। এসব সংগ্রহের শখ তো সাধনা। আমার তো কোনো শখও, নেই সাধনাও। ওষুধগুলো জমাতে তো আর আমাকে সাধনা করতে হয়নি। তবে কষ্ট করতে হয়েছে বৈকি।

নিহালের নাক ডাকার আওয়াজে রাতের নীরবতা ভেঙে ভেঙে যাচ্ছে। আমার ঘুম আসছে না। ওষুধগুলো আগের জায়গায় রেখে আমি বিছানায় যাই। ডিমলাইটের আলোয় রাতের রহস্যময়তা ছিন্ন করে নিহাল নাক ডেকেই চলে। নিহালের গা থেকে ওষুধের গন্ধ আসছে। নিহাল ডেন্টাল কেয়ার সেন্টারে পার্টস সরবরাহের ব্যবসা করে। চীন থেকে চেয়ার বা অন্যান্য সামগ্রী এনে ঢাকাসহ অনেক জেলার ডেন্টাল কেয়ার সেন্টারগুলোতে দেয়। বেশ লাভজনক ব্যবসা। বছরে বেশ কয়েকবার চীন থেকে ঘুরে আসে। ঢাকা শহরের বহু দাঁতের ডাক্তারের সাথে ওর সখ্যতা। সেই সাথে হাসপাতালের গন্ধের সখ্যতা ওর গায়ের সাথে।

আমি কাঁথার নিচে ঢুকে যেতেই নিহালের পায়ের আঙুল আমার পায়ের পাতার ওপর উদ্দেশ্যহীন সফর করতে থাকে। ওর আঙুলের উদ্দেশ্যহীন বিচরণের উদ্দেশ্য আমি ঠিকই বুঝে যাই। তাই নিজেকে সমর্পণ করার ইচ্ছে-অনিচ্ছে মাপবার সুযোগ আমি নেই না। কারণ আমি ভাল করেই জানি নিহাল সংসারে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথায় বিশ্বাস করে। খুব দ্রুত ঝানু ব্যবসায়ীর মত আঙুলের খোপে আঙুল পুরে শরীরের খোপে শরীর নিয়ে যায় নিহাল।

শরীরের বর্জ্য এর গন্ধে আমি রোজকার মত বাথরুমের দিকে ছুটে যাই। বমি করে হালকা হই। কলের শীতল পানিতে হাত বরফ হয়ে যাচ্ছে। বরফ হাত গালে ছোঁয়াই। তারপর চোখে-মুখে পানি দিয়ে বিছানায় ফিরে আসি। নিহাল আবার ঘুমিয়ে পড়েছে। আমার তিন বছরের সংসার জীবনের শেষ দেড় বছর ধরে ঘুমের সব রকম-সকম ভুলে বসেছি আমি। সকালের আয়েসী ঘুম, ভাত ঘুম, রাতের অবসন্নতার ঘুম। রাতের পর রাত ঘুমের নিরবচ্ছিন্নতা উপভোগ করা আর হয়ে ওঠে না আমার।

কোনো এক অজাত ভ্রুণের কান্না রাতভর তাড়া করে বেড়ায় আমাকে। ক্ষণে ক্ষণে ঘুমন্ত নিহালকে আমি আঁকড়ে ধরি। নিহালের প্রতিক্রিয়াহীনতা আমাকে আরও ঘুমহীন করে তোলে। আমার রাত জাগার কারণ বোঝার ইচ্ছে নিহালের নেই। আমি ঠিকই বুঝতে পারি অখ্যাত এক ক্লিনিক থেকে সাফ-সুতরো হয়ে আসার পর থেকেই ঘুমহীনতার সাথে গন্ধময়তা আমাকে ক্রমশ কাবু করে ফেলছে। অথচ সেই সময়ে নিজের জমিতে ইট গাঁথবার উত্তেজনায় ব্যস্ত নিহালের ঘুম কী গাঢ়ই না ছিল!

ঘুমহীন আমি সংসারের যাবতীয় উপকরণের গন্ধময়তার মাঝেও আশ্চর্যজনকভাবে টিকে থাকি। আমার গন্ধরোগের পর থেকে সাথীর মা কাটা-বাছা আর রান্নার কাজ করে। সংসারে কাজের অভাব নেই। ছন্দেরও অভাব নেই। শুধু সেই ছন্দ তার ইচ্ছেমত আমাকে নাচায়। হঠাৎ একদিন নাচতে নাচতে আমি নতুন শখে ছেলেবেলার মতন বিভোর হয়ে যাই। আজকাল শেষ রাতে শেষ রাতে সেই আনন্দে আমার চোখ একটু-আধটু বন্ধ হয়ে আসে কী? আমি টের পাই না। ভোরের পাখির গুঞ্জণে আমার রাতের নিঃসঙ্গতা কেটে যেতে থাকে।

সকালে নিহাল বাইরে চলে যেতেই আমি টুকিটাকি কাজ সেরে বেডরুমের জানালার কাছে এসে দাঁড়াই। জানালা আমার মত যে কোনো গৃহিনীরই প্রিয় অনুষঙ্গ। জানালার গা ঘেঁষে আমড়া গাছ। গাছের ডালের ফাঁকে কয়েকটি শালিক পালক প্রসাধনীতে ব্যস্ত। গাছটি বেশ বড়ই। ঘুরে ফিরে বছরে দু-তিনবার আমড়া ধরে। পাঁচ শতাংশ জমির ভেতরে দুই ইউনিটের ছোট্ট দোতলা বাড়ি করেছে নিহাল। বাউণ্ডারি দেয়ালের পাশ দিয়ে বেশ কয়েকটা ফলের গাছও আছে। আমড়া, পেয়ারা, জলপাই। আমড়া খেতে আমার ভাল লাগে না। ভেতরের আঁটিটা বিচ্ছিরি। তাতে নিহালের সুবিধা হয়েছে। ব্যবসায়ী মানুষ আমড়াও বেচতে পারে! তবে আমি একটা অদ্ভুত জিনিস শিখেছি। আমড়ার পাতা খাওয়া। নিচতলার ভাড়াটিয়ার পাঁচ বছরের ছেলে সবুজ আমাকে এই পাতা খাওয়া শিখিয়েছে।

একদিন দুপুরে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে দেখি আমড়া গাছের নিচে দাঁড়ানো সবুজ কচকচ করে পাতা খাচ্ছে। আমি ডাকলাম।
-কিরে...ছাগলের মত পাতা খাচ্ছিস কেন? মা ভাত খেতে দেয়নি?
-ভাত খেয়েছি। সেই রকম টেস্ট! বাবা পেড়ে দিল।
-পেট খারাপ করবেরে তোর। ছাগল একটা।
সবুজ সবসময় আমার গালমন্দে খুশি হয়ে যায়। একটু পর একগাদা আমড়া পাতা নিয়ে ছেলেটা দোতলায় চলে আসে। দৌড়ে রান্নাঘর থেকে লবনও আনে। ওর সাথে সেদিন আমিও আমড়ার কচি পাতা খেলাম। আশ্বর্য হলেও সত্যি আমার সেদিনের বমি ভাব চলে গেল। সেই থেকে মাঝে মাঝে সেই টকটক পাতার স্বাদের জন্য আমার জিভ লোভাতুর হয়ে ওঠে। আজ আমড়া গাছে সবুজ পাতা নেই। শীতের মাঝামাঝি বলে ডালের ফাঁকে ফাঁকে হলুদ পাতায় গাছটাকে কেমন ঢ্যাঙা লাগে। নিহাল এমন ঢ্যাঙা লম্বা। ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি লম্বা মানুষের মাথার বুদ্ধি কম। কিন্তু কঠিন উপপাদ্যেরও তো ব্যতিক্রম আছে। আমি আমড়া গাছের হলুদ পাতার দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করি, এই বুঝি ঝরে পড়বে!

৩.
-কিরে এমন শুকিয়ে গেছিস কেন? চোখ বসে গেছে। খাস না? নাকি এখনো চিড়া-মুড়ির ওপরে আছিস? কবে থেকে বলছি ডাক্তার দেখা, ডাক্তার দেখা। গায়ে লাগে না!
আমার একই প্রশ্নের উত্তর দিতে ভাল লাগে না। ভাল না লাগা বুবুকে বুঝতে দেই না। বুবু এসেছে অনেকক্ষণ। সাথে আজ সাধও আছে। ঘরময় ছেলেটা ছুটোছুটি করছে। মাঝে মাঝে ছুটে এসে আমাকে বলে যাচ্ছে, চন্দা খালামনি...আমাকে ধর তো। সাড়ে তিন বছরের সাধের মুখে আমার চন্দ্রা নামটি বেশ লাগে। চন্দ্রা থেকে চন্দা। বুবু ছন্দা আর আমি চন্দ্রা। বাবার কাছে একবার জানতে চেয়েছিলাম, আমার নাম চন্দ্রা কেন বাবা? আমার ভালো মানুষ বাবা খুব জোরে হেসে উঠে বলেছিল, আরে...আমার এই চাঁদমুখী মেয়ের জন্য এর চেয়ে সুন্দর নাম আছে কি? আমি সুন্দর। সেই ছোট্টবেলা থেকে বাবা বলেছে আমি সুন্দর।

বড় হতে হতে আয়না বলেছে আমি সুন্দর। দাদা বলেছে আমি সুন্দর। বুবু হিংসুটে চোখে তাকিয়েছে তবু বলেছে আমি সুন্দর। যে পাড়াতে গিয়েছি সেই পাড়ার যুবক-বৃদ্ধের অস্থির চোখ আড়ে আড়ে আমাকে দেখেছে আর বলেছে আমি সুন্দর। কেবল মা বলেনি। বরং দিন দিন আমার রূপ-গুনের বহর মায়ের জোড় ভ্রু দু’টোকে আরও সংকুচিত করেছে। অথচ মায়ের চিন্তিত মুখ দেখে দেখেও আমি পরিপাটি সচেতনতায় আরও সুন্দরী হওয়ার চেষ্টা করেছি। মা জানত আমি পাগলাটে। ক্ষ্যাপা। তাই মা আমাকে বেশি ঘাটাতো না।

আমার মাথা অবশ্য এমনিতেই খারাপ তা না হলে এমন ঘুমের ওষুধ কেউ জমায়? নতুবা আমার মত কারো কী গন্ধরোগ আছে? বুবু তো আজকাল প্রায়ই বলে, পাগলের ডাক্তার দেখা। পাগল বটে। আমার চেয়ে বড় পাগল কী আছে? ওহ্ আমি তো শ্যামলীর কথা বলতে ভুলেই গেছি। কলেজ জীবনে আমার বেস্ট ফ্রেন্ড শ্যামলী দত্ত। শ্যামলীর মাথা আমার চেয়ে বেশি খারাপ ছিল। তখন বাবার পোস্টিং ছিল চাঁদপুর। পি ডাব্লিউ ডির ইঞ্জিনিয়ার ছিল বাবা। কলেজের সেকেন্ড ইয়ারে থাকতে হুট করে শ্যামলী আমাদের ক্লাসের শোভনকে বিয়ে করে ফেলেছিল। হিন্দুর মেয়ে মুসলিম ছেলেকে বিয়ে করেছে! শুধু পুরো কলেজে নয় পুরো চাঁদপুর শহরে ঢি ঢি পড়ে গিয়েছিল। তার ওপর শ্যামলীর বাবা ছিল চাঁদপুর জেলার সিভিল সার্জন আর শোভনের বাবা পোস্টমাস্টার। শ্যামলী আসলে তখনই মরেছিল। তাই পরে ষাটটা রিলাক্সেনও ওর কিছু করতে পারেনি। আমার হাসি পেয়ে যাচ্ছে।

বোকা শ্যামলী এতগুলো ঘুমের ওষুধেও মরতে পারল না। এখন তিন-চারটা টিউশনি করে স্বামীর নেশার টাকা জোগাড় করছে আর দুই বেলা রুটিন করে মার খাচ্ছে। এর চেয়ে মরণটা কি আরও সোজা নয়! শ্যামলী মানুষ চিনতে ভুল করেছিল। শোভন কিন্তু করেনি! ইস্ একটু বেশিই বলে ফেললাম বোধহয়। সেদিন বাবার ওখান থেকে ফেরার পথে শ্যামলীর সাথে দেখা। সাথে ওর বড় মেয়ে। মেয়ের নাম রেখেছে শ্যামা। কী হাড় জিড়জিড়ে গড়ন আর গায়ের রং হয়েছে শ্যামলীর! প্রথমে আমি চিনতে পারিনি। চিনতে পেরেই জড়িয়ে ধরলাম। মনে হল কাঠের খুঁটি।
-কি খাস না, মেয়েকেও তো খাওয়াস না দেখি।
শ্যামলী জোরে হেসে উঠেছিল,
-তোর মত তো রাজা আর রাজত্ব নেই আমার তাই ক’দিন পর গায়ে থাকা বাকি মাংসটুকুও কেটে খাব।
শ্যামলীর সেই হাসির ভয়াবহতায় আজও মাঝ রাতে আমি আঁতকে উঠি। আবার যদি শ্যামলী মরতে যায়? আমার মত! কী যে আবোল-তাবোল ভাবছি। ঠিকই তো। রাজা আর রাজত্ব! আমি কি রাজকন্যা? নাকি ঘুঁটেকুড়ানি? আমি মরতে চাইছি কেন? আমার কোল এখনও খালি বলে? মা ডাক শুনতে পাওয়ার অতৃপ্তি? এ কি খুব ন্যাকা ন্যাকা কথা। না আমার মত সব পাওয়া রাজরাণীর সুখের অসুখ!

বুবু সেই কখন এসেছে। যাই বুবুকে চা করে দেই। আমি রান্নাঘরে ঢোকার আগে সাধ ছুটে আসে। দু’হাতে শক্ত করে ধরে রাখা কৃত্রিম অস্রটিতে কচি আঙুলের নিখুঁত নিশানা বসিয়ে সাধ দৃপ্ত কন্ঠে হুঙ্কার করে,
-ইয়া ঢেইয়া... ঢেইয়া... খালামনি, তুমি মলে যাও...।
বুকের ডানপাশটা চেপে ধরে আরও নিখুঁত ভঙিমায় আমি আর্তনাদ করে উঠি,
-উহ্... মরে গেলাম।
অভিযানের সফলতা সেরে এক দৌড়ে মায়ের আঁচলের তলে সেঁধিয়ে যায় সাধ,
-মা খালামনি মলে গ্যাথে।

মরণ... আমার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। ঝিরঝিরে শব্দ চারপাশে... ভীষণ দ্রুততায় কে যেন ক্রমাগত মাটি ঠেলে দিচ্ছে আমার উপর। একটু একটু করে গহীন অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছি আমি। আমার শরীর ক্রমশ আটকে যাচ্ছে সাড়ে তিন হাতের নির্দিষ্ট র্দৈঘ্যে। এখন চারপাশে শুধু মৃতের আধাঁর। কষ্ট... কষ্ট... আচমকা দুচোখের ভরাট আঁধার মিলিয়ে যায়, সামনে দোল খায় রঙিন সুতো। ভেজা স্যাঁতস্যাঁতে চোখ সেই সুতো বেয়ে চলে যায় অনেক দূর... টুইয়ের সংসার, মাটির বাসন-কোসন, এলোমেলো গৃহস্থালী, হাঁড়ির গোলাকার জলবৃত্তে নৌকার দিকদর্শন...।‘এই রে, দাদা তোর পাজী লাটিমটা আজ আমার টুইয়ের শোবার ঘরে ঢুকে পড়েছে, কী কেলেংকারী! বিকেলে বরপক্ষ ওকে দেখতে আসছে … যেই না আমার মাটির ঢ্যালা তার আবার বিয়ে, বুড়ি ধাড়ি মেয়ে তাও পুতুল খেলা চাই।’ হতচ্ছাড়া লাটিমটা ঘুরে চলে ঘরময়। কিশোরীর অভিমানী চোখ ডুবে যায় জলে। দুঃখমেদুর চোখ বেয়ে একসময় জলের ধারা নামে। আহা... কি টলমলে জল! দু’হাতের তালুতে তুলে নিতে ইচ্ছে হয়, আমি হাত বাড়াই... ততোক্ষণে মাটির স্তূপ জমে গেছে বুকের ওপর। আমি নাক দিয়ে প্রাণপণে বাতাস টানতে থাকি। কষ্ট... বড়ো কষ্ট।

-এ্যাই খালামনি, আবাল।
ছোট্ট দুটি হাত প্রচন্ড শক্তিতে মাটির আলিঙ্গন থেকে আমায় টেনে তোলে। আমি তাকাই সামনে। ধূলার দুলাল দুষ্ট দাদার হাতের তালুতে বেয়াড়া লাটিমটা তখনো নেচে চলে পেছনে নাচে তার লম্বা রঙিন লেজ।
-ইয়া ঢেইয়া... ঢেইয়া... খালামনি তুমি আবাল মল।
সাধের খেলনা পিস্তলটা আমার দিকেই তাক করা। ওর চকচকে চোখের দিকে তাকিয়ে আমি অপেক্ষা করি।

অপেক্ষা করি... কে জেতে, অবাধ্য লাটিম নাকি বুলেটের ক্ষিপ্রতা।

(লেখার সময়কাল: ২৫-২৬ ডিসেম্বর, ২০১৩খ্রিঃ, লেখাটি পূর্বে প্রকাশিত)
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে জানুয়ারি, ২০১৪ বিকাল ৩:৫২
১২টি মন্তব্য ১২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×