somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

"চিত্রা"

১৩ ই জুন, ২০১৫ দুপুর ২:০৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



ছাদের এই দক্ষিন কোণটা চিত্রার খুব প্রিয়। এই কোণে চিত্রার নিজস্ব একটি ফুল বাগান রয়েছে। নানান বর্ণের ফুল টবের মধ্যে সারি ধরে সাজানো। মাঝে মাঝে কয়েকটা পাতাবাহার গাছও আছে। বিকেল চারটার দিকে এই কোণে রোদ সরে গিয়ে ছায়া নামে। তখন একটি গল্প অথবা কবিতার বই নিয়ে এখানে এসে বসে চিত্রা। ওর বসার জন্য এখানে চেয়ার থাকে সবসময়। চেয়ারে বসে দোল খেতে খেতে অথবা ছাদে হাঁটতে হাঁটতে কফির কাপে চুমুক দিয়ে বই পড়াও ভীষণ প্রিয় চিত্রার।তবে সবথেকে বেশি ভালোবাসে ও ছবি আঁকতে। ছোটবেলা থেকে ছবি আঁকা তার অস্তিত্বের সাথে মিশে গেছে। সেই ভালোবাসা থেকেই চিত্রার চারুকলাতে ভর্তি হওয়া। ছাদে তার বিশাল একটি অংশ কাটে ছবি আঁকা নিয়ে। তবে আগামী সপ্তাহ থেকে চিত্রার শেষ বর্ষের পরীক্ষা শুরু,সেই ব্যস্ততায় কয়েকদিন ঠিকমতো আসা হবে না ছাদে।
মন ভারী করে গাছের চারাগুলোর ওপর আলতো করে হাত বুলালো চিত্রা। ‘ তোদের সবাইকে খুব মনে পড়বে। আমাকে ভুলে যাবিনা কিন্তু। ’ আপন মনে কথা বলতে বলতে চোখ তুলে একবার আকাশের দিকে তাকালো সে। হঠাৎ এক ঝলক দখিনা হাওয়া এসে চিত্রার চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে গেল। যেন অভিমানের সুরে প্রশ্ন করে গেল, ‘ আর আমাকে মনে পড়বে না বুঝি ? ’
চোখ নামিয়ে ঘুরে পাশের বাসার ছাদের দিকে তাকালো চিত্রা। যা ভেবেছিল ঠিক তাই। ছেলেটা বসে আছে ইজি চেয়ারে। বরাবরের মতোই তার হাতে বড় একটি নোটবুক অথবা ডায়েরি।
ভ্রু কুঁচকে ছেলেটার দিকে আনমনে তাকিয়ে থাকে চিত্রা । চিত্রাদের বাসা তিন তলা । পাশের বাসাটিও তাই । অবশ্য দুটি বাসা ঠিক পাশাপাশি বলা যাবে না । দুই বাসার মাঝখানে প্রায় হাত বিশেক দুরত্ব রয়েছে । এই ফাঁকা জায়গাতে কয়েকটা পাইন গাছ মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। বাসাটি রাহাত চাচার,চিত্রার বাবার বন্ধু তিনি। গত বছর রাহাত চাচারা সপরিবারে আমেরিকা চলে যাবার পর থেকে বাসায় একজন কেয়ারটেকার ছাড়া আর কেউ ছিল না। মাস ছয়েক আগে চিত্রা বাবার কাছে শুনেছিল রাহাত চাচার কোন আত্মীয় নাকি এসেছেন বাসাটায়। তার কয়েকদিন পর থেকেই ছেলেটাকে ছাদে দেখে আসছে চিত্রা ।বেশির ভাগ সময়ই ছেলেটা একটি নোটবুক বা ডায়েরি জাতীয় কিছু একটা হাতে নিয়ে বসে থাকে । ছেলেটা বোধহয় একটু অলস প্রকৃতির । খুব কমই তাকে হাঁটতে দেখেছে চিত্রা । বেশ দূরে বলে ছেলেটার মুখটি ¯পষ্ট বোঝা না গেলেও এটা বোঝা যায় যে ছেলেটি বেশ সুদর্শন । ছেলেটাকে এতো পর্যবেক্ষণ করার মানে যে চিত্রা তার প্রতি আগ্রহী তা মোটেই নয়। ছেলেদের সাথে বরং কমই মিশে চিত্রা । তার কাছে মনে হয় এটা যতো কম হবে,জীবনে জটিলতা ততো কম হবে । তবু এই ছেলেটার প্রতি তার কৌতুহলের কারণ হলো ছেলেটার আচরণ ।

চিত্রা প্রথম প্রথম ছেলেটাকে খেয়াল করেনি । প্রথম যেদিন ছেলেটাকে দেখে সেদিন বিকেলে চিত্রা ছবি আঁকছিল ।হঠাৎ করেই ঝড়ো হাওয়া শুরু হলো সাথে টুপটাপ বৃষ্টি । চিত্রা তাড়াহুড়ো করে সব গুটিয়ে নিয়ে ছাদ থেকে নামতে যাবার সময় হঠাৎ খেয়াল করল একটি ছেলে পাশের ছাদে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। সেদিন কিছুটা রাগই হয়েছিল চিত্রার। কি বেহায়া ছেলেরে বাবা। এইভাবে হ্যাংলার মতো তাকিয়ে থাকা ছেলেরা চিত্রার দুই চোখের বিষ।চিত্রাদের বাসার কাছে আর কোন এরকম ছাদওয়ালা বাসা না থাকায় সে কখনো ছাদে ওঠা নিয়ে বিব্রতকর কোন অবস্থায় পড়েনি । তবে সেদিন ছেলেটাকে দেখে খুব অস্বস্তিতে পড়ে গিয়েছিল। মনে মনে ভেবেছিল যদি ছেলেটি কোন ইশারা ইঙ্গিত করে তাহলে একদম মজা বুঝিয়ে দেবে। কিন্তু অবাক করা ব্যাপার হলো এখন পর্যন্ত ছেলেটা তেমন কিছুই করেনি। শুধু মাঝে মাঝে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। অদ্ভূত ব্যাপার হলো নোটবুক বা ডায়েরিটা ছেলেটার হাতে সবসময়ই থাকে। কি সাত রাজার ধন আছে ওটায় কে জানে। প্রথমে রাগ হলেও পরে চিত্রার মনে হলো ছেলেটি বোধ করি খুব খারাপ না। শুধু তাকিয়ে থাকার জন্য তো আর কাউকে কিছু বলাও যায় না। আবার অস্বস্তির কারণে ছাদে আসাও চিত্রা বন্ধ করতে পারবে না। তাই ছেলেটির দৃষ্টিপাতে ক্রমশ অভ্যস্ত হয়ে ওঠেছে চিত্রা। ও ছবি আঁকা বা বই পড়ার সময় যেমন মাথার ওপর আকাশ থাকে আকাশে পাখি থাকে বাগানে ফুলের সৌরভ থাকে ঠিক তেমনি ছেলেটির ছাদে উপস্থিতিও যেন প্রাকৃতিক এক ব্যাপার হয়ে ওঠেছে এখন। বরং ছেলেটি এখন ছাদে না থাকলে সেটাই যেন অস্বাভাবিক লাগবে। ভাবতে ভাবতে হেসে ফেললো চিত্রা। চুল গুলো গুছিয়ে নিয়ে ছেলেটির দিকে তির্যক দৃষ্টি হেনে দখিনা হাওয়াকেই যেন জবাব দিলো চিত্রা হুম।‘ ভালোই মনে পড়বে। ’
নিচে নামার জন্য সিঁড়ির কাছে চলে এলো চিত্রা।সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে আপনমনেই বললো,‘ আমি না ফেরা পর্যন্ত ভালো থেকো কিন্তু সবাই।’



পরীক্ষা শেষ করে যেন পাখির মতো হাওয়ায় ভেসে বাড়ি ফিরছিল চিত্রা ।একটি সপ্তাহ যেন ঘোরের মধ্যে কেটেছে ওর। এই সপ্তাহটা চিত্রা তার প্রিয় বাগান আর ছাদ ওর মা সুলতানা রহমানের হাতে সমর্পণ করে সবার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল প্রায় । তবে মাঝে একদিন বিকেলে একটু ক্ষণের জন্য ছাদে উঠেছিল চিত্রা। সবই ঠিক আছে শুধু একটি জিনিস বেমানান। পাশের ছাদে সেই ছেলেটির অনুপস্থিতি । মনে মনে হেসেছিলো চিত্রা । সে ছাদে থাকলেই ছেলেটি ছাদে থাকে তাহলে। দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে মনটা কেন জানি এক অদ্ভুত ভালো লাগায় ভরে উঠেছিল চিত্রার। ঈষৎ লজ্জ্বায় গালটা ওর রক্তিম হয়ে উঠেছিল। আজ বাসায় পৌঁছেই যেন তর সইল না চিত্রার। নাকে মুখে দুটো খেয়ে নিয়েই সে ছুটলো ছাদে। বুকের ভেতর কেমন যেন একটা কাঁপুনি টের পেল সে ।
অন্যদিন ছাদে উঠে প্রথমে বাগানে যায় চিত্রা। কিন্তু আজ সেদিকে মন টানলো না তার। বরং পাশের বাড়ির ছাদটাই তাকে আকর্ষণ করল। কিন্তু সেদিকে তাকিয়েই চিত্রার উচ্ছলতা যেন ম্লাণ হয়ে গেল। আজও নেই ছেলেটা ।হয়তো এই কয়দিন চিত্রাকে ছাদে না দেখে সে ভেবেছে চিত্রা আর ছাদে আসবে না। ঠোঁট কামড়ে ভাবলো চিত্রা। কিন্তু ছেলেটা জানবে কি করে যে চিত্রা আবার ছাদে আসছে।আচ্ছা,ওরা বাসা ছেড়ে চলে গেল না তো ! ভাবতে ভাবতেই চিত্রা খেয়াল করল পাশের ছাদে একজন মহিলাকে দেখা যাচ্ছে।এই মহিলাকে সেই ছেলেটির সাথে কয়েকবার দেখেছে চিত্রা ।হয়তো ছেলেটির মা হবেন। তিনি যখন আছেন তাহলে ওরা এই বাসাতেই রয়েছে। তাহলে ছেলেটি কোথায় ? এই প্রশ্ন মনের মধ্যে এপাশ ওপাশ করতে করতে ঘরে ফিরল চিত্রা ।



চিত্রা বরাবরই ভীষণ শান্ত আর ধৈর্যশীল মেয়ে বলে পরিচিত। কিন্তু আজ ভীষণ অস্থির লাগছে ওর। আজ তিনদিন হয়ে গেছে ওর পরীক্ষা শেষ হয়েছে ।এই তিনদিন প্রত্যেক টা বিকেল কেটেছে ওর ছাদে ছেলেটির অপেক্ষা করে। কিন্তু সে যেন কর্পূরের মতো উবে গেছে। কোন পাত্তাই নেই। এমনিতেই মনটা বিক্ষিপ্ত তার ওপর গত রাতে খাওয়ার টেবিলে বাবার বলা কথাগুলো চিত্রাকে আরো অস্থির করে তুলেছে। চিত্রার বাবা আনিসুর রহমান খুব মুক্তমনা স্বভাবের মানুষ। একমাত্র মেয়ের সাথে তার সম্পর্ক অনেকটা বন্ধুর মতো। কাল আনিসুর রহমান আগে খেয়ে উঠে পড়েছিলেন। হঠাৎ ফিরে এসে চিত্রার মাথায় হাত রেখে বললেন,‘তোর পরীক্ষা তো শেষ হলো। এবার নতুন জীবনে পা দেবার পালা। তা তোর কি কেউ পছন্দের আছে ? থাকলে বলতে পারিস। তুই আমাদের একমাত্র মেয়ে তোর ইচ্ছের গুরুত্ব আমাদের কাছে অনেক। তুই ভেবে জানাস।’ বলেই তিনি চলে গিয়েছিলেন। অর্ধেকটা খাওয়া হয়েছিল চিত্রার। বাকিটা আর গলা দিয়ে নামল না। রাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে চিত্রা নিজেকেই প্রশ্ন করল, ‘ কেউ কি আছে তার ভালো লাগার অথবা পছন্দের ?’

ভাবতে ভাবতে কখন যেন ঘুমে দুচোখ জড়িয়ে এলো চিত্রার। ঠিক ঘুম না তন্দ্রার মতো। আবছাভাবে তন্দ্রাঘোরে চিত্রা যেন পাশের ছাদের ছেলেটিকে দেখতে পেল। সে হেঁটে এসে দাঁড়িয়েছে ছাদের কিনারায়। হাত তুলে যেন দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছে চিত্রার। এতো দিনে তবে সময় হলো বেচারার। মুচকি হাসলো চিত্রা। সেই হাসিটা ঠোঁটে লেগে থাকলো যতোক্ষণ না ঘুম ভাঙলো তার। ঘুম ভেঙে চুপচাপ কতোক্ষণ শুয়ে রইল চিত্রা। কাঁচের জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে গভীর অন্ধকার দেখে সে বুঝলো ভোর হয়নি এখনো। নিজের মধ্যে ছেলেটাকে নিয়ে অদ্ভুত টানাপোড়েন দেখে অবাক লাগছে চিত্রার। আচ্ছা, ছেলেটার অনুভূতিও কি ঠিক এমনিই হয় ? ছেলেটি কি তবে ওকে পছন্দ করে ? ভালোবাসে ? নাহ।এই প্রশ্নের উত্তরগুলো ছেলেটির সাথে সরাসরি দেখা না হলে পাওয়া যাবে না। কিন্তু বাবাকে উত্তর দেওয়ার আগে এই প্রশ্নের উত্তরগুলো চিত্রার প্রয়োজন। কিন্তু ছেলেটি কোথায়। কোন অসুখ করেনি তো ? মনে মনে একটি দুঃসাহসী সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো চিত্রা। যা থাকে কপালে কাল সকালে সে যাবে ছেলেটির বাসায়। এখন শুধু সকালের অপেক্ষা।




কলিংবেলে চাপ দিতে গিয়ে যেন হৃৎস্পন্দনের গতি দ্বিগুণ হয়ে গেল চিত্রার।ছেলেটার বাসায় এভাবে ঝোঁকের বশে চলে আসা কি ঠিক হলো ওর ? ফিরে যাবে নাকি ? ভাবতে ভাবতে পেছন ফিরলো চিত্রা। ঠিক তখুনি ওর পেছনে দরজাটা সশব্দে খুলে গেল। চিত্রা ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখল একজন মাঝবয়সী মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন। উজ্জ্বল শ্যামলা বর্ণের মহিলার মাথায় কাঁচা পাকা চুলের মিশ্রণটা বেশ ভালোই মানিয়ে গেছে।
‘ ইয়ে .....মানে.....আমি..... ,’ কথার যেন খেই হারিয়ে ফেলে চিত্রা। পরক্ষণে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করে। ‘ আমি আপনাদের পাশের বাসাতেই থাকি। আমার বাবা রাহাত চাচার বন্ধু। আপনারা এখানে এসেছেন কিন্তু পরিচয় হয়নি,তাই..... ’
ভদ্রমহিলা হাসলেন, ‘এসো। ভেতরে এসো।’
মৃদু পায়ে ভেতরে ঢুকলো চিত্রা। ‘ আমার নাম চিত্রা। চারুকলা নিয়ে পড়ছি।’
আবার হাসলেন মহিলা। ‘ জানি। ’ চিত্রার চোখ বিস্ময়ে বড় বড় হয়ে উঠতে দেখে যোগ করলেন। ‘ প্রতিবেশীর খবর রাখতেই হয় তো।’
এবার চিত্রাও হাসলো। ঘরের চারপাশে নজর বুলাল সে। পরিপাটি করে সাজানো ঘরটায় রুচির ছাপ ¯পষ্ট। তবে চিত্রার চোখ কেড়ে নিল ঘরের এক কোণে ঝুলানো কয়েকটি চিত্রকর্ম। ছবিগুলোর সামনে এসে দাঁড়াল সে। চারুকলার ছাত্রী হিসেবে সে জানে শিল্পবিচারে ওর চোখের সামনের ছবিগুলো শুধু ভালো নয়,অসাধারণও বটে। অজান্তেই ওর মুখ দিয়ে বের হয়ে আসলো, ‘অসাধারণ।’
ভদ্রমহিলা পাশে এসে দাঁড়ালেন। ‘আমার ছেলে সৌম্যের আঁকা।’
‘আপনার ছেলের আঁকা ! ’ ভীষণ অবাক হয়ে ঘুরে দাঁড়াল চিত্রা। তিনিও কি চারুকলা...’
‘না। ’ থামিয়ে দিলেন সৌম্যের মা। ছবিটার দিকে আনমনে কথা বলতে লাগলেন।‘সৌম্য আমার একমাত্র ছেলে। ওর বয়স যখন দশ তখন ওর বাবা মারা যান । তিনি যা রেখে গিয়েছিলেন তাই দিয়েই আমাদের মা-ছেলের চলে যায়। কোন সমস্যাই থাকতো না যদি শুধু আমার ছেলেটা অটিজমে ভুগতো না।’
‘ কি ! ’ প্রায় আর্তনাদ করে উঠল চিত্রা।
‘ হ্যাঁ। অটিজমে আক্রান্ত সে ছোট থেকেই। পড়ালেখাটা তাই ওর সেভাবে হয়ে ওঠেনি। তবে ছোটবেলা থেকেই সে ছবি আঁকতে খুব পছন্দ করতো। অটিজমে আক্রান্ত অনেকের কোন কোন ক্ষেত্রে বিশেষ দক্ষতা থাকে। সৌম্য ছবি আঁকাতে সেটা পেয়েছে। গত কয়েকদিন থেকে ছেলেটার খুব জ্বর। বিছানা থেকেই উঠতে পারছে না।’

চিত্রার মনে হলো মাথা ঘুরছে ওর। কেমন জানি লাগছে তার। কোনমতে বলল, ‘ আন্টি আমি এখন যাই।’
‘ সে কি ! কিছু খেয়ে যাবে।তুমি বসো। ’
‘ অন্যদিন। আজ যাই আমি। ’ বলেই ঘুরে ছুটে বেরিয়ে এলো চিত্রা। বাসায় ঢুকে নিজের রুমে ঢুকে কান্নায় ভেঙে পড়ল সে। সারা দিন শুধু ভাবল চিত্রা। দুপুরে খাওয়ার টেবিলে বসেও উঠে গেল। রাতেও খেলো না। শুধু চোখে জলই আসছে ওর। কেন এমন হলো ? রাতে ঘুমাতে এসেও চোখের জলে বালিশ ভিজাতে লাগল চিত্রা।



কাঁদতে কাঁদতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল নিজেই জানে না চিত্রা। ঘুম ভাঙলো তার ভোরের প্রথম আলোয়। প্রচণ্ড ঝড়ের পর প্রকৃতি যেমন হঠাৎ করেই আবার শান্ত হয়ে যায় ঠিক তেমনি রাতভর অশ্র“পাতের পর চিত্রাও যেন হঠাৎ করেই খুব শান্ত হয়ে গেছে। বিছানায় উঠে বসলো সে। হেলান দিল দেয়ালে। এখন তাহলে কি করবে চিত্রা ? ছোট্ট ছোট্ট ভালো লাগার অনুভূতিগুলো তাকে এমন এলোমেলো করে দেবে ভাবতেও পারেনি ও। কিন্তু যাকে নিয়ে এই অনুভূতি সে তো এসব বুঝবেই না। অটিজমে আক্রান্ত সৌম্যের কাছে এর কি আদৌ কোন মূল্য আছে ? দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো চিত্রা। ঠিক তখুনি বিদ্যুত চমকের মতো একটি কথা মাথায় এলো ওর। সৌম্যের মা ওর সম্পর্কে এতো কিছু জানলেন কি করে? প্রতিবেশী হওয়া সত্ত্বেও সে নিজেও তো ওদের সম্পর্কে কিছু জানতো না। একটি সন্দেহ মনের ভেতর ঘুরপাক খেতে লাগলো চিত্রার। তবে কি সে যা ভাবছে তাই ! ওকে যাচাই করতে হবে। আবার যেতে হবে ওই বাসায়। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বেলা বাড়ার অপেক্ষা করতে লাগলো চিত্রা ।



কলিংবেল বাজার প্রায় সাথে সাথে দরজা খুলে দিলেন সৌম্যের মা। মৃদু হেসে বললেন,‘ এসো চিত্রা। আমি তোমার অপেক্ষাই করছিলাম ।’
অবাক চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইল চিত্রা।‘ আপনি জানতেন আমি আসবো ?’
‘মন বলছিল তুমি আসবে।’ চিত্রার হাত ধরে ভেতরে নিয়ে এলেন সৌম্যের মা ।
‘ইয়ে...মানে...আন্টি আপনার ছেলে বলেছিলেন খুব অসুস্থ। উনাকে দেখে যাওয়া উচিৎ মনে হলো তাই... ’
‘আমার সাথে এসো। ’ বলে ভেতরের দিকে হাঁটতে লাগলেন সৌম্যের মা। চিত্রা অনুসরণ করল তাকে।
‘সে অবশ্য ঘুমে এখন,তবে দেখতে পারবে। ’
একটি রুমে ঢুকে পড়লেন সৌম্যের মা। সাথে চিত্রাও। হালকা আলো জ্বলছে রুমে। সামনেই একটি বিছানায় ঘুমিয়ে আছে সৌম্য। এই প্রথম ছেলেটাকে কাছ থেকে দেখলো চিত্রা। ভীষণ মায়াবী একটা মুখ। দেখলে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় এই ছেলেটি অটিজমে ভুগছে। বিছানার পাশে সৌম্যের মাথার কাছে একটি বাটিতে সামান্য জল আর কয়েকটা ছোট্ট কাপড়ের
টুকরো ।
সৌম্যের মাথার কাছে বসলেন তার মা । হাত বুলিয়ে দিলেন ছেলের মাথায়।‘ কাল সারা রাত ভীষণ জ্বর ছিল ওর। সারা রাত মাথায় জলপট্টি দিয়েছি। ভোরে একটু কমেছিল। এখন আবার বাড়ছে জ্বর।’
এদিক ওদিক তাকিয়ে কিছু খুঁজল চিত্রা। পেয়েও গেল। সামনেই একটি টেবিলের ওপর পড়ে আছে সৌম্যের নোটবুকটা। এগিয়ে গিয়ে সেটা হাতে তুলে নিল সে। স্বাভাবিকের থেকে একটু বড় নোটবুকটা। পৃষ্ঠা উল্টিয়েই স্থির হয়ে গেল চিত্রা। যা ভেবেছিল তাই। এটা আসলে আর্ট বুক। পেন্সিলে নিখুঁত হাতে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা একটি মেয়ের ছবি এঁকে গেছে সৌম্য। মুখটা স্পষ্ট না হলেও চিত্রার বুঝতে অসুবিধা হলো না যে ওর ছাদে থাকার মুহূর্তগুলোকে সৌম্য বন্দী করে রেখেছে আর্টবুকে।
আবেগে চোখ ভিজে উঠল চিত্রার। কে বলে সৌম্যের অনুভূতি নেই ! নিজের অজান্তে যে অনুভূতি তার বুকে দোলা দিয়ে এই ছবিগুলো আঁকিয়েছে তা সে নিজে না চিনলেও অনুভূতি তো মিথ্যে হতে পারে না।
চিত্রা মুখ তুলে দেখল সৌম্যের মা তাকিয়ে আছেন তার দিকে। চোখ মুছে চিত্রা বলল,‘ আপনি জানতেন তাই না ? তাই কাল আমাকে দেখে অবাক হননি,আমার সম্পর্কে আগেই খোঁজ নিয়েছিলেন ?’
হেসে চিত্রার হাত ধরলেন সৌম্যের মা।‘ তুমি শুধু দেখতে মিষ্টি নও, বুদ্ধিমতিও বটে। যে মেয়ে আমার ছেলের মনে দোলা দিয়ে গেল তার সম্পর্কে জানবো না ?’
হেসে ফেলল চিত্রা।‘ আপনার কাছে আমার গতকালকের খাওয়া পাওনা রয়েছে। কাল থেকে কিছু খাওয়া হয়নি। আপনি আমার জন্য নাস্তা নিয়ে আসুন। আমি উনাকে জলপট্টি দিয়ে দিচ্ছি।’
মাথা নেড়ে হেসে চলে গেলেন সৌম্যের মা।
সৌম্যের কপালে গভীর মমতায় হাত রাখল চিত্রা। এ কোন চিত্রের জালে জড়িয়ে গেলো চিত্রা জানে না। সামনের ভবিষ্যৎটাও অজানা। তবে চিত্রা মনেপ্রাণে চায় তার এই মুহূর্তের ছবিটাই যেন হয় তার জীবনের শ্রেষ্ঠ ছবি।

( সমাপ্ত )
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই জুন, ২০১৫ দুপুর ২:০৪
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=কবিতাগুলো যেনো এক একটি মধুমঞ্জুরী ফুল=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৩ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:২০



©কাজী ফাতেমা ছবি
মনের মাধুরী মিশিয়ে যে কবিতা লিখি
কবিতাগুলো যেনো আমার এক একটি মঞ্জুরী লতা ফুল,
মনের ডালে ডালে রঙবাহারী রূপ নিয়ে
ঝুলে থাকে কবিতা দিবানিশি
যে কবিতার সাথে নিত্য বাস,
তাদের আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফিরে দেখা - ১৩ মে

লিখেছেন জোবাইর, ১৩ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:০৩

১৩ মে ২০০৬


দমননীতির অদ্ভুত কৌশল
সরকার নির্বাচনকে সামনে রেখে বিরোধী দলের ওপর দমন নীতির আশ্রয় নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দ্রুত বিচার আইন ও পুলিশ প্রশাসনকে ব্যবহার করে দমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

কাঁচা আম পাড়ার অভিযান

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৩ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৩২



গাজীপুর জেলার জয়দেবপুরের বাড়ীয়া ইউনিয়নের দেউলিয়া গ্রামে আমার প্রায় ৫২ শতাংশ জমি কেনা আছে। সেখানে ছোট একটি ডোবা পুকুর, অল্প কিছু ধানের জমি আর বাকিটা উঁচু ভিটা জমি। বেশ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমরা কেন এমন হলাম না!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৪ ই মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪১


জাপানের আইচি প্রদেশের নাগোইয়া শহর থেকে ফিরছি৷ গন্তব্য হোক্কাইদো প্রদেশের সাপ্পোরো৷ সাপ্পোরো থেকেই নাগোইয়া এসেছিলাম৷ দুইটা কারণে নাগোইয়া ভালো লেগেছিল৷ সাপ্পোরোতে তখন বিশ ফুটের বেশি পুরু বরফের ম্তুপ৷ পৃথিবীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি

লিখেছেন প্রামানিক, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১



২৬শে মার্চের পরে গাইবান্ধা কলেজ মাঠে মুক্তিযুদ্ধের উপর ট্রেনিং শুরু হয়। আমার বড় ভাই তখন ওই কলেজের বিএসসি সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র ছিলেন। কলেজে থাকা অবস্থায় তিনি রোভার স্কাউটে নাম... ...বাকিটুকু পড়ুন

×