somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ দুই কমলালেবু

৩০ শে আগস্ট, ২০১৪ রাত ১:৫৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

....সকাল সাড়ে ছয়টা। রিহানের ঘুম ভাঙে ঘড়ির এলার্মে। সে লাফিয়ে বিছানায় উঠে বসে। পাশে তাকিয়ে দেখে তার বড় ভাই রিফাত এখনো ঘুমুচ্ছে। রিহান তার ছোট ছোট হাত দিয়ে ভাইয়ের গায়ে ঠেলা দেয়। বলে, “ভাইয়া ভাইয়া উঠো...মর্নিং ওয়াল্কে যাবা না?”

রিহানের এমন ধাক্কাধাক্কিতে রিফাতের ঘুম ভেঙে যায়, মিটমিট করে তাকিয়ে বলে, “রিহু বাবু! তোমাকে না সেদিন বলেছি ওটা ওয়াল্ক না Walk।”

- কিন্তু তোমার লাপটপে সেদিন হাল্কের মুভি দেখলাম না? সেই দৈত্যটার নাম যদি H, u, l, k হাল্ক হয় তাহলে এটাও ওয়াল্ক হবে!

- হাল্কে U আছে তাই ওমন আর এই শব্দে A আছে তাই এটা এভাবে উচ্চারণ করতে হবে।

- না আমি ওয়াল্ক ই বলবো।

- তাহলে তোমাকে আজ আমি খাইয়ে দিবো না যে রিহু বাবু।

এবার রিহান চুপ মেরে যায়। আর সব কিছু বাদ গেলেও সকালের নাস্তা সে তার বড় ভাইয়ের হাতেই খায়। এটা সে কখনো মিস করতে চায় না। সে মেনে নেয় যে শব্দটা ওয়াক। তবে তা ব্রেকফাস্ট পর্যন্তই স্থায়ী হবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা।

ফ্রেশ হয়ে দুই ভাই নাস্তার টেবিলে যায়। বাবা, মা এখনো ঘুমুচ্ছেন। ফ্রিজ থেকে কিছু ফল নিয়ে আসে রিফাত। রিহানের সামনে বসে তার মুখে কাটা আপেলের টুকরা তুলে দেয়।

রিফাত- চোখ বন্ধ করো তো রিহু বাবু।
রিহান- কি দিবা কি দিবা বলো? বলো?

- আগে চোখ বন্ধ করতে হবে যে...

- আচ্ছা করলাম। দাও।

রিহান কিছু পাবার আশায় চোখ বন্ধ করে হাত বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু রিফাত বলে, “উহু, হাতে না। তোমাকে একটা জিনিস খাওয়াবো, মুখ হা করো!”

রিহান ইয়াম্মি বলে মুখ হা করে। আর রিফাত একটা কমলার কোয়ার ভেতর এক গাদা লবন মিশিয়ে রিহানের মুখে দেয়। তিতা কমলার কোয়াটি জোরে চিবানো শুরু করে রিহান। একটু পরেই চোখ মুখ গোল করে ইয়াক থু থু বলে ছুড়ে ফেলে তা।
আর রিফাত খিলখিল করে হেসে উঠে ছড়া কেটে বলে, “রিহান বাবু কমলালেবু, কমলা খেও না...জানালা দিয়ে বউ পালাবে টেরও পাবেনা”

**

পার্কের রাস্তা দিয়ে রিফাত হেঁটে যাচ্ছে, তার কাঁধে চড়ে বসে আছে রিহান। সকাল বেলা তাকে ওমন কমলা খাওয়ানোর প্রতিশোধ স্বরুপ তাকে আজ পুরা পার্ক কাঁধে চড়িয়ে ঘুরিয়ে দেখাতে হবে। ওরা অবশ্য প্রতিদিনই এই পার্কটায় আসে। যখনই রিফাতের হাঁটার গতি স্লো হয়ে যাচ্ছে তখনই রিহান তার মাথার চুল ধরে টান দিচ্ছে, আর ব্যাথায় রিফাত জোড়ে হাঁটতে বাধ্য হচ্ছে। আর এটা দেখে রিহান নিজেই খিলখিল করে হাসছে।

হাঁটতে হাঁটতে একটা ফাঁকা যায়গায় এসে দাঁড়ায় রিফাত। কাঁধে বসে থাকা রিহান কে বলে, “লক্ষ্মি ভাইয়া আমার, এখন একটু নামো। ব্যায়াম করবো! বুকডন দিবো!”

- নামবো যদি তুমি আমাকেও আজ বুকডন দিতে দাও।

- তুমি বাচ্চা মানুষ ভাইয়া, পারবা না।

- না আমি পারবো। জানো কাল আমি একটা চেয়ার সরিয়েছি হাত দিয়ে? আমার গায়ে হাল্কের মত শক্তি আছে!

- ও তাই? তাহলে আমাদের রিহু বাবু একটা মিনি হাল্ক?

- না। আমি রিহান হাল্ক।

রিফাতের কাঁধ থেকে নামে রিহান। রিফাত একের পর এক বুকডন দিয়ে যায় আর রিহান ভালোমত লক্ষ্য করে দেখে। একটু পর সে নিজেও মাটিতে দুই পা মেলে উপুড় হয়ে সামনে দুই হাত দিয়ে নিজেকে উঁচু করে ধরে। তারপর ভাইয়ের বুকডন দেয়া আরও কয়েকবার দেখে নিজেও বুকটা মাটির কাছে নিয়ে যায়। আর থপাস করে মুখ থুবড়ে পরে সেখানে।

রিফাত বুকডন দেয়া থামিয়ে রিফাতের মাটি মাখা মুখের দিকে তাকিয়ে হোহো করে হেসে উঠে। ছড়া পড়ে, “রিহু হলো বিলাই ম্যাও...ভাত নাই, মাটি খাও”

রিহান ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে উঠে। রিফাত তড়িঘড়ি করে ওকে কোলে নিয়ে লেকের দিকটায় যায়। একটা গাছের নিচে বসে। পকেট থেকে একটা ক্যাডবেরী চকোলেট বের করে রিহান কে দেয়। এসব পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য সব সময় এটা রাখতে হয় রিফাত কে। চকোলেট দেখে সাথে সাথে রিহানের কান্না থেমে যায়। ইয়াম্মি বলে চকোলেটের উপর ঝাপিয়ে পরে।

লেকের পাশে কিছু কাপল দেখা যায়। সকাল বেলা জগিং এর নাম করে এখানে এসে মিলিত হয়েছে নিশ্চিত। রিহান ওর ভাই কে বলে, “ভাইয়া ওরা কি করছে ওখানে?”

- গল্প করছে ভাইয়া।

- কি গল্প?

- জানিনা তো।

- ওরা কি ভাই বোন?

- মনে হয় না!

- তাহলে?

প্রেমিক-প্রেমিকা বলা ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারেনা রিফাত, তাই বলে, “ওরা স্বামী স্ত্রী”

- তারমানে ওই মেয়েটা আমার আন্টি হয়!

- ওই মেয়ে তোমার আন্টি হবে কেন?

- কেন বিয়ে হওয়া মেয়েরা আমাদের আন্টি হয় না? আমার বন্ধু রমিমের তিনটা আন্টি।

- ও হাহাহা, এই কথা? রমিমের তিনটা বড় ভাই। তিন ভাই বিয়ে করেছে বলে তাদের বউ গুলা রমিমের আন্টি মানে ভাবী হয়। আমি যদি বিয়ে করি তাহলে আমার বউ তোমার আন্টি হবে। তবে এটাকে ভাবী বলে ডাকবা। আন্টি বলবা না!

- ভাইয়া তুমি কবে বিয়ে করবে?

- কেন? জেনে কি হবে?

- এমনি, তুমি যদি বিয়ে করো তাহলে পাঁচটা ভাবীকে বিয়ে করবে হ্যা? রমিম কে ওর আন্টি গুলা অনেক চকোলেট দেয়, তুমি পাঁচটা বিয়ে করলে আমি রমিমের চাইতে বেশি চকোলেট পাবো!

- হাহাহাহা, আচ্ছা বাবু করবো।

- আমার বিয়ে হবে কবে?

- খাইছে! মানে কি?

- আমার বিয়ে হলে আমার বউও আমাকে আরও চকোলেট কিনে দিবে, তাহলে আমি আরও বেশি চকোলেট খেতে পারবো!

- হাহাহাহাহা, ফাজিল ছেলে। তোমাকে বিয়ে করতে হবেনা। আমার বউই তোমার বউ হবে বুঝছো?

- কি মজা! সত্যি?

- হ্যা! যাও আমি আমার বউ কে তোমাকে দিয়ে দিবো!

- তাহলে আমার আন্টি থুক্কু ভাবী হবে কে?

- উমম...রমিমের বউ। হাহাহা।

- ভাইয়া এই গাছে আমাকে একটা দোলনা লাগিয়ে দিবা? আমার দোলনায় চড়ার খুব শখ।

- ইয়ে ভাইয়া, এটা তো সরকারী পার্ক, এখানে আমাকে দোলনা লাগাতে দিবেনা যে...

“ওওও...” বলে মাথা নামায় রিহান, নিশ্চিত মন খারাপ হয়েছে। রিহানের মন খারাপ দেখে রিফাতেরও মন খারাপ হয়। সে কি মনে হওয়াতে উঠে একটু দূর থেকে একটা পরে থাকা মেহগনি ফল নিয়ে আসে। বলে, “আসো তোমাকে একটা জিনিস শিখাই!” রিহান উৎসুক দৃষ্টিতে তাকায়। রিফাত তখন রিহান কে শিখায় যে কিভাবে মেহগনি ফলের ভেতর থেকে তিতা সাদা অংশ বের করতে হয়। সে আরও বলে এটা কৌশলে খাইয়ে যে কোন বন্ধুর মুখ তিতা করে দিতে পারবে সে।

এমন আবিষ্কারে রিহান তার দোলনার কথা ভূলে যায়।

**

আজ রিহানের বড় ভাই রিফাতের বিয়ের দিন। সারাদিন অনেক হৈ হুল্লোরে কেটেছে রিহানের। প্রচুর চকোলেট আর মিষ্টি খেয়েছে সে। তার আনন্দ সে এখন থেকে পার্মানেন্টলি একজন মানে ভাবীর কাছ থেকে চকোলেট পাবে। তবে সে ভেবে রেখেছে আজ একটা মেয়ের সাথে ভাইয়ার বিয়ে হয়েছে তাহলে নিশ্চিত কাল আরেকটা মেয়ের সাথে ভাইয়ার বিয়ে হবে। এভাবে পর পর পাঁচদিন পাঁচটা মেয়ের সাথে বিয়ে হবে। প্রচুর চকোলেট তখন বার বার রিহানের চোখে ভেসে উঠছিলো। সে সেই অদৃশ্য চকোলেটের দিকে তাকিয়েই ইয়াম্মি ইয়াম্মি করছিলো।

রাতের বেলা স্বভাবতই সে তার ভাইয়ার ঘরে ঘুমুতে যায়। কিন্তু গিয়ে দেখে ভাইয়া নাই। একটা মেয়ে লাল শাড়িতে বসে আছে আর তাকে ঘিরে কিছু মেয়েরা বসে আছে। তাকে একটা বড় মেয়ে ডাক দিলো কিন্তু সে গেলোনা।

একটু পর তার বড় ভাই সেই ঘরে ঢুকলো, এবং সেই লাল শাড়ি পরা মেয়েটা বাদে আর সবাই হাসতে হাসতে বের হয়ে গেলো। রিফাত এগিয়ে এসে রিহান কে বললো,

- ভাবীর সাথে কথা হয়েছে তোমার?

- না তো।

- কথা বলবা?

- না।

- আসো ভাবীর সাথে পরিচিত হও।

- না আমি ঘুমাবো, আমার ঘুম ধরেছে।

- আজ যে তুমি আমার সাথে ঘুমাতে পারবেনা রিহু বাবু। তোমার জন্য একটা সুন্দর ঘর তৈরী করা হয়েছে। তোমার সেখানে থাকতে ভাল লাগবে, অনেক খেলনাও আছে সেই ঘরে।

রিহান কি শুনছে বুঝছেনা। সে কখনো ভাবতেই পারেনা যে ভাইয়াকে ছেড়ে কখনো তাকে একা থাকতে হবে! এ মাথা নিচু করে বলে, “না আমি তোমার সাথে ঘুমাবো!”

একটু পরে তার আম্মু আসেন। বলেন, “রিহান, আজ থেকে এই ঘরে তোমার ভাইয়া আর ভাবী থাকবেন, তুমি অন্য একটা ঘরে ঘুমাবে, আমি তোমাকে ঘুম পারিয়ে দিবো!”

- না আমি ভাইয়ার কাছে ঘুমাবো!

- না বাবা! তোমার ভাইয়া বিয়ে করেছে, তার নতুন বউ এসেছে। তার বউ আজ থেকে তার সাথে ঘুমুবে।

- ওটা শুধু ভাইয়ার বউ না, আমারও বউ। তাই আমিও এখানে ঘুমাবো।

- তোমার বউ কিভাবে?

- ভাইয়া বলেছে তার বউকে আমাকে দিয়ে দিবে, তার বউই আমার বউ। তাই আমি আমার বউ এর সাথে ঘুমাবো।

এমন পাকা কথা শুনে তার মা স্তব্ধ হয়ে যান, শাড়ি পরা মেয়েটার খিলখিল করে হাসির শব্দ শুনা যায়, রিফাতও মিটিমিটি হাসে।

যাই হোক সেদিন জোর করে রিহান কে সেই ঘর থেকে আনা হয়েছিলো। রিহান কেঁদে বুক ভাসিয়েছে, ওর নতুন ঘরের খেলনা গুলা ভেঙ্গেছে, এবং একসময় ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পরেছে।

সকাল বেলা ঘড়িতে এলার্ম বাঁজা শুনে লাফ দিয়ে উঠেছে। চোখ মিটমিট করে তার ভাইয়াকে ধাক্কা দিয়ে বিছানা থেকে ফেলে দিয়ে বলেছে, “ভাইয়া উঠো, মর্নিং ওয়াল্কে যাবো”

কিন্তু আজ তার ভূল উচ্চারন ঠিক করে দিলো না তার ভাই। রিহান ভাল করে চোখ খুলে দেখলো সে তার নতুন ঘরে, আর ধাক্কা দিয়ে যা ফেলেছিলো ভাইয়া মনে করে তা হলো কোলবালিশ।

রিহান দ্রুত বিছানা থেকে উঠে ভাইয়ার ঘরের দিকে যায়। বন্ধ দরজায় ধাক্কা মেরে বলে, “ভাইয়া...ভাইয়া উঠো!”

বেশ কয়েকবার ধাক্কা দেবার পর রিফাত দরজা খুলে। চোখ কচলিয়ে বলে, “কি হয়েছে ভাইয়া?”

- মর্নিং ওয়াল্কে যাবানা?

- আজ থাক ভাইয়া, অন্যদিন যাবো! খুব টায়ার্ড লাগছে।

“না না চলো চলো...” বলে রিফাতের হাত টানা শুরু করে রিহান। কিন্তু রিফাত হাত ঝামটা মেরে ছাড়িয়ে নিয়ে বলে, “বললাম না আজ যেতে পারবো না?”

রিফাতের গলার আওয়াজে চমকে উঠে ভয় পেয়ে যায় রিহান। এই প্রথম এমন করে কথা বললো তার ভাই। সে চুপচাপ মাথা নিচু করে নিজের ঘরে আসে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না শুরু করে।

**

তারপর থেকে রিহান আর কখনো তার ভাইয়ের সাথে থাকার সুযোগ পায়নি। এবং রিফাত, রিহান দুজনেই আর মর্নিং ওয়াকে বের হয় নি। রিহান বুক ভরা অভিমান নিয়ে আর তার ভাইয়ের সাথে তেমন কথাও বলে না। এবং তার ভাবী তাকে এ পর্যন্ত একটা চকোলেটও দেয় নি।

বেশ কয়েক মাস যাবার পর রিহান তার ভাইকে ভাল মত দেখে অবাক হয়ে যায়, কেমন শুকিয়ে গেছে। চেহারা রুক্ষ হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে রাতে ভাইয়ার ঘর থেকে হালকা চিল্লাচিল্লিও শুনতে পায় সে। হয়তো তারা ঝগরা করছে। একদিন রুমের পাশ দিয়ে যাবার সময় রিহান শুনতে পায় তার ভাবীর গলা। ভাইয়াকে জোরে জোরে বলছিলো তিনি নাকি বাপের বাড়ি চলে যাবেন।

তারপর কিছুদিন ঠান্ডা, আবার কিছুদিন ঝগরা। ভাইয়া দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছেন। হয়তো মনে শান্তি নেই। রিহান তার বাবা মাকেও ভাইয়াকে নিয়ে চিন্তিত মনে হয়। সে বুঝে পায় না আগে তো তাদের পরিবার অনেক সুন্দর ছিলো! হঠাৎ করে একি হলো।

যত দিন যাচ্ছে তত যেন পরিবার থেকে শান্তি উঠে যাচ্ছে।

**

সকাল সাড়ে ছয়টা। ঘড়িতে এলার্ম বেজে উঠলো। রিহান এখন আর এলার্মের শব্দ শুনে উঠে না। উঠে লাভও নাই।

কিন্তু রিহানের মনে হলো কে যেনো ওকে ডাকছে, “রিহু বাবু উঠো...মর্নিং ওয়াকে যাবো!”

রিহান জেগে উঠে, এবং অবাক হয়ে দেখে ওর পাশেই ওর বড় ভাইয়া রিফাত। সে নিজের গায়ে চিমটি মেরে দেখে সে স্বপ্ন দেখছে কি না? না সে তো জেগেই আছে। সে বলে, “ভাইয়া তুমি?”

- হা আমি! অনেকদিন ব্যায়াম করা হয়না , চলো আজ সেই পার্কে যাবো।

রিহান অবাক হয়ে যায়। তড়িঘড়ি করে ফ্রেশ হয়। আজ তার ভাইয়া আবার আগের মত তাকে খাইয়ে দেয়। এবং পার্কে যাবার সময় তাকে তার কাঁধে চড়িয়ে নেয়।

রিহান যতটা না অবাক হয়েছে তার চেয়ে বেশি আনন্দ পাচ্ছে আজ। সেই আগের মত দুই ভাই এক সাথে বের হয়েছে।

একটু পর সেই ফাঁকা যায়গায় এসে থামে তারা। রিফাত বলে, “অনেক দিন বুকডন মারিনি। আজ কয়েকটা মারি।” বলে সে ঘাসের উপর হাত রেখে বুকডন মারা শুরু করে। কিন্তু মাত্র কয়েকটা বুকডন মেরে ঘাসের উপর পিছলে পরে। উঠার পর দেখা যায় তার মুখে বালু ভরেছে। রিহান দেখে হেসে উঠে ছড়া কাটে, “রিফাত হলো হনুমান, ভাত নাই বালু খান”

রিফাতও ছড়াটা শুনে হেসে উঠে। তারা হাঁটতে হাঁটতে সে লেকের কাছে এসে পৌছায়। একটু দূরে থাকতেই রিফাত রিহানকে বলে, “চোখ বন্ধ করো তো রিহু বাবু!”

- কেন ভাইয়া?

- আরে করোই না!

- আচ্ছা করলাম।

- আমি না বলা পর্যন্ত চোখ খুলবে না।

- আচ্ছা।

রিহান কিছু পাবার আশায় হাত বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু সেই হাতে কিছু না দিয়ে রিফাত হাতটা ধরে ওকে নিয়ে এগিয়ে যায়। কিছুদূর যাবার পরে এক যায়গায় এসে থামে। তারপর বলে, “এবার চোখ খুলো”

রিহান চোখ খুলে সামনে তাকিয়ে অবাক হয়ে যায়। খুশিতে ওর মনটা নেচে উঠে। কারন সামনের একটা গাছে তার বহু আকাঙ্ক্ষিত দোলনা ঝুলছে। সে খুশিতে ভাইয়ের গলা জড়িয়ে ধরে। রিফাত বলে উঠে, “হ্যাপী বার্থডে রিহান বাবু, এটা তোমার বার্থডে গিফট!” কাল পার্কের কেয়ারটেকার কে ঘুষ দিয়ে সে দোলনা টা লাগিয়ে নিয়েছে।

রিহান অবাক হয়ে যায়, সে জানতো না আজ তার জন্মদিন ছিলো। রিফাত পকেট থেকে একটা ক্যাডবেরী বের করে রিহান কে দেয়। রিহান কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকে প্যাকেটটার দিকে। কতদিন খায় নি সে। রিহান চকোলেটটা হাতে নেয়। ছলছল চোখে বলে, “ভাইয়া তুমি অনেক ভাল! তুমি পাঁচটা বিয়ে করবানা কেমন? আমার ভাবীর দরকার নাই, আমার শুধু তুমি ভাইয়া থাকলেই হবে।”

রিফাতেরও চোখ দিয়ে অশ্রু গরিয়ে পরে। সে জড়িয়ে ধরে রিহানকে।

একটু পর ধাতস্থ হয়ে বলে, “তা তোমাকে যে গিফট দিলাম আমাকে খাওয়াবানা? আমাকেও চকোলেটের ভাগ একটু দাও!”

- আচ্ছা চোখ বন্ধ করো।

- চোখ বন্ধ করতে হবে কেন?

- তা তো বলা যাবেনা! খেতে চাইলে চোখ বন্ধ করতে হবে।

রিফাত চোখ বন্ধ করে। বেশ কিছুক্ষন পর রিহান বলে উঠে, “এবার মুখ হা করো”। রিফাত মুখ খোলে। রিহান একটা কিছু ঢুকিয়ে দেয় রিফাতের মুখে। তারপর বলে, “এবার খাও”

রিফাত চিবানো শুরু করার পর পরই থু থু করে উঠে। চোখ খুলে দেখে রিহান ওকে মেহগনির ফল খাইয়েছে। তিতায় মুখ ভরে উঠে ওর। রিফাতের এ অবস্থা দেখে রিহান খিলখিল করে হেসে উঠে। ছড়া কাটা শুরু করে,

“রিফাত বাবু, কমলা লেবু, #মেহগনি খেও না...
দরজা দিয়ে বউ পালাবে টেরও পাবা না!”

রিফাত মুচকি হাসে। তার বউ যে আগের দিনই বাপের বাড়ি চলে গেছে সেটা অবশ্য রিহান জানেনা।.।সকাল সাড়ে ছয়টা। রিহানের ঘুম ভাঙে ঘড়ির এলার্মে। সে লাফিয়ে বিছানায় উঠে বসে। পাশে তাকিয়ে দেখে তার বড় ভাই রিফাত এখনো ঘুমুচ্ছে। রিহান তার ছোট ছোট হাত দিয়ে ভাইয়ের গায়ে ঠেলা দেয়। বলে, “ভাইয়া ভাইয়া উঠো...মর্নিং ওয়াল্কে যাবা না?”

রিহানের এমন ধাক্কাধাক্কিতে রিফাতের ঘুম ভেঙে যায়, মিটমিট করে তাকিয়ে বলে, “রিহু বাবু! তোমাকে না সেদিন বলেছি ওটা ওয়াল্ক না Walk।”

- কিন্তু তোমার লাপটপে সেদিন হাল্কের মুভি দেখলাম না? সেই দৈত্যটার নাম যদি H, u, l, k হাল্ক হয় তাহলে এটাও ওয়াল্ক হবে!

- হাল্কে U আছে তাই ওমন আর এই শব্দে A আছে তাই এটা এভাবে উচ্চারণ করতে হবে।

- না আমি ওয়াল্ক ই বলবো।

- তাহলে তোমাকে আজ আমি খাইয়ে দিবো না যে রিহু বাবু।

এবার রিহান চুপ মেরে যায়। আর সব কিছু বাদ গেলেও সকালের নাস্তা সে তার বড় ভাইয়ের হাতেই খায়। এটা সে কখনো মিস করতে চায় না। সে মেনে নেয় যে শব্দটা ওয়াক। তবে তা ব্রেকফাস্ট পর্যন্তই স্থায়ী হবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা।

ফ্রেশ হয়ে দুই ভাই নাস্তার টেবিলে যায়। বাবা, মা এখনো ঘুমুচ্ছেন। ফ্রিজ থেকে কিছু ফল নিয়ে আসে রিফাত। রিহানের সামনে বসে তার মুখে কাটা আপেলের টুকরা তুলে দেয়।

রিফাত- চোখ বন্ধ করো তো রিহু বাবু।
রিহান- কি দিবা কি দিবা বলো? বলো?

- আগে চোখ বন্ধ করতে হবে যে...

- আচ্ছা করলাম। দাও।

রিহান কিছু পাবার আশায় চোখ বন্ধ করে হাত বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু রিফাত বলে, “উহু, হাতে না। তোমাকে একটা জিনিস খাওয়াবো, মুখ হা করো!”

রিহান ইয়াম্মি বলে মুখ হা করে। আর রিফাত একটা কমলার কোয়ার ভেতর এক গাদা লবন মিশিয়ে রিহানের মুখে দেয়। তিতা কমলার কোয়াটি জোরে চিবানো শুরু করে রিহান। একটু পরেই চোখ মুখ গোল করে ইয়াক থু থু বলে ছুড়ে ফেলে তা।
আর রিফাত খিলখিল করে হেসে উঠে ছড়া কেটে বলে, “রিহান বাবু কমলালেবু, কমলা খেও না...জানালা দিয়ে বউ পালাবে টেরও পাবেনা”

**

পার্কের রাস্তা দিয়ে রিফাত হেঁটে যাচ্ছে, তার কাঁধে চড়ে বসে আছে রিহান। সকাল বেলা তাকে ওমন কমলা খাওয়ানোর প্রতিশোধ স্বরুপ তাকে আজ পুরা পার্ক কাঁধে চড়িয়ে ঘুরিয়ে দেখাতে হবে। ওরা অবশ্য প্রতিদিনই এই পার্কটায় আসে। যখনই রিফাতের হাঁটার গতি স্লো হয়ে যাচ্ছে তখনই রিহান তার মাথার চুল ধরে টান দিচ্ছে, আর ব্যাথায় রিফাত জোড়ে হাঁটতে বাধ্য হচ্ছে। আর এটা দেখে রিহান নিজেই খিলখিল করে হাসছে।

হাঁটতে হাঁটতে একটা ফাঁকা যায়গায় এসে দাঁড়ায় রিফাত। কাঁধে বসে থাকা রিহান কে বলে, “লক্ষ্মি ভাইয়া আমার, এখন একটু নামো। ব্যায়াম করবো! বুকডন দিবো!”

- নামবো যদি তুমি আমাকেও আজ বুকডন দিতে দাও।

- তুমি বাচ্চা মানুষ ভাইয়া, পারবা না।

- না আমি পারবো। জানো কাল আমি একটা চেয়ার সরিয়েছি হাত দিয়ে? আমার গায়ে হাল্কের মত শক্তি আছে!

- ও তাই? তাহলে আমাদের রিহু বাবু একটা মিনি হাল্ক?

- না। আমি রিহান হাল্ক।

রিফাতের কাঁধ থেকে নামে রিহান। রিফাত একের পর এক বুকডন দিয়ে যায় আর রিহান ভালোমত লক্ষ্য করে দেখে। একটু পর সে নিজেও মাটিতে দুই পা মেলে উপুড় হয়ে সামনে দুই হাত দিয়ে নিজেকে উঁচু করে ধরে। তারপর ভাইয়ের বুকডন দেয়া আরও কয়েকবার দেখে নিজেও বুকটা মাটির কাছে নিয়ে যায়। আর থপাস করে মুখ থুবড়ে পরে সেখানে।

রিফাত বুকডন দেয়া থামিয়ে রিফাতের মাটি মাখা মুখের দিকে তাকিয়ে হোহো করে হেসে উঠে। ছড়া পড়ে, “রিহু হলো বিলাই ম্যাও...ভাত নাই, মাটি খাও”

রিহান ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে উঠে। রিফাত তড়িঘড়ি করে ওকে কোলে নিয়ে লেকের দিকটায় যায়। একটা গাছের নিচে বসে। পকেট থেকে একটা ক্যাডবেরী চকোলেট বের করে রিহান কে দেয়। এসব পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য সব সময় এটা রাখতে হয় রিফাত কে। চকোলেট দেখে সাথে সাথে রিহানের কান্না থেমে যায়। ইয়াম্মি বলে চকোলেটের উপর ঝাপিয়ে পরে।

লেকের পাশে কিছু কাপল দেখা যায়। সকাল বেলা জগিং এর নাম করে এখানে এসে মিলিত হয়েছে নিশ্চিত। রিহান ওর ভাই কে বলে, “ভাইয়া ওরা কি করছে ওখানে?”

- গল্প করছে ভাইয়া।

- কি গল্প?

- জানিনা তো।

- ওরা কি ভাই বোন?

- মনে হয় না!

- তাহলে?

প্রেমিক-প্রেমিকা বলা ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারেনা রিফাত, তাই বলে, “ওরা স্বামী স্ত্রী”

- তারমানে ওই মেয়েটা আমার আন্টি হয়!

- ওই মেয়ে তোমার আন্টি হবে কেন?

- কেন বিয়ে হওয়া মেয়েরা আমাদের আন্টি হয় না? আমার বন্ধু রমিমের তিনটা আন্টি।

- ও হাহাহা, এই কথা? রমিমের তিনটা বড় ভাই। তিন ভাই বিয়ে করেছে বলে তাদের বউ গুলা রমিমের আন্টি মানে ভাবী হয়। আমি যদি বিয়ে করি তাহলে আমার বউ তোমার আন্টি হবে। তবে এটাকে ভাবী বলে ডাকবা। আন্টি বলবা না!

- ভাইয়া তুমি কবে বিয়ে করবে?

- কেন? জেনে কি হবে?

- এমনি, তুমি যদি বিয়ে করো তাহলে পাঁচটা ভাবীকে বিয়ে করবে হ্যা? রমিম কে ওর আন্টি গুলা অনেক চকোলেট দেয়, তুমি পাঁচটা বিয়ে করলে আমি রমিমের চাইতে বেশি চকোলেট পাবো!

- হাহাহাহা, আচ্ছা বাবু করবো।

- আমার বিয়ে হবে কবে?

- খাইছে! মানে কি?

- আমার বিয়ে হলে আমার বউও আমাকে আরও চকোলেট কিনে দিবে, তাহলে আমি আরও বেশি চকোলেট খেতে পারবো!

- হাহাহাহাহা, ফাজিল ছেলে। তোমাকে বিয়ে করতে হবেনা। আমার বউই তোমার বউ হবে বুঝছো?

- কি মজা! সত্যি?

- হ্যা! যাও আমি আমার বউ কে তোমাকে দিয়ে দিবো!

- তাহলে আমার আন্টি থুক্কু ভাবী হবে কে?

- উমম...রমিমের বউ। হাহাহা।

- ভাইয়া এই গাছে আমাকে একটা দোলনা লাগিয়ে দিবা? আমার দোলনায় চড়ার খুব শখ।

- ইয়ে ভাইয়া, এটা তো সরকারী পার্ক, এখানে আমাকে দোলনা লাগাতে দিবেনা যে...

“ওওও...” বলে মাথা নামায় রিহান, নিশ্চিত মন খারাপ হয়েছে। রিহানের মন খারাপ দেখে রিফাতেরও মন খারাপ হয়। সে কি মনে হওয়াতে উঠে একটু দূর থেকে একটা পরে থাকা মেহগনি ফল নিয়ে আসে। বলে, “আসো তোমাকে একটা জিনিস শিখাই!” রিহান উৎসুক দৃষ্টিতে তাকায়। রিফাত তখন রিহান কে শিখায় যে কিভাবে মেহগনি ফলের ভেতর থেকে তিতা সাদা অংশ বের করতে হয়। সে আরও বলে এটা কৌশলে খাইয়ে যে কোন বন্ধুর মুখ তিতা করে দিতে পারবে সে।

এমন আবিষ্কারে রিহান তার দোলনার কথা ভূলে যায়।

**

আজ রিহানের বড় ভাই রিফাতের বিয়ের দিন। সারাদিন অনেক হৈ হুল্লোরে কেটেছে রিহানের। প্রচুর চকোলেট আর মিষ্টি খেয়েছে সে। তার আনন্দ সে এখন থেকে পার্মানেন্টলি একজন মানে ভাবীর কাছ থেকে চকোলেট পাবে। তবে সে ভেবে রেখেছে আজ একটা মেয়ের সাথে ভাইয়ার বিয়ে হয়েছে তাহলে নিশ্চিত কাল আরেকটা মেয়ের সাথে ভাইয়ার বিয়ে হবে। এভাবে পর পর পাঁচদিন পাঁচটা মেয়ের সাথে বিয়ে হবে। প্রচুর চকোলেট তখন বার বার রিহানের চোখে ভেসে উঠছিলো। সে সেই অদৃশ্য চকোলেটের দিকে তাকিয়েই ইয়াম্মি ইয়াম্মি করছিলো।

রাতের বেলা স্বভাবতই সে তার ভাইয়ার ঘরে ঘুমুতে যায়। কিন্তু গিয়ে দেখে ভাইয়া নাই। একটা মেয়ে লাল শাড়িতে বসে আছে আর তাকে ঘিরে কিছু মেয়েরা বসে আছে। তাকে একটা বড় মেয়ে ডাক দিলো কিন্তু সে গেলোনা।

একটু পর তার বড় ভাই সেই ঘরে ঢুকলো, এবং সেই লাল শাড়ি পরা মেয়েটা বাদে আর সবাই হাসতে হাসতে বের হয়ে গেলো। রিফাত এগিয়ে এসে রিহান কে বললো,

- ভাবীর সাথে কথা হয়েছে তোমার?

- না তো।

- কথা বলবা?

- না।

- আসো ভাবীর সাথে পরিচিত হও।

- না আমি ঘুমাবো, আমার ঘুম ধরেছে।

- আজ যে তুমি আমার সাথে ঘুমাতে পারবেনা রিহু বাবু। তোমার জন্য একটা সুন্দর ঘর তৈরী করা হয়েছে। তোমার সেখানে থাকতে ভাল লাগবে, অনেক খেলনাও আছে সেই ঘরে।

রিহান কি শুনছে বুঝছেনা। সে কখনো ভাবতেই পারেনা যে ভাইয়াকে ছেড়ে কখনো তাকে একা থাকতে হবে! এ মাথা নিচু করে বলে, “না আমি তোমার সাথে ঘুমাবো!”

একটু পরে তার আম্মু আসেন। বলেন, “রিহান, আজ থেকে এই ঘরে তোমার ভাইয়া আর ভাবী থাকবেন, তুমি অন্য একটা ঘরে ঘুমাবে, আমি তোমাকে ঘুম পারিয়ে দিবো!”

- না আমি ভাইয়ার কাছে ঘুমাবো!

- না বাবা! তোমার ভাইয়া বিয়ে করেছে, তার নতুন বউ এসেছে। তার বউ আজ থেকে তার সাথে ঘুমুবে।

- ওটা শুধু ভাইয়ার বউ না, আমারও বউ। তাই আমিও এখানে ঘুমাবো।

- তোমার বউ কিভাবে?

- ভাইয়া বলেছে তার বউকে আমাকে দিয়ে দিবে, তার বউই আমার বউ। তাই আমি আমার বউ এর সাথে ঘুমাবো।

এমন পাকা কথা শুনে তার মা স্তব্ধ হয়ে যান, শাড়ি পরা মেয়েটার খিলখিল করে হাসির শব্দ শুনা যায়, রিফাতও মিটিমিটি হাসে।

যাই হোক সেদিন জোর করে রিহান কে সেই ঘর থেকে আনা হয়েছিলো। রিহান কেঁদে বুক ভাসিয়েছে, ওর নতুন ঘরের খেলনা গুলা ভেঙ্গেছে, এবং একসময় ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পরেছে।

সকাল বেলা ঘড়িতে এলার্ম বাঁজা শুনে লাফ দিয়ে উঠেছে। চোখ মিটমিট করে তার ভাইয়াকে ধাক্কা দিয়ে বিছানা থেকে ফেলে দিয়ে বলেছে, “ভাইয়া উঠো, মর্নিং ওয়াল্কে যাবো”

কিন্তু আজ তার ভূল উচ্চারন ঠিক করে দিলো না তার ভাই। রিহান ভাল করে চোখ খুলে দেখলো সে তার নতুন ঘরে, আর ধাক্কা দিয়ে যা ফেলেছিলো ভাইয়া মনে করে তা হলো কোলবালিশ।

রিহান দ্রুত বিছানা থেকে উঠে ভাইয়ার ঘরের দিকে যায়। বন্ধ দরজায় ধাক্কা মেরে বলে, “ভাইয়া...ভাইয়া উঠো!”

বেশ কয়েকবার ধাক্কা দেবার পর রিফাত দরজা খুলে। চোখ কচলিয়ে বলে, “কি হয়েছে ভাইয়া?”

- মর্নিং ওয়াল্কে যাবানা?

- আজ থাক ভাইয়া, অন্যদিন যাবো! খুব টায়ার্ড লাগছে।

“না না চলো চলো...” বলে রিফাতের হাত টানা শুরু করে রিহান। কিন্তু রিফাত হাত ঝামটা মেরে ছাড়িয়ে নিয়ে বলে, “বললাম না আজ যেতে পারবো না?”

রিফাতের গলার আওয়াজে চমকে উঠে ভয় পেয়ে যায় রিহান। এই প্রথম এমন করে কথা বললো তার ভাই। সে চুপচাপ মাথা নিচু করে নিজের ঘরে আসে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না শুরু করে।

**

তারপর থেকে রিহান আর কখনো তার ভাইয়ের সাথে থাকার সুযোগ পায়নি। এবং রিফাত, রিহান দুজনেই আর মর্নিং ওয়াকে বের হয় নি। রিহান বুক ভরা অভিমান নিয়ে আর তার ভাইয়ের সাথে তেমন কথাও বলে না। এবং তার ভাবী তাকে এ পর্যন্ত একটা চকোলেটও দেয় নি।

বেশ কয়েক মাস যাবার পর রিহান তার ভাইকে ভাল মত দেখে অবাক হয়ে যায়, কেমন শুকিয়ে গেছে। চেহারা রুক্ষ হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে রাতে ভাইয়ার ঘর থেকে হালকা চিল্লাচিল্লিও শুনতে পায় সে। হয়তো তারা ঝগরা করছে। একদিন রুমের পাশ দিয়ে যাবার সময় রিহান শুনতে পায় তার ভাবীর গলা। ভাইয়াকে জোরে জোরে বলছিলো তিনি নাকি বাপের বাড়ি চলে যাবেন।

তারপর কিছুদিন ঠান্ডা, আবার কিছুদিন ঝগরা। ভাইয়া দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছেন। হয়তো মনে শান্তি নেই। রিহান তার বাবা মাকেও ভাইয়াকে নিয়ে চিন্তিত মনে হয়। সে বুঝে পায় না আগে তো তাদের পরিবার অনেক সুন্দর ছিলো! হঠাৎ করে একি হলো।

যত দিন যাচ্ছে তত যেন পরিবার থেকে শান্তি উঠে যাচ্ছে।

**

সকাল সাড়ে ছয়টা। ঘড়িতে এলার্ম বেজে উঠলো। রিহান এখন আর এলার্মের শব্দ শুনে উঠে না। উঠে লাভও নাই।

কিন্তু রিহানের মনে হলো কে যেনো ওকে ডাকছে, “রিহু বাবু উঠো...মর্নিং ওয়াকে যাবো!”

রিহান জেগে উঠে, এবং অবাক হয়ে দেখে ওর পাশেই ওর বড় ভাইয়া রিফাত। সে নিজের গায়ে চিমটি মেরে দেখে সে স্বপ্ন দেখছে কি না? না সে তো জেগেই আছে। সে বলে, “ভাইয়া তুমি?”

- হা আমি! অনেকদিন ব্যায়াম করা হয়না , চলো আজ সেই পার্কে যাবো।

রিহান অবাক হয়ে যায়। তড়িঘড়ি করে ফ্রেশ হয়। আজ তার ভাইয়া আবার আগের মত তাকে খাইয়ে দেয়। এবং পার্কে যাবার সময় তাকে তার কাঁধে চড়িয়ে নেয়।

রিহান যতটা না অবাক হয়েছে তার চেয়ে বেশি আনন্দ পাচ্ছে আজ। সেই আগের মত দুই ভাই এক সাথে বের হয়েছে।

একটু পর সেই ফাঁকা যায়গায় এসে থামে তারা। রিফাত বলে, “অনেক দিন বুকডন মারিনি। আজ কয়েকটা মারি।” বলে সে ঘাসের উপর হাত রেখে বুকডন মারা শুরু করে। কিন্তু মাত্র কয়েকটা বুকডন মেরে ঘাসের উপর পিছলে পরে। উঠার পর দেখা যায় তার মুখে বালু ভরেছে। রিহান দেখে হেসে উঠে ছড়া কাটে, “রিফাত হলো হনুমান, ভাত নাই বালু খান”

রিফাতও ছড়াটা শুনে হেসে উঠে। তারা হাঁটতে হাঁটতে সে লেকের কাছে এসে পৌছায়। একটু দূরে থাকতেই রিফাত রিহানকে বলে, “চোখ বন্ধ করো তো রিহু বাবু!”

- কেন ভাইয়া?

- আরে করোই না!

- আচ্ছা করলাম।

- আমি না বলা পর্যন্ত চোখ খুলবে না।

- আচ্ছা।

রিহান কিছু পাবার আশায় হাত বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু সেই হাতে কিছু না দিয়ে রিফাত হাতটা ধরে ওকে নিয়ে এগিয়ে যায়। কিছুদূর যাবার পরে এক যায়গায় এসে থামে। তারপর বলে, “এবার চোখ খুলো”

রিহান চোখ খুলে সামনে তাকিয়ে অবাক হয়ে যায়। খুশিতে ওর মনটা নেচে উঠে। কারন সামনের একটা গাছে তার বহু আকাঙ্ক্ষিত দোলনা ঝুলছে। সে খুশিতে ভাইয়ের গলা জড়িয়ে ধরে। রিফাত বলে উঠে, “হ্যাপী বার্থডে রিহান বাবু, এটা তোমার বার্থডে গিফট!” কাল পার্কের কেয়ারটেকার কে ঘুষ দিয়ে সে দোলনা টা লাগিয়ে নিয়েছে।

রিহান অবাক হয়ে যায়, সে জানতো না আজ তার জন্মদিন ছিলো। রিফাত পকেট থেকে একটা ক্যাডবেরী বের করে রিহান কে দেয়। রিহান কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকে প্যাকেটটার দিকে। কতদিন খায় নি সে। রিহান চকোলেটটা হাতে নেয়। ছলছল চোখে বলে, “ভাইয়া তুমি অনেক ভাল! তুমি পাঁচটা বিয়ে করবানা কেমন? আমার ভাবীর দরকার নাই, আমার শুধু তুমি ভাইয়া থাকলেই হবে।”

রিফাতেরও চোখ দিয়ে অশ্রু গরিয়ে পরে। সে জড়িয়ে ধরে রিহানকে।

একটু পর ধাতস্থ হয়ে বলে, “তা তোমাকে যে গিফট দিলাম আমাকে খাওয়াবানা? আমাকেও চকোলেটের ভাগ একটু দাও!”

- আচ্ছা চোখ বন্ধ করো।

- চোখ বন্ধ করতে হবে কেন?

- তা তো বলা যাবেনা! খেতে চাইলে চোখ বন্ধ করতে হবে।

রিফাত চোখ বন্ধ করে। বেশ কিছুক্ষন পর রিহান বলে উঠে, “এবার মুখ হা করো”। রিফাত মুখ খোলে। রিহান একটা কিছু ঢুকিয়ে দেয় রিফাতের মুখে। তারপর বলে, “এবার খাও”

রিফাত চিবানো শুরু করার পর পরই থু থু করে উঠে। চোখ খুলে দেখে রিহান ওকে মেহগনির ফল খাইয়েছে। তিতায় মুখ ভরে উঠে ওর। রিফাতের এ অবস্থা দেখে রিহান খিলখিল করে হেসে উঠে। ছড়া কাটা শুরু করে,

“রিফাত বাবু, কমলা লেবু, #মেহগনি খেও না...
দরজা দিয়ে বউ পালাবে টেরও পাবা না!”

রিফাত মুচকি হাসে। তার বউ যে আগের দিনই বাপের বাড়ি চলে গেছে সেটা অবশ্য রিহান জানেনা।
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্মৃতিপুড়া ঘরে

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৩০



বাড়ির সামনে লম্বা বাঁধ
তবু চোখের কান্না থামেনি
বালিশ ভেজা নীরব রাত;
ওরা বুঝতেই পারেনি-
মা গো তোমার কথা, মনে পরেছে
এই কাঠফাটা বৈশাখে।

দাবদাহে পুড়ে যাচ্ছে
মা গো এই সময়ের ঘরে
তালপাতার পাখাটাও আজ ভিন্নসুর
খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯




মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজীব নূর কোথায়?

লিখেছেন অধীতি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪

আমি ব্লগে আসার পর প্রথম যাদের মন্তব্য পাই এবং যাদেরকে ব্লগে নিয়মিত দেখি তাদের মধ্যে রাজীব নূর অন্যতম। ব্যস্ততার মধ্যে ব্লগে কম আসা হয় তাই খোঁজ-খবর জানিনা। হঠাৎ দু'একদিন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×