somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মাতৃপুরাণ

৩০ শে মার্চ, ২০০৯ দুপুর ২:০৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আদিপর্ব: পাহাড়ে

পাহাড়ের গায়ে লেগে-থাকা শৈবালেরও থাকে পাহাড়কে গিলে খাবার বাসনা। তাদের কোনো একজনের শৈশবের জুতাজোড়ার ভেতর আমার জন্ম। উল্লসিত ঊষাকাল থেকে প্রজ্ঞাশায়িত প্রদোষ অব্দি আমার আয়ুষ্কাল। এর মধ্যেই সকল রহস্য আমি জেনেছি, শুধু সেই বৃষ্টিকে ছাড়া যা আমার পায়ের পাতায় জমে বাতাসের সাহচর্যে উপত্যকায় ফুল ফোটায়।

কেবল স্বপ্নের সাথেই আমি বিবাহিত, পূর্বপার্শ্বের ‘যন্ত্রণা’ নামে যে হ্রদখানি আছে, তার কন্যা সে। আমাকে সে শিখিয়েছিল কিভাবে মাইলের পর মাইল সর্পিল ধূলিপথ পার হয়ে শান্তশিষ্ট একটি সন্ধ্যার হৃদয়ে প্রবেশ করতে হয়। আমাদের প্রথম সন্তান ‘মৃত্যু’।

মৃত্যুর সঙ্গী ছিল না, তাই ওকে জুটিয়ে দেয়া হল ‘ঈর্ষা’ নাম্নী পাহাড়ি ছাগলের সাথে। দুজনেই তাদের পিতামাতার সঙ্গমদৃশ্য লুকিয়ে দেখত। কিন্তু ঈর্ষা মূলত ছিল নিজের ছায়ারই বাগদত্তা, ফলে ওর হাতে অবিশ্বাসের যে সবুজ অঙ্গুরী, সেটা সে রেখে দিল পিতাপুত্র থেকে সমান দূরত্বে। হায় প্রদোষ, আমি কি জানতাম!

যে পাহাড়চূড়ায় ওরা আমাকে প্রোথিত করল, অনেক অনেকদিন পরে তারই কোনো খাঁজে স্বপ্ন আমার মা-কে প্রসব করেছিল।

সমতল পর্ব

মাতৃদেবীর সাথে মৃত্যুর সখ্যতা দীর্ঘ দীর্ঘ সময়ের। তাদের প্রথম সন্তান ‘প্রযুক্তি’ -- বিকলাঙ্গ এই শিশুটিকে ওরা নিক্ষেপ করে অদৃষ্ট নামক অন্ধগহ্বরে। ফেরার পথে তাড়া করে অপরাধবোধের বাদামি ষাঁড়টি। ফলে পাহাড় থেকে পালিয়ে সমতলে। প্রথম কুটির রচনা। পূনর্জন্ম হয় আমার, নাম রাখা হয় ‘অনিদ্রা’।

সুতরাং জন্ম থেকেই আমি হাসপাতালের মত নিরব আর দর্শনার্থীর মত উদ্বিগ্ন একটি দ্বৈততা। বেড়ে ওঠেছি পরিত্যক্ত রেল স্টেশনে, তালি বাজিয়েছি প্রেক্ষাগৃহের দৈনিক উল্লাসে, শুশুকের ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সাঁতরে এসেছি কুমীরে-ভরা নদী। আমি কি জানতাম প্রতিটি রোমাঞ্চযাত্রার শেষে অবধারিত অশ্রুধারায় প্লাবিত হয়ে যাচ্ছে আমার ফেলে-আসা পথরেখা!

তবু ভালো লাগত -- আখাউড়াগামী ট্রেন যখন স্লিপারগুলোর ঘুম ভাঙ্গাতে ভাঙ্গাতে যেত। আমার ছিল মৌন একখানা পাটখড়ির গাণ্ডীব, আর ধ্যানী একজোড়া ঘুড়ি। সকালসন্ধ্যা মৌমাছির চেয়েও ব্যস্ত, কিন্তু জিরাফের থেকেও নিরব। পথে বেরুত নিদ্রামাসি, আমাকে খুঁজে না-পেয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিত গোটা মধ্যাহ্নটিকেই।



ধাঁধা এবং প্রবাদ: যুদ্ধপর্ব

ধাঁধা ওর কুমারী মায়ের গর্ভপাতের ফলে নষ্ট হয়ে যাওয়া সন্তান। প্রবাদের সাথেও সখ্যতা হয়নি, না-হওয়াটাই তখন প্রথা। সেই আমার প্রথম শরসন্ধান, অশ্বমেধের শুরু। তারপর রক্তক্ষয়ী কত যুদ্ধ, যুদ্ধবন্দী হয়ে এল ‘কল্পনা’ – ঘুমন্ত স্তনস্পর্শের শিহরণ থেকে ওর জন্ম। আমার ক্রোধের ওপর পোশাক খুলে রাখল সে, আমার দিগ্বিজয়ের বাসনাকে চেপে ধরল ঠোঁট দিয়ে। আমারও গাণ্ডীব নমিত হয়ে এল, পৃথিবীর মহান পরাজিত সেনাপতিদের মত।

আমি আর কল্পনা, ঘর বাঁধলাম রকমারি পার্বণে – কৃষিসভ্যতার শিরার ভিতর দিয়ে বিন্দু বিন্দু স্যালাইনের মত ঝরছিল ওরা। হাওয়া বইছিল পূব থেকে পশ্চিমে, কথা বলা শিখছিল মেঘনা, দিনে-দিনে আরো অপ্রতিভ হয়ে যাচ্ছিল ব্রহ্মপুত্র। উত্তর থেকে ঘাটে এসে ভিড়ছিল ধানবোঝাই নৌকা, ফিরে যাচ্ছিল আখের গুড়ের গন্ধে মাতাল হয়ে। তবুও বাণিজ্য হয় নি প্রবাদের সাথে, না-হওয়াটাই তখন প্রথা।

প্রথার ঘোড়াটি ছিল কৃষ্ণবর্ণের, আর হাতের চাবুকটিতে ছিল মৃত দাড়াশের হামবড়া ভাব। পূর্বপুরুষদের দর্পিত পোর্ট্রেটগুলোর মধ্যে বসে আলবোলা টানত সে। শেষবার ওকে যারা ঘরের বার করতে পেরেছে, আমার পিতা সেই অবশিষ্ট লাঠিয়ালদের একজন। আজ অনেকদিন পর যখন ওর দরজায় নিজের মাথা রক্তাক্ত করছি -- মর্মর উঠল বাঁশবনে।

নির্বাসনপর্ব


মাতৃহাসিখানি আজো কাঠের পুরনো দোতলা বাড়ির মত। তার ঔজ্জ্বল্যের ছায়া ম্লান হয়ে পড়েছে আমার মুখমণ্ডলে। মৃত্যু উদ্ভিদ হয়ে জন্মেছে ওর নিজেরই উঠানে, শুধু বিচিত্র ফলের সম্ভারে সে আমার মাতৃমুখটিকে বন্দী করে রেখেছে। আমার পা জড়িয়ে আছে ওর শেকড়ে, সেই আর্তি আমি ছড়িয়ে দিচ্ছি ওরই ডালপালায়। ধাঁধাবিজিত প্রবাদে-বন্দী জীবন -- একবার মাত্র জীর্ণ কোনো কবরের উপর দিয়ে খুব নিচু হয়ে উড়ে যেতে পেরেছি। সেই প্রশান্তিটুকুই ফুটে আছে ঘাসে ঘাসে, ঝোপের অযত্নে, ঝোপের লাবণ্যে।

১৯৯৩
৬টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

গণতন্ত্র আর বাক-স্বাধীনতার আলাপসালাপ

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:২৩


একাত্তর সালে আওয়ামী লীগের লোকজন আর হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা ছিল পাকবাহিনীর প্রধান টার্গেট। যদিও সর্বস্তরের মানুষের ওপর নিপীড়ন অব্যাহত ছিল। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধা আর তাদের পরিবারের... ...বাকিটুকু পড়ুন

কাফের কুফফারদের দেশে বাস করা হারাম।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:১৩

ফেসবুকে বাঙালিদের মধ্যে ইদানিং নতুন এক ফতোয়া চালু হয়েছে, এবং তা হচ্ছে "দাওয়াতের নিয়্যত ছাড়া কাফের কুফফারদের দেশে বাস করা হারাম।"
সমস্যা হচ্ছে বাঙালি ফতোয়া শুনেই লাফাতে শুরু করে, এবং কোন... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধাদের মুমিনী চেহারা ও পোশাক দেখে শান্তি পেলাম

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:৫৮



স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে স্টেজে উঠেছেন বত্রিশ মুক্তিযোদ্ধা তাঁদের চব্বিশ জনের দাঁড়ি, টুপি ও পাজামা-পাঞ্জাবী ছিলো। এমন দৃশ্য দেখে আত্মায় খুব শান্তি পেলাম। মনে হলো আমাদের মুক্তিযোদ্ধা আমাদের মুমিনদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দুই টাকার জ্ঞানী বনাম তিনশো মিলিয়নের জ্ঞানী!

লিখেছেন সাহাদাত উদরাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ২:৫৯

বিশ্বের নামীদামী অমুসলিমদের মুসলিম হয়ে যাওয়াটা আমার কাছে তেমন কোন বিষয় মনে হত না বা বলা চলে এদের নিয়ে আমার কোন আগ্রহ ছিল না। কিন্তু আজ অষ্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত ডিজাইনার মিঃ... ...বাকিটুকু পড়ুন

×