somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

উইকিলিকস-অ্যাফেয়ার

১০ ই ডিসেম্বর, ২০১০ সকাল ৯:১১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

যেসব তথ্য দীর্ঘদিন অনুমান, সন্দেহ কিংবা কানাঘুষা-আকারে জানা ছিল, উইকিলিকস তাকে প্রামাণিকতা দিয়েছে মাত্র। এসব গোপন নথির "ফাঁস" হয়ে যাওয়ার প্রেক্ষিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক-কুটনৈতিক সম্পর্ক কিংবা সামরিক প্রতিষ্ঠান কোনোটাই অচিরাৎ ধ্বসে পড়ার সম্ভাবনা নেই। উইকিলিকস-এর এই অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার ধারাবাহিকতায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কোনো বিপ্লবও সংঘটিত হবে না। তাহলে, জুলিয়াস অ্যাসাঞ্জের এই কীর্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে এইরকম খ্যাপা কুত্তার দশায় ফেলল কেন? কোথায় সমস্যা তৈরি করলেন এই সাংবাদিক?


আমি মনে করি, জুলিয়াস আঘাত করেছেন মার্কিন হেজিমনিতে। হেজিমনি গড়ে ওঠে সম্মতির মধ্যে, যার বিস্তার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার সম্মতিদানগোষ্ঠীর মধ্যে গড়ে উঠতে দেখেছে গত অর্ধশতক ধরে, যারা তার স্পাইডার ওয়েবে নিরুপায় মাছির মত আটকা পড়ে আছে বুকভরা কামনা, চামচভরা প্রাপ্তি আর চোখভরা সন্দেহ নিয়ে। এই গোষ্ঠীর চোখে যেন ব্রাত্য রাইসুর কবিতার সেই প্রশ্ন: বাঘ বুঝবে আমায়? আমি জানি এবং জানি না, এভাবে বাঘের হেজিমনি তৈরি হয় আমার মনে। স্নায়ুযুদ্ধোত্তর ইউনিপোলার দুনিয়ায় এই হেজিমনি আরো তুখোড় হয়ে ওঠে। নিশ্চিত শত্রুতার সাবেক সম্পর্কগুলো পর্যন্ত এই সম্মতিদানের খেলায়, এই অন্তর্গত দোলাচলে সামিল হয়: বাঘ বুঝবে আমায়?


জুলিয়াস অ্যাসাঞ্জের "অপরাধ" হল, মার্কিন হেজিমনির মায়াবি পর্দাটা ছিঁড়েখুঁড়ে ফেলেছেন তিনি। ফলে বহির্বিশ্ব সম্পর্কে যেসব মার্কিন-মনোভাব প্রায়-প্রকাশ্য, অনুমান আকারে অহরহ উচ্চারিত, তাকে "ক্লাসিফায়েডে" পুরে রেখে, তার ব্যাপারে যেসব সংশয়ী কামনা সে তার মিত্রদের মাঝে বেড়ে ওঠতে দেখছিল, জুলিয়াস মার্কিন হেজিমনির সেই আত্ম-উদযাপনের বিনোদন নষ্ট করে দিয়েছেন।


জুলিয়াস কি নিও? নাকি "ভার্চুয়াল রবিন হুড"? নাকি বিন লাদেন? এদের বীরত্ব দিয়ে জুলিয়াসকে বুঝতে সমস্যা হয় আমার। তবে, বীর তিনি নিশ্চিত। তাহলে পৃথিবীর অনিঃশেষ পুরাণভাণ্ডার থেকে কোন্ চরিত্র তার জন্য বরাদ্দ করা যায়?


মিথলজিক্যাল, লিজেন্ডারি কিংবা সিনেম্যাটিক চরিত্রগুলো তৈরি হয় বাই-পোলারিটির মাধ্যমে। এই ধরনের "বাইনারী-অপজিট" (ভাল-মন্দ, শুভ-অশুভ, ন্যায়-অন্যায়) এর ধারণা, দেরিদা যেমন ভাবেন, শাদামানুষের বিশ্বাসকে অগ্রায়ন করার মাধ্যমে পাশ্চাত্যের ক্ষমতাকাঠামোকেই শক্তিশালী করে। মার্কিন হেজিমনি যে বাই-পোলারিটির ধারণার ওপর গড়ে উঠেছে, জুলিয়াস তারও সর্বনাশ করেছেন। তিনি শাদা, অস্ট্রেলিয়ান, ইংল্যান্ডে ও সুইডেনে বসবাসকারী, অমুসলিম। ফলে তিনি মিথ-বিধ্বংসী এক নতুন মিথ।


কিন্তু তাকে মোকাবেলা করতে গিয়ে মার্কিন পৌরাণিক বলয়ের বাইরে যাবে মনে হয় না। পুরাণ-ধ্বংসের শাস্তিও পৌরাণিক হবার কথা। কী হবে জুলিয়াসের? আহত মার্কিন নিশ্চিতভাবেই জুলিয়াসকে দীর্ঘমেয়াদী পৌণপুণিক শাস্তির মহিমা দিয়ে তার সেক্সি হেজিমনি পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা করবে, যেটা তারা লাগাতার করছে বিন লাদেনকে বাঁচিয়ে রেখে-রেখে। ফলে নতুন-মিথ জুলিয়াসের অপরাধের শাস্তি পৌরাণিক ম্যানুয়াল ঘেঁটেই বের করা হবে। প্রমিথিউস। বা সিসিফাস।


এই নতুন মিথকে আমাদের সামনে এনে দিয়েছে নতুন মিডিয়া। ফলে আমরা তার প্রশংসা করছি। পাশাপাশি, গালমন্দও করছি কর্পোরেট-শাসিত মিডিয়াগুলোকে। এটা করতে গিয়ে আমরা খেয়াল করছি না যে, হাত-পা বাঁধা কর্পোরেট মিডিয়াও কিন্তু ব্রেখটিয়ান স্টাইলে এই লড়াইয়ে সামিল আছে। ভাবলেশহীন নিউজকাস্টার এবং ইনোসেন্ট মুদ্রকের মত এই অনলাইন মিডিয়াকে সে লোকের হাতে তুলে দিচ্ছে। মানুষ এখনো স্থানিকতার মহিমা দিয়েই বোঝে সবকিছু। ফলে, জুলিয়াস আন্তর্জাতিক হয়েও অস্ট্রেলিয়ান, নইলে অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী কেভিন রাড (জুলিয়াসের বাড়ি যার সংসদীয় এলাকায়) কেন অদ্ভূত দ্ব্যর্থবোধক বিবৃতি দেবেন, যে, তথ্যফাঁসের জন্য জুলিয়াস নয় -- আমেরিকা দায়ী!


এই গল্পের শেষ কোথায়? উইকিলিকস-অ্যাফেয়ার মার্কিন-প্রবর্তিত বিশ্বব্যবস্থাকে রাতারাতি বদলে ফেলবে না। সৌদী বাদশা, অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী বা মিসরের প্রেসিডেন্ট আগে যা করছিলেন তাই করতে থাকবেন। শুধু আগের সেই মোহখানি তারা হারিয়ে ফেলবেন, কারণ জুলিয়াস তাদের প্রত্যেকের সামনে কিং-সাইজ আয়না দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। হেজিমনির মোহমায়ায় এখন আর তারা গাইতে পারবেন না "আমার আঁধার ভাল"! এ যেন আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের সেই নারীর মত যিনি তার স্বামীকে ভালবাসেন এবং স্বামীর ভালবাসাকে সন্দেহ করেন। স্বামীর কাছে স্ত্রীর এই মৃদুমন্দ সন্দেহ নিঃসন্দেহে উপভোগ্য, কারণ এতে করে স্বামীপ্রবর নিজের স্ত্রীর ওপর নিজের সীমাহীন প্রভাব বুঝতে পারেন। হেজিমনি তৈরি হয়। এখন কেউ যখন স্বামীর পরকীয়া প্রেমের/ স্ত্রীর প্রতি বিরাগের অকাট্য প্রমাণ সেই নারীর কাছে হাজির করবে, তিনি কী করবেন? যাই করুন তিনি, সংসার থাকুক বা নাই থাকুক, হেজিমনি আর থাকছে না নিশ্চিত। হেজিমনিহীনতায় মার্কিন কিভাবে বাঁচিবে?


প্রতীকী অর্থে, উইকিলিকস-এর হামলা টুইনটাওয়ার হামলা থেকেও সুদূরপ্রসারী। টুইনটাওয়ার হামলা মার্কিন হেজিমনিতে আঘাত করে নি, বরং তাকে সংহত করেছে। এর ফলে রেনেসাঁ-উত্তর মার্কিন ও তার মিত্রশক্তির পক্ষে দুনিয়াকে জাতিগোষ্ঠী ও ধর্মগোষ্ঠীর বিভাজনে শাসন করার উছিলা তৈরি হয়েছে। উইকিলিকস তাকে এই সুযোগটা দেয় নি। তার হামলা মায়াবি, কারণ তিনি কোনোভাবেই পাশ্চাত্যের ডিফাইনড শত্রুবলয়ের প্যারাডাইমে বসবাস করেন না। (জুলিয়াসের এই স্থানিকতাকে আমাদের রিকনফার্ম করতে হবে।) তার ওপর, এই হামলায় আহত হবার দায় কেউ মুখে স্বীকার করবে না। সত্যিকারের অন্তর্ঘাতমূলক কাজ।

স্নায়ুযুদ্ধোত্তর মার্কিন হেজিমনির উঠানে জুলিয়াসই প্রথম বিষবৃক্ষ। তিনি ক্রমশই ফুলে-ফলে পয়মন্ত হতে থাকবেন, তার মৃত্যুতে, শাস্তিতে, কিংবা যাবতীয় অপবাদের ভেতর। ফলে, গল্পের শুরু এটা।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই ডিসেম্বর, ২০১০ সকাল ৯:১২
৮টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ঝিনুক ফোটা সাগর বেলায় কারো হাত না ধরে (ছবি ব্লগ)

লিখেছেন জুন, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৮:০৯

ঐ নীল নীলান্তে দূর দুরান্তে কিছু জানতে না জানতে শান্ত শান্ত মন অশান্ত হয়ে যায়। ১৯২৯ সালে রবার্ট মোস নামে এক ব্যাক্তি লং আইল্যান্ড এর বিস্তীর্ণ সমুদ্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

মামুনুলের মুক্তির খবরে কাল বৃষ্টি নেমেছিল

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৪৯


হেফাজত নেতা মামুনুল হক কারামুক্ত হওয়ায় তার অনুসারীদের মধ্যে খুশির জোয়ার বয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ তো বলল, তার মুক্তির খবরে কাল রাতে বৃষ্টি নেমেছিল। কিন্তু পিছিয়ে যাওয়ায় আজ গাজীপুরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

'চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি'

লিখেছেন এমজেডএফ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


নীলসাধুকে চকলেট বিতরণের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসী ব্লগার সোহানীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বিলম্বে হলেও আমরা জেনেছি। যাদেরকে চকলেট দেওয়ার কথা ছিল তাদের একজনকেও তিনি চকলেট দেননি। এমতাবস্থায় প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বরাবর ব্লগ কর্তৃপক্ষ

লিখেছেন নীলসাধু, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২২

আমি ব্লগে নিয়মিত নই।
মাঝে মাঝে আসি। নিজের লেখা পোষ্ট করি আবার চলে যাই।
মাঝেমাঝে সহ ব্লগারদের পোষ্টে মন্তব্য করি
তাদের লেখা পড়ি।
এই ব্লগের কয়েকজন ব্লগার নিজ নিক ও ফেইক... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ অপেক্ষা

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২৩



গরমের সময় ক্লাশ গুলো বেশ লম্বা মনে হয়, তার উপর সানোয়ার স্যারের ক্লাশ এমনিতেই লম্বা হয় । তার একটা মুদ্রা দোষ আছে প্যারা প্রতি একটা শব্দ তিনি করেন, ব্যাস... ...বাকিটুকু পড়ুন

×