somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

এক প্রতিবন্ধী শিশুর ইচ্ছার গল্প

২৬ শে মার্চ, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:১৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সেদিন ছিল মঙ্গলবার। বরাবরের মতো সেদিন ও ছিল স্কুলে ভর্তিচ্ছু বাচ্চাদের এসেসমেন্ট এর দিন। সেদিন আবার আমার স্কুল পরিদর্শনে এসেছেন সেনাপ্রধান। পুরো স্কুলজুড়ে একটা তটস্থ ভাব। এর মধ্যেই একে একে বিভিন্ন বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন বাচ্চা আসছে আর আমি তাদের স্পীচ থেরাপী এসেসমেন্টটা করে দিচ্ছি। হথাৎ করে এক বাচ্চা আসলো বেশ ভালো কথা বলে। তাকে যেটাই জিজ্ঞেস করি বেশ ভালো করে সব কিছুর বর্ননা দেয়।
তার সাথে আমার কথোপকথনটা অনেকটা ছিল এইরকম।
- নাম কি??
- বাচ্চা উত্তরে তার নাম বলল।
- বাবার নাম কি??
- বাচ্চা উত্তরে তার বাবার নাম, মায়ের নাম, দাদা এবং দাদীর নাম ও আমাকে বলে ফেললো। আরও বলল তার বাবা এখন বেঁচে নেই। মায়ের সাথেই সে থাকে।
- বাসা কোথায়??
- বাসা তেজকুনিপাড়া, সংসদ ভবনের সামনে। অখানে যেয়ে দেখবেন কয়েকটা গেট আছে, অখানে তিন নম্বর গেটটা দিয়ে ঢুকে, সামনে এগিয়ে গিয়ে একটা স্কুল পাবেন অখান থেকে কিছুটা ডানে গেলে পাবেন কয়েকটা বাসা। অখানকার নীল রঙের বাসাটা আমাদের। ওটার ৫ তলার ডান পাশে আমি থাকি। আমার দাদার নাম, আব্বুর নাম বললেই যে কেও আপনাকে দেখিয়ে দেবে, বাসা নম্বর এতো! রোড নাম্বার এতো!
- আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে, তা তুমি কোন স্কুলে পড়?
- আমি আমার বাসার কাছের একটা স্কুলে পড়ি। আমার বাসা থেকে হেটে হেটে স্কুলে যাওয়া যায়। ওটা ছোট একটা কিন্ডার গার্ডেন স্কুল। ভালো না। আমি আমার চাইতে বয়সে ছোট অনেকের সাথে ক্লাস করি। অদের সাথে আমার ক্লাস করতে ভালো লাগে না।
- তাহলে তুমি অখানে ক্লাস কর কেন??
- আমি অনেক লেখাপড়া করবো। লেখাপড়া করে আমি তিন বাহিনীর প্রধান হবো।
তার জন্য আমি প্রতিদিন স্কুলে যায়।
কথোপকথনের এ অবস্থায় একটু বিষম খেলাম ছেলেটি কথা চালিয়েই যেতে থাকলো।
- আমি আর্মির সব কিছু দেখি, সমরাস্ত্র যাদুঘর, ক্যান্টনমেন্ট এ আমি প্রায়ই ঘুরতে আসি। এ বছর প্যারেড গ্রাউন্ড এ সেনাবাহিনীর কোন অনুষ্ঠান হয় নি। আমি প্রতি বছর বিজয় দিবসে ঐ অনুষ্ঠান দেখতে যায়। এবার আমি যেতে পারিনি। অনুষ্ঠান দেখতে পারিনি। তাই আমার মন খুব খারাপ। অমার মন অনেক খারাপ।
- আমার তো আজকে কপাল ভালো। অফিসে সেনাপ্রধান, সামনে হবু তিন বাহিনীর প্রধান। তা কি তুমি তার সাথে দেখা করতে চাও।
- না। আমি অনুষ্ঠান না দেখে খুব মন খারাপ করছিলাম। পরে আমার মামা আমাকে সাভার ক্যান্টনমেন্ট এ নিয়ে গেছিলো। আমি ওখানে ট্যাঙ্কের সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে চাইছিলাম কিন্তু ওখানকার এম পি পুলিশ আমাকে ছবি তুলতে দেয়নি। আমি খুব মন খারাপ করছিলাম।
এ অবস্থায় আমি পরিস্থিতি হালকা করার উদ্দেশ্যে তাকে বললাম। এম পি বলল আর তুমি ছবি তুললে না!!! তুমি ভবিষ্যতে তিন বাহিনীর প্রধান হবে। তুমি একটা এম পি কে ধমক দিলেই তো সে চুপ করে যেত।
- না!! ঐ যে আমাকে বলল ছবি তুললে বেধে রাখবে।
এ অবস্থায় আমি আর না হেসে পারলাম না। বললাম, আচ্ছা ঠিক আছে তুমি একদিন ঠিকই তিন বাহিনির প্রধান হবে। ঠিক মতো পড়ালেখা চালিয়ে যাও। সে দোয়া চেয়ে সেদিন চলে গেলো।
এই ঢাকা শহরে অনেক প্রতিষ্ঠান আছে যারা বিশেষ শিশুদের নিয়ে কাজ করে। কিন্তু আমার এই প্রতিষ্ঠানের মতো সেবা দিতে তারা বিভিন্ন কারনে ব্যর্থ্য হয়। কারো ফান্ডের অভাব, কারও প্রশিক্ষিত কর্মীর অভাব। আর একটা অভাব সবারি একঃ কারোরই পর্যাপ্ত যায়গা নেই কাজ চালাবার মতো। হয়তো কয়েকটি ফ্লাট বা সম্পুর্ন একটা বাসা বাড়ি নিয়েই কাজ চালাতে হয়। সে সব অভাব আমার এই প্রতিষ্ঠানের নেই। তাই ভর্তিচ্ছু শিশুর চাপ এই প্রতিষ্ঠানে অনেক বেশী। এ কারনে আমার এই প্রতিষ্ঠানে ভর্তিচ্ছু সবাইকে ভর্তি করানো অনেক সময়ই সম্ভব হয় না। হয়তো এই কারনেই পরে আর শিশুটি আমার প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে পারেনি বা হয়নি। কিন্তু ওর কথাগুলো ঠিকই মাথার মধ্যে বাজে। মন থেকে কোনদিন মুছে যায় নি, হয়তো কোনদিন যাবেও না।
এর কয়েকদিন পরেই স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগীতা অনুষ্ঠিত হল। সেদিন যেমন খুশী তেমন সাজো তে কেও সেজেছিল নবাব সিরাজুদ্দৌলা, কেওবা শেয়ার ব্যাবসায়ী, কেওবা সেনাবাহিনী অফিসার কেও নৌবাহিনী অফিসার কেওবা বিমান বাহিনী অফিসার। এদেরকে দেখে সেদিন সেই কথা খুব মনে পড়ছিল। ইচ্ছা হচ্ছিল কি এমন ক্ষতি হত যদি ওকে সেদিন তিন বাহিনীর প্রধান সাজিয়ে দিতাম। এমন কোন পদ নেই যদিও। প্রতি বাহিনীর প্রধান ও আলাদা, পোশাকও তাদের আলাদা। তাকে না হয় পড়িয়ে দিতাম তাকে পড়িয়ে দিতাম নৌবাহিনীর সাদা একটা প্যান্ট, বিমান বাহিনীর একটা সার্ট, সেনাবাহিনীর একটা টুপি। দুকে না হয় লাগিয়ে দিতাম অনেকগুলো ব্যাচ। গলার কলারে ঝুলতো লাল তারা লাগানো লাল ফিতা। কাধে লাগিয়ে দিতাম সেনাপ্রধানের চারটি ঝকঝকে তারা। না হয় লাগিয়ে দিতাম একটি বেশীই। কিছুক্ষনের জন্য সে হয়ে যেত ফিল্ড মার্শাল। তিন বাহিনীর প্রধান সেজে সে সেদিন দেশের বড় বড় জেনারেল দের সামনে দিয়ে বুক ফুলিয়ে হেটে যেতো। তার জীবনের একমাত্র বড় আশাটি সেদিন কিছুক্ষনের জন্য পূরন হতো। সেদিনের দিনটার গল্প সে সাড়াজীবন অন্যদের শোনাতো। কিন্তু আমি কিছুই করতে পারিনি তার জন্য। হয়তো তাদের জন্যও। একজন স্পীচ থেরাপিষ্ট হয়ে শুধু তার কথা মনে করা ছাড়া আর কিই বা আমি করতে পারি। নিজেকে পেশাজীবি হিসাবে অনেক সময়ই অক্ষম মনে হয় যেমন মনে হয়েছিল সেদিন। সেদিন তাই আশেপাশে সবার আনন্দের মাঝে শুধু আমিই ছিলাম কিছুটা আনমনা।

সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে মার্চ, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:৩৪
৪টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা সকলের দায়িত্ব।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৩৮



এগুলো আমার একান্ত মতামত। এই ব্লগ কাউকে ছোট করার জন্য লেখি নাই। শুধু আমার মনে জমে থাকা দুঃখ প্রকাশ করলাম। এতে আপনারা কষ্ট পেয়ে থাকলে আমি দায়ী না। এখনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

তাবলীগ এর ভয়ে ফরজ নামাজ পড়ে দৌড় দিয়েছেন কখনো?

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:২৬


আমাদের দেশের অনেক মসজিদে তাবলীগ এর ভাইরা দ্বীন ইসলামের দাওয়াত দিয়ে থাকেন। তাবলীগ এর সাদামাটাভাবে জীবনযাপন খারাপ কিছু মনে হয়না। জামাত শেষ হলে তাদের একজন দাঁড়িয়ে বলেন - °নামাজের... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফেতনার সময় জামায়াত বদ্ধ ইসলামী আন্দোলন ফরজ নয়

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ১১:৫৮



সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ১০৩ নং আয়াতের অনুবাদ-
১০৩। তোমরা একত্রে আল্লাহর রজ্জু দৃঢ়ভাবে ধর! আর বিচ্ছিন্ন হবে না। তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ কর।যখন তোমরা শত্রু ছিলে তখন তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

=নীল আকাশের প্রান্ত ছুঁয়ে-৭ (আকাশ ভালোবেসে)=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:১৯

০১।



=আকাশের মন খারাপ আজ, অথচ ফুলেরা হাসে=
আকাশের মন খারাপ, মেঘ কাজল চোখ তার,
কেঁদে দিলেই লেপ্টে যাবে চোখের কাজল,
আকাশের বুকে বিষাদের ছাউনি,
ধ্বস নামলেই ডুবে যাবে মাটি!
================================================
অনেক দিন পর আকাশের ছবি নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

পানি জলে ধর্ম দ্বন্দ

লিখেছেন প্রামানিক, ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৫২


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

জল পানিতে দ্বন্দ লেগে
ভাগ হলোরে বঙ্গ দেশ
এপার ওপার দুই পারেতে
বাঙালিদের জীবন শেষ।

পানি বললে জাত থাকে না
ঈমান থাকে না জলে
এইটা নিয়েই দুই বাংলাতে
রেষারেষি চলে।

জল বললে কয় নাউযুবিল্লাহ
পানি বললে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×