‘বাজান কই গেছিলা।’
:হাতজোড়া সামনে বাড়িয়ে কোলে উঠতে উঠতে মহিন বললো
‘আজ আমি তকমা(ছক্কা) মারছি ।’
:‘আমার বাজান বড় অইলে মেলা বড়ো বড়ো আরও তকম(ছক্কা) মারবো।’ মহিনের গায়ে স্নেহপরায়ন হাত বোলিয়ে শফিকের জবাব ।
মহিন কাচুমাচু শুরু করলো; কোল থেকে নামিয়ে দিলো শফিক । যেই না নামিয়ে দিলো, তখন বস্তাটা হাতে নিয়ে,এক হাতে হাফপ্যান্টটা উপরে তুলতে তুলতে দৌড়ে চলে গেল মাঠের দিকে ।
মহিনএকজন বুদ্ধি প্রতিবন্ধী। বয়সের তুলনায় এখনো ঠিকঠাকভাবে কথা বলতে শেখে নি। কথায় আড়ষ্টতা স্পষ্ট ।
হেমন্তের শেষাংশের বিকেল । মিষ্টি রোদে শস্যহীন সবুজ মাঠ হাসছে।সবুজ ,হলদে ঘাসগুলো প্রশান্তিচিত্তে খেয়ে যাচ্ছে গবাদি পশুগুলো ।
মহিন বস্তা ভরে শুকনো গোবর কুড়াবে । অনেকক্ষণ ধরে শুকনো গোবর কুড়াচ্ছে । কেউ কেউ তাঁর বস্তা থেকে শুকনো গোবর নিয়ে যাচ্ছে । এসব দেখেও মহিন বাঁধা দিচ্ছে না । একান্ত মনে নিজের কাজ করছে ।
একজন বললো ‘অই মইন্না,’ ‘তর বস্তা ভরতো না,বাড়িত জা গা, ‘
:কাআলহাও(কালকেও) খেলাত আমারে লইবি(নিবি)?
মহিনের চিন্তা আজকের মতই আরও ক্রিকেট খেলবে সে । সে সুযোগ পাই না খেলার । তাকে কেউ দলে নিতে চাই না ।
বস্তাটি মাথায় নিয়ে টলতে টলতে অস্তমান সূর্যের মুখ হয়ে বাড়ি যাচ্ছে । প্রতিদিন শুকনো গোবর সংগ্রহ করে মহিন। জমতে জমতে অনেকগুলো গোবর হয়েছে । টিলাটা বড় দেখায় এখন । নির্দয় শীতের প্রস্তুতি নিচ্ছে সে । সকাল-সন্ধ্যা আগুন পোহাবে মহিন ।
টিপটিপ পায়ে চারদিকে তীব্র শীত হুমড়ি খেয়ে পড়ছে । রাতের শেষটাই শফিকের পরিবারের একদম ঘুম হয় না । মসজিদে আজান দিতেই উঠে পড়লো শফিক । খড়- কুটো,হেমন্তী নাড়া আর কিছু শুকনো গোবর পুড়িয়ে ,শীতকাতর দেহকে উষ্ণ করবে ।
:‘মহিন সজাগ হইছিস,’‘আয় রে বাজান আগুন ধরছি,’ সফিক বললো ।
:‘হু,’ ‘বাজান! বলেই ঘুমহীন রক্তাভ চোখ নিয়ে চলে আসলো অাগুনে পাশে ।
:এসেই মহিন বললো ‘আমার ঘুমতে আরি না (ঘুমাতে পারি),’
‘:আর কয়টা দিন কষ্ট করো বাজান শীত চলে যাবে,’ সফিক নিজের শরীরের চাদরটা মহিনের গায়ে দিতে দিতে দিতে বললো ।
আগুনে পুড়িয়ে মেরা পিঠা খেতে খেতে সূর্যালোক উকি দেয় উঠানপানে । তখন শফিক চলে যাই মাঠে ।আর মহিন, বাড়ির সামনে মেঠো পথে বসে আঁকুবুকি করতে থাকে ,সূর্যের তাপের প্রখরতায় শরীরটা চনমনে হয়ে উঠে তার । সময় গড়ানোর সাথে সাথে সমবয়সী ছেলে-মেয়েরা স্কুলগামী হয় । মহিনের তাড়া নেই স্কুলে যাওয়ার । একাকীত্বের খেলায় সময়টা ভালোই যাই মহিনের । একদিন স্কুলে যাওয়ার জোক পেয়ে বসলো । সেদিন চলে যাই স্কুলে । ময়লাটে কাপড়,শীর্ণ-জীর্ণ দেহ দেখে অনেকগুলো উৎসুখ চোখ চেয়ে থাকছিলো কিন্তু সে সবের প্রতি কোনো দৃষ্টি নেই । ক্লাসে গিয়েই অন্য একজনের বই নিয়ে বসে রইল বেঞ্চে । তারপর বই চুরির জন্য ছেলেটি খুব মেরে রক্তাত্ব করলো । মহিন একটি আঁচরও দেয়নি । বই রেখে দৌড়ে পালিয়ে এলো ।
শীত আসে,শীত যায় । মহিন সেই আগের মত খড়-কুটো ,গোবর কুড়ায় ।মহিনের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয় না । শীতের তীব্রতায় হাড় কাঁপুনি আসে । আগুন এখন নিজেই ধরাতে পারে । মাঝে মাঝে কেউ কেউ আসে আগুন পোহাতে । চলেও যায় । কিন্তু মহিনের উষ্ণতা গ্রহণ শেষ হয় না, যতক্ষণ না পর্যন্ত সূর্য উঠে ।
সঙ্গহীন মহিন কতারোক্তি করে জিজ্ঞেস করে
‘বাজান আয়ে(আসে) না?’