somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জলমানব-কল্পবিজ্ঞান উপন্যাস - মুহম্মদ জাফর ইকবাল

০৭ ই ডিসেম্বর, ২০০৬ দুপুর ১২:২৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কল্পবিজ্ঞান উপন্যাস - মুহম্মদ জাফর ইকবাল

সৌজন্যেঃ প্রথম আলো ঈদ সংখ্যা ২০০৬
http://omiazad.wordpress.com

কায়ীরা কোমরে হাত দিয়ে খানিকটা অনিশ্চিত ভঙ্গিতে ভাসমান দ্বীপটির কিনারায় নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে ছিল। সমুদ্রের ছোট ছোট ঢেউ মৃদু শব্দ করে ভাসমান দ্বীপের পাটাতনে আছড়ে পড়ছে, কায়ীরার দৃষ্টি এই সবকিছু ছাড়িয়ে বহুদূরে কোথাও আটকে আছে। তাকে দেখে মনে হয় না সে নির্দিষ্ট করে কিছু দেখছে, চারিদিকে যতদূর চোখ যায় শুধু সমুদ্রের নীল পানি, আর কোনো ব্যতিক্রম নেই, বৈচিত্র্য নেই তাই কাউকে নির্দিষ্ট একটা ভঙ্গিতে একদিকে তাকিয়ে দেখতে থাকলে এক ধরনের অস্বস্তি হয়।

নিহনেরও একটু অস্বস্তি হচ্ছিল, সে সমুদ্রের পানি থেকে নিজের পা দুটি ওপরে তুলে নিচু গলায় ডাকল, ্তুকায়ীরা।্থ
কায়ীরা ঠিক শুনতে পেল বলে মনে হলো না। নিহন তখন গলা আরেকটু উঁচিয়ে ডাকল, ্তুকায়ীরা।্থ
কায়ীরা বলল, ্তুশুনছি। বলো।্থ
্তুতুমি কী দেখছ?্থ
কায়ীরা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ্তুজানি না।্থ
্তুতাহলে এভাবে দূরে তাকিয়ে আছ কেন?্থ

কায়ীরা ঘুরে নিহনের দিকে তাকিয়ে একটু হাসার ভঙ্গি করল। কায়ীরার বয়স চল্লিশের কাছাকাছি, যখন তার বয়স কম ছিল তখন সে নিশ্চয়ই অপূর্ব সুন্দরী ছিল। এই জীবনটিতে তার ওপর দিয়ে ঝড়-ঝাপটা খুব কম যায়নি। কঠিন একটি জীবন, দুঃখ-কষ্ট আর সমুদ্রের লোনাপানিতে তার সৌন্দর্যের কমনীয়তাটুকু চলে গিয়ে সেখানে এক ধরনের বিষাদ পাকাপাকিভাবে স্থান করে নিয়েছে। কায়ীরার মাথায় কাঁচাপাকা চুল, তামাটে রোদেপোড়া গায়ের রঙ এবং সুগঠিত শরীর। মাথার চুল পেছনে শক্ত করে বাঁধা, পরনে সামুদ্রিক শ্যাওলার একটা সাদামাটা পোশাক, গলায় হাঙরের দাঁত দিয়ে তৈরি একটা মালা। এই অতি সাধারণ পোশাকেও কায়ীরাকে কেমন জানি অসাধারণ দেখায়।

কায়ীরা বলল, ্তুআমার মনে হয় একটা টাইফুন আসছে।্থ
নিহন চমকে উঠে কায়ীরার দিকে তাকাল, বলল, ্তুকী বলছ তুমি?্থ
কায়ীরার মাথা নাড়ল, বলল, ্তুহ্যাঁ। এটা টাইফুনের সময়। সমুদ্রের পানির তাপমাত্রা বাড়ছে-বছরের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর সময়।্থ

নিহল অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে একবার সমুদ্রের দিকে আরেকবার আকাশের দিকে তাকাল, তারপর শুকনো গলায় বলল, ্তুতুমি কেমন করে বুঝতে পারলে? কী দেখে বুঝতে পারলে?্থ
কায়ীরা মাথা নাড়ল, বলল, ্তুজানি না। বাতাসে কিছু একটা হয়, পানিতে কিছু একটা থাকে।্থ
্তুআমি তো কিছু বুঝতে পারছি না।্থ
্তুতুমি যখন আমার মতো বুড়ি হবে তখন তুমিও বুঝতে পারবে।্থ
নিহন বলল, ্তুতুমি মোটেও বুড়ি না। তুমি তুমি্থ নিহন বাক্যটা শেষ করতে পারল না।
কায়ীরা জিজ্ঞেস করল, ্তুআমি কী?্থ
্তুতুমি এখনো অনেক সুন্দরী।্থ
কায়ীরা শব্দ করে হেসে বলল, ্তুতোমার বয়স কত হলো নিহন?্থ
্তুসতেরো।্থ
্তুসতেরো? আমার ছেলেটি বেঁচে থাকলে সে এখন তোমার বয়সী হতো।্থ

নিহল মাথা নাড়ল, বলল, ্তুহ্যাঁ।্থ ভাসমান দ্বীপের সবাই জানে কায়ীরার পাঁচ বছরের দুরন্ত ছেলে আর তার দুঃসাহসী বাবা একটা খ্যাপা হ্যামার হেড হাঙরের হাতে মারা গেছে। কেউ সেটা নিয়ে কথা বলে না। কায়ীরা হাসিমুখে বলল, ্তুতোমার বয়স যখন সতেরো তখন তোমার কী করা উচিত জানো?্থ
্তুকী?্থ
্তুতোমার বয়সী একটা সুন্দরী মেয়ে খুঁজে বের করা। আমাদের এই দ্বীপে অনেকে আছে।্থ
নিহন কেন জানি একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেল, ইতস্তত করে বলল, ্তুআমি আসলে ঠিক এভাবে বলছিলাম না।্থ
্তুতাহলে কীভাবে বলছিলে?্থ
্তুশুধু চেহারা দিয়ে তো সৌন্দর্য হয় না। সৌন্দর্যের জন্য আরও অনেক কিছু লাগে।্থ
্তুআর কী লাগে?্থ
্তুসাহস লাগে, বুদ্ধি লাগে, অভিজ্ঞতা লাগে। তা ছাড়া মানুষটাকে আরও ভালো হতে হয়। তোমার সবকিছু আছে।্থ কায়ীরা কিছু না বলে খানিকটা কৌতুকের সঙ্গে এই কমবয়সী ছেলেটার দিকে তাকিয়ে রইল। ভাসমান দ্বীপের এই বয়সী ছেলে-মেয়ে থেকে সে যে একটু আলাদা এটা সে আগেও লক্ষ করেছে। কায়ীরা জিজ্ঞেস করল, ্তুআমার সব কিছু আছে? সব?্থ
্তুনা, ঠিক সব কিছু নেই্থ
্তুকী কী নেই?্থ
্তুতোমার পরিবার নেই। তুমি একা থাকো কিন্তু সেটা তো ইচ্ছে করে। তুমি চাইলেই তোমার একটা পরিবার থাকত। আমাদের ভাসমান দ্বীপের সব ব্যাটাছেলে তোমাকে বিয়ে করার জন্য ব্যস্ত-্থ
কায়ীরা হাত নেড়ে বলল, ্তুথাক, অনেক হয়েছে! কোন কোন ব্যাটাছেলেরা আমার পেছনে ঘুর ঘুর করে সেটা তোমার মুখ থেকে শুনতে হবে না। সেটা আমিই ভালো করে জানি। এখন এই ব্যাটাছেলেদের কাজে লাগাতে পারলে হয়্থ
্তুতুমি টাইফুনের কথা বলছ?্থ
্তুহ্যাঁ।্থ কায়ীরা ঘুরে তাদের ভাসমান দ্বীপটার দিকে তাকাল, এটি প্রায় পাঁচ কিলোমিটার লম্বা আর দুই কিলোমিটার চওড়া। এখানে সব মিলিয়ে প্রায় দুই হাজার মানুষ থাকে। বড় ধরনের টাইফুন এলে সবাইকে পানির নিচে আশ্রয় নিতে হয়। সবকিছু নিয়ে পানির নিচে যাওয়া খুব সহজ ব্যাপার নয়।
্তুকায়ীরা, তোমার কী সত্যিই মনে হচ্ছে টাইফুন আসবে? আকাশ ঝকঝকে পরিষ্কার্থ
্তুআর দুই-একদিনে এটা ঝকঝকে পরিষ্কার থাকবে না। ব্যারোমিটারের পারদ নিচে ঝাপ দেবে্থ
নিহন মাথা নেড়ে বলল, ্তুতুমি কেমন করে এটা আগে থেকে বুঝতে পারো আমি বুঝি না!্থ
কায়ীরা বলল, ্তুএকসময়ে পৃথিবীতে হাজারো রকম যন্ত্রপাতি থাকত, সেগুলো বলতে পারত। এখন যন্ত্রপাতি নেই, তাই আগে থেকে অনুমান করতে হয়-্থ
্তুযন্ত্রপাতি নেই সেটা তো সত্যি নয়-্থ নিহন ইতস্তত করে বলল, ্তুযন্ত্রপাতি আছে। আমাদের কাছে নেই। স্থলমানবদের কাছে আছে।্থ
কায়ীরা ঘুরে নিহনের দিকে তাকাল, ্তুতোমার কি ধারণা, স্থলমানবেরা কোনো দিন এসে আমাদের বলবে, নাও এই যন্ত্রপাতিগুলো নাও?্থ
নিহন বলল, ্তুনা, তা আমি বলছি না।্থ
্তুএই টাইফুন আমাদের জন্য যত বড় বিপদ, তার চেয়ে অনেক বড় বিপদ এই স্থলমানবেরা। আমরা যদি কোনো দিন পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাই, তাহলে সেটা টাইফুনের জন্য হবে না, রোগ-শোক-মহামারীর জন্যে হবে না, সেটা হবে এই স্থলমানবদের জন্য! বুঝেছ? তারা কোনো একদিন এসে আমাদের নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে।্থ
নিহন একটু অস্থির হয়ে বলল, ্তুকিন্তু কায়ীরা, আমি এই একটা জিনিস বুঝতে পারি না। আমরা যেরকম মানুষ তারাও ঠিক সেরকম মানুষ। কিন্তু তারা কেন আমাদের নিশ্চিহ্ন করে দিতে চাইবে? এক সময়ে তো আমরা একসঙ্গে ছিলাম-্থ
্তুপৃথিবীটা পানির নিচে ডুবে সব হিসাব অন্য রকম হয়ে গেছে!্থ
নিহন মাথা ঘুরিয়ে সমুদ্রটির দিকে তাকায়, চারিদিকে শুধু পানি আর পানি। একসময় পৃথিবীতে মাটি ছিল। এখন নেই। সব এই সমুদ্রের নিচে তলিয়ে গেছে। ছিটেফোঁটা যেটুকু তলিয়ে যায়নি সেখানে স্থলমানবেরা থাকে। আর তারা থাকে সমুদ্রের পানিতে। তাদের জন্য একটা নতুন নাম হয়েছে, জলমানব। পৃথিবীটা দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছে প্রায় দুই শত বছর আগে, জলমানব আর স্থলমানব!
কায়ীরা একটা ছোট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ্তুযদি কখনো ঠিক করে এই পৃথিবীর ইতিহাস লেখা হয় তখন সেখানে কী লেখা হবে জানো?্থ
্তুকী?্থ
্তুসেখানে লেখা হবে এই পৃথিবীর সবচেয়ে চমকপ্রদ ব্যাপার হচ্ছে আমাদের টিকে থাকা! শুকনোতে থাকা স্বার্থপর মানুষগুলো ২০০ বছর আগে যখন আমাদের পানিতে ঠেলে দিয়েছিল তখন আমাদের টিকে থাকার কথা ছিল না। কিন্তু আমরা টিকে গিয়েছি।্থ
নিহন অন্যমনস্কের মতো মাথা নাড়ল, বলল, ্তুহ্যাঁ টিকে গিয়েছি। কিন্তু-্থ
্তুকিন্তু কী?্থ
্তুআমাদের কোনো জ্ঞান-বিজ্ঞান নেই, প্রযুক্তি নেই-্থ ্তুকে বলেছে নেই?্থ
স্থলমানবেরা কত কিছু করে। মহাকাশে রকেট পাঠায়। আকাশে উড়ে কত রকম আনন্দ-ফূর্তি-আর আমরা? আমরা শুধু কোনোভাবে বেঁচে আছি।্থ
কায়ীরা বিচিত্র একটা দৃষ্টিতে নিহনের দিকে তাকিয়ে রইল। নিহন বলল, ্তুকী হলো, তুমি কিছু বলছ না কেন?্থ
্তুআমি ইচ্ছে করলেই বলতে পারি। কিন্তু আমি নিজে থেকে বলতে চাই না। তোমার নিজেকে সেটা বুঝতে হবে। আমরা এমনি এমনি টিকে নেই নিহন, আমরা টিকে আছি আমাদের নিজস্ব জ্ঞান-বিজ্ঞানের জন্য। সেই জ্ঞান-বিজ্ঞানটা কী জানো?্থ
্তুকী?্থ
্তুসেটা আমি তোমাকে বলব না। সেটা তোমাকে বের করতে হবে।্থ
নিহন মাথা চুলকে বলল, ্তুআমাদের ইলেকট্রিক জেনারেটর? অক্সিজেন টিউব? পানির পাম্পমেশিন?্থ
কায়ীরা মাথা নাড়ল, বলল, ্তুনা। এগুলো ছোটখাটো ব্যাপার। এর চেয়ে অনেক বড় আবিষ্কার আমাদের আছে!্থ
্তুসেটা কী?্থ
কায়ীরা এক ধরনের রহস্যের ভাব করে বলল, ্তুসেটা আমি তোমাকে বলব না! তোমার নিজেকে বের করতে হবে?্থ
নিহন কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, কায়ীরা তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ্তুএখন চলো, অনেক কাজ আছে। দেখি রিসি বুড়ো কী বলে!্থ

বিশাল একটা সামুদ্রিক কচ্ছপের খোলসের ভেতর রিসি বুড়ো গুটিসুটি মেরে বসেছিল। কায়ীরা আর নিহনের পায়ের শব্দ শুনে বলল, ্তুকে?্থ
কায়ীরা বলল, ্তুআমি রিসি বুড়ো। আমি আর নিহন।্থ
্তুনিহন? নিহনটা কে?্থ
্তুক্রানার বড় ছেলে।্থ
্তুও।্থ রিসি বুড়ো বিড় বিড় করে বলল, ্তুক্রানার বাপ খুব সাহসী মানুষ ছিল। স্থলমানবের সঙ্গে একবার একা যুদ্ধ করেছিল। একেবারে ফাটাফাটি যুদ্ধ।্থ
নিহন সেই গল্প অনেকবার শুনেছে। কে জানে তাকেও কোনো দিন তার পূর্বপুরুষের মতো স্থলমানবের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হবে কি না!
কায়ীরা বলল, ্তুবাতাসটা টের পাচ্ছো রিসি বুড়ো?্থ
্তুবুড়ো হয়েছি, আগের মতো টের পাই না। তবু মনে হচ্ছে গোলমাল।্থ
্তুমনে হয় টাইফুন আসছে।্থ
রিসি বুড়ো মাথা নাড়ল, বলল, ্তুহ্যাঁ। মনে হয় বড় একটা আসছে।্থ
্তুবছরের শুরুতেই এ রকম, পরে কী হবে?্থ
রিসি বুড়ো বিড় বিড় করে বলল, ্তুসব কিছু ওলটপালট হয়ে গেছে। কোনো কিছুর আর হিসাব মেলে না!্থ
্তুআমাদের তো কাজ শুরু করে দিতে হবে।্থ
্তুহ্যাঁ, দিতে হবে।্থ
্তুসবাইকে ডাকব?্থ
রিসি বুড়ো নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ্তুডাকো।্থ
কিছুক্ষণের মধ্যেই ভাসমান দ্বীপের মানুষেরা রিসি বুড়োর কাছে হাজির হতে শুরু করে। প্রত্যেকটা পরিবার থেকে একজন আসার কথা, যারা মাছ ধরতে বা অন্য কাজে সমুদ্রে গিয়েছে তারা আসতে পারেনি। তারপরও প্রায় দুই শ পুরুষ আর মহিলা হাজির হয়েছে। যারা এসেছে তারা কেউই বসে নেই, মেয়েরা সামুদ্রিক শ্যাওলার সুতো দিয়ে কাপড় বুনছে। পুরুষেরা পাথরের টুকরোয় হাঙরের দাঁত ঘষে ধারালো করে তুলতে তুলতে নিচু গলায় কথা বলছে। তাদের অনেকেরই উদোম শরীর, শক্ত পেশিবহুল শরীর, রোদে পুড়ে তামাটে।
রিসি বুড়ো তার শীর্ণ হাত ওপরে তুলতেই সবাই কথা বন্ধ করে মাথা তুলে তাকাল। রিসি বুড়ো গলা উঁচিয়ে বলল, ্তুতোমরা নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারছ আমি তোমাদের কেন ডেকেছি।্থ
উপস্থিত মানুষগুলোর মধ্যে একটা গুঞ্জন শুরু হয়ে আবার থেমে গেল। রিসি বুড়ো তার নিষ্প্রভ চোখ দুটো দিয়ে সবাইকে দেখার চেষ্টা করতে করতে বলল, ্তুকেন ডেকেছি তোমরা জানো?্থ
কাছাকাছি বসে থাকা একটি মেয়ে তার কাপড় বোনার কাঁটা দুটো পাশে সরিয়ে রেখে বলল, ্তুনেপচুনের দোহাই-টাইফুন আসছে বলার জন্য ডাকোনি তো?্থ
্তুহ্যাঁ, টাইফুন আসছে, কিন্তু আমি সে জন্য তোমাদের ডাকিনি। আমি তার থেকে গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা বলার জন্য তোমাদের ডেকেছি।্থ
কায়ীরা একটু অবাক হয়ে রিসি বুড়োর দিকে তাকাল। আট থেকে দশ মাত্রার টাইফুন থেকে গুরুত্বপূর্ণ কী কথা তার বলার আছে?
রিসি বুড়ো তার শীর্ণ শরীরটি সোজা করে বসার চেষ্টা করে বলল, ্তুতোমরা সবাই জানো, আমার বয়স হয়েছে। চোখ দিয়ে বলতে গেলে কিছু দেখি না। ভালো করে শুনতেও পাই না। সহজ কথাটাও মনে থাকে না, ভুলে যাই। তোমাদের দেখলে চিনতে পারি না। বুঝতে পারছি অতল সমুদ্রের ডাক আসছে।্থ
রিসি বুড়ো নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য এক মুহূর্ত থামল, সবার ভেতরে এক মুহূর্তের জন্য একটা গুঞ্জন শুরু হয়ে আবার থেমে গেল। বুড়ো রিসি মাথা তুলে বলল, ্তুপ্রায় বিশ বছর আগে ক্রাতুল মারা যাওয়ার পর আমি তোমাদের দায়িত্ব নিয়েছিলাম। দুঃখে-কষ্টে সুখে-দুঃখে আমি তোমাদের সঙ্গে ছিলাম। আমি তোমাদের কথা শুনেছি, তোমরা আমার কথা শুনেছ।
গত কিছুদিন থেকে আমি বুঝতে পারছিলাম এখন আমার বিদায় নেওয়ার সময় হয়েছে। অন্য একজনকে এখন তোমাদের নেতৃত্ব দেওয়ার দায়িত্ব নিতে হবে। কাকে সেই দায়িত্ব দেওয়া যায় আমি সেটা বুঝতে পারছিলাম না। আমি মনে মনে সেই মানুষটিকে খুঁজছিলাম। কিন্তু খুঁজে পাচ্ছিলাম না।্থ
রিসি বুড়ো এক মুহূর্তের জন্য থেমে তার নিষ্প্রভ দৃষ্টিতে সবার দিকে তাকায়, তারপর গলায় একটু জোর দিয়ে বলল, ্তুআমি অল্প কিছুক্ষণ আগে সেই মানুষটিকে খুঁজে পেয়েছি। সেই মানুষটির কাছে আমার সব দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য আমি তোমাদের ডেকেছি।্থ
ছড়িয়ে-ছিটিয়ে মানুষগুলো এবারে উত্তেজনায় হট্টগোল শুরু করে দেয়। রিসি বুড়ো সবাইকে থেমে যাওয়ার জন্য সময় দেয়। হট্টগোল এবং গুঞ্জন থেমে যাওয়ার পর রিসি বুড়ো আবার মুখ খুলল, বলল, ্তুপৃথিবীর স্থলমানবেরা যখন আমাদের সমুদ্রের মধ্যে ঠেলে দিয়েছিল, সবাই ভেবেছিল আমরা শেষ হয়ে যাব। আমরা শেষ হয়ে যাই নাই এবং এখন মনে হচ্ছে সমুদ্রের পানিতে বেঁচে থেকে আমরা একটা নতুন সভ্যতা তৈরি করতে যাচ্ছি। তার একটা কারণ, আমরা কখনো নেতৃত্ব নেওয়ার জন্য ব্যস্ত হই না। যে নেতৃত্ব নেওয়ার যোগ্য আমরা তার হাতে সেটা তুলে দিই। আমি আজ সেই নেতৃত্বটি তোমাদের একজনের হাতে তুলে দেব। আমাদের জলমানবের ইতিহাস আর ঐতিহ্য অনুযায়ী তোমরা সবাই তাকে অভিনন্দন জানাও।্থ
চকচকে উত্তেজিত চোখে অনেকে উঠে দাঁড়িয়ে গেল, চিৎকার করে বলল, ্তুকে? কে? কে নতুন নেতা।্থ
রিসি বুড়ো ধীরে ধীরে সামুদ্রিক কচ্ছপের ফাঁকা খোলসটা থেকে বের হয়ে আসে, নিজের গলা থেকে জেড পাথরের মালাটি খুলে নিয়ে নরম গলায় ডাকল, ্তুকায়ীরা, তুমি সবার সামনে এসে দাঁড়াও।্থ
উপস্থিত মানুষগুলো উত্তেজনায় চিৎকার করতে থাকে, কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকা কমবয়সী কয়েকটি মেয়ে কায়ীরাকে জড়িয়ে ধরে। কায়ীরা তাদের ভালোবাসার আলিঙ্গন থেকে নিজেকে মুক্ত করে রিসি বুড়োর সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
রিসি বুড়ো সস্মেহে কায়ীরার দিকে তাকিয়ে বলল, ্তুএসো কায়ীরা। তোমার দায়িত্বটুকু বুঝে নাও।্থ
কায়ীরা নিচু গলায় বলল, ্তুজেড পাথরের এই মালাটা আমার গলায় পরিয়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার জীবনটা অন্য রকম হয়ে যাবে।্থ
রিসি বুড়ো মাথা নাড়ল, বলল, ্তুহ্যাঁ কায়ীরা।্থ
্তুতুমি ঠিক করে পুরো ব্যাপারটা ভেবেছ? সত্যিই তুমি আমাকে দায়িত্ব দিতে চাও?্থ
্তুহ্যাঁ কায়ীরা। এই পুরো দ্বীপটিতে শুধু তুমিই এই টাইফুনের কথা বুঝতে পেরেছ। আর কেউ পারেনি।্থ
্তুনেতা হওয়ার জন্য সেটাই কী যথেষ্ট?্থ
্তুনা কায়ীরা, সেটা যথেষ্ট না। আরও কী দরকার আমি সেটা জানি। আমি বিশ বছর থেকে সেটা করে আসছি।্থ
্তুতুমি নিশ্চিত, তুমি ভুল করছ না?্থ
্তুআমি নিশ্চিত কায়ীরা। তুমি জানো, গত বিশ বছরে আমি একবারও ভুল সিদ্ধান্ত নিইনি।্থ
্তুবেশ।্থ কায়ীরা নিঃশ্বাস ফেলে রিসি বুড়োর সামনে মাথা নিচু করল। রিসি বুড়ো তার গলায় জেড পাথরের মালাটি পরিয়ে দিয়ে শীর্ণ হাতে কায়ীরার মাথা স্পর্শ করে বলল, ্তুতুমি আমাদের জন্য নতুন সভ্যতার জন্ন দাও কায়ীরা।্থ
কায়ীরা ফিসফিস করে বলল, ্তুযদি সেটাই আমাদে্#24
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই ডিসেম্বর, ২০০৬ রাত ১:২৯
৭টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পিআর পদ্ধতিতে জাতীয় সংসদের উচ্চ কক্ষের নির্বাচন আগে দিয়ে দেখতে দিন কে বাঘ কে বিড়াল?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:৪৬



সব দলের অংশগ্রহণে পিআর পদ্ধতিতে জাতীয় সংসদের উচ্চ কক্ষের নির্বাচন আগে দিন। কোন দলকে জনগণ প্রত্যাখ্যান করেছে কি করেনি সেইটাও জাতিকে দেখতে দিন। পিআর পদ্ধতির জাতীয় সংসদের উচ্চ... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিশ্চিত থাকেন জামায়েত ইসলাম এবার সরকার গঠন করবে

লিখেছেন সূচরিতা সেন, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৪২


আমাদের বুঝ হওয়ার পর থেকেই শুনে এসেছি জামায়েত ইসলাম,রাজাকার আলবদর ছিল,এবং সেই সূত্র ধরে বিগত সরকারদের আমলে
জামায়েত ইসলামের উপরে নানান ধরনের বিচার কার্য এমন কি জামায়েতের অনেক নেতা... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রকৌশলী এবং অসততা

লিখেছেন ফাহমিদা বারী, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১১:৫৭


যখন নব্বইয়ের দশকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সিদ্ধান্ত নিলাম এবং পছন্দ করলাম পুরকৌশল, তখন পরিচিত অপরিচিত অনেকেই অনেকরকম জ্ঞান দিলেন। জানেন তো, বাঙালির ইঞ্জিনিয়ারিং এবং ডাক্তারিতে পিএইচডি করা আছে। জেনারেল পিএইচডি। সবাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি ভারতকে যাহা দিয়াছি, ভারত উহা সারা জীবন মনে রাখিবে… :) =p~

লিখেছেন নতুন নকিব, ০৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১:১৫

আমি ভারতকে যাহা দিয়াছি, ভারত উহা সারা জীবন মনে রাখিবে… :) =p~

ছবি, এআই জেনারেটেড।

ইহা আর মানিয়া নেওয়া যাইতেছে না। একের পর এক মামলায় তাহাকে সাজা দেওয়া... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযুদ্ধের কবিতাঃ আমি বীরাঙ্গনা বলছি

লিখেছেন ইসিয়াক, ০৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:১৫


এখনো রক্তের দাগ লেগে আছে আমার অত্যাচারিত সারা শরীরে।
এখনো চামড়া পোড়া কটু গন্ধের ক্ষতে মাছিরা বসে মাঝে মাঝে।

এখনো চামড়ার বেল্টের বিভৎস কারুকাজ খচিত দাগ
আমার তীব্র কষ্টের দিনগুলোর কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×