বাংলাদেশের এক সময়ের প্রভাবশালী মন্ত্রী ছিলেন লুৎফুজ্জামান বাবর। তার সময়ের অনেক কিছুই ভুলে যাওয়ার কথা নয়। চলনে-বলনেও তিনি ছিলেন আলাদা। র্যাবের প্রতিষ্ঠাতা হিসাবেও তার নাম আছে। একই সঙ্গে র্যাবকে দিয়ে বিচার বহির্ভূত হত্যাকা- মানে ক্রসফায়ারের জনকও তিনি। বিএনপির সরকারের সময় তার ক্ষমতাও ছিল সেই সময়ের অনেকের মত ‘অসীম’। কিন্তু ‘পাপ বাপকেও ছাড়ে না’। এটা এখন প্রমাণিত।
২০০১ সালে খালেদা জিয়া সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হয়ে লুৎফুজ্জামান বাবর বলেছিলেন ‘অপরাধ জগতে আমি আগন্তুক নই’। তিনি যে আগন্তুক ছিলেন না, সেটা ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলার রায় হওয়ার পর একেবারে পরিস্কার হয়ে গেছে। অস্ত্র চোরাচালান মামলায় তাকে মৃত্যুদ- ও অস্ত্র আইনে তাকে যাবজ্জীবন কারাদ- দেয়া হয়েছে।
নেত্রকোনায় বাবরের গ্রামের বাড়ি হলেও তিনি বেড়ে উঠেছিলেন ঢাকার মগবাজারে। তখন থেকেই সন্ত্রাসী কর্মকা-ে জড়িত ছিলেন তিনি। এসব কাজে তার এত জোঁক ছিল যে তিনি এসএসসিও পাশ করতে পারেননি। জাতীয় পার্টির সরকারের আমল থেকে তিনি বেপরোয়া চোরাচালানে জড়িয়ে পড়েন। দহরম-মহরম ছিল দেশের শীর্ষ সন্ত্রাসীদের সঙ্গেও। ৮০ দশক জুড়ে তিনি দোর্দ- প্রতাপে চোরাচালানি চালিয়ে যান। এসময় তিনি মূলত ডিজিটাল ঘড়ি বিশেষ করে সিকো ব্যান্ডের ঘড়ি চোরাচালানি করে তার ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে দেন। কিন্তু তিনি ১৯৯৬ সালে বিএনপিতে যোগ দিলে তার কলঙ্ক ঢাকা পড়ে। এসময় তিনি বিএনপির কেন্দ্রিয় কমিটিতে স্থান করে নেন। এবং নেত্রকোনা ৪ আসন থেকে সংসদ নির্বাচিত হন। ২০০১ সালে তিনি সবাইকে অবাক করে দিয়ে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। তার সরকারের আমলেই ২০০৪ সালে ধরা পড়ে ১০ ট্রাক অস্ত্রের চালান। পরবর্তি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ১০ ট্রাক অস্ত্র চোরা চালানে বাবরের জড়িত থাকার বিষয়টি মামলার শুনানি থেকে বেরিয়ে আসে।
আশির দশক থেকে বাবরের সঙ্গে রওশন এরশাদের ঘনিষ্ট সম্পর্কের কথা জানা যায়। তখন তিনি রওশন এরশাদকে মা বলে ডাকতেন। বিমান বন্দরে রওশন এরশাদের ছেলে বলেই তিনি চোরাচালানিতে পার পেয়ে যেতেন।
স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হওয়ার পর তিনি ২০০১ সালে মগবাজার থেকে চলে আসেন। মগবাজারে থাকাকালীন তিনি মগবাজারের শীর্ষ সন্ত্রাসী আরমানের সঙ্গে একত্রিত হয়ে স্বর্ণ চোরাচালানির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালীন শীর্ষ সন্ত্রাসী পিচ্চি হান্নানকে তিনি আশ্রয় প্রশ্রয় দিতেন। ওয়ার্ড কমিশনার খালেদ ইমাম হত্যা মামলার আসামি হওয়ার পরও পিচ্চি হান্নান তার প্রশ্রয়েই ছিলেন।
বাবর তারেক রহমানের আশীর্বাদও পেয়েছিলেন স্বরাষ্ট্রপ্রতিমন্ত্রী থাকার সময়। এসময় তিনি টেন্ডারবাজি, প্রমোশন, নিয়োগ বাণিজ্য, ভূমি জবর দখলের মাধ্যমেও সম্পদের মালিক হন।
২০০৬ সালের ৪ জুলাই গুলশানের ১০৪ নম্বর সড়কে বসুন্ধরা গ্রুপের মালিকানাধীন ৩/জি নম্বর বাসার ছাদ থেকে বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহানের ছেলে সাফিয়াত সোবহান সানবী নামকরা আইটি প্রকৌশলী সাব্বিরকে ফেলে দিয়ে হত্যা করে। খুন থেকে বাঁচার জন্য তারেক রহমান এবং তার বিশ্বস্ত সহযোগী সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফজ্জামান বাবর মিলে খুনের বিষয় ধামাচাপা দেয়ার ব্যবস্থা করে। গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে গ্রেপ্তার হওয়ার পর বাবর জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেন যে তিনি সানবীরকে খুনের মামলা থেকে বাঁচাতে বসুন্ধরা গ্রুপের মালিকের কাছ থেকে ২১ কোটি টাকা ঘুষ নিয়েছিলেন। যারা সাক্ষি ছিল এই মামলায় তাদের ভয় দেখিয়ে সাক্ষ্য দিতে দেয়নি বরং তাদের ভ্রাম্যমাণ পতিতা বানারোর চেষ্টাও করা হয়েছে।
যৌথ বাহিনী বাবরকে ২০০৭ সালে চারটি অবৈধ অগ্নেয়াস্ত্র , ২৯৭ টি বুলেট রাখার দায়ে গ্রেপ্তার করে। নবম পার্লামেন্ট নির্বাচনে তিনি জামিনে বেরিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থি হিসাবে নির্বাচনও করেন। এবং বিপুল ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হন। নির্বাচনের পর তার জামিন বাতিল হয়। পরে অবৈধ সম্পত্তির জন্য দুদকও তার বিরুদ্ধে মামলা করে। এতে তার ১৭ বছরের জেল হয়।
যেভাবে ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলার আসামি হলেন বাবর : সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৭ সালের ২০ নভেম্বর রাষ্ট্রপক্ষের তৎকালীন কৌঁসুলি ও অতিরিক্ত মহানগর পিপি হুমায়ুন কবির রাসেল মামলার অধিকতর তদন্তের জন্য মহানগর দায়রা জজ আদালতে আবেদন করেন। সে আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত অস্ত্রের উৎস, গন্তব্য, অস্ত্রের ধরন, চালান থেকে অস্ত্র খোয়া গিয়েছিল কিনা, কাদের জন্য অস্ত্র আনা হয়েছিল, কোন জলযানে করে অস্ত্র ঢুকেছিল- এ ধরনের সাতটি পর্যবেক্ষণসহ অধিকতর তদন্তের আদেশ দেন।
সিআইডি’র এএসপি ইসমাইল হোসেন প্রথম দফা অধিকতর তদন্তের দায়িত্ব পেলেও তিনি তদন্ত শেষের আগেই বিদায় নেন। পরে সিআইডি’র চট্টগ্রাম অঞ্চলের সিনিয়র এএসপি মনিরুজ্জামান চৌধুরী ২০০৯ সালের ২৯ জানুয়ারি তদন্তভার গ্রহণ করেন। মনিরুজ্জামানের তদন্তে বেরিয়ে আসতে থাকে ঘটনার সঙ্গে জড়িত রাঘববোয়ালদের নাম, উলফার প্রসঙ্গ, একের পর এক স্পর্শকাতর ও চাঞ্চল্যকর বিষয়। অধিকতর তদন্ত শেষে ২০১১ সালের ২৬ জুন দু’টি মামলায় সম্পূরক অভিযোগপত্র জমা দেন তদন্তকারী কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান। এতে দুই মামলায় নতুনভাবে ১১ জনকে আসামি হিসেবে অর্ন্তভুক্ত করা হয়। যেখানে বাবরকে আসামি করা হয়।
এর আগে ২০১০ সালের ৩ অক্টোবর তদন্তকারী কর্মকর্তার আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালতের নির্দেশে ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলায় শ্যেন অ্যরেস্ট দেখানো হয় বাবরকে।
আর আজ সেই সময়ের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীকে ফাঁসির আসামি করা হয়েছে। এটা কোন নিয়তি নির্ধারিত বিষয় নয়। বরং রাষ্ট্রের জন্য অত্যন্ত কলঙ্কজনক। যে ব্যক্তি ফাঁসির আসামি হওয়ার মত অপরাধে জড়িত থাকতে পারে বা অভ্যস্ত রাষ্ট্র তাকেও মন্ত্রী বানানোর জন্য দায়িত্ব নেয়। এটা কোথায়, কোন অবস্থায় আমরা বসবাস করছি তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কারণ এমনই এখানকার রাষ্ট্র পরিচালনাকারীরা। তাদের ভোট দেয় জনগণ। তাদের মাথায় তুলে রাজনৈতিক দলের প্রধানরা। এটার কারণ কি? একজন চোরাচালানকারীও হয়ে উঠে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী। আর তিনি এসে সদম্ভে বলেন, অপরাধ জগতে তিনি নতুন নয়। এটার পরিণতি তিনি এখন হাতে নাতে পেয়েছেন। একজন বাবরকে দিয়ে অন্যরাও সতর্ক হবে। এটাই হল অন্য যারা সন্ত্রাসী, যারা অতীতে পার পেয়ে গেছে। [ বাবরের অপরাধ জগৎ সংক্রান্ত সব তথ্য ডেইলি স্টার থেকে নেয়া]