এবারের ঈদের একমাত্র গরম খবর
তোবা গ্রুপ তাদের গার্মেন্টস শ্রমিকদের নিয়ে যে গেমটা খেলল তা চোখ এড়ানোর মত নয়। যখন সারাদেশের মানুষ ঈদ প্রস্তুতিতে ব্যস্ত তখন তারা বেতনের দাবিতে অনশন চালিয়ে যাচ্ছে। এরপর ঈদ শুরু হলেও পরিস্থিততি বদলায়নি। সারা দেশের মানুষ ঈদ উৎসবে মেতে উঠলেও তোবার অনশনরত শ্রমিকরা অসুস্থ হয়ে একের পর এক হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে(প্রায় শ’খানেক অসুস্থ হয়েছে)। তাদের প্রতিবাদ যদি সহিংস হত তাহলে সকলেই আরও তৎপর হত। তাদের বেতনের বিষয়টা অনেক আগেই সমাধান হয়ে যেত। কিন্তু সেটা হয়নি। কারণ শান্তিপূর্ণ কর্মসূচীতে খুব বেশি সাড়া দেয়ার নজির এখানে নেই। তাই সহিংসতা অনেক সময় অনিবার্য হয়ে উঠে। এদেশের গ্রার্মেন্টস শ্রমিকদের বেতনের জন্য বিদেশিদের কথা বলতে হয়, শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বিদেশে দৌঁড়াতে হয়। তাই সহিংসতা এদেশের বাস্তবতা থেকে সৃষ্টি হয়েছে। কারণ কেউ না খেয়ে থাকলেও আমাদের কিছু যায় আসে না। কেউ মাথার ঘাম পায়ে ফেলে উদয়াস্ত পরিশ্রম করলেও সেসব মানুষের শ্রম চুরি করে খেয়ে নিজে দামি গাড়ি হাঁকিয়ে শান শওকত দেখাতে অনেকেই অভ্যস্থ। না হলে তোবা গার্মেন্টসে যারা কাজ করেছে তাদের বেতন নিয়ে কেন এত নাটক। যে নাটকের এখনও শেষ দেখা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে এ নাটকে শ্রমিকদের মধ্যেও অনেকেই জড়িত। না হলে এতটা শান্তিপূর্ণ অনশন কর্মসূচী সহজ কথা নয়। এ চালটা খেলেছে তোবার মালিকপক্ষ আর বিজিএমইএ। তোবার মালিকের জামিনের জন্য এ নাটক।
আদালত তাকে এখন জামিন দিয়েছে। কিন্তু গার্মেন্টস শ্রমিকরা তাদের পাওনা আদায়ের কোন প্রতিশ্রুতি পায়নি। পায়নি বিদায় তারা আন্দোলনের লাগাতর কর্মসূচী ঘোষণা করেছে। এবার তারা বিক্ষোভ করবে।
এ ঘটনার মাধ্যমে বিজিএমইএ একটি মেসেজ দিতে চাচ্ছে - তা হল তারা যত শ্রমিকই হত্যা করুক না কেন- তাদের লোকজনদের জেলে আটকে রাখা যাবেনা। তাদের বিচার করা যাবে না। তারা কিন্তু এটাই বোঝানোর চেষ্টা করছে। না হলে তারা ঠিকই বেতন দিত। এ বেতন যদি তোবা দিতে না পারে তাহলে বিজিএমই দেবে। বিজিএমইএ না দিলে সরকার। কিন্তু কোন পক্ষই বেতনের সুরাহা না করে তারা শ্রমিকদের ক্ষেপাচ্ছে। নির্মম রসিকতা।
তারপরও গার্মেন্টস শ্রমিকরা আরও একটি নজির স্থাপন করল এদেশে। যা আগের চেয়ে ভিন্ন। যা আগে কখনও দেখা যায়নি। আগে যেখানে শ্রমিকরা ভাঙ্গচুর করতে। আগুন জ্বালাত। স্থানীয়ভাবে পরিস্থিতি জটিল ও ভয়ঙ্কর করে তুলত। আর তা চারপাশে ছড়িয়ে পড়ত। এবার তা না করে এমন শান্তিপূর্ণ কর্মসূচীই দিল তোবার শ্রমিকরা। আনন্দ বঞ্চিত হয়েও তারা অনশন করছে। ৩মাসের বেতন, ওভারটাইম ও ঈদ বোনাস পাওনা ছিল তোবার শ্রমিকদের। পাওনা না পেয়ে ঈদের আগের দিন থেকে তারা অনশন শুরু করে। যেখানে ১ হাজার ৬ শ’ শ্রমিক রয়েছে। কেন তোবা গ্রুপ তাদের কর্মচারিদের বেতন দিতে পারছে না- তা নানাভাবে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে বিজিএমইএ ও সংশ্লিষ্টদের পক্ষ থেকে। এর প্রধান কারণ হচ্ছে সেই ২০১২ সালের নভেম্বরে তাজরীন ফ্যাশনে অগ্নিকা-ের ঘটনা ও অগ্নিকা-ে ১১১ জনের বেশি শ্রমিক অগ্নিদগ্ধ হয়ে নিহত হওয়া। এ মামলার জামিন নিতে গিয়ে গত ৯ ফেব্রুয়ারি মালিককে কারাগারে প্রেরণের নির্দেশ দেন আদালত। তাতেই আটকে যায় তোবা গ্রুপের পরিচালনাধীন গার্মেন্টস শ্রমিকদের বেতন। কিন্তু যিনি যে কারণে অভিযুক্ত আইন আদালতের মাধ্যমে তার যা পাওনা তাকে সেই শাস্তি ভোগ করতেই হবে। কিন্তু তাকে ছাড়ানোর জন্য গার্মেন্টস শ্রমিকদের বেতন আটকিয়ে তাদের জীবন ও জীবিকা বঞ্চিত করা কতটাই অমানবিক। দ্বিতীয় কথা- এসব গার্মেন্টস শ্রমিকের বেতনের উপর শুধু ব্যক্তিগতভাবে শ্রমিকরা নির্ভরশীল ছিল না, এ বেতনের আশায় দিন গুণেছে -তাদের পরিবার পরিজন। বেতনের টাকায় ঈদ করবে- একটু আনন্দের হাসি হাসবে। তাও শুধু এক মাসের বেতন নয় - ৩ মাসের বেতন। একটি চাকরিজীবীর যদি ৩ মাসের বেতন আটকে যায়, ৩ মাসে তার উপর কি পরিমাণ দায়-দেনা চেপে বসে। আর দায় দেনা করে একজন গার্মেন্টস শ্রমিকের কতটুকু চালানো সম্ভব। কিসের উপর নির্ভর করে তাকে পরিচিতরা ধার-দেনা দেবে। এসব তো বিবেচনায় নিতে হবে। এরমধ্যে যারা শ্রমিক তাদের যদি এভাবে শারীরিক ও মানসিকভাবে লাঞ্জিত করা হয় তাহলে তার মাধ্যমে একজন মালিক কিভাবে তার গার্মেন্টসের পর্যাপ্ত ও মানসম্পন্ন উৎপাদন আশা করতে পারে। অন্যক্ষেত্রে হলে আশা করা দুরূহ হয়ে পড়ত। কিন্তু তবু তারা মালিকের উৎপাদন ঠিক রাখে। রাতদিন গতর খেটে যায়।
বস্তুত শ্রমিকদের ব্যাপারে মানুষ হিসাবে কিছুই বিবেচনায় আনতে চায় না এখানকার ব্যবসায়ি সমাজ।
কিন্তু নিজেদের ব্যাপারে অন্যরকম। যে গার্মেন্টসে অগ্নিকা-ে এতগুলো শ্রমিক অগ্নিদগ্ধ হয়ে নিহত হল সেক্ষেত্রে তাদের আশা- তিনি শাস্তিরই উপযুক্ত নন। বা কোন শাস্তি ভোগ করতে চান না। যে মালিকের কারখানায় অগ্নিকা-ে এতগুলো শ্রমিকের নির্মম মৃত্যু হয়েছে সেখানে গিয়ে আবার শ্রমিকেরা কাজ করেছে- এটার একটা শোকরিয়া থাকা দরকার ছিল ওই মালিকের। উল্টো তিনি সেইসব শ্রমিকদের ঢাল হিসাবে ব্যবহার করতে চাচ্ছেন। এমনকি বেতনের নামে তাদের এক রকম জিম্মি করেছেন। তাও রমজান মাসে। এটা একটা ভয়াবহ খেলা। এবং সরকার শান্তিপূর্ণ একটা পরিবেশকে অনর্থক ঘোলাটে করার জন্য প্রভাবক হিসাবে কাজ করেছে বলে মনে হচ্ছে। সরকারের কঠোরতার কারণে যেমন অনেক কিছুই সামাল দেয়া সম্ভব হয়েছে তেমনি এটাও তার সিরিয়াসভাবে নিতে পারত। কিন্তু সরকার বিষয়টাকে ছেড়ে দিয়েছে। মনে হয়েছে তোবার মালিকের প্রতি সহানুভূতিশীল।
অবশ্য অনশনকারিরা তোবার মালিক দেলোয়ার হোসেনের শাশুড়ি লাইলি বেগমকে অফিসে গত শুক্রবার(২৪ জুলাই) থেকে অবরুদ্ধ করে রেখেছে। তোবা গ্রুপের কোন পদে না থাকা সত্ত্বেও তাকে হেনস্থা করা হয়েছে- এমনটিই শোনা গেছে। প্রথমে পুলিশ তাকে ডেকে নিয়ে আসেন শ্রমিকদের বেতন সংক্রান্ত বিষয়ে কথা বলার জন্য। কিন্তু তিনি আর শ্রমিকদের জিম্মা থেকে যেতে পারেন নি।
কয়েকটা বিষয় অত্যন্ত নির্মম। ফেব্রুয়ারি থেকে তোবা গ্রুপের মালিক দেলোয়ার কারাগারে। তাহলে তার আগে মালিক পক্ষ বা বিজিএমইএ বা সরকার কেউ শ্রমিকদের বেতনের বিষয়টি নিশ্চিত করল না কেন। এতবড় ঈদের আনন্দের মধ্যে তারা আত্মীয় পরিজন ছেড়ে কেন গার্মেন্টসের চারপাশে অনশন করতে হবে। আগেও বলেছি- শ্রমিকদের পাওনা থেকে আবার একটি বড় অঘটন ঘটতে পারত। দাঙ্গা ফ্যাসাদের মত মারাত্মক পরিস্থিতি । কিন্তু সেটা হয়ত হয়নি। কিন্তু যদি হত, তাহলে হতাহতের মত বিষয়ও চলে আসত। এতগুলো আশঙ্কা থাকার পরও বিষয়টা অনেকটা হেলাফেলা করা হয়েছে। তার মানে আবারও কি ভাবা হচ্ছে- বেতন পাইনি গার্মেন্টস শ্রমিকরা। দাঙ্গা ফ্যাসাদ করলেও তারা করবে। মারা পড়লেও তারা মারা পড়বে। কার কি যায় আসে এতে। ভাবখানা এরকমই ছিল। কিন্তু ফুলকি থেকে আগুন ছড়িয়ে পড়লে তাতে ওই গার্মেন্টস শ্রমিকদের জানমালের আবার কোন হিসাব মিলত না।
তোবা গ্রুপের গার্মেন্টস শ্রমিক পাওনা নিয়ে মূল দায়িত্ব ছিল বিজিএমইএর। যেহেতু তোবা গ্রুপের মালিক কারাগারে। এজন্য শ্রমিকরা কেন ঈদ উদযাপন করতে পারেনি তার জবাব দিতে হবে তাদেরকেই। একইভাবে সমান দায় সরকারের। আর সরকার জবাব নিবে তোবা গ্রুপের অন্য যারা উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা আছেন তাদের কাছ থেকে। বিজিএমইএ দায় নিয়েছিল - ওইটুকুই তারা শ্রমপ্রতিমন্ত্রীকে কথা দিয়েছিলেন বেতন পরিশোধের। কিন্তু সেটা করেনি। না করে শ্রমিকদের বেতন আটকে রেখে - তাদেরকে অনশনে এনে কৌশল করেছে দেলোয়ার হোসেনকে জামিনে মুক্তির জন্য। কিন্তু পরিস্থিতি মোড় নিচ্ছে অন্যদিকে।