সুরেশ কুমার দাশ
চট্টগ্রামের যানজট নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে ইদানিং। কিন্তু যানজটের কারণ ও প্রতিকারের বিষয়টা বলাবলি হচ্ছে খুব কম। এটা কেউ তলিয়ে দেখে না। এটা তলিয়ে দেখা দরকার নাকি শুধু যানজট-যানজট করে চিৎকার করলেই এটার সমাধান হয়ে যাবে। কিন্তু সব সময় এটাই হয়ে আসছে। যানজট কি কারণে হচ্ছে তার সামান্যই হয়ত ট্রাফিক পুলিশ জানে বা তাদের কাছে তথ্য থাকতে পারে। আর কোথায় কোথায় যানজট হচ্ছে তার হিসাবও থাকতে পারে। এসব স্পটে কেন যানজট হয় তা তারা ভালোই জানে। অর্থাৎ ট্রাফিক পুলিশ। জানলেও যখন সড়ক পরিকল্পনা করা হয় তখন তাদের কোন ভূমিকা থাকে না। তাদের খোঁজা হয় না। কিংবা তাদের কাছ থেকে আদৌ যানজট সংক্রান্ত কোন তথ্য যাওয়া হয় কিনা সেটা কেউ জানে না। এটা চাওয়া হয় না। কারণ এখানে আসলেই এক পক্ষ আর এক পক্ষকে কোন গুরুত্ব দিতে চাই না। কিংবা এখানকার কর্তৃপক্ষ এ নিয়মেই চলে আসছে। এ সুযোগে ট্রাফিক বিভাগও দায়সারা গোছের কিছু করে খাচ্ছে।
যদি তারা তলিয়ে দেখার চেষ্টা করেও থাকে তাহলে যে কারণে যানজট হচ্ছে সেটা আগে সমাধান করা দরকার ছিল। কিন্তু তলিয়ে দেখার কাজটি যেমন ঠিকভাবে হয়নি। তেমনি বার বার সেটা ধর্তব্যেই থাকছে না।
সত্যিই ট্রাফিক পুলিশ যানজট নিয়ন্ত্রণের জন্য ঠিকভাবে দাঁড়ালেই যানজট নিয়ন্ত্রণ হয়। সেটা যারা বোঝার চেষ্টা করেছে তারা অন্তত এ ঈদে দেখেছে। ট্রাফিক পুলিশ চাইলেই পারে।
যদি আমরা কোন জরিপকারির ভূমিকায়ও না দেখি তাহলে দেখতে পাব চট্টগ্রাম শহরের যানজট কেন হচ্ছে। এর প্রধান কারণ যত্রতত্র স্ট্যন্ডগুলোতে গাড়ি পার্কিং। গাড়ি বলতে কোন ধরনের গাড়ি- প্রথমত রিকশা। দ্বিতীয়ত সিএনজি অটো রিকশা। তারপর রাইডার, রেইঞ্জার স্ট্যান্ডে গাড়ি যাত্রী উঠানামার জন্য দাঁড়ালে সহজে যেতে চায় না। তারপর এগুলোর দাঁড়ানোর কোন নির্দিষ্ট জায়গা নেই। একইরকম অভ্যাস অন্যান্য গণ পরিবহনগুলোতেও দেখা যায়। বাস সহ অন্য সবগুলোই।
আর ট্রাফিক পুলিশ চাইলেই স্ট্যান্ড থেকে এ সমস্যাগুলো ৫ মিনিটে দূর করতে পারে। এক শ্রেণির সাংবাদিক সারাজীবন ট্রাফিক পুলিশের গাড়ি থেকে টাকা উঠানোর বিষয়টা নিয়েই ব্যস্ত থেকেছে। তারা বোঝাতে চেয়েছে - এ কারণেই যানজট হচ্ছে। আসলে কি তাই। এ ধরনের সাংবাদিকতার কারণে যানজটের প্রকৃত কারণটাই আড়াল করা হয়েছে। অথচ স্ট্যান্ডে ও মোড়ে মোড়ে পার্কিং ও গাড়ি দাঁড়ানো এসব খুব কমই লেখাতে এসেছে। এতে অনেক পথচারি মনে করতেই পারে সিএনজি অটো রিকশা ও রিকশাওয়ালারা চাইলেই যে কোন মোড়ে যাত্রীর জন্য এলোমোলো গাড়ি দাঁড় করিয়ে রাখতে পারে। যেন এটা তাদের অধিকার।
যানজটের দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে যত মার্কেট গড়ে উঠেছে- ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, সড়কের উপর স্কুল, হাসপাতাল, ক্লিনিক এদের কারো কোন পার্কিং ব্যবস্থা নেই। শহরের কোন সড়কের দোকান, মার্কেট, রেস্টুরেন্ট, হোটেল ব্যবসায়ির গাড়ির পার্কিং ব্যবস্থা আছে কেউ মুখস্থ দুই একটা নামও বলতে পারবে না। কিন্তু তারা জনজীবনকে দুর্বিসহ করে দেদারসে ব্যবসার নামে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। কিন্তু জনদুর্ভোগের জন্য কোন দ- বা জরিমানা তাদের গুণতে হয় না।
তারপর স্ট্যান্ডগুলোতে যত্রতত্র পার্কিং আছে ধনি প্রাইভেট কারওয়ালাদের। সেখানে আবার সর্বত্র ফুটপাত থেকে সড়কের অর্ধেক জুড়ে হকারদের উৎপাত। তাদের রমরমা ব্যবসা। এসব ব্যবসার সঙ্গে কারা জড়িত। তাদের এমন কি ক্ষমতা তারা সড়ক ফুটপাত দখল করে ব্যবসা চালিয়ে যাবে। কেন এদেরকে কেউ টু শব্দটি করতে পারে না। এদের এত জোর কেন। কোন পথচারি তো নয়ই। যারা জনগণের প্রতিনিধি তারাও না, আইন শৃঙ্খলা বাহিনী কেউ এদের বিরুদ্ধে টু শব্দ করে না। এটার কারণ কি।
এখন পথচারিদের হাঁটার কথায় আসি। ফুটপাত এক দফা দখল করে হকাররা। আর এক দফা দখল করে দোকানদাররা। তারা দোকানের সীমানা ফেলে বাড়তি ছাউনি দিয়ে ফুটপাতের অর্ধেক দখল করে নেয়। যেখানে ফুটপাত নেই সেখানে মূল সড়ক দখল করে। তাছাড়াও নালা নর্দমা যা পারে তাই দখল করে।
কোন জরিপকারির ভূমিকায় নয়, যদি কেউ একজন সাধারণ পথচারি হিসাবেও এসব বিষয়গুলো আঁচ করে থাকে তাহলে সেখানে যারা সড়ক পরিকল্পনাবিদ বলে খ্যাতি কুড়িয়েছেন তাদের লজ্জা পেতে হয়। কারণ একজন সাধারণ পথচারি আর ওইসব পরিকল্পনাবিদদের কাজ কি, দায়িত্ব কি। কোন সমস্যা সমাধানের জন্য আমি যদি কোন উদ্যোগ গ্রহণ করে থাকি তাহলে আমাকে আগে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে হবে। এরপর আসছে সমাধান। যদি আমার ট্রাফিক সিস্টেম কাজ না করে আগে সেটাই মেরামত করতে হবে। তারপর আমি অন্য সিস্টেমে যাব। এরপর অন্য পরিকল্পনার সঙ্গে সেটাকে যুক্ত করব। কিন্তু তা তো হচ্ছে না। গোটা শহরে সড়ক সংস্কার ও পরিধি বাড়ানো হচ্ছে। নতুন নতুন কাজ হচ্ছে আর যানজট কমছে না। এটা কোন যুক্তি নয়। কারণ আমরা যানজটের মৌলিক কারণগুলো চিহ্নিত করছি না। সড়ক সম্প্রসারণ করতেই থাকব আর গোটা সড়ক জুড়ে গাড়ির স্ট্যান্ড বসাব, রিকশা সিএনজি দাঁড়িয়ে থাকবে, ধনিরাও রিকশাওয়ালার মত রাস্তায় গাড়ি পার্কিং করে ঘন্টার পর ঘন্টা অফিসের কাজকর্ম চালিয়ে যাবে তাহলে তো সমস্যার সমাধান আসবে না। শেষ পর্যন্ত সুযোগ পেলে ফ্লাইওভার বানাব। কিন্তু ফ্লাইওভার দিয়ে রিকশা চলবে গাড়ি চলবে না।
আর পথচারিরা। সড়ক ব্যবহারে তাদেরও দায় আছে। ট্রাফিক আইন তাদের জন্যও। সড়ক যারা ব্যবহারকারী তাদের দায়িত্ব নিতে হবে। তাদের সচেতনতা বাড়ানোর দায়িত্ব নিতে হবে কর্তৃপক্ষকে। তাতেও যদি কাজ না হয় জরিমানা বা শাস্তি দেয়ার ব্যবস্থা করা যায়।
যদি মনে করি, শুধু উপরে উল্লেখিত কারণে আমাদের যানজট হচ্ছে তাহলে আমাদের আগে ওসব সমস্যাগুলোর বিহিত করতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে আমরা একটি ফুটপাত ও সড়কের কত শতাংশ ব্যবহার করছি। অথবা কেন ব্যবহার করতে পারছি না। ফুটপাত, সড়ক, যাত্রী উঠানামার সুপরিসর স্থান কেউ দখল করবে না, সেখানে গাড়ি ইচ্ছেমত দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না- এসব নিশ্চিত করতে হবে। এসব প্রতিকারের দায়িত্ব যাদের তাদের দায়িত্ব পালন করতে হবে। এটা কি আসলে নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে। এটা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। ঢাকা শহরে কয়েক মাইল যানজট ৫/১০ মিনিটের মধ্যেই ট্রাফিক পুলিশই রফা করে দেয়। কিন্তু এটা এখানে সম্ভব হবে না কেন। ট্রাফিক পুলিশের সক্ষমতার সবটুকু নিশ্চিত করতে হবে।
সড়ক পরিকল্পনার কথায় আবার আসা যাক। নগরীতে নতুন অনেক সড়কের কাজ হয়েছে। ঝকঝকে তকতকে। পুরনো সড়কও আছে। কিন্তু সড়কগুলোর কোথাও কোন রোড সাইন নেই। পুরনো সড়কেও ছিল না । সংস্কার ও সম্প্রসারিত সড়কগুলোতেও নেই। পৃথিবীতে অন্তত শতাধিক রোডসাইন ট্রাফিক বিভাগ ব্যবহার করে। কিন্তু যানজট নিয়ে এত কথা হলেও এ রোড সাইনগুলো বাংলাদেশে একেবারে হাওয়া। রোড সাইনের অর্থই হচ্ছে সতর্কতা ও সচেতন করা। কিন্তু এসব কিছু ছাড়াই চারপাশে যানজট প্রতিরোধের একমাত্র ব্যবস্থাই যেন সড়ক সম্প্রসারণ কিংবা ফ্লাইওভার বানানো।
বিমান বন্দর থেকে আগ্রাবাদ চেম্বারে আসতে বিদেশি বিভিন্ন ব্যবসায়ি প্রতিনিধি চট্টগ্রাম শহরের যানজটকে অসহনীয় ও ব্যবসায় বিনিয়োগে প্রতিবন্ধকতা মনে করছেন। তারা এখানে বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। চট্টগ্রাম শহরের এতবড় সম্ভাবনা শুধু কিছু ফুটপাতের চ্যালা-চামু-ার জন্যই ব্যাহত হবে?
গত শনিবার(৯ আগস্ট) বাংলাদেশের উন্নয়ন-চট্টগ্রাম শীর্ষক একটি মত বিনিময় সভা চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেখানে পরিকল্পনামন্ত্রী আ.হ.ম. মোস্তফা কামাল এমপি অনেক কথাই বলেছেন। চট্টগ্রামের উন্নয়নের অনেক পরিকল্পনার বয়ান দিলেন। কিন্তু শেষের দিকে তিনি সবাইকে বিস্মিত করে দিয়ে বললেন, সবকিছুই চট্টগ্রামে হবে। তার আগে আপনাদের প্রতিশ্রুতি দিতে হবে এখানে ফুটপাত ও সড়ক দখলমুক্ত থাকবে। এবং চট্টগ্রামবাসীই এটা দখলমুক্ত করবে তার নিশ্চয়তা দিতে হবে। তিনি বলেছেন, আপনার বাড়ির সামনের ফুটপাত অন্য কেউ দখল করে কিভাবে। একদম খাস কথা। তবে কথা হল বাড়ির লোকেরাও ফুটপাত দখলে জড়িত কিনা। না হলে মন্ত্রী যে প্রতিশ্রুতি চাইলেন- তার কোন নিশ্চয়তা পেলেন না কেন।
চট্টগ্রামের লোক একটা অজুহাত দেখাতে পারে। বর্তমান পরিকল্পনামন্ত্রী শত বললেও তারা কি পেরেছেন ঢাকার ফুটপাত ও সব সড়কের দখল মুক্ত করতে। পারেননি। নজিরও নেই। কিন্তু তারা যদি আমাদের উন্নয়নের নিশ্চয়তা হিসাবে শুধুই সড়ক ও ফুটপাত দখলমুক্ত করার প্রতিশ্রুতি চান - সেটা কোন অজুহাত নয়। বরং লজ্জা দেওয়া। আর চট্টগ্রামবাসী কি এটা করতেও অক্ষম। এমন হতে পারে আমরা যা ভাবছি তারা চট্টগ্রাম নিয়ে আরও বৃহৎ কিছু ভাবছে। চট্টগ্রামকে অন্যরূপে দেখতে চাচ্ছে। সত্যিকার একটি ব্যবসা ও শিল্প বান্ধব নগরী হিসাবে। যা ঢাকা থেকে অনেকখানি এগিয়ে থাকবে। এ কারণেও হয়তো মন্ত্রী চট্টগ্রামের জনসাধারণের কাছে এমন প্রতিশ্রুতি চাইতে পারে।
বাস্তবতা হচ্ছে - সেদিনের সভায় অনেক কথা চট্টগ্রামের নেতৃবৃন্দরাও বলেছেন, কিন্তু কেউ মন্ত্রীকে সড়ক ও ফুটপাত দখলমুক্ত করতে পারবে এমন প্রতিশ্রুতি দেননি। সবাই ছিলেন নিরব। এই নিরবতার আসলে কোন অর্থ হয়না। শুধু আ.হ.ম. মোস্তফা কামালই নন, যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও এসে বলে গেছেন, সড়ক সম্পসারণ করা হচ্ছে আর নতুনভাবে তা দখল হচ্ছে। তাহলে সড়ক সম্প্রসারণের তো দরকার নেই। সড়ক ও ফুটপাত সম্প্রসারণ মানে তো এসব দখল করে ব্যবসা করা নয়।
আর যারা চায় ফুটপাতের ব্যবসায়িরাও থাকুক। তাদের জন্যও সমাধান আছে। তাদের জন্য অন্য কোথাও ব্যবস্থা করা যায়।
তারা কি আসলে চট্টগ্রামের উন্নয়ন চায় নাকি উন্নয়নের নামে কিছু হলে সেই অজুহাতে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের কোন ছক বানাচ্ছে সেটা একটা কৌতূহলের বিষয়। না হলে ফুটপাত দখলমুক্ত করা কি কঠিন কাজ ?