সংবিধানে ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে আদালত যে রায় দিয়েছে এবং পূর্ণাঙ্গ রায়ে যে বিশ্লেষণ করেছে তা সংবিধানের মূলনীতির বিরোধী, গণতন্ত্রের বিরোধী। বিচার বিভাগের কোন আইন প্রণয়ের ক্ষমতা নেই, তারা শুধু সংবিধানের মূলনীতি পরিপন্থী কোন আইন পাস হলে বাতিল করার ক্ষমতা রাখেন। বিচারপতি অপসারণে যে জুডিশিয়াল কমিটির কথা বলা হয়েছে তা অস্ত্রে মুখে ক্ষমতা দখলকারী সামরিক সরকারের একটি অধ্যাদেশ মাত্র যা পরে তিনি পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে আইনে পরিনত করেন। যদি তখনকার রাজনৈতিক বাস্তবতা দেখি তবে দেখা যায় জিয়া সরকার পাকিস্তান তোষণ নীতির ধারাবাহিকতার একটি জ্বলন্ত উদাহরণ এই পঞ্চম সংশোধনী যা সম্পূর্ণ সংবিধান বিরোধী বলে আদালত রায় দিয়েছে। কিন্তু সেই আদালত, সেই অবৈধ সামরিক সরকারের অধ্যাদেশ কিভাবে বহাল করে যা সম্পুর্ণ গণতন্ত্র বিরোধী। যদি এই প্রধান বিচারপতি কোন অন্যায় করেন তার বিচার তিনি নিজেই করবেন। এটা শুধু গণতন্ত্রের পরিপন্থীই নয় চরম হাস্যকরও বটে। আমার বিচার আমিই করব। যখন তিনি নিজেই নিজের বিচার করবেন তখন জনগণের ভূমিকা কি? আর যদি জনগণের কোনরূপ ভূমিকা না থাকে তবে তা গণতান্ত্রিক হয় কি করে? এর অর্থ প্রধান বিচারপতি যে বিশ্লেষণ দিয়েছেন তা স্ববিরোধী এবং নিজ স্বার্থে জনগণের স্বার্থে নয়। তবে তিনি এটা করতে পারতেন, সংবিধানের যে সব ধারা সংসদ সদস্যদের ক্ষমতা কুক্ষিগত করেছে সেগুলো বাতিল করে সংসদের হাতে তথা জনগণের হাতে ক্ষমতা অর্পণ করা বা আইনটি বহাল রাখা। আমাদের জেনে রাখা দরকার আজ আওয়ামী লীগ আছে কাল অন্য কেউ থাকবে কিন্তু প্রধান বিচারপতির এই কেউটে কখনো যাবে না। বিশ্বে এক মাত্র পাকিস্তান ছাড়া কোন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এই নিয়ম নেই। আমরা ৪৬ বছর পরে এসে সংবিধানের মূলনীতি ভেঙ্গে পাকিস্তানকে ফলো করতে পারি না। এটা বিবেকেরও চরম পরাজয়। খুব সম্ভবত আওয়ামী সরকারের সবচেয়ে বড় ভুল সিনহাকে প্রধান বিচারপতি করা যার মাশুল গণতন্ত্রকে দিতে হচ্ছে। "আমার বক্তব্যকে যদি কেউ রাজনৈতিক মনে করে তবে এমন বক্তব্য আমি দিতেই থাকব"। এটা তার পোস্ট ও আইনের সাথে যায় কি না তা আমার বেশ সন্দেহ আছে। এটা সরাসরি সরকারকে চ্যালেন্জ ছুড়ে দেয়া যা তিনি পারেন না। অতি সম্প্রতি সরকার তথা আইনমন্ত্রীর সাথে বেশ কিছু ইসুতে দ্বিমত ও দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে প্রধান বিচারপতির বিশেষ করে বিচার বিভাগের ক্ষমতা বন্টন নিয়ে। প্রধান বিচারপতি বলেন, বিচার বিভাগের ৮০% ক্ষমতা সরকারের হাতে যেমন নিয়োগ বদলী, অপসারণসহ অন্যান্য বিষয়ে, অন্যদিকে আইনমন্ত্রী বলেন, প্রধান বিচারপতি রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা চান যা আমি দিতে পারি না। এই টানপরেন যে রায়ে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে তা বুঝতে খুব বেশি জ্ঞান থাকার প্রয়োজন নেই। শুধু সাধারণ দৃষ্টি থাকলেই যতেষ্ট। আশা করছি সরকারের তিনটে বিভাগই জনগণ তথা জনপ্রতিনীধিদের হাতে ফিরে আসবে শিঘ্রই।
যেহেতু প্রধান বিচারপতির অপসারণ ক্ষমতা প্রথম সংবিধানে সংসদকে দেয়া হয়েছিল সেহেতু এটি সংবিধান বিরোধী নয়। সংবিধান বিরোধী না হলে তার বিচার করার ক্ষমতা বিচার বিভাগের নেই একই সাথে প্রথম সংবিধানের কোন একটি আইন কিম্বা ধারা নিয়েও বিচার করার এক্তিয়ার বিচার বিভাগের নেই, নেই অবৈধ বলার ক্ষমতা। এখন আপনি যদি বলেন, এটি সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক তাহলে আপনাকে বলতে হবে প্রথম সংবিধানই সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক যা পাগলের প্রলাপ ছাড়া আর কিছুই নই।
যেহেতু পঞ্চম সংশোধনী আদালত কর্তৃক বাতিল হয়েছে, সেহেতু জুডিশিয়াল কাউন্সিলে অটোমেটিক্যালি ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। আদালত স্পষ্ট করে বলেছে, সামরিক সরকার কর্তৃক গৃহীত সব আইন অবৈধ। সেই অবৈধ আইন দিয়ে গঠিত জুডিশিয়াল কাউন্সিল চলতে পারে না। আবার আদালত আইন বিভাগকে নির্দেশ দিতে পারে না তোমরা নতুন আইন তৈরি কর। আদালতের কাজ বর্তমান আইনে বিচার করা, কোন নতুন আইন তৈরি করা বা করার নির্দশনা দেয়া নয়। আদালত মামলার রায়ে একটি অবজারভেশন দিয়ে থাকেন, সেই অবজারভেশন হতে হবে মামলা রিলেটেড কিন্তু এই আদালত অযাচিত ইতিহাস টেনে বিতর্ক সৃষ্টি করতে পারে না যেখানে মামলার সাথে কোন প্রকার সম্পর্ক নেই। একই সাথে জনগণ দ্বারা নির্বাচিত সম্মানিত পার্লামেন্ট মেম্বারদের ইমমেচিউর্ড বলারও ক্ষমতা নেই। তাদের উচিত পার্লামেন্ট মেম্বারদের সম্মানের সাথে কথা বলা কেননা এই এমপিগণ সরাসরি জনগণ দ্বারা নির্বাচিত। গণতন্ত্রকে সম্মান করতে হলে অবশ্যই গণপ্রতিনীধিদের আগে সম্মান করতে হবে। গণপ্রতিনীধিদের অসম্মান করে গণতন্ত্র, গণতন্ত্র বলে মুখে ফেনা তোলা সত্যি ন্যাক্কারজনক। হ্যা এটা মানছি, স্বাধীনতার পর থেকে বেশ কিছু পার্লামেন্ট বিতর্কিত হয়েছে তার মানে এই নয় যে সব পার্লামেন্ট এবং পার্লামেন্টারিয়ান ইমমেচিউর্ড। আমাদের মনে রাখতে হবে, আমরা তৃতীয় বিশ্বের একটি উন্নায়নশীল দেশ ঠিক একই ক্যাটাগরির আর পাঁচটি দেশের মত যেখানে যেখানে শিক্ষা, বস্ত্র, পুষ্টিহীনতার সাথে সাথে রয়েছে বড় ধরনের দুর্ণীতি। তাই আমরা যেমন স্বপ্নের মত ফার্স্ট ওয়ার্ল্ড কান্ট্রির একটি হতে পারব না, তেমনই চায়লেই ক্ষুদা, দারিদ্র্য, দুর্নীতি একদিনে বন্ধ করতে পারব না। আমাদের যেতে হবে গুটি গুটি পায়ে, আস্তে আস্তে।
এই রায় নিয়ে সরকার ও বিরোধী দলের যে টানাটানি চলছে, রাজনীতি চলছে তাও বন্ধ হওয়া উচিত। এটি একটি আদালতের বিষয়, রাজনৈতিক বিষয় নয়। আদালতের একটি রায় নিয়ে এমন টানা হেচড়া আমাদের রাজনীতিতে শিশুসুলভ আচরণ ছাড়া কিছুই নয়। সরকারের উচিত, আইনগত বিষয় আইনের মাধ্যমে সমাধান করা, টেবিলের নিচ দিয়ে নয়। টেবিলের নিচ দিয়ে কোন সমস্যার সমাধান করতে গেলে সমস্যা শুধু বাড়বে বই কমবে না। জনমনেও সন্দেহের সৃষ্টি হবে। সরকার যেভাবে নড়চড়ে বসছে তাতে মনে হচ্ছে, যে কোন উপায়ে সমাধান চায়। কিন্তু যেনতেন বা যেকোন উপায়ে সামাধানের ফল যে খুব ভাল হবে না তা সরকারের বোঝা উচিত।