কিছু বিষয়ে হয়তো আমাদের সেভাবে নাড়া দেয় না, আমরা ঠিক বুঝি না, কেননা আমরা তার ভুক্তভুগী নয়। আসলে ভুক্তভুগী না হলে বোঝা বড় কষ্টকর। দূর থেকে দেখে, কিছু কথা শুনে বা বলে কতটুকুই বা উপলদ্ধি করা যায়। যতটুকু উপলদ্ধি করা যায় তাতে অন্তত পরিপূর্ণতা আসে না, আসা সম্ভবও নয়। তারপরও আশেপাশের পরিবেশ পরিস্থিতি দেখে কিছুটা উপলদ্ধি করা যায়, কিছুটা অনুভূব করা য়ায়। নিরবে নিভৃতির কান্না মাঝে মাঝে দেওয়াল ভেদ করে বেরিয়ে আসে। রাতের যে বালিশটা আনন্দের সাক্ষী হওয়ার কথা সে বালিশ যখন চোখের জলে ভিজে চপচপ হয়ে যায়, যে সজীব হৃদয়ে ফুল ফুটার কথা সেখানে যদি শুকনো কাষ্ঠখণ্ড বাসা বাধে তখন মুখ দেখে বুঝতে সািক্লোজিস্ট হওয়ার দরকার পড়ে না মুখখানা দেখলেই বুঝা যায় কালী মাখা মেঘে ছেয়ে আছে হয়তো কাল বৈশাখী ঝড় অত্যাসন্ন। হ্যা এতক্ষণ একজন ডিভোর্সী মেয়ের কথা বলছিলাম। তাকে নিয়েই যত সামান্য আলোচনা করবো। আপনার আশেপাশে নিশ্চয় কোন না কোন বিধবা মেয়ে বা বেটি আছে যিনি সিঙ্গেল মাদারও হত পারেন। এই বিষয়ে একটু পরে আসছি,,,,,
বিবাহ হচ্ছে একটি বন্ধন, কিছু শর্ত সাপেক্ষে দুজন মানুষ সারা জীবন এক সাথে থাকবেন। কিন্তু এই বন্ধনটা শুধু দুজন মানুষকে নিয়ে নয়, দুটি পরিবারকে নিয়েও। দুজন খুব কাছের বন্ধু সারাজীবন এক সাথে থাকতে পারে না, দু ভাই এক সাথে থাকতে পারে না, এমন কি বাবা মায়ের সাথেও অনেক সময় আমরা একসাথে থাকতে পারি না তবে সম্পূর্ণ অপরিচিত মানুষ বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া মাত্র আজীবন এক সাথে থাকবে কি করে? খুব যৌক্তিক কারনেই সব সময় সম্ভব নয়। হয়তো অর্থনৈতিক, সামাজিক বা নিজের জীবনের কথা চিন্তা করে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করি সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে তারপরও পারি না, সম্ভব নয়। আমাদের সমাজে মেয়েদের একবার বিয়ে হয়ে গেলে খুব চেষ্টা করে সংসার টিকিয়ে রাখার। কখনো কখনো অনেক দুঃখ কষ্ট মেনে নিয়েও সংসার চালিয়ে যান বা চেষ্টা করেন তারপরও ভেঙ্গে যায়, ভেঙ্গে দিতে হয়। এই ভেঙ্গে যাওয়ার পর মেয়েরা প্রথম ও প্রধান সমস্যার কারণ আমি বা আপনি। আমরা প্রথম চিন্তা করি মেয়েটির স্বামী নেই, এতদিন এক সাথে ছিল, এখন একা থাকে কেমন করে, নিশ্চয় কারো না কারো সাথে অবৈধ সম্পর্ক আছে। একই সাথে আকার ইঙ্গিতে, বিভিন্ন কথার ছলে বলে কু প্রস্তাব দিয়ে বসি যদি লেগে যায়। এই কাজগুলো কিন্তু খুব কাছের এবং পরিচিত মানুষগুলোই করে থাকে। হয়তো আমি আপনি করি না কিন্তু যারা করে তারা কিন্তু আমি আপনিই। রাস্তা দিয়ে হাটতে গেলে একটা খারাপ কমেন্টস করবো, চাকরী খুঁজতে গেলে বেডের যাওয়ার প্রস্তাব দিব (প্রতেক্ষ বা পরোক্ষভাবে), আম কিনতে গেলে জাম ফ্রি দিব, একটু সুযোগ দিলে রসের কথা বলে একেবারে তুলতুল হয়ে যাব, দুনিয়ার সব করতে পারবো কিন্তু মাগার বিয়ে করতে পারবো না, করলে যে জাত যাবে। একেবারে চৌদ্দ পুরুষের জাত একবারে যাবে। হোক সে সুন্দরী, হোক সম্পদশালী, ভালবাসা দিব, প্রেম দিব, রিপুর তারনা মেটাবো মাগার বিয়ে করবো না। পতিতালয়ের পতিতা বিয়ে করা যায় কারন তিনি অবিবাহিতা কিন্তু ডিভোর্সী মেয়ে বিয়ে করা যাবে না কারন তিনি বিয়ে করেছিলেন এক সময়।
দ্বিতীয় সমস্যা পরিবার, বিয়ের আগে তিনিই ছিলেন পরিবারের সবচে আদরের, বাবা মায়ের প্রিন্সেস, আম্মু তো চুলার কাছেই যেতে দেয় না, যদি হাত পুড়ে যায় বা কেটে যায়, যদি একটু ধোঁয়া নাকে মুখে লাগে। যখন কোন বিষয়ে স্বামীর সাথে মনামালিন্য হয় তখন বলে, চলে আয়, তোকে আবার বিয়ে দিবো, বিয়ে হয়েছে বলে কি আমার মেয়ে পঁচে গেছে, দরকার হলে সারা জীবন বসিয়ে খাওয়াব তবু এমন ছেলের ঘর করবি না। ডিভোর্সের পর দুদিন বেশ ভালই চলে, তারপর মনে মনে এদিকে ছেলে খোজে, ওদিকে ছেলে খোজে কিন্তু মনের মত হয় না। অবশেষে চিন্তা করে এ বোঝা বড্ড ভারি, তারাতারি নামাতে হবে, যাকে পাও ধরে এনে ফরজ কাজ সারো। তার বউ থাকুক আর মরুক দেখা দরকার নেই, আপদ বিদায় কর। সবচেয়ে আদরের মেয়েটি তখন বড্ড ভারি, খুব অসহ্যকর, বিনা কারনে বা খুব নগন্য কারনে বকাঝকা আর বিয়ের খোঁটা, এ কারনেই তুই সংসার করতে পারিস নি, এটা সেটা। যা সত্যিই খুব কষ্টকর একটা মেয়ের জন্য, তখন নিজেকে বড্ড একা মনে হয়। সুইসাইডালের মত কঠিন বিষয়গুলো মাথায় ঘুর পাক খায়। কাউকে কিছু বলতেও পারে না, সইতেও পারে না, খুব সামান্য বা অকারণেই মনটা বিষাক্ত হয়ে উঠে।
তৃতীয় সমস্যা, মেয়েটি নিজেই, ভুলতে পারে না ফেলে আসা স্বামী সংসারের কথা, বলতে পারে না কারোর কাছে। দিনে দিনে আপন মানুষগুলো দুরে সরে যায়, চাকরি করতে পারে না। এক সময় দেখা যায় বড়ই একাকি জীবন। এই জীবনযুদ্ধে কেউ কেউ পরাজিত সৈনিকের মত চরম পন্থা বেছে নেয়, কেউ আবারো যেমন তেমন বিয়ে করে সংসারি আর কেউ কেউ আবারো নতুন স্বপ্ন নিয়ে স্ট্রাগল করে। এই নতুন স্বপ্ন যে আরো কঠিন, আগের তুলনায় হাজার গুণ কঠিন। চারিদিকের গঞ্জনা-প্রবঞ্জনা, অকথা-কুকথা, পারিবারিক চাপ, অর্থনৈতিক সংকট সব মিলিয়ে বিষিয়ে উঠা এক জীবন। যে লড়াই একা করতে হয় সমাজের বিরুদ্ধে, পরিবারের বিরুদ্ধে, অর্থনীতির বিরুদ্ধে, সমাজের উচ্ছৃঙ্খল কিটগুলোর বিরুদ্ধে। এতগুলো সমস্যার মধ্যে যারা নির্ভিক লড়ে যায় তাদের তো স্বশ্রদ্ধা সালাম জানাতেই হয়।
কিন্তু আমার প্রশ্ন এই সাধু ও শিক্ষিত সমাজের কাছে আমি বা আমরা বিয়ে করবো না কেন? তার কি সমস্যা? আগে বিয়ে হয়েছিল তাই?
আপনি যদি মনে করেন যে মেয়েটির বিয়ে হয়েছিল, স্বামীর সাথে ছিলো বলে বিয়ে করা যাবে না তবে আপনী যাকে বিয়ে করবেন তারও প্রেমিক থাকতে পারে, তার সাথেও দীর্ঘ দিন বেড শেয়ার করতে পারে। সুতরাং এটা বললে যৌক্তিক হবে না যে মেয়েটির বিয়ে হয়েছিল বলেই আর বিয়ে করা যাবে না। তবে অন্য একটি কারন হচ্ছে সম্মান, সামাজিক সম্মান। পাড়ার লোকে অকথা কুকথা বলবে, পাড়ায় ছি ছি পড়ে যাবে। আহা মান সম্মান ইজ্জত সব গেল রে এবার। অমুক যে বিধবা বিয়ে করেছে। ছোট বেলায় শুনতাম অমুক বিধাবা মেয়ে করেছে যদিও সত্যি কি না আজও জানি না তবে যে মানুষগুলো আমাকে বলেছিল তারা যে দৃষ্টিকোণ থেকে আমাকে এই কথাগুলো বলেছিল দীর্ঘদিন ধরে আমি নিজেও সেই দৃষ্টিভঙ্গি পছন্দ করতাম বা ধারন করতাম। কখনো নিজে উপলদ্ধি করতে পারি নি বা কেউ শিখিয়ে দেয় নি যে এই দৃষ্টিভঙ্গি ভুল। এই ভুল কথাটিই আমাদের সমাজে প্রসিদ্ধ, চরমভাবে প্রসিদ্ধ ও প্রতিষ্ঠিত বলেই মেয়েরা ডিভোর্সকে ভয় পায়, হাজার নির্যাতন করলেও মুখে কচটেপ এঁটে সহ্য করে। নারী নির্যাতনের অন্যতম প্রধান কারনই এটি। যা দু একজনের জীবনে এই ডিভোর্স নামক শব্দটি জড়িয়ে যায় তাদের জীবন যেন বিষাক্ততায় ভরা, এ বিষে যেন কুড়ে কুড়ে খায়। আমাদেরই চারপাশে ডিভোর্সী মেয়েগুলোর কান্না শক্ত দেওয়াল ভেদ করে কার বা কর্ণকুহরে পৌছে, যদি কারো কর্ণে পৌঁছেও যায় তবে সে মুখ বুঝে শুনে শেষ, তার আর কোন বাকি কর্ম নেই। আমরা ভাঙ্গা পরিবার চাই না, অটুট পরিবার চাই তবে কোন কারনে ভেঙ্গে গেলে ভাঙ্গা পরিবার বিশেষ করে মেয়েটি বা মহিলার প্রতি শুভ দৃষ্টি কামনা অত্যান্ত প্রয়োজন। এটি আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। এমন একটি মেয়ের পাশে দাড়ালে আল্লাহ নিশ্চয় আপনার পাশে দাড়াবেন। যে সমাজে আপনি সারাদিন না খেয়ে থাকলে একমুঠো ভাত দেয় না, একটু খোঁজও রাখে না বৃহৎ স্বার্থে না হয় একটু এই দৃষ্টিভঙ্গির বলিদান করলেন অন্তত তাতে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে না। এটি কোনভাবেই ডিভোর্সী মেয়ের জন্য করুনা নয়, আমাদের ভুল দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন, অনাকারনে জেনে বুঝে বা না বুঝে যে মেয়েটিকে কষ্ট দিচ্ছি, তার জীবনকে বিষিয়ে তুলছি, যার নুন্যতম অধিকার আমাদের নেই, সেই ভুলগুলো শুধরে সুন্দর সমাজ গঠন করা আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য। নৈতিকভাবেও আমাদের কিছু দায়বদ্ধতা আছে, সেই দায়বদ্ধতার বিষয়গুলো একটু হলেও চিন্তা করা উচিত । ডিভোর্সী মেয়ের কান্নার লোনা জল যদি এতটুকু আমাকে না ছুঁতে পারে, যদি শুধুই তার অসহায়ত্বের সুযোগ নিই, যদি বিবেক ও মনুষ্যত্ববোধ জাগ্রত না হয় তবে সত্যিই কি আমি মানুষ! আমরা যারা সকাল থেকে রাত অব্দী মিষ্টি মিষ্টি কথা বলি, মাঝে মধ্যে পীর সন্যাসী হয়ে উঠি, এই আমাদের মিষ্টি কথার আড়ালে, মিষ্টি হাসির আড়ালে বিষ লুকিয়ে আছে, কাল নাগের বিষ। এই মিষ্টি কথার আড়ালে, মিষ্টি হাসিতে কখন যে কাকে ছোবল মারি আমরা নিজেও জানি না। তবে হ্যা অবশ্যই আমাদের মাঝে কেউ কেউ ভাল মানুষ আছে, সুন্দর ও পরিশীলিত মনের মানুষ আছে। এই কুঠিল সমাজের আড়ালে ভাল মানুষের সংখ্যা অতিশয় নগন্য। শহরের এই ইট বালি আর কংক্রিটের মধ্যে নিজেরাও ইট পাথরের মত শক্তি হয়ে গেছি। অন্যের অনুভূতিগুলো এখন আর নাড়া দেয় না, ঠিক এন্টিবাইটিক যেমন দিনে দিনে কর্মক্ষমতা হারাচ্ছে, এক সময় এগুলো আর কাজ করবে না, তখন অতি সামান্য কারনেই লক্ষ লক্ষ মানুষ মরবে ঠিক তেমনই আমাদের অনুভূতিগুলো একসময় আর কাজ করবে না, মনুষত্ব ও বিবেকের ঘর তালাবদ্ধ থাকবে। তখন কি হবে আল্লাহ মালুম জানেন।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ দুপুর ১:২১