বৃষ্টি দেবতার সন্ধানে
ব্যাসি হেড(১৯৩৭-১৯৮৬)। বোতসোয়ানার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লেখিকা। জন্ম দক্ষিণ আফ্রিকায়। শিক্ষকতার পেশায় নিয়োজিত লেখিকা কিছুদিন "ড্রাম" ম্যাগাজিনের জন্য সাংবাদিকতা করেন। এছাড়া গোল্ডেন সিটি পোস্টেও ছিলেন কিছুদিন।
লোকেরা যেখানে চষতে যায় ঐ জায়গাগুলি বেশ ফাঁকা। জঙ্গলের মধ্যে বেশ খোলা জায়গা নিয়ে জমিগুলি আর বুনো জঙ্গলও বেশ নির্জন। বেশির ভাগ জমিই গ্রাম থেকে হাটা পথের দূরত্বে। জঙ্গলের কিছু কিছু অংশে মাটির তলার পানির স্তর পৃষ্ঠের অনেক কাছাকাছি; নিজেদের জমিতে যাবার পথে তারা ওসব জায়াগায় ছোট বিশ্রামের কুড়ে বানায়, অগভীর কুয়া খুঁড়ে তৃষ্ণা নিবারণের ব্যবস্থা করে। গ্রাম ছাড়ার পর থেকে তাদের প্রায় সব ধরনের ব্যবস্থাই নিতে হয়। জলাভুমির পাশে প্রচুর গাছগাছালিপূর্ণ ছায়াযুক্ত জায়গাগুলিতে তারা জিরিয়ে নিতে পারে, সবুজ মসগুলির মধ্যে ফুটে থাকে সুক্ষ্ণ সোনালী-বেগুনি বুনো ফুল, আর বাচ্চারা ওরই মধ্যে খুঁজতে থাকে বুনো ফিগ আর জামের ফল, যেগুলি কখনো কখনো বছরের ঐ সময়গুলিতে পাওয়া যায়। কিন্তু ১৯৫৮ সাল থেকে সাত বছরের খরা শুরু হলো। খোলা শুষ্ক কাঁটা ঝোপের সাথে সাথে জলাভুমিগুলিও পর্যন্ত হয়ে গেলো নিরস, গাছের পাতাগুলি কুঞ্চিত, রসহীন, মস শুকিয়ে শক্ত হয়ে এলো, গাছের ছায়ার নিচের মাটি ঝুরঝুরে হয়ে সাদাকালো বর্ণ ধারন করলো; কারণ পর্যাপ্ত বৃষ্টি হয়নি। লোকেরা ঠাট্টা করে বলতে লাগলো, বৃষ্টির পানি কাপে ভরতে গেলে তা বড়জোর চা-চামচ পর্যন্ত ভরতে পারে। খরার সপ্তম বৎসরের শুরুর দিকে গ্রীষ্মের সময়টা বেঁচে থাকার পক্ষে তীব্র যন্ত্রণার হয়ে দাড়িয়েছিল। বাতাস এত শুষ্ক আর আর্দ্রতা এত কমে গিয়েছিল যে গায়ের চামড়াও পুড়ে যায়। এই দাবদাহ থেকে বাঁচার উপায় কারো জানা ছিল না, আর বাতাসেই ছিল সবচেয়ে তীব্র ট্রাজেডি। ঐ গ্রীষ্মের শুরুতেই কিছু লোক বাড়িঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিল আর গাছের ডালে ফাঁস লটকে মৃত্যু বেছে নিয়েছিলো। বেশির ভাগ লোকেরাই জমিতে ফলানো শস্যের উপর নির্ভর করতো, বিগত দুই বছর ধরে তারা সবাই জমি থেকে শুধু মোড়ানো চামড়ার কম্বল আর রান্নার সরঞ্জাম নিয়ে ফিরে আসছিল। শুধু ঠগ, বাটপার, ঝাড়ফুঁক-কবিরাজেরা এ সময় প্রচুর টাকা জমাতে পারছিল, কারণ ঐ সময় লোকেরা চাষের লাঙ্গলে ছোয়ানোর জন্য আর বৃষ্টির প্রত্যশায় তাবিজ-কবচ আর শিকড়-বাকড়ের উপর নির্ভর হয়ে এদের শরণ নেয়া শুরু করেছিল।
বৃষ্টি সেবার একটু দেরি করে এসেছিল। নভেম্বরের শুরুতে অনেক আশা নিয়ে শুরু হলো। সম্পূর্ণ বর্ষণ হয়নি, আর বছরের মতো স্বাভাবিক বৃষ্টিও না, খুবই অল্প, অপর্যাপ্ত, আর্দ্র বৃষ্টি। মাটি নরম হলো, চারিদিকে প্রচুর সবুজের আনাগোনা, গবাদি পশুদের খাবারের একটা ব্যবস্থা হলো। সবাইকে কোগটলা গ্রামে ডাকা হলো চাষের মৌসুম শুরুর ঘোষণা শোনার জন্য। পরিবার পরিজনসহ সোৎসাহে সবাই চললো চাষের জমিগুলির দিকে।
মকগব্জা নামের এক বৃদ্ধের একটা পরিবার ছিল, এরা চাষের জন্য আগে আগেই বেরিয়ে এসেছিল। তাদের একটা গাধায় টানা গাড়ি ছিল, যেটাতে সবকিছু তুলে নেয়া হয়েছিল, সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধ মোকবজা, নিও আর বসেয়াং নামের দুটো ছোট বাচ্চা মেয়ে, তাদের মা টিরু, নেস্তা নামের কুমারী বোন, আর তাদের বাবা, এই পরিবারের প্রধান সহায় রামাদি। রামাদি গাধার গাড়িটাকে চালিয়ে আসছিল। প্রথম বৃষ্টির পর আশান্বিত রামাদি আর দুই স্ত্রীলোক কাঁটা ঝোপের সমগ্র জমিটাকে পরিষ্কার করে ফেললো আর দুধের জন্য ওদের সাথে আনা ছাগলগুলির প্রকোপ থেকে ভবিষ্যতে জমির ফসল বাঁচাতে এই পুরো জমিটাকে ঐ সব কাঁটা ঝোপ দিয়ে বেড়া দিয়ে ঘিরে দিলো। পুরোনো কুয়াটাকে কর্দমাক্ত পানিসহ পরিষ্কার করে আরো গভীর করে খুঁড়ে নিল, আর এই অপর্যাপ্ত বৃষ্টির মধ্যেই রামাদি তার ষাড় দুটিকে হাতে টানা লাঙ্গলের সাথে জুড়ে জমিটাতে চাষ দিতে শুরু করলো।
জমি প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিলো, চাষ দেয়া শেষ হয়ে গেছিলো, শুধু ফসলের জন্য অপেক্ষা বাকি ছিল। রাতের বেলা খাবারের সন্ধানে পোঁকাগুলি যখন গুনগুন করে গান গাইতো তখন পৃথিবীকে জীবন্ত মনে হতো। কিন্তু হঠাৎই নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকে বৃষ্টি গায়েব হয়ে গেলো, মেঘশূণ্য আকাশ নগ্ন হয়ে পড়ে রইল। আশ্চর্য নির্মমতার সাথে সূর্যটা আকাশে পাঁক দিয়ে উঠলো। দিনের পর দিন ধোঁয়ার মত করে বাষ্পায়িত হয়ে জমিগুলি থেকে মাটির শেষ আর্দ্র বিন্দুটুকু পর্যন্ত নিঃশেষিত হতে লাগলো। হতাশ হয়ে পরিবারের সবাই শুধু অপেক্ষার পর অপেক্ষা করে গেলো। তাদের আকাঙ্ক্ষা অনেক বেড়ে গিয়েছিলো, ছাগলগুলি দুধ দিতে আরম্ভ করেছিলো, যবের সাথে মিশিয়ে খাওয়াও যাচ্ছিল। এখন শুকনো যব খেতে হচ্ছে দুধ ছাড়াই। শুষ্ক জমিতে যব, ভূট্টা, কুমড়া বা তরমুজের চাষ ছিল প্রায় অসম্ভব। প্রায় সারাদিন তারা বসে থাকতো কুড়েগুলির নিচে, এমনকি চিন্তা করাও বন্ধ করে দিল, কারণ বৃষ্টির দেখা নেই। শুধু নিও আর বসেয়াং তাদের ছোট্ট বাল্যজগতে মোটামোটিভাবে খুশি ছিল। তারা তাদের মায়ের মত ঘরকন্নার খেলায় মেতে ছিলো, আর রাতের বেলায় পরস্পরের সাথে নিচু স্বরে আলাপ করত। কাঠিতে কাপড় জড়িয়ে বাচ্চা তৈরী করলো এবং ঠিক তাদের মায়ের অনুকরণে ওদেরকে ক্রুদ্ধ স্বরে বকাবকি করত। প্রায় সারাদিন তাদের কন্ঠে শোনা যেত, বকছে, “এই বোকা মেয়ে! যখনই আমি তোমাকে জল আনতে পাঠাই তুমি বালতির অর্ধেকটা ফেলেই দাও বাইরে!!””এই বোকা মেয়ে!! যবের পাত্রে যব যব যাতে না পুড়ে যায় তা মনে রাখতে পারো না? ” এরপর তারা কাপড়ের পুতুলগুলির পায়ের দিকে পেটাতে আরম্ভ করতো আরো নির্মমভাবে।
বয়োজেষ্ঠ্যরা এর কোনকিছুর প্রতিই মনোযোগ দিত না, এমনকি কৌতুকপূর্ণ বাক্যালাপেও না। তারা বসে থাকতো বৃষ্টির অপেক্ষায়। তাদের স্নায়ুগুলি বৃষ্টির জন্য আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে প্রায় ভোতা হয়ে গেছিল। বৃষ্টির চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আসলেই আর কিছু ছিল না। আকালের সময় তাদের সবগুলি পশু তারা বিক্রি করে দিয়েছিল খাবার কিনতে গিয়ে, গোটা পালের শুধু দুটো ছাগল রয়ে গিয়েছিলো। পরিবারের মধ্যে সবার আগে ভেঙ্গে পড়ল মহিলাটি, বৃষ্টির জন্য বসে থাকতে থাকতে চাপ সহ্য করতে না পেরে। প্রকৃতপক্ষে এই দুই রমণী দায়ী ছিল ছোট বাচ্চা দুটির মৃত্যুর জন্য। প্রত্যেক রাতে তারা বিশ্রীরকম উঁচু স্বরে কান্না জুড়ে দিত, শুরু হত নিম্ন স্বরে কিন্তু শেষ পর্যন্ত গিয়ে ঠেকতো উন্মাদীয় প্রলাপে। এমনভাবে চিৎকার করত আর পা ছুড়তে শুরু করতে যেন তাদের মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে। পুরুষেরা বসে থাকত চুপচাপ, নিজের উপর ্তাদের নিয়ন্ত্রণ ছিল তখনো। তাদের সবসময়ই স্বনিয়ন্ত্রণ ধরে রাখা প্রয়োজন ছিল, তবে তাদেরও ভেঙ্গে পড়ার আশঙ্কা ছিল। তারা জানতো মহিলারা অনাগত বৎসরের অনাহারের কথা চিন্তা করে ভীত হয়ে গেছিল।
শেষ পর্যন্ত বৃদ্ধ মকগব্জার একটা পুরোনো স্মৃতি মনে পড়ে গেল। যখন সে খুব ছোট ছিল, আর তার পূর্বপুরুষের রীতিরেওয়াজগুলি বজায় ছিল। তখনকার কথা, একটা বৃষ্টি নামানোর অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিল সে। খ্রিস্টান চার্চের দীর্ঘদিনের প্রার্থনার অভ্যাসের কারণে যে স্মৃতি প্রায় ভুলেই গিয়েছিলো, কষ্ট করে সেসব মনে করতে লাগলো সে। কুয়াশা সরে গেলেই সে তার ছোট ছেলে রামাদির সাথে ফিসফিস করে আলোচনা করতে লাগলো। একজন বৃষ্টিদেবতা আছেন, যিনি শিশুদের বলি গ্রহণ করেন। আর তা হলেই বৃষ্টি হবে, শস্য ফলবে। তিনি প্রথানুষ্ঠানটির বর্ণনা শুরু করলেন, তার অনেকখানি স্মৃতিভ্রম হয়েছিল, আর সে কারণেই সত্যমিথ্যা মিলিয়ে কর্তৃত্বের পুরোটা ব্যবহার করে নির্দ্বিধায় বলতে লাগলেন। মহিলাদের বিশ্রী কান্নায় রামাদির স্নায়ুবিক অবস্থাও ছিল বিপর্যস্ত, তারা অচিরেই দুই রমণীর সাথেও আলাপ করলেন। বাচ্চারা তাদের খেলা চালিয়ে যাচ্ছিলম “এই বোকা মেয়ে, তুমি দোকানের পথে টাকা হারালে কিভাবে? নিশ্চয়ই খেলা করছিলে!”
এর পর সব শেষ হল, বাচ্চা মেয়ে দুটোর দেহ জমির উপর ছড়িয়ে দেয়া হলো। তবু বৃষ্টি এলো না। এর বদলে পাওয়া গেলো রাতের বেলার মুমূর্ষু নিস্তব্ধতা আর দিনের বেলার মর্মন্তুদ রৌদ্রতাপ। সমগ্র পরিবারের উপর ভয়াবহ শোকের ছায়া নেমে এলো। চামড়ার কম্বলগুলি আর বাসনপত্র গুছিয়ে তারা গ্রামে ফিরে গেল।
গ্রামবাসী অচিরেই বাচ্চা মেয়ে দুটির অনুপস্থিতি টের পেল। পরিবারতী সবাইকে জানাল, তারা জমির ওখানে মারা গিয়েছিল, আর ওদের কবর দেয়া হয়েছিল। কিন্তু লোকজন ঠিকই তাদের ভয়ার্ত চোখমুখ খেয়াল করল, আর ধীরে ধীরে একটা গুঞ্জন উঠলো। তারা জানতে চায় কিভাবে বাচ্চারা মারা গেছে? পরিবার থেকে শুধু জানানো হলো, তারা মারা গেছে। লোকজনেরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি শুরু করল যে এটা খুবই আশ্চর্যের কথা যে দুটি মৃত্যু একই সাথে ঘটেছে। আর পরিবারের সবার চেহারায় একটা অস্বস্তি আর অস্বাভাবিক ছাপ লক্ষ্য কররা যাচ্ছিল। শীঘ্রই পুলিশ এল। পরিবারটি সেই একই মৃত্যু আর কবর দেয়ার গল্প শোনাল। পুলিশ কবরগুলি দেখতে চাইল। এর ফলে বাচ্চাদের হত্যার কথা বেরিয়ে আসলো আর তারা সব কিছু বলে দিল।
সেই ভয়াবহ গ্রীষ্মের পুরোটা জুড়ে বাচ্চাদের গল্পটা গ্রামটার উপর কালো মেঘের মত ছেয়ে রইল। ধর্মীয় হত্যার দায়ে রামাদি আর তার বৃদ্ধ বাবার মৃত্যুদন্ডের পরও দুঃখের অবসান ঘটলো না। আইন অনুযায়ী এরকম গোষ্ঠীগত প্রথার কারণে হত্যা করা হলে মৃত্যুদন্ড নির্ধারিত ছিল। যে প্রচন্ড মানুসিক চাপ আর ক্ষুধা যে এই হত্যার কারণ তা কোনভাবেই আদালতে উপস্থাপণ করার মত ছিল না; কিন্তু গ্রামের বাকি চাষীরা বুঝতে পারলো হয়ত চুল পরিমাণ এদিক ওদিক হলে তাদেরও মকগব্জা পরিবারের মত একই পরিণতি হতো। তারাও বৃষ্টির জন্য কাউকে না কাউকে খুন করে ফেলতে পারতো।
[চলবে]
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা জুন, ২০২০ রাত ১২:৪২