আমাদের দেশে বহুজাতিক নিকোটিন ব্যবসায় বড়ো কম্পানিটি'র নাম বৃটিশ আমেরিকান টোবাকো ! টোবাকো প্রথম পাওয়া যায় আমেরিকায়, সম্ভবতঃ খৃষ্টের জন্মের ৬ হাজার বছর আগে । ঊত্তর দক্ষিণ আমেরিকার আবিষ্কার ও ঔপনিবেশিকতার মধ্যদিয়ে প্রথমে ইউরোপে, পরে সভ্য বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে এর ব্যবহার। ষোল শতকের গোড়ার দিকেই সভ্য মানুষ প্রথম অবগত হয় যে এই টোবাকোর সাথে ক্যান্সার রোগের যোগসূত্র আছে। তারপরও এর ব্যবহার থেমে নেই !
একশ বছর আগে পুরাণ ঢাকার আরমানিটোলায় আগমন ঘটে আজকের বৃটিশ আমেরিকান টোবাকোর আদি কম্পানিটির। আজকের কম্পানিটির বাংলাদেশ সাইটে স্বাস্থ্য ও বিজ্ঞান প্রোফাইলে বলা হয়েছে- " ধূমপান ঝুঁকিপূর্ণ তা আমাদের দীর্ঘ্য গ্রহনযোগ্যতা আছে । আমাদের ব্যবসায় এই নয় যে ধূমপানের জন্য লোকজনকে তাড়া করা। এটা যারা ধূমপানের সিদ্ধান্তই নিয়ে ফেলেছেন তাদের জন্য একটা উন্নত ব্র্যান্ড প্রস্তাব করা । আমরা জোরালোভাবেই বিশ্বাস করি যে ধূমপান হবে শুধুমাত্র প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য যারা ঝুকি সম্পর্কে জানে।" তেনারা আরো বলেছেন যে বিভিন্ন মারাত্মক রোগের কারণ হচ্ছে ধূমপান আর ধূমপানের ঝুকি এড়ানোর একমাত্র নিশ্চিত পন্থা হচ্ছে ধূমপান না করা। যদি বলা হয় যে তেনারা বলতে চাচ্ছেন চোরকে বল চুরি কর আর গেরস্থকে বল সজাগ থাক , তাহলে ভালই হত ! তারচে ভয়াবহ মজার ব্যাপার হচ্ছে একই সঙ্গে তেনারা ধূমপায়ীকে চোর ও গেরস্থ বানাচ্ছেন !
আমরা যদি তামাক বা ধূমপানের আসল স্বাস্থ্য ও বিজ্ঞানটা দেখি তাহলে রীতিমত আৎকে ঊঠার মতো ! কী আছে এই ধূম্র সুধায় ?
(১) নিকোটিন ও ডিডিটিঃ কীটনাশক ও আগাছা গুল্মনাশক হিসেবে ব্যবহৃত হয় ।
(২) নেফতালেনঃ পেস্টিসাইড বা মথ দমনে ব্যবহৃত হয় ।
(৩) আর্সেনিকঃ মৃত্যুর বিষাক্ত উপকরণ।
(৪) ভিনাইল ক্লোরাইডঃ প্লাষ্টিক পণ্য উৎপাদনে ব্যবহৃত হয় ।
(৫) কার্বন মন অক্সাইডঃ বর্জ গ্যাস ।
(৬) টলুইন ও এসিটোনঃ ফোম ইন্ডাষ্ট্রির সল্ভেন্ট কেমিক্যাল।
(৭) মিথানলঃ রকেট ফোয়েল হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
(৮) সায়ানাইড্রিক এসিডঃ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে গ্যাস চেম্বারে ব্যবহৃত কেমিক্যাল।
(৯) ন্যাফতাইলেমিন, পাইরেন, ইউরেথেইন, ডাইবেঞ্জাক্রাইডিন, রেডিও পলনিয়াম২১০, ক্যাডমিয়ামঃ যারা সরাসরি দেহে ক্যান্সারের কারণ তৈরিতে কাজ করে !
এই যদি হয় ধূমপানের বিজ্ঞানটা, তাহলে আমাদের দেশে বহুজাতিক টোবাকো বেপারীদের কর্মফলটা দেখি ! বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার চলতি বছরের প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে একজন পুরুষ ধূমপায়ী জামাকাপড়, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে মাথাপিছু যে খরচ করে, তার দ্বিগুণেরও বেশি খরচ করে ধূমপানের পেছনে। বাংলাদেশকে দরিদ্রতম দেশগুলোর একটি উল্লেখ করে প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে যে পুরুষ ধূমপায়ীর সংখ্যার বিচারে বিশ্বে দেশটির অবস্থান সপ্তম। এ দেশে সবচেয়ে দরিদ্র শ্রেণীর মধ্যে ধূমপায়ীর হার বেশি। পরিবারগুলো গড়ে পারিবারিক খরচের ২ দশমিক ৮ শতাংশ ধূমপানের জন্য খরচ করে। বাংলাদেশের প্রসঙ্গ তুলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, একজন দরিদ্র ধূমপায়ী ধূমপানের খরচ বাঁচিয়ে প্রতিদিন একটি বা দুটি শিশুর খাদ্যে বাড়তি ৫০০ ক্যালরি যোগ করতে পারেন।
প্রতিবেদন থেকে আরো জানা যায়, বাংলাদেশে প্রতিবছর ৫৭ হাজার মানুষ মারা যায় তামাকসংক্রান্ত রোগে। ত্রিশোর্ধ্ব যত মানুষ মারা যান, তার ১৬ শতাংশ তামাকের ব্যবহার-সংক্রান্ত কারণে। এ ছাড়া তামাক ব্যবহারের কারণে প্রতিবছর অসুস্থ হয় ১২ লাখ মানুষ। কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে (১৩-১৫) বাড়ির বাইরে পরোক্ষভাবে ধূমপানের শিকার হয় ৪২ শতাংশ এবং বাড়িতে ৩৫ শতাংশ। আর প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে ৪৫ শতাংশ বাড়ির বাইরে প্রকাশ্য স্থানে এবং ৬৩ শতাংশ কর্মক্ষেত্রে পরোক্ষভাবে ধূমপানের শিকার। তামাক সেবন-সংক্রান্ত অসুস্থতা থেকে মৃত্যু বা অক্ষম হয়ে আয় বন্ধ হওয়ার কারণে প্রতিবছর ক্ষতি হয় ৬৫ কোটি মার্কিন ডলারের বেশি। ধূমপানসংশ্লিষ্ট কারণে যত মানুষ মারা যায়, তার অর্ধেকের মৃত্যু হয় জীবনের সবচেয়ে কর্মক্ষম সময় অর্থাৎ ৩০ থেকে ৫৯ বছর বয়সের মধ্যে। একজন মানুষের মাসিক সংসার খরচের ১০ শতাংশ ব্যয় হয় তামাকজাত পণ্য ব্যবহারে অসুস্থতার চিকিৎসায়।
আরো একটি ভয়াবহ ক্ষতি পরিবেশের ! বাংলাদেশে প্রতিবছর যে বনভূমি ধ্বংস হয়, তার ৩০ শতাংশ ধ্বংস হয় তামাকজাত পণ্য উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতের কারণে। এ বছর তামাক প্রক্রিয়াকরণ চুল্লিতে ছাই হয়েছে বিশ লক্ষাধিক কিশোরী যুবা গাছের দেহ ! এ ছাড়া ধূমপানের কারণে অগ্নিকাণ্ড ও তামাকজাত পণ্য উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতের ফলে পরিবেশেরও মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে । অপব্যবহার হচ্ছে প্রতি বছর ২৬ হাজার ৩৮৮ হেক্টর কৃষি জমির, কমছে জমি'র উর্বরতা, বঞ্চিত হচ্ছে জাতির কাংখিত ফসল উৎপাদন থেকে।
অর্থনীতিতে সে'র বিখ্যাত বিধি হচ্ছে " যোগান তার নিজের চাহিদার সৃষ্টি করে" ! আমরাও চাই আগে তামাকের ঊতপাদন বন্ধ করা হোক । আমাদের সার্কভূক্ত দেশ ভূটান সম্ভবত বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেব আভির্ভূত হয়েছে ধূমপান মুক্ত দেশ হিসেবে। সেখানে শতায়ু ওই বহুজাতিক কম্পানিটি'র সাইট থেকে আরো জানা যায়, ৩৪.০৯ শতাংশ শেয়ার দেশী কতিপয় বাঘা বাঘা কম্পানির হাতে ! আর এটি একটি সর্বোচ্চ বেসরকারী করদাতা প্রতিষ্ঠান ! গত বছর এ কম্পানিটি ৪৬.২৭ বিলিয়ন টাকা সাকুল্য কর দিয়ে আমাদের অর্থনীতিকে ধন্য করেছে । ১১৮৬ জন প্রত্যক্ষ ও ৫০ হাজার মানুষের পেশা পরোক্ষভাবে জড়িত এই নিকোটিন কম্পানিটি'র সাথে। তাছাড়া ৯ লক্ষ খুচরা লোকও তার পণ্য বিপননের সাথে জড়িত। ধূমপান মুক্তির ব্রত কতটা নিগড়ে বন্দি তা এই তথ্য থেকে সহজেই অনুমেয় ! আমাদের অভিভাবকরাও যেন অসহায় !একটি পত্রিকায় আজ জনৈক অভিভাবক বলেছেন, চাষ নিরুৎসাহিত করতে সরকার তামাকচাষিদের ভর্তুকি মূল্যে সার দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। চলতি বছর তামাক চাষের এলাকায় কৃষকদের মাত্র দুই শতাংশ হারে ঋণ দিয়ে আদা ও হদুলের চাষে উৎসাহিত করা হয়েছে !
কিন্তু দুপায়ে নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকা ব্লগের ওই সাইনবোর্ডটি কী বহন করছে ! সচল ভাসা দৃষ্টিতে অনেকের চোখ এড়িয়ে যেতে পারে ! অন্ততঃ আজ বিশ্ব তামাক মুক্ত দিবসে হয়তো আপনাকে মনে করিয়ে দিবে অন্য কথা ! কি বলবেন তাদের ওই "একটি গাছ একটি জীবন" কূটনীতিকে ! ডাবল স্ট্যান্ডার্ড এই নীতি কি সহস্রাব্ধের ঠান্ডা কৌ্তুক নয় ! আমরা ধূমপান করি না, আমরা পরিবেশ-প্রতিবেশ থেকে নিতে চাই না নিকোটিন ! আমরাও কর দেই, আমরা কেন দেখতে চাইব স্বাধীন দেশে বহুজাতিকের বজ্জাতি বা 'ভুতের মুখে রাম নাম' !
"একটি গাছ একটি জীবন" - ভূতের মূখে রাম নাম !
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
জেনারেল রাও ফরমান আলী ছিল ইন্ডিয়ান 'র'-এর এজেন্ট

জেনারেল রাও ফরমান আলী ছিল ইন্ডিয়ান 'র'-এর একজন এজেন্ট। এই তথ্য কেউ জানতো না। তার ফ্যামিলিও জানতো না। ১৯৪১ সালে বর্ডার ক্রস করে সে ঢুকেছিল পাকিস্তান। তারপর আস্তে আস্তে... ...বাকিটুকু পড়ুন
বন্ডাইর মত হত্যাকাণ্ড বন্ধে নেতানিয়াহুদের থামানো জরুরি...
বন্ডাইর মত হত্যাকাণ্ড বন্ধে নেতানিয়াহুদের থামানো জরুরি...

অস্ট্রেলিয়ার সিডনির বন্ডাই সৈকত এলাকায় ইহুদিদের একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে সমবেত মানুষের ওপর দুই অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী অতর্কিতে গুলি চালিয়েছে। এতে... ...বাকিটুকু পড়ুন
আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমাণ নন বলা কুফুরী

সূরাঃ ২ বাকারা, ২৫৫ নং আয়াতের অনুবাদ-
২৫৫। আল্লাহ, তিনি ব্যতীত কোন ইলাহ নেই।তিনি চিরঞ্জীব চির বিদ্যমাণ।তাঁকে তন্দ্রা অথবা নিদ্রা স্পর্শ করে না।আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সমস্তই... ...বাকিটুকু পড়ুন
বিজয়ের আগে রাজাকারের গুলিতে নিহত আফজাল

ঘটনা স্থল গাইবান্ধা জেলার ফুলছড়ি থানার উড়িয়া ইউনিয়নের গুণভরি ওয়াপদা বাঁধ।
১৯৭১সালের ১৬ই ডিসেম্বরের কয়েক দিন আগের ঘটনা। আফজাল নামের ভদ্রলোক এসেছিলেন শ্বশুর বাড়ি বেড়াতে। আমাদের পাশের গ্রামেই তার... ...বাকিটুকু পড়ুন
৫৫ বছর আগে কি ঘটেছে, উহা কি ইডিয়টদের মনে থাকে?

ব্লগের অনেক প্রশ্নফাঁস ( Gen-F ) ১ দিন আগে পড়া নিউটনের ২য় সুত্রের প্রমাণ মনে করতে পারে না বলেই ফাঁসকরা প্রশ্নপত্র কিনে, বইয়ের পাতা কেটে পরীক্ষার হলে নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।