আমি যখন অফিসে প্রথম অনিন্দিতাকে দেখি তখন তার সৌন্দর্যে একদম মুগ্ধ বিস্মিত হয়ে গিয়েছিলাম। পরে যখন জানতে পারি তার ক্লাস ফাইভে পড়ুয়া একটি মেয়ে আছে তখন বিস্ময়ের মাএা আরো বেড়ে গিয়েছিলো। ছিপছিপে লম্বা, ফর্সা,টিকালো নাক আর একদম সোজা, ঘন কালো কোমর ছারানো চুলে তাকে দেখাতো ঠিক ফিল্মের নায়িকার মত। তার মেদহীন সুন্দর দেহে একরঙ্গা সিল্কের শাড়িগুলো আরোবেশি অভিজাত হয়ে ধরা দিত। কম্পিটারের মনিটরে যখন একটানা তাকিয়ে কাজ করে যেত, তখন দেখলে মনে হত, অভিমানে দূর দিগন্তে হারিয়ে যাওয়া কোন রাজকন্যা। ভিতরের বিষন্নতাটা প্রায়ই হাসিখুশি মুখকে ফাঁকি দিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইতো। কি করে জানিনা আমরা খুব ঘনিষ্ট হয়ে গেলাম। একসঙ্গে লান্চ করা দিয়ে শুরু তারপর একসঙ্গে বাসায় ফেরা। ওর আর আমার বাসা ছিল একই এলাকাতে উত্তরায়।মাঝে মাঝে ট্রেনে চরে যখন যেতাম মনে হত এই ট্রেন যেন আমাদের পৃথীবির শেষ প্রান্ত সীমায় নিয়ে যাবে। আসলে আমরা দুজনেই হারিয়ে যেতে চাইতাম।
একদিন এক বিষন্ন বিকেলে আমরা বসেছি অফিস ক্যান্টিনে চা খেতে। এ সময়টাতে কেউ আসেনা বলেই আমরা প্রায়ই এখানে এসে কিছুটা সময় চা খেয়ে গল্প করে কাটাতাম। অনেক সময়ই আমার প্রিয় কোন কবিতার লাইনও তাকে শোনাতে হত। সেদিনও ও শুনছিল হঠাৎ করে তাকিয়ে দেখি তার মুখটা একদম ব্লটিংপেপার দিয়ে শুষে নেয়া বিবর্ন সুখনো পাতার মত দেখাচ্ছে। জিজ্ঞেস করতেই আাস্তে আস্তে বললো, তার একটা স্বপ্ন ছিলো যে,তার ভালোবাসার মানুষটি তাকে সময়ে অসময়ে তাকে কবিতা আবৃতি করে শোনাবে। তার বিখ্যাত প্রফেসর স্বামী কোনদিনও তার স্বপ্নের খোঁজ রাখেনি। তার ভালো লাগা মন্দ লাগার কোন দামও তার স্বামীর কাছে ছিলো না। তার স্বামীর রুক্ষ স্বভাবের কাছে কবিতা আবৃতি করে শোনানোর আশা করাটাও বাতুলতা মাএ। সেটাও না হয় সে মেনে নিয়েছিলো। কিন্তু কোন এক রাতে তার ঘুম ভেঙ্গে যায় কবিতা আবৃতির শব্দে। শব্দটা আসছে পাশের স্ট্যাডিরুম থেকে। সেখানে গিয়ে খুব অবাক হয়ে সে দেখে , তার স্বামী তার ছাএির হাত ধরে উদাত্ব কন্ঠে কবিতা আবৃতি করছে
আমাকে একটি কথা দাও যা আকাশের মতো
সহজ মহৎ বিশাল,
গভীর; – সমস্ত ক্লান্ত হতাহত গৃহবলিভুকদের রক্তে
মলিন ইতিহাসের অন্তর ধুয়ে চেনা হাতের মতন,
আমি যাকে আবহমান কাল ভালোবেসে এসেছি সেই নারীর।
সেই রাত্রির নক্ষত্রালোকিত নিবিড় বাতাসের মতো:
সেই দিনের – আলোর অন্তহীন এঞ্জিন চঞ্চল ডানার মতন
সেই উজ্জ্বল পাখিনীর – পাখির সমস্ত পিপাসাকে যে
অগ্নির মতো প্রদীপ্ত দেখে অন্তিমশরীরিণী মোমের মতন।
আর ছাএি প্রশ্রয়ের হাসি দিয়ে প্রায় গা ঘেঁষে বসে সে আবৃতি উপভোগ করছে। দৃশ্যটা তাকে এতই ব্যথিত করেছিলো যে, আজও যেন সে তার বুকের ভিতর ভাঙ্গনের শব্দটা স্পষ্ট শুনতে পায়। আমি এত রাতে ছাএির উপস্হিতি নিয়ে অন্যরকম কিছুর ইঙ্গিত দিলাম। সে জানালো প্রায়ই নাকি ছাএিরা থিসিস পেপারের জন্য অনেক রাত পর্যন্ত থাকে। ভিতরে কি হয় সেটা জানার চেষ্টা সে কখনোই করেনি। এসবে সে নির্লিপ্ত। এসব নিয়ে কষ্ট পাওয়ার চিন্তা সে অনেক আগেই সে ছেড়ে দিয়েছে ,দীর্ঘদিন ধরে তাদের মধ্যে কোনরকম শারীরিক সংসর্গও নেই। সেই নিয়ে তার তেমন কোন দুঃখবোধও নেই। তার যাবতীয় কষ্ট যেন আটকে আছে ঐ একটা মাএ কবিতা আবৃতিতেই।