somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাঁধ ও ব্যারেজ সর্ম্পকিত কিছু সাধারণ তথ্য

০১ লা ডিসেম্বর, ২০১১ বিকাল ৩:১২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

জলবিদ্যুৎ বাঁধ

বাঁধ হলো নদীর প্রবাহের সাথে সমকোনে (আড়াআড়ি) স্থাপিত প্রতিবন্ধক এবং পানিবিদ্যুৎ প্রকল্পের মূল স্থাপনা, যেমনটা কাপ্তাই বাঁধ। সাধারণত খরোস্রোতা নদীর প্রবাহকে বাঁধ দিয়ে আটকে এর উজানে জলাধার তৈরী করে পানির উচ্চতা বাড়ানো হয়। এরপর জলাধারের নিচে সুড়ঙ্গের মাধ্যমে এই পানিকে প্রবাহিত করে টারবাইন ঘুড়িয়ে উৎপন্ন করা হয় বিদ্যুৎ। সুতরাং বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানো বা কামানো মানে জলাধার থেকে পানি ছেড়ে দেয়ার পরিমান কম বেশি করা। বর্ষা মৌসুমে নদীতে পানির প্রবাহ বাড়লেও জলাধারে আটকে রাখার কারণে ভাটি অঞ্চলে পানির প্রবাহ কমে যাবে। অন্যদিকে শুষ্ক মৌসুমে উজান থেকে পানি কম আসলেও বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রয়োজনে জলাধার থেকে নিয়মিত পানি ছাড়া হবে, ফলে বাঁধের ভাটিতে পানির প্রবাহ আগের থেকে বাড়বে।


ফারাক্কা ব্যারেজ

অন্যদিকে ব্যারেজ হলো নদীর পানিকে একাধিক গেইট দিয়ে নিয়ন্ত্রিত ভাবে প্রবাহিত করা। ব্যারেজের ঠিক উজানে এক বা একাধিক কৃত্রিম খাল খনন করে নিয়ন্ত্রিত ভাবে পানি প্রবাহিত করে আরো ছোট ছোট খাল দিয়ে (তিস্তা ব্যারেজ, বাংলাদেশ) বা পাম্পের মাধ্যমে (জিকে প্রকল্প, বাংলাদেশ) আবাদী জমিতে সেচ দেয়া হয় অথবা অন্য কোন নদীতে পানি প্রবাহ বাড়ানো হয় (যেমন ফাঁরাক্কা ব্যারেজ)। অর্থ্যাৎ ব্যারেজের মূল লক্ষ্যই থাকে একটি নদী থেকে পানি অপসারণ, অন্যদিকে বাঁধের মূল উদ্দেশ্য উজানে পানি সঞ্চয়। ভারতের টিপাইমুখ প্রকল্প শুধু বাঁধ নয়। টিপাইমুখ প্রকল্পের উদ্দেশ্যের মধ্যে এই বাঁধ থেকে ৯৫ কিমি ভাটিতে একটি ব্যারেজের (ফুলেরতাল) প্রস্তাবও রয়েছে।


ব্যারেজ

উজান এবং ভাটি - দুই দিকেই বাধের প্রভাব পরে। উজানে কৃত্রিম জলাধারের কারণে এবং ভাটিতে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ নিয়ন্ত্রনের কারণে। উজানে বাঁধের সাধারণ প্রভাব –

ক) কৃত্রিম জলাধারের কারণে বিপুল পরিমান এলাকা পানির নিচে নিমজ্জিত হয়, ফলে মানুষের ঘরবাড়ি আবাদী জমিসহ শুষ্ক/শুকনো এলাকা জলাভূমিতে পরিনত হয়। বনভূমি ও অন্যন্য উদ্ভিদ পানির নিচে তলিয়ে পচে গিয়ে বিপূল পরিমান কার্বন নিঃসরণ করে, ফলে বায়ুমন্ডলে গ্রীন হাউস গ্যাস বাড়ায়।

খ) নদীর স্থানে জলাধার তৈরির ফলে পানির উপরিতলের ক্ষেত্রফল বাড়ে, যা স্বতঃবাষ্পীভবনের (ইভ্যাপরেশন) হার বাড়ায়। আগে নদী থেকে যে পরিমান পানি বাষ্প হতো, এখন অনেক বেশী পরিমান স্বতঃবাষ্পীভূত হয়। এটি প্রকারান্তরে নদীর পানির প্রবাহকে কমিয়ে দেয়। এর পরিমান নেহায়েত কম নয়। এক হিসেব মতে আমেরিকার ‘হোভার ড্যামে’র কারণে সৃষ্ট ‘লেক মেড’ থেকে বাৎসরিক ৩৫০ বিলিয়ন গ্যালন পানি কমে যায় এবং নদীর প্রবাহ কমিয়ে দেয়।

গ) বাঁধের সবচাইতে বড় প্রভাব হল বাস্তুসংস্থান বিপর্যয়। বাঁধের উজানে স্বাভাবিক ভাবেই একটি স্থলজ বাস্তুসংস্থান ছিল। সেটি সম্পূর্ণ ভাবে বিনষ্ট হয়ে একটি কৃত্রিম জলজ বাস্তুসংস্থান তৈরী হয়। এতে করে অনেক প্রজাতির প্রাণী বিলুপ্ত হয়। এছাড়াও বহু প্রজাতির মাছ বছরের একটি বিশেষ সময়ে ভাটি থেকে উজানে যায়। বাঁধের কারনে মাছের এই অভিভাসন সম্পূর্ণ রূপে বিনষ্ট হয়ে উৎপাদন কমে, বা নিঃশেষ হয়।

ঙ) শুধু পানিই না নদী প্রবাহ বয়ে নিয়ে চলে বিপূল পরিমান পলি। বাঁধের ফলে উজানে নদীর গতিবেগ অনেক কমে যায়, পানির পক্ষে এই পলি আর ধরে রাখা সম্ভব হয়না, তা ধীরে ধীরে নিচে পড়ে জলাধারের বুকে জমতে থাকে। এটি জলাধারের নিচের স্তরের উচ্চতা বাড়িয়ে দেয়।

ভাটিতে এর সাধারণ প্রভাব –

ক) পানিবিদ্যুৎ বাঁধের কারণে স্বভাবতই বর্ষা মৌসুমে প্রবাহ কমে, ফলে ভাটি অঞ্চলের স্বাভাবিক জলজ বাস্তুসংস্থান ব্যহত হয়। যেসকল জলজ প্রানীর প্রজননে বাৎসরিক বন্যা সম্পর্কযুক্ত, তাদের স্বাভাবিক প্রজনন ব্যহত হয়। এছাড়াও স্বাভাবিক বন্যায় আশেপাশের স্থলাভূমি থেকে জলজ প্রানীর প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর খাদ্য নদীতে মেশে। সুতরাং স্বাভাবিক বন্যা ব্যহত হলে এই প্রক্রিয়া বাধগ্রস্থ হয় এবং ফলশ্রুতিতে এদের বিলুপ্তি ঘটে।

খ) গভীরতা অনুযায়ী পানির বেগ নদীতে ভিন্ন ভিন্ন হয়। সাধারণত নদীর তলদেশে বেগ কম থাকে আর উপরিতলের ঠিক আগে থাকে সর্বোচ্চ। উলম্ব তল বরাবর পানির বেগের পরিবর্তনের উপর নির্ভর করে নদীর বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন ধরনের মাছ অভিযোজিত হয়। এই বেগের পরির্বতন মাছের স্বাভাবিক অভিযোজন বিনষ্ট ও জীবনচক্র ধ্বংস করে। ধ্বংসে হয় ভাটির মৎস সম্পদ।

গ) ‘নিন্মাঞ্চল’ সমতল ভূমির বৈশিষ্ট। প্রাকৃতিক নিয়মে বর্ষায় নদীর পানি উপচে এইসব নিন্মাঞ্চলগুলো পূর্ন হয়ে সারা বছর জলজ প্রানীর অভয়াশ্রমে পরিনত হয়; উদাহরণ স্বরূপ বাংলাদেশের হাওড়গুলি। এই নিন্মাঞ্চগুলোই আবার শুষ্ক মৌসুমে পানি মজুদের কাজ করে, যা থেকে ছোটছোট নদী-খালগুলি ‘বেইজ ফ্লো’ হিসেবে পানির যোগান পায়। এই প্রক্রিয়া ব্যাহত হলে নিন্মাঞ্চগুলি সঠিক সময়ে পানি না পাওয়াতে এদের স্বাভাবিক ‘মরফোলজি’ ব্যহত হবে আর সেই সাথে এর উপর নির্ভরশীল ছোট ছোট নদী-খালগুলো শুকিয়ে যাবে।

গ) বাঁধের ফলে নদীর সমস্ত পলি উজানের জলাধারের নিচে সঞ্চিত হওয়ার কারণে, টারবাইনের মধ্যে দিয়ে পানির যে প্রবাহ ভাটিতে পরিবাহিত হয় তা সম্পূর্নরূপে পলিমূক্ত থাকে আর তাই এর পলি ধারন ক্ষমতাও হয় সর্বোচ্চ। ফলে তা ভাটিতে প্রবাহিত হবার সময় নদীর বুক আর পাড় থেকে মাটি নিয়ে যায় আর তাই নদী ক্ষয়ের পরিমান হঠাৎ করে বিপূলাংশে বেড়ে যায়।

সহায়ক গ্রন্থসমূহঃ
০১. বাংলা দেশের নদ নদী ও পরিকল্পনা; কপিল ভট্টাচার্য। প্রথম সংহতি সংস্করণ, জানুয়ারী ২০০৮। সংহতি প্রকাশন।
০২. টিপাইমুখ বাঁধ ও বাংলাদেশ প্রক্ষাপট; জাহিদুল ইসলাম। ২০০৯। প্রকাশায়তন।



সর্বশেষ এডিট : ০১ লা ডিসেম্বর, ২০১১ বিকাল ৪:১০
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×