somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পুরানো লেখার নতুন পাঠ: বিদেশি কোম্পানির স্বার্থেই দাম বাড়ছে by আনু মুহাম্মদ

০৭ ই জানুয়ারি, ২০১৩ দুপুর ২:২২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

(তেল সহ অন্যান্য জ্বালানীর দাম আবারো বাড়িয়েছে বর্তমান সরকার। ফলে পুরো অর্থনীতি ও জনজীবনে এর প্রভাব পরবে। ধারাবাহীক ভাবে জ্বালানীর দাম বৃদ্ধির এই প্রক্রিয়া চলছেই। কেন জ্বালানী দাম বাড়ানো হয়? কাদের স্বার্থ এর পেছনে? এই বিষয়গুলো আমাদের কাছে পরিস্কার নয়। আমরা অনেকেই জ্বালানী দামে বৃদ্ধির পেছনে আন্তর্জাতি বাজারে তেলের দাম বৃদ্ধি এবং ভর্তুকি সহ সরকারী নানা যুক্তি বিশ্বাস করি। কিন্তু ঘটনা এমন সরল নয়। তাহলে ঘটনা কি? এই সকল প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধান করেছেন অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ এই লেখায়। বন্ধুরা পড়ুন। অন্য বন্ধুদের মাঝে শেয়ার করুন।)

তেল-গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ার পেছনে প্রধান যুক্তি হলো ভর্তুকি। ভর্তুকি দিন দিন বাড়ছে এবং তা কমানোর যুক্তিতেই প্রতিবার দাম বাড়ানো হয়। কোনো সরকারের পক্ষ থেকে কখন কেন ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে, কেন তা বাড়ছে, এর কার্যকর ব্যাখ্যা এবং সেই কারণগুলো দূর করার পদক্ষেপ নেওয়া হয় না। গ্যাসের ভর্তুকি বাড়ানোর পেছনে প্রধান কারণ হচ্ছে বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি। এই চুক্তির কারণে গত সাত বছরে বিদেশি কোম্পানির থেকে ১৬ হাজার কোটি টাকার গ্যাস কিনেছে সরকার। অথচ জাতীয় সংস্থাগুলোর কাছ থেকে এটা দুই হাজার কোটি টাকাতেই কেনা সম্ভব ছিল। সুতরাং সাত বছরে ভর্তুকি বাবদ গেছে ১৪ হাজার কোটি টাকা। প্রতিবছর আড়াই হাজার কোটি টাকা করে, সামনে তা আরও বাড়বে। এই টাকা জোগাতে সরকারকে প্রতিবছর ঋণ করতে হচ্ছে। ঋণের সুদও বাড়ছে। তার জন্য আবার নতুন নতুন ট্যাক্স, ভ্যাটসহ করের আওতা প্রসারিত করে জনগণের ওপর চাপ বাড়ানো হচ্ছে।

বিদ্যুতের ক্ষেত্রেও গত কয়েক বছরে রেন্টাল ও কুইক রেন্টালের মাধ্যমে দুই টাকা ইউনিটের বিদ্যুৎ ১২-১৪ টাকায় কিনতে হচ্ছে। এ খাতেও নতুন চুক্তি হয় আর ভর্তুকির চাপ বাড়ে। গ্যাস ও বিদ্যুৎক্ষেত্রের এই ভর্তুকি জনগণের প্রয়োজনে নয়। তা আসলে বিদেশি কোম্পানি এবং তাদের দেশীয় কতিপয় সহযোগীর সুবিধার জন্য। অথচ বলা হয় উল্টোটা। এই ভর্তুকির ধারা ও চুক্তিগুলো যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে কয়েক মাস পরপর আমরা দেখব, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হচ্ছে। গ্যাস, বিদ্যুৎ ও তেলের দাম বাড়লে সমগ্র অর্থনীতিতে ভয়ানক চাপ সৃষ্টি হয়। ভর্তুকি মেটাতে ১০ টাকা দাম বাড়ার ফলাফল জনগণের ওপর প্রায় ৫০ টাকায় গিয়ে দাঁড়ায়।

তেলের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ প্রায় পুরোপুরি আমদানিনির্ভর। তেলের আন্তর্জাতিক দামে কোনো স্থিরতা নেই। আন্তর্জাতিক ফাটকা পুঁজি অত্যন্ত সক্রিয় হয়ে ওঠার কারণে দামও ক্রমাগত বাড়ছে। ফলে তেল আমদানি বাবদ ব্যয়টাও বাড়ছে। আন্তর্জাতিক দর বিবেচনা করে তেলের চাহিদার পর্যালোচনাও কোনো সরকার করেনি। তেলের চাহিদার অগ্রাধিকার নিয়ন্ত্রণও করা হয়নি। এদিকে তেলনির্ভর বিভিন্ন বিদ্যুৎ প্ল্যান্টের অনুমোদন দিয়ে সমস্যাকে আরও গভীর করা হচ্ছে। গাড়ি আমদানি কমাতেও সরকারের চাহিদা-ব্যবস্থাপনা নেই। যে পরিমাণ তেল আমদানি হয়, সেই পরিমাণ তেল আদৌ ব্যবহূত হয় কি না সন্দেহ। বাংলাদেশ প্রধানত অপরিশোধিত তেল আমদানি করে। তা শোধন করা হয় দেশের একমাত্র শোধনাগারে। তেল শোধনাগারের ক্ষমতার চেয়ে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বেশি তেল বাংলাদেশ আমদানি করে। এই তেল কোথায় যায়, সেই বিষয়টি একটা রহস্য। এর কোনো সন্তোষজনক জবাব আমরা কারও কাছ থেকে পাইনি।

আমদানির পরিমাণ ও চাহিদা নিয়ন্ত্রণ নিয়েও প্রশ্ন আছে। বিশেষত সরকারি খাতে তেলের ব্যবহার, বিভিন্ন বেসরকারি কোম্পানির স্বার্থে তেলের ব্যবহার এবং ভোগবিলাস কমানো নিয়ে সরকারের মাথাব্যথা নেই। জ্বালানি খাতের প্রতিটি উপাদান তথা তেল-গ্যাস-বিদ্যুৎ অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। ১৯৯৩ সাল থেকে জ্বালানি খাতে যেসব নীতি সরকার নিয়েছে এবং যেসব চুক্তি করেছে, তাতে জাতীয় স্বার্থ বিসর্জিত হয়েছে। এসবের ধারাবাহিকতাতেই নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে গ্যাস রপ্তানির আওয়াজ উঠেছিল। সে সময় রপ্তানি ঠেকাতে সক্ষম না হলে এখন আমাদের আরও বেশি তেল আমদানি করতে হতো। তার জন্য প্রতিবছর কমপক্ষে ২০ হাজার কোটি টাকা বাড়তি খরচ হতো। লোডশেডিং এবং শিল্প ও কৃষিতে বিদ্যুতের ঘাটতিও দ্বিগুণের বেশি হতো।

সুতরাং জ্বালানি খাতে তেলের ওপর নির্ভরতা কমানোর জন্য চাহিদা নিয়ন্ত্রণ দরকার, তেমনি গ্যাস-কয়লার ওপর জাতীয় সংস্থার মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠারও বিকল্প নেই। জাতীয় সংস্থাকে শতভাগ গ্যাস উত্তোলনের সুযোগ দেওয়া হলে গত সাত বছরে ১৪ হাজার কোটি টাকার ভর্তুকি গুনতে হতো না। এই পরিমাণ অর্থ শিক্ষা-চিকিৎসা-পরিবহন এবং জ্বালানি খাতে খরচ করা সম্ভব হতো। বাংলাদেশের জনগণ কম দামে গ্যাস এবং বিদ্যুৎও পেতে পারত। এই পরিমাণ অর্থ বাংলাদেশের বর্তমানে জ্বালানি খাতে বার্ষিক বরাদ্দের প্রায় তিন গুণ।

প্রথমত, ভর্তুকির যুক্তি দিয়ে ঘন ঘন তেল-গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়াটিও অর্থনীতির নিয়মবিধির পরিপন্থী। এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন নামের একটি প্রতিষ্ঠান থাকলেও তা কার্যকর ও দাম নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়নি। এই প্রতিষ্ঠান গ্যাস ও বিদ্যুতের ভর্তুকি নিয়ে যতটা আগ্রহী, ভর্তুকির গোড়ার কারণের প্রতি ততটাই অনাগ্রহী। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে জ্বালানির দাম বাড়ানোর মাধ্যমে বিজাতীয় স্বার্থকে বৈধতা দেওয়ার জন্যই এই কমিশন ব্যবহূত হচ্ছে। আবার কমিশনকে পাশ কাটিয়েও সরকার গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ায়। এ থেকে প্রমাণিত হয়, এই প্রতিষ্ঠানের কোনো কার্যকারিতা নেই।

দ্বিতীয়ত, বাজেট হচ্ছে একটা বছরে অর্থনীতির আয়-ব্যয়ের হিসাব। বাজেটের প্রক্রিয়ার বাইরে সরকার তেল-গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়াতে পারে না। কারণ, এই বৃদ্ধির প্রভাব বাজেটের সব বরাদ্দকে প্রভাবিত করে এবং জনগণের জীবনযাত্রার ব্যয়, উৎপাদন ব্যয় এবং পরিবহন ব্যয়ের ওপর ব্যাপক চাপ সৃষ্টি করে। কিন্তু প্রায়ই দেখা যায়, বাজেট ঘোষণার আগে ও পরে গ্যাস-বিদ্যুৎ-তেলের দাম বাড়ানো হয়, এবারও হয়েছে। তার মানে অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ার বড় অংশ বাজেট কাঠামোর বাইরে নির্ধারিত হচ্ছে। এর থেকে স্পষ্ট হচ্ছে, সরকারের নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে বাজেট বা সংসদের গুরুত্ব নেই।

সিএনজি-বিদ্যুৎ-তেলের দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে আরেকটি যুক্তি জনপ্রিয় করার চেষ্টা হয় যে এর সুবিধাভোগী বিত্তবানেরা। যাঁদের ক্ষমতা আছে তাঁরা বর্ধিত দামে ওসব কিনবেন। কিন্তু অভিজ্ঞতা থেকে আমরা স্পষ্টতই দেখি, বিদেশি কোম্পানি, তাদের দেশীয় সহযোগীসহ কতিপয় বড়লোকের স্বার্থেই এই দাম বাড়ানো হয়। সিএনজির দাম যখন বাড়ে, তখন একে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে পরিবহনমালিকেরা তেল ও গ্যাসের দামের চেয়ে অনেক বেশি হারে ভাড়া বাড়ান। একই অজুহাতে কতিপয় ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এবং আমদানিকারক সিন্ডিকেট দ্রব্যমূল্যও বাড়ায়। অন্যদিকে প্রকৃত শিল্পোদ্যোক্তা ও কৃষকেরা উৎপাদন ব্যয় বাড়ার চাপে পড়েন। পরিণতিতে নতুন অনেক মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে পতিত হয়। জীবনযাত্রার মান রাখতে গিয়ে অধিকতর ব্যয় করতে হয়। ফলে শিক্ষা ও চিকিৎসা খাতে ব্যয় সংকোচন করতে হয়। এই প্রক্রিয়া সরকারি ক্ষমতা প্রয়োগ করে ক্রমাগত জনগণের পকেট কাটার শামিল।

জ্বালানি খাতে দেশি-বিদেশি দুর্নীতি এবং এর সহযোগী হিসেবে বিভিন্ন নীতি ও চুক্তি অবিরামভাবে তেল-গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ার প্রধান কারণ। জ্বালানি খাতে ভর্তুকি দূর করার সহজ উপায় হচ্ছে ভর্তুকির কারণ দূর করা। ভর্তুকির কারণ সৃষ্টি হচ্ছে বহুজাতিক কোম্পানি এবং দেশীয় কমিশনভোগীদের স্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্যে গৃহীত নীতি ও চুক্তির কারণে। এই নীতি ও চুক্তির ধারা অব্যাহত থাকলে একদিকে অপ্রয়োজনীয় ভর্তুকির চাপ বাড়বে, অন্যদিকে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়তেই থাকবে।

সুত্র: বিদেশি কোম্পানির স্বার্থেই দাম বাড়ছে by আনু মুহাম্মদ

০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বরিষ ধরা-মাঝে শান্তির বারি

লিখেছেন বিষাদ সময়, ০৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:১৬





মাসের আধিক কাল ধরে দাবদাহে মানব প্রাণ ওষ্ঠাগত। সেই যে অগ্নি স্নানে ধরা শুচি হওয়া শুরু হলো, তো হলোই। ধরা ম্লান হয়ে, শুষ্ক হয়, মুমূর্ষ হয়ে গেল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=নীল আকাশের প্রান্ত ছুঁয়ে-৭ (আকাশ ভালোবেসে)=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:১৯

০১।



=আকাশের মন খারাপ আজ, অথচ ফুলেরা হাসে=
আকাশের মন খারাপ, মেঘ কাজল চোখ তার,
কেঁদে দিলেই লেপ্টে যাবে চোখের কাজল,
আকাশের বুকে বিষাদের ছাউনি,
ধ্বস নামলেই ডুবে যাবে মাটি!
================================================
অনেক দিন পর আকাশের ছবি নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

পানি জলে ধর্ম দ্বন্দ

লিখেছেন প্রামানিক, ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৫২


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

জল পানিতে দ্বন্দ লেগে
ভাগ হলোরে বঙ্গ দেশ
এপার ওপার দুই পারেতে
বাঙালিদের জীবন শেষ।

পানি বললে জাত থাকে না
ঈমান থাকে না জলে
এইটা নিয়েই দুই বাংলাতে
রেষারেষি চলে।

জল বললে কয় নাউযুবিল্লাহ
পানি বললে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সমস্যা মিয়ার সমস্যা

লিখেছেন রিয়াদ( শেষ রাতের আঁধার ), ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৭

সমস্যা মিয়ার সিঙ্গারা সমুচার দোকানে প্রতিদিন আমরা এসে জমায়েত হই, যখন বিকালের বিষণ্ন রোদ গড়িয়ে গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে, সন্ধ্যা পেরিয়ে আকাশের রঙিন আলোর আভা মিলিয়ে যেতে শুরু করে। সন্ধ্যা সাড়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

এই মুহূর্তে তারেক জিয়ার দরকার নিজেকে আরও উন্মুক্ত করে দেওয়া।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৬ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:২৬


তারেক জিয়া ও বিএনপির নেতৃত্ব নিয়ে আমি ব্লগে অনেকবারই পোস্ট দিয়েছি এবং বিএনপি'র নেতৃত্ব সংকটের কথা খুব স্পষ্টভাবে দেখিয়েছি ও বলেছি। এটার জন্য বিএনপিকে সমর্থন করে কিংবা বিএনপি'র প্রতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×