somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

তাহমিদ রহমান
একজন অলস মানুষ; ভালোবাসি স্বপ্ন দেখতে, চিন্তা করতে, আর কবিতা লিখতে।পেশায় চিকিৎসক, তবে স্বপ্ন দেখি সাহিত্যের সাথে নিবিড় সখ্য গড়বার।ছাত্রজীবনে জড়িত ছিলাম স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনে, ভবিষ্যতে কাজ করতে চাই কন্যাশিশু নিরাপত্তা ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ নিয়ে।

অনিকের গল্প (পর্ব ১)

২০ শে নভেম্বর, ২০২৫ রাত ১০:৫০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :




অধ্যায় ১ঃ হাসপাতালের নাইট শিফট (১ম খন্ড)


লন্ডনের নভেম্বর। রাত আড়াইটা। St. Margaret's Hospital-এর করিডোরে ফ্লুরোসেন্ট লাইটের সাদা আলো পড়ছে মেঝের নীলচে টাইলসে। মিটমিট করে কাঁপছে সে আলো, মেঝেতে আলোর কম্পিত প্রতিচ্ছবি দেখে মনে হয় যেন কোনো মৃতপ্রায় নদীর ক্ষীণ স্রোতের ধারা বয়ে চলেছে। বাইরে ঝিরঝিরে বৃষ্টি পড়ছে, জানালার কাচে জমে আছে কুয়াশা। ডা. অনিক আহমেদ হাঁটছিল দ্রুত পায়ে — স্টেথোস্কোপ ঝুলছে ঘাড়ে, পকেটে রক্তপরীক্ষার রিপোর্ট, চোখেমুখে ক্লান্তির ছাপ।

ত্রিশ বছর বয়সী এই তরুণটির চেহারায় এক ধরনের উদাসীনতা। ফর্সা, দীর্ঘকায়, সুদর্শন — তবে নিজেকে ফুটিয়ে তোলার কোনো চেষ্টা নেই। কালো চুল এলোমেলো, যেন সকালে তাড়াহুড়ো করে বেরিয়েছে। চোখ গভীর, কিন্তু ক্লান্ত। ঠোঁটে হাসি নেই। গাঢ় নীল রঙের scrubs পরনে, ভেতরে কালো গলাবন্ধ টি-শার্ট। সাদামাটা। কিন্তু তার হাঁটার ভঙ্গিতে, তার নীরব উপস্থিতিতে এক ধরনের আকর্ষণ আছে — যা সে নিজেও জানে না।

ওয়ার্ড ৭-বি। বেড নম্বর ১৪। একজন বয়স্ক মহিলা শ্বাসকষ্টে ভুগছেন। অনিক তার পাশে দাঁড়িয়ে স্টেথোস্কোপ বুকে রাখল।
শ্বাসের শব্দ — ঘড়ঘড়, অনিয়মিত। ফুসফুসে পানি জমেছে। মহিলাটি চোখ খুলে তাকালেন। বয়স হবে আশির কাছাকাছি। চোখে এক ধরনের ক্লান্তি, যেন জীবন এখন শুধু একটা রুটিনের অংশ।

"কেমন লাগছে, মিসেস প্যাটারসন?" অনিক জিজ্ঞেস করল, গলায় যতটা সম্ভব উষ্ণতা আনার চেষ্টা করে।

মহিলা একটু হাসলেন। হাসিটা দুর্বল, কিন্তু আন্তরিক। "Doctor, never get old. I tell you, young man, it's not fun at all."

অনিক হাসল। হাসিটা তার ঠোঁটের কোণে দৃশ্যমান হলো, কিন্তু চোখের তারায় পৌঁছাল না। সে জানে এই কথার ভার। বার্ধক্য। একাকিত্ব। শরীরের ক্রমশ ভেঙে পড়া... কিন্তু সে কী বলবে? সান্ত্বনার কোনো শব্দ তার কাছে নেই। তাই শুধু হাসল, আর নার্সকে ইশারা করল অক্সিজেনের মাত্রা বাড়াতে।

"আমরা আপনার দিকে নজর রাখছি, মিসেস প্যাটারসন। একটু বিশ্রাম নিন," সে বলল, মৃদু স্বরে।

মহিলা মাথা নাড়লেন। চোখ বন্ধ করলেন।

অনিক চার্টে নোট লিখল। করিডোরে ফিরে এল। দেয়ালে ঘড়ি — রাত তিনটা। আরও চার ঘণ্টা। তারপর বাসায় ফেরা। Stratford-এর সেই এক বেডরুমের ফ্ল্যাট। শূন্য। নীরব।

করিডোর ধরে এগিয়ে গেল সে। দীর্ঘ, দুপাশে দরজা। কোথাও আলো জ্বলছে, কোথাও অন্ধকার। মেঝেতে তার জুতোর শব্দ — টক্ টক্ টক্। একটানা। যান্ত্রিক।

করিডোরের শেষ প্রান্তে একটা ছোট্ট স্টাফ রুম। এককোণে টেবিলের উপর রাখা একটি কফি মেশিন। প্লাস্টিকের কাপে কালো কফি ঢাললো অনিক। এক চুমুক নিল — তেতো, কিন্তু জাগিয়ে রাখে।

"দীর্ঘ রাত, তাই না?"

পেছন থেকে পরিচিত কণ্ঠস্বর ভেসে এলো। অনিক ঘুরে তাকাল। সিনিয়র নার্স মার্গারেট। পঞ্চাশের কাছাকাছি বয়স, চুলে পাক ধরেছে, কিন্তু চোখে এখনও তীক্ষ্ণতা। এই হাসপাতালে তিরিশ বছর ধরে কাজ করছেন তিনি। অনিক তাকে পছন্দ করে। মার্গারেট কথা কম বলেন, কিন্তু যখন বলেন, তখন তাঁর স্বরে একই সাথে ব্যক্তিত্ব ও মমত্ব ফুটে ওঠে।

"হ্যাঁ," অনিক বলল। "মনে হচ্ছে এই শিফট আর শেষ হবে না।"

মার্গারেট হাসলেন। "হবে। দিনশেষে সবকিছুই শেষ হয়। এই শিফট শেষ হবে, তারপর তুমি বাড়ি যাবে, কয়েক ঘণ্টা ঘুমাবে, আবার ফিরে আসবে। এটাই জীবন, মাই ডিয়ার।"

অনিক মাথা নাড়ল। সে জানে, এটাই জীবন — এই হাসপাতাল, এই রোগীরা, এই রাতের শিফট। দুই বছর হলো এই চাকরিতে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস, তারপর PLAB পরীক্ষা, তারপর এই চাকরি — হাউস অফিসার, মেডিসিন বিভাগ।

মার্গারেট কফি ঢাললেন। "তুমি তো বাংলাদেশ থেকে এসেছো, তাই না?"
"হ্যাঁ।"
"দেশের কথা মনে পড়ে?"
অনিক একটু থামল। মনে পড়ে? পড়ে। নাকি পড়ে না। দুটোই সত্যি। "মাঝেমধ্যে," সে বলল।
"ব্যাপারটা আসলে কঠিন, তাই না?... দূরে থাকা।" মার্গারেট বললেন, গলায় এক ধরনের সহানুভূতি। "কিন্তু তুমি ভালো কাজ করছ। কনসালট্যান্টরা তোমার প্রশংসা করেন।"
অনিক হাসল। "ধন্যবাদ।"

কিন্তু ভেতরে একটা শূন্যতা। সে জানে, কনসালট্যান্টরা তার কাজের প্রশংসা করেন। কিন্তু তাতে কী? রাতের শেষে, যখন সে Stratford-এর সেই ফ্ল্যাটে ফিরে যায়, তখন কে আছে সেখানে তার জন্য? কেউ না।

মার্গারেট চলে গেলেন। অনিক আবার নিজের মধ্যে ফিরে এল। কফি শেষ করে কাপটা ডাস্টবিনে ফেলল, করিডোরে ফিরল।
বেড নম্বর ২২। একজন মধ্যবয়সী আফগান পুরুষ, মিস্টার খলিল। হার্ট অ্যাটাক। এখন সে স্থিতিশীল, কিন্তু পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। অনিক চার্ট দেখল। সব ঠিক আছে। পালস চেক করল — স্বাভাবিক। রক্তচাপও স্থিতিশীল। ভালো। ECG মনিটরে চোখ রাখল। কোনো অস্বাভাবিকতা নেই।
মিস্টার খলিল ঘুমাচ্ছিলেন। অনিক চুপচাপ চলে এল।

বেড নম্বর ৩৫। একজন তরুণী, বয়স হবে পঁচিশ-ছাব্বিশ। নিউমোনিয়া। অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়েছে। সে ঘুমাচ্ছিল। মনিটরে অক্সিজেন লেভেল দেখল অনিক - ৯৫%, ভালো আছে। চুপচাপ চলে এল।

রাত চারটা। হাসপাতাল এখন সবচেয়ে নীরব। রোগীরা ঘুমাচ্ছে। নার্সরা চুপচাপ কাজ করছে। শুধু মাঝেমধ্যে মনিটরের বিপ বিপ শব্দ অথবা কারও পায়ের শব্দ। করিডোরের আলো ম্লান। রাতের এই সময়টা অনিকের সবচেয়ে কঠিন মনে হয় — যখন কাজ কম, যখন চারপাশ নীরব, তখন মন ভারী হয়ে ওঠে।

জানালায় গিয়ে দাঁড়াল। বাইরে লন্ডনের রাত — স্ট্রিট ল্যাম্পের কমলা আলো ভিজে রাস্তায় প্রতিফলিত হচ্ছে। গাড়ি নেই, মানুষ নেই — শুধু বৃষ্টি। ঝিরঝিরে, একটানা। জানালার কাচে বৃষ্টির ফোঁটা গড়িয়ে পড়ছে।

ঢাকায় এখন কয়টা বাজে? সকাল দশটা হবে। মা হয়তো বাজার করতে গেছেন। বাবা হয়তো কলেজে ক্লাস নিচ্ছেন। তারা জানেন না, এই মুহূর্তে তাদের ছেলে লন্ডনের এক হাসপাতালে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখছে।

মোবাইলের স্ক্রিন অন করল। কোনো মেসেজ নেই। WhatsApp খুলল। মায়ের শেষ মেসেজ এক দিন আগের।
"ভালো আছো, বাবা? খাওয়া-দাওয়া ঠিকমতো করছ তো? শীত বেশি?"

অনিক উত্তর দেয়নি। কী লিখবে? সত্যিটা? — সে ভালো নেই, একা। রাতের পর রাত কাজ করে তারপর খালি ফ্ল্যাটে ফিরে যেতে তার ভালো লাগে না। সে মোটামুটি ভালোই আয় করছে, কিন্তু লন্ডন এতটাই ব্যয়বহুল যে সঞ্চয় সামান্যই। সে কি লিখবে যে মাঝেমধ্যে ভাবে, এই কষ্টের কী কোনো মূল্য আছে?

......... (চলবে)


সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে নভেম্বর, ২০২৫ রাত ১০:০০
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হাদির হত্যাচেষ্টা: কার রাজনৈতিক ফায়দা সবচেয়ে বেশি?

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:১৮


হাদির হত্যাচেষ্টা আমাদের সাম্প্রতিক রাজনীতিতে একটি অশনি সংকেত। জুলাই ২০২৪ আন্দোলন-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের দ্বিধাবিভক্ত সমাজে যখন নানামুখী চক্রান্ত এবং রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অন্তর্কলহে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও আয়-উন্নতির গুরুত্বপূর্ন প্রশ্নগুলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

Testimony of Sixty- By Edward Kennedy বাংলাদেশের রক্তাক্ত সত্যের এক আন্তর্জাতিক স্বীকারোক্তি

লিখেছেন কিরকুট, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:৫৩




১৯৭১ বাংলাদেশের ইতিহাসে এক গভীর বৈপরীত্যের বছর। এটি যেমন ছিল অন্ধকার ও রক্তাক্ত, তেমনি ছিল সত্যের প্রতি অবিচল এক সময়কাল। এই বছরের গণহত্যা, শরণার্থী স্রোত ও মানবিক বিপর্যয়ের বিবরণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি আর এমন কে

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:১৩


যখন আমি থাকব না কী হবে আর?
থামবে মুহূর্তকাল কিছু দুনিয়ার?
আলো-বাতাস থাকবে এখন যেমন
তুষ্ট করছে গৌরবে সকলের মন।
নদী বয়ে যাবে চিরদিনের মতন,
জোয়ার-ভাটা চলবে সময় যখন।
দিনে সূর্য, আর রাতের আকাশে চাঁদ-
জোছনা ভোলাবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

২০২৪ সালের জুলাই মাস থেকে যেই হত্যাকান্ড শুরু হয়েছে, ইহা কয়েক বছর চলবে।

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:৪৭



সামুর সামনের পাতায় এখন মহামতি ব্লগার শ্রাবনধারার ১ খানা পোষ্ট ঝুলছে; উহাতে তিনি "জুলাই বেপ্লবের" ১ জল্লাদ বেপ্লবীকে কে বা কাহারা গুলি করতে পারে, সেটার উপর উনার অনুসন্ধানী... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজাকার হিসাবেই গর্ববোধ করবেন মুক্তিযোদ্ধা আখতারুজ্জামান !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১১:১৮


একজন রাজাকার চিরকাল রাজাকার কিন্তু একবার মুক্তিযোদ্ধা আজীবন মুক্তিযোদ্ধা নয় - হুমায়ুন আজাদের ভবিষ্যৎ বাণী সত্যি হতে চলেছে। বিএনপি থেকে ৫ বার বহিস্কৃত নেতা মেজর আখতারুজ্জামান। আপাদমস্তক টাউট বাটপার একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×