somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ঝরা ফুলের গল্প

১৩ ই অক্টোবর, ২০১২ রাত ১২:৩৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ঝরা ফুলের গল্প
তাইফুর সরোয়ার

খালাম্মা, ও খালাম্মা, খালাম্মা, খুব কাতর স্বরে দরজায় কড়া নাড়ে মুকু।
কে? কে? ওখানে? ও পার থেকে ধমকের সুর ভেসে আসল।
আমি মুকু।
এই সাঝ সকালে কি চাই?
দরজাডা একটু খোলেন, খালাম্মা।
অনেকক্ষণ পর মাঝ বয়সী এক মহিলা দরজা খুললেন । মহিলার চোখে ঘুম ঘুম ভাব। হাই তুলতে তুলতে বললেন, বল, আবার কী খবর নিয়ে এসেছিস। মায়ের শইলডা কয় দিন ধইরা খুব খারাপ।
এটা আবার নতুন কি
খুব জ্বর। আর খালি কাশে। কাশতে কাশতে গলা দিয়া রক্ত বের হয়। কয়ডা যদি টাকা দিতেন তাইলে মায়ের ডাক্তার দেহাইতাম
টাকা! মহিলার মাথায় যেন বাজ পড়ল। পেঁচার মত করে মুখটাকে বাঁকিয়ে বলল। এই, তোর মা কি আমার কাছে টাকা জমা রেখে গেছে নাকি যে চাইতে এসেছিস। তোর মা যত দিন না কাজ করেছে তার চেয়ে বেশি বন্ধ দিয়েছে।
দেন না খালাম্মা দেন না, মায় কাম কইরা পরে শোধ কইরা দিব।
না-বাপু, তোর মায়ের মত একটা অসুখের ফ্যাক্টরির আমার কোন দরকার নাই। আজ মাথা ব্যাথা তো কাল জ্বর। পরশু পেট ব্যথা তো তার পর দিন বুক ব্যথা। অসুখ যেন তাকে চুম্বুকের মতো আটকে ধরে রাখে। যা ভাগ এখান থেকে। মহিলা আবার দরজা আটকে দিলেন। হঠাৎ দরজা আটকানোর শব্দটা যেন ধক করে মুকুর মনে আঘাত হানে। দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে ও গুটি গুটি পায়ে চলে বাড়ির পথে।
মুকুর বাবা নেই। ঘরে অসুস্থ মা। ওরা থাকে মেডিক্যাল কলেজের হলের পাশের একটা পরিত্যক্ত জায়গায়। চারপাশে আবর্জনার স্তুপ। এই আবর্জনার পাশেই পলিথিনের চালা দিয়ে ছোট ঘর তৈরি করে সেখানে চলে ওদের মা মেয়ের সংসার। মুকুর মা রাহিমা বানু সকাল সন্ধ্যা অন্যের বাড়িতে ঝি এর কাজ করে। জীবনের প্রয়োজনে, জীবিকার তাগিদে বেঁচে থাকার নির্মম প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে অসুস্থ্য শরীর নিয়েই তাকে কাজে নামতে হয়। অসুস্থ্য থাকায় তার কাজের স্বীকৃতি ও মিলে কম। শুধু দু বেলা দু মুঠো ওরা মা মেয়ে পেট পুরে খাওয়া আর সামান্য কিছু হাত খরচের টাকার বিনিময়ে তিনি অন্যের বাড়িতে গতর খাটেন।
সংসারের দীনতা ঘুচাতে মুকু ও কিন্তু কম কষ্ট করে না। হাড় কাপা শীতে মায়ের উষ্ণতার আঁচল ছেরে কুয়াশার পর্দা ভেদ করে শিশির মাড়িয়ে চলে আসে মেডিক্যালের পিছনের বকুল তলায়। তলায় ঝরে পরা বকুল ফুল কুড়ানোই ওর লক্ষ্য। খুব ভোরে না আসলে বেশি একটা ফুল কুড়ানো যায় না। কিন্তু মুকু তেমন ভোরে আসতে পারে না। ঘুম থেকে ওঠে আধ ঘুম চোখে গুটি গুটি পায়ে বকুল তলায় আসতেই অনেক সময় গড়িয়ে যায়। এর আগেই অন্যরা সব ফুল কুড়িয়ে নিয়ে যায়। হতাশ মুকু এদিকে সেদিকে সামান্য কিছু ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ফুল কুড়িয়ে তা দিয়ে কয়েকটা মালা বানিয়ে শাহবাগের মোড়ে বিক্রি করে। চলন্ত গাড়িগুলো সিগনালের কারনে যখন থেমে যায় মুকু তখন এগিয়ে যায়। গাড়ির যাত্রীদের ফুল কিনার জন্য ও আকুল অনুরোধ করে। অনেকে কিনে, অনেকে নেড়ে চেড়ে গন্ধ শুকে রেখে দেয়। আবার অনেকে পয়সা না দিয়েই চলে যায়। অসহায় মুকু তখন অনুনয় বিনয় করে ও পয়সা না পেয়ে ব্যর্থ হয়ে ঘৃনাভরে নিরব হয়ে তাকিয়ে থাকে। ওর মনের গভীরে সেই শোষকদের প্রতি যে ঘৃনার সঞ্চার হয় তা আকাশ বাতাস ছাড়িয়ে এক সময় শূণ্যে একাকার হয়ে যায়।
কিরে মুুকু, ম্যাডামে কি টাকা পয়সা কিছু দিল? বিছানায় শুয়ে কাতরাতে কাতরাতে বলল মুকুর মা রাহিমা বানূ।
মুকু ওর মায়ের বিছানার পাশে এসে বসল। মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল, না মা। খালাম্মারে অনেক বুঝাইয়া কইলাম তবুও দিল না।
ুকী কছ! আতকে উঠল রাহিমা বানু। ঘরে তো এক কানা কড়িও চাইল নাই। তাছাড়া শইলের যে অবস্থা তাতে কইরা ওষুদ না খাইলে তো বিছানা থেকেই উঠতে পারুম না। বিছানায় পইরা থাকলে কি কেউ কামে লইব? আর কাম না পাইলে খামু কি? রহিমা বানু ঢুকরে কেঁদে উঠলেন। মুকু ওর মাকে শান্তনা দেয়। মাথায় হাত বুলাতে বলল , মা তুমি এত চিন্তা কর ক্যা। আজকের দিনডা একভাবে না একভাবে যাইবই। কাইলকা খুব ভোরে আজানের ও আগে আমারে তুমি জাগায়া দিও। আমি সবার আগে বকুল তলায় গিয়া সব ফুল কুড়ায়া মালা বানায়া বিক্রি কইরা আমাগো লাইগা খাওন কিনুম, তোমারে ডাক্তার দেহাম্।
মুকুর স্বান্তনাতে রাহিমা বানু ও শ্বান্তনা খুঁজে পায়। ওর সাথে একমত হয়ে বললেন, আচ্ছা, ঠিক আছে তাই করুম। কাইলকা খুব ভোরে তোরে জাগাইয়া দিম।
বিকালের দিকে মুকুর মায়ের প্রচুর জ্বর আসে । জ্বরে তিনি কাঁপছেন। তার সাথে বাঁশের তৈরি চৌকিটাও কাঁপছে। মুকু বুঝতে পারে ওর মাকে ডাক্তার দেখান দরকার। কিন্তু ডাক্তার দেখানোর জন্য, ঔষধ পথ্য কিনার জন্য তো টাকা দরকার। ও টাকা পাবে কোথায়? অসহায় মুকু ওর মায়ের যন্ত্রনায় ছটফটানির দিকে নিরব তাকিয়ে থাকে। ওর মনের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সঞ্চার হয়। এই ক্ষোভ রক্ষণশীল সমাজের প্রতি, সমাজের উচু তলার মানুষের প্রতি।
এখন ও বাইরে ঘুট ঘুটে অন্ধকার। কুয়াশার কারনে ল্যাম্পপোস্টের লাইটের আলো ও ভাল করে দেখা যাচ্ছে না। দূরের মসজিদ থেকে আজানের সুমধুর ধ্বনী ভেসে আসছে মুকুর কানে। ওর চোখে মুখে কী এক ব্যস্ততা। ব্যস্ত পায়ে ও এগিয়ে চলছে বকুল গাছ তলায়। ওর মায়ের ভীষন অসুখ। তাকে চিকিৎসা করাতে হবে। বকুল ফুল দিয়ে মালা তৈরি করে তা বিক্রি করে ওর মায়ের চিকিৎসার ফী, ঔষধ পথ্যের টাকা, ওদের খাবারের
টাকা যোগার করতে হবে। মুকুর মনের মধ্যে একটা অজানা আকাঙ্কা নাড়া দিয়ে যায়। সায়লা, সোনিয়া, ফুলি, ইলিয়াস হাবিবরা যেন ওর আগে পৌঁছে ফুল গুলো কুড়িয়ে নিয়ে না যায়। মুকুর বুকের ভেতরটা স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশি ধুকধুক করতে লাগল যা বকুল তলায় পৌছার আগ পর্যন্ত কমল না। না! সায়লা সোনিয়া হাবিবরা এসে এখনো পৌছায় নি। সাদা তুষারের মত অজস্র বকুল ফুল পরে আছে গাছ তলায়। মুকুর মনটা আনন্দে নেচে উঠলো। মুকু স্বপ্ন দেখতে লাগল-বকুল ফুল দিয়ে ও মালা তৈরি করছে। সেই মালা রাস্তার মোড়ে বিক্রি হচ্ছে। মালা বিক্রির টাকা দিয়ে মুকু এবং ওর মা পেট ভরে খাচ্ছে। ওর মায়ের চিকিৎসা হচ্ছে এবং তিনি সুস্থ হয়ে আবার কাজে যাচ্ছেন।
মুকু আপন মনে মালা গাঁথছে। কালো সুতোর সাথে লাগা সুইয়ের ভিতর সাদা বকুল ফুল গেঁথে ও যেন ওর স্বপ্নের জাল বুনছে। মুকু সবগুলো ফুল দিয়ে ছোট বড় বিশটা মালা তৈরি করে তা বিক্রির জন্য রাস্তার মোড়ে দাড়িয়ে আছে। ব্যস্ত গাড়িগুলো খুব দ্রুত চলে যাচ্ছে। হঠাৎ লাল বাতি জ্বলে উঠল। মুকু রাস্তায় দাড়িয়ে থাকা গাড়ির ভিড়ে মিশে গেল। এবার ও মালা বিক্রি ুুুুকরতে ব্যস্ত। গাড়ির জানালা দিয়ে ও ভিতরের যাত্রীদের ফুল কিনার জন্য বিনীত অনুরোধ করতে লাগল। কিন্ত কেউ কিনল না। নেড়ে চেড়ে গন্ধ শুকে রেখে দিল। হঠাৎ একটি লাল গাড়ি দেখে মুুকু সেদিকে এগিয়ে গেল। গাড়ির ভিতরে বসা ভদ্রলোকের দিকে মুকু সবগুলো ফুল এগিয়ে দিল। লোকটি বাঁকা হেসে সবগুলো ফুল নিয়ে গন্ধ শুকে গাড়ির ভিতরে রেখে দিল। মুকুর মনটা আনন্দে ভরে উঠল। এবার মুকু লোকটার কাছে মালার দাম চাইল। কিন্তু লোকটি ওর কথার কোন জবাব দিলেন না। মুকু আবার ও লোকটার কাছে টাকা চাইল। কিন্তু লোকটি এবার ও নিরব। ভাবখানা এমন যেন তিনি মুকুর কথা শুনতেই পাচ্ছেন না। মুকুর হাস্যোজ্ঝল মুখে বেদনার ছায়া নামল। ওর কাজল কালো চোখে অশ্রু ছলছলিয়ে উঠল। হঠাৎ সবুজ বাতি জ্বলে উঠল। লাল গাড়িটা সামনের দিকে দ্রুত এগিয়ে গেল। মুকুর বুকের ভিতরটা হুহু করে কেদে উঠল। ওর স্বপ্নগুলো ভেঙ্গে গেল। ওর এবং ওর মায়ের দীর্ঘ উপবাস, চিকিৎসার অভাবে ওর মায়ের অকাল মৃত্যু ওর কল্পনার চোখে ভেসে উঠল। অসহায় মুকু লাল গাড়িটির চলার পথে নিরব তাকিয়ে থাকে। ওর এই তাকিয়ে থাকা ঘৃনার সঞ্চার করে সভ্য পোষাক পরে থাকা সমাজের অসভ্য বর্বর মানুষের প্রতি করা অন্যকে পায়ের তলায় রেখে নিজেরা উপরে উঠতে চায়।





পাতা-০৯
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই অক্টোবর, ২০১২ রাত ১২:৩৮
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কর কাজ নাহি লাজ

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ১৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪


রাফসান দা ছোট ভাই
ছোট সে আর নাই
গাড়ি বাড়ি কিনে সে হয়ে গেছে ধন্য
অনন্য, সে এখন অনন্য।

হিংসেয় পুড়ে কার?
পুড়েপুড়ে ছারখার
কেন পুড়ে গা জুড়ে
পুড়ে কী জন্য?

নেমে পড় সাধনায়
মিছে মর... ...বাকিটুকু পড়ুন

তাঁর বোতলে আটকে আছে বিরোধী দল

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:০৭



সেই ২০০৯ সালে তিনি যে ক্ষমতার মসনদে বসলেন তারপর থেকে কেউ তাঁকে মসনদ থেকে ঠেলে ফেলতে পারেনি। যারা তাঁকে ঠেলে ফেলবে তাদের বড়টাকে তিনি বোতল বন্দ্বি করেছেন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

নতুন গঙ্গা পানি চুক্তি- কখন হবে, গ্যারান্টি ক্লজহীন চুক্তি নবায়ন হবে কিংবা তিস্তার মোট ঝুলে যাবে?

লিখেছেন এক নিরুদ্দেশ পথিক, ১৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:২৬


১৬ মে ঐতিহাসিক ফারাক্কা দিবস। ফারাক্কা বাঁধ শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে খরা ও মরুকরণ তীব্র করে, বর্ষায় হঠাৎ বন্যা তৈরি করে কৃষক ও পরিবেশের মরণফাঁদ হয়ে উঠেছে। পানি বঞ্চনা এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

কেউ কি আমার বন্ধু শাহেদের ঠিকানা জানেন?

লিখেছেন জিএম হারুন -অর -রশিদ, ১৬ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:৩৪



কেউ কি আমার বন্ধু শাহেদের ঠিকানা জানেন?
আমার খুবই জরুরি তার ঠিকানাটা জানা,
আমি অনেক চেষ্টা করেও ওর ঠিকানা জোগাড় করতে পারছিনা।

আমি অনেক দিন যাবত ওকে খুঁজে বেড়াচ্ছি,
এই ধরুণ, বিশ-একুশ বছর।
আশ্চর্য্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

আজকের ব্লগার ভাবনা:কথায় কথায় বয়কট এর ডাক দেয়া পিনাকীদের আইডি/পেইজ/চ্যানেল বাংলাদেশে হাইড করা উচিত কি? ব্লগাররা কি ভাবছেন?

লিখেছেন লেখার খাতা, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ১২:১৩



অপূর্ব একজন চমৎকার অভিনেতা। ছোট পর্দার এই জনপ্রিয় মুখকে চেনেনা এমন কেউ নেই। সাধারণত অভিনেতা অভিনেত্রীদের রুজিরোজগার এর একটি মাধ্যম হইল বিজ্ঞাপনে মডেল হওয়া। বাংলাদেশের কোন তারকা যদি বিদেশী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×