somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নায়কের পরাজয়

১৪ ই এপ্রিল, ২০১৩ রাত ১:২৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


নায়কের পরাজয়
শীতের মধ্য রাত। কুয়াশার চাঁদর মুড়ি দিয়ে সারা গ্রাম গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। মাঝে মাঝে এক ঝাঁক বাদুর ডানা ঝাপটে উড়ে যায় দূর আকাশে। জোনাকিদের দল এক গাছ থেকে আরেক গাছে গিয়ে আপন মনে আলো বিলিয়ে অন্ধকার গ্রামকে আলোকিত করার ব্যর্থ চেষ্টা করে। দু’একটা শিয়াল থেকে থেকে ডেকে উঠে। ঘুমন্ত গ্রামের প্রাণ বলতে ঐ একটি “মনিপুর রেল স্টেশন”। মধ্যরাত কী আর ভর দুপুরই কী ট্রেন আসা ও যাওয়ার সময় লোকজনের কোলাহলে স্টেশন যেন রূপ নেয় মাছ বাজারে।
রাত একটা বেজে ত্রিশ মিনিট। রাত বারোটার ট্রেন এখনও আসেনি। তাই স্টেশনে অপেক্ষমাণ যাত্রীদের মধ্যে এক চাপা উত্তোজনা বিরাজ করছে। হাড়কাঁপা শীতে সবাই গরম জামা কাপড় পরে আছে। স্টেশনের দোকানগুলোতে ক্রেতাদের উপচে পরা ভিড়। পান, সিগারেট এবং চায়ের ক্রেতাই বেশি। স্টেশনের প্লাটফর্মে আধাশোয়া হয়ে কয়েকজন যাত্রী বসে আছে। অনেকে আবার দেয়ালে পিঠ হেলান দিয়ে ঘুমাচ্ছে। আমি আমার ব্যাগটা কোলের ভিতরে রেখে প্লাটফর্মের বেঞ্চিতে বসে আছি। এ সময় একজন মাঝবয়সী লোক আমার কাছে আসল। তার হাতে চা ভর্তি কাপ। সে আমাকে জিজ্ঞাসা করল, “ভাই সাহেবের নাম কী?” আমি অনেকটা অস্বস্তি বোধ করলাম। ইতঃস্তত আমার নাম বললাম, “সমির, সমির চৌধুরী”।
কী করেন?
জি, আমি একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করি।
তারপর লোকটি তার হাতে রাখা চায়ের অর্ধেকটা পিরিচে রেখে কাপসহ বাকি অর্ধেকটা আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। আমি প্রথমে নিতে চাইনি। ঈষৎ হেসে না করে দিলাম। কিন্তু লোকটা নাছোড়বান্দা। আমাকে বলল, “ভাই সাহেব মনে হয় আমাকে চিনতে পারেনি”। অবশ্য পরিচয় না দিলে চিনবেই বা কি ভাবে। আমি ইন্সপেক্টর মোবারক হোসেন। ছুটিতে বাড়ী যাচ্ছি। স্টেশনে ট্রেনের অপেক্ষায় বসে থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে গিয়েছি। তাই আপনার সাথে একটু গল্প করতে এলাম। এরপর লোকটি তার পকেট থেকে তার পরিচয়পত্র বের করে আমাকে দেখাল। আমি তা এক ঝলক দেখে তাকে সেটি ফিরিয়ে দিলাম। ইন্সপেক্টর সাহেব হয়ত ভেবেছিল আমি তার পরিচয় জানতে পেরে খুব খুশি হব। এমন এক বিশিষ্ট ব্যক্তিকে নিজের খুব নিকটে পেয়ে নিজেকে ধন্য মনে করব। কিন্তু আমার নিরুৎসাহিতায় এখন হয়ত বুঝতে পেরেছন যে তার ধারণা অনেকটাই ভুল। লোকটির বারংবার অনুরোধে আমি চা নিলাম। লোকটা আবার বলতে শুরু করল, “ভাই ট্রেন আজকে আর আসবে না, আসবে কাল সকালে”। আমি অবাক হলাম। চোখ জোড়া বাঁকা করে জিজ্ঞাসা করলাম, “আপনি জানলেন কি করে?”
পোস্ট মাস্টারের সাথে আমার কথা হয়েছে। এর আগের ট্রেনটা এক্সিডেন্ট করেছে। লাইন ক্লিয়ার না হওয়া পর্যন্ত পরের ট্রেন আসতে পারবে না। লাইন ক্লিয়ার হতে হতে ভোর হয়ে যাবে।
লোকটার কথা বার্তা খুব সহজ সরল। তার বক্তব্যে কোন কিছুর আড়াল নেই। এ যুগে এরকম অকপটে মনখোলা লোক খুব সাধারণত দেখা যায় না। লোকটার প্রতি ক্রমেই আমার আগ্রহ ও উৎসাহ সৃষ্টি হতে লাগল। লোকটি আবার বলল, “ভাই আপনার সাথে যদিও আমার অল্প সময়ের স্বল্প পরিচয়, তারপরও আপনাকে আমার বেশ মনে ধরেছে। খুব কাছের মনে হচ্ছে। আপনার আপত্তি না থাকলে আপনার কাছে আমার জীবনের একটি স্মরণীয় ঘটনা বলব। এ কাহিনী এর আগে আমি কাউকে বলিনি। আপনি এর মধ্যে নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন যে আমি বাচাল প্রকৃতির মানুষ। আমার মত বেশি কথা বলা মানুষের কাছে এরকম কাহিনী চেপে রাখা প্রায় অসম্বব। কাহিনীটি আমার জীবনের একটা অধ্যায়ের, একটা পরাজয়ের। এর আগে কারো কাছে বলিনি। কিন্তু আমি আর পারছি না। কাহিনীটি যেন আমার পেটের ভেতর থেকে ক্রমেই উপুেড় আসতে চায়। তাই আজ তা আপনার কাছে বলে আমার মনকে কিছুটা হলেও হালকা করব।
লোকটির কথায় ক্রমেই আমার আগ্রহ বাড়ছে। আমি তাকে আশ্বস্ত করলাম। বললাম, “হাড়কাপা এই শীতে সেই রাত এগারোটা থেকে বসে থাকতে থাকতে প্রায় বিরক্ত হয়ে গিয়েছি।। এমন সময় আপনার সঙ্গ কিছুটা হলেও আমাকে স্বস্তি দিচ্ছে। প্রতিক্ষার প্রহর সব সময় দীর্ঘ হয়। ট্রেন আসতে এখনও অনেক দেরি। এই সময়টা আমরা গল্প করে কাটাতে পারি। শুরু করুন আপনার সেই স্মরনীয় ঘটনা। লোকটা দম নিলেন। বার কয়েক কাশ দিয়ে গলা পরিষ্কার করলেন। এরপর বলা শুরু করলেন,
গত বছরের ঘটনা। মাঘ মাসের পূর্ণ শীত তখন। মধ্য রাতে আমার কাছে এস.পি স্যারের ফোন আসল। নীলরাঙ্গা গ্রামের চেয়ারম্যানের বউ চেয়ারম্যানকে কুপিয়ে হত্যা করে গ্রামে গাঁ ঢাকা দিয়ে আছে। এস.পি. স্যার কেসটা আমাকে দেখার আদেশ দিলেন। সময়টা ছিল আমার প্রমোশনের। সাব ইন্সপেক্টর থেকে ইন্সপেক্টরে প্রমোশনের সময়। ঐ সময়ে এস.পির মন যুগিয়ে চলা ছিল আমার একান্ত দায়িত্ব। তাই এই হাঁড় কাপা শীতে আমি তিনজন কনস্টেবলকে সাথে করে গাড়ি নিয়ে ছুটলাম নীলরাঙ্গা গ্রামের দিকে। পুলিশ স্টেশন থেকে নীলরাঙ্গা গ্রামের দুরত্ব প্রায় পাঁচ কিলোমিটার। কুয়াশা ঢাকা গ্রামের মেঠো রাস্তায় গাড়ি চলছিল একটু সাবধানে। আমরা চেয়ারম্যানের বাড়ীতে যখন পৌছলাম তখন ফজরের আজান হচ্ছিল। চেয়ারম্যানের মর দেহটা তার শোবার ঘরেই ছিল। সে যেখানে খুন হয়েছিল সে ভাবেই তার দেহ পরে আছে। তার ঘরে কয়েকটি হুইস্কি এবং বিদেশী স্যাম্পানের বোতল দেখলাম। চেয়ারম্যান যে মদ্যপ ছিল এগুলোই তার প্রমাণ বহন করে। বাড়ীতে তেমন কোন মানুষজন দেখলাম না । শুধু এক বৃদ্ধ কে দেখলাম, বাড়ীর দোড় গোড়ায় দাড়িয়ে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। হবে হয়ত চেয়ারম্যানের খুব বিশ্বত এবং পুরানো চাকর। আমরা চেয়ারম্যানের লাসটা পোস্ট মর্টামের জন্য মর্গে পাঠাবার ব্যবস্থা করলাম। এরপর গ্রামের চৌকিদারকে সাথে নিয়ে চেয়ারম্যানের খুনি বউকে খোঁজা শুরু করলাম।

বিশাল বড় বাগান বাড়ি। বাড়ির পিছনটা সুপারি, নারকেল, খেঁজুর, তাল গাছে ভরা। বাগানের ভিতরে বিশাল বড় দিঘী। দিঘীর চারপাশে কয়েকটি কুঁড়ে ঘর। আমরা তারই একটিতে খোঁজা শুরু করলাম। সকালের সূর্য তখনও উঠেনি। সারা গ্রামকে ঘন কুয়াশা তার সাদা ওড়না দিয়ে ঢেকে রেখেছে। বাড়ির কর্তা এবং কর্তী তখনও গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। আমরা অনেক্ষণ দরজার কড়া নাড়ার পর বাড়ির কর্তা ঘুম চোখে দরজা খুলল। আকস্মাৎ পুলিশ দেখে তিনি যেন ভয়ে কাঠ হয়ে গেলেন। আমরা তাঁকে অভয় দিয়ে চেয়ারম্যানের খুনি বউয়ের সন্ধান চাইলাম। লোকটি জানাল তার ঘরে ঐ মহিলা নেই এবং তিনি তার সন্ধান জানেন না। জানলেও বলবেন না। অন্যান্য ঘর গুলোতে গিয়ে ও একই উত্তর শোনা গেলো। সকলেই ঐ মহিলার সন্ধান দিতে নারাজ। এদের এই অসম্মতি থেকে সহজেই অনুমান করা যায় যে, চেয়ারম্যান ভালো লোক ছিলেন না। জনগণ কে তিনি হয়ত অত্যাচার করতেন। তার বউ নিশ্চয়ই উদার হৃদয়ের ছিল। পাড়া পড়শীদের সাথে হয়ত তার সু-সর্ম্পক ছিল। তাই তার এ দুর্দিনে সবাই তাকে সাহায্য করছে। অবশেষে আমরা ঢুকলাম এক বুড়ির ঘরে। বুড়ির ঘরে এক মহিলা শায়িত ছিল। চৌকিদার তার দিকে লক্ষ্য করে চেচিয়ে বলল “ঐ তো খুনি, চেয়ারম্যানের বউ” ।
আমি ঐ মহিলার দিকে ভাল করে তাকালাম এবং অবাক হলাম। বিস্ময়ে আমার চোখকেও বিশ্বাস করতে পারলাম না। এই মহিলা ছিল আমার পূর্ব পরিচিতা। এর নাম সোহাগী। বিস্ময়ে আমি অনুচ্চারিত রব তুললাম, ‘সোহাগী’!
সোহাগীদের বাড়িতে আমি লজিং থাকতাম। আমার অনার্স জীবনটা ওদের বাড়িতে থেকেই শেষ করি। আমি ওর ছোট ভাইকে সকাল সন্ধ্যা পড়া দেখিয়ে দিতাম। সোহাগী ছিল অসম্ভব সুন্দরী। দুধে আলতা ছিল গায়ের রং। চোখ দুটি ছিল হরিণীর মত। রহস্যে ঘেড়া ছিল ওর হাসি। গ্রামের প্রায় ছেলেই ওর জন্য পাগল ছিল। সোহাগীর বাবা ছিল অনেক সম্পত্তির মালিক। সোহাগীর সৌন্দর্য এবং ওর বাবার সম্পত্তি হয়ত এদের ওর প্রতি দুর্বল হতে বাধ্য করেছিল।

ইন্সপেক্টার সাহেব থামলেন। আবার দম নিলেন। বললেন “সমীর সাহেব শীতে জমে গেছি। গলা বসে গেছে। শরীর গরম করা দরকার।” ইন্সপেক্টর সাহেবের গল্পটা আমার মনে অকৃত্রিম অগ্রহের সৃষ্টি করেছে। তার কাহিনীর প্রতিটি কথা আমি শুনছি খুব আগ্রহের সাথে। তার গল্পটা আমার মনে তীব্র উত্তোজনা সৃষ্টি করছে। তাই তাকে আবার তার কাহিনী রাজ্যে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য দ্রুত স্টেশনের দোকান থেকে দু’কাপ চা নিয়ে এলাম। ইন্সপেক্টর সাহেব চায়ের পেয়ালায় কয়েক বার চুমুক দিয়ে আবার বলতে লাগলেন, “স্কুল জীবনের গন্ডি পেরিয়ে কলেজ জীবনে পা দেয়ার কয়েক মাস পর গ্রামের কিছু বখাটে ছেলেদের উত্যুক্তির কারণে সোহাগীর কলেজে যাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পরল। ওর বাবা বাড়ীতে রেখেই ওর পড়ালেখার ব্যবস্থা করলেন, যার দায়িত্বটা পরেছিল আমার উপর। সকাল সন্ধ্যা ও বই নিয়ে বসত আমার কাছে। মাঝে মাঝে আমি লক্ষ্য করতাম পড়ার দিকে মনোযোগ না দিয়ে এক মনে এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকত,। অসাধারণ কিছু খোঁজার চেষ্টা করত। থেকে থেকে রহস্যময় হাসিতে হেসে উঠত। আমি ছিলাম ওর শিক্ষক এবং আমি যথার্থ শিক্ষকের মতোই আচরণ করতাম। পড়া রেখে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রসঙ্গে কথা বলতে চাইত ও। মাঝে মাঝে আমার সৌন্দর্য প্রশংসায় নিজেকে ব্যস্ত রাখত। কিন্তু আমি বিভিন্ন অজুহাতে অপ্রাসঙ্গিক কথা বাদ দিয়ে লেখাপড়ার প্রসঙ্গে ফিরে আসতাম। ক্রমান্বয়ে আমার প্রতি ওর ভালোবাসা এবং দুর্বলতা উপলদ্ধি করতে লাগলাম। আমারও যে ওর প্রতি ভালোলাগা ছিল না তা ঠিক নয়। হয়ত একটু বেশিই ভালোবাসতাম। তাই আমার অনিশ্চিত জীবনের সাথে ওর সুনিশ্চিত জীবনকে জড়াতে চাইনি বলেই আমার ভালোবাসা তার প্রতি পূর্নরূপে নিবেদিত হয় নি।
অনার্স পাশের পর আমি ওদের বাড়ী থেকে বিদায় নিয়ে চাকরির সন্ধানে ঢাকার ট্রেন ধরার জন্য স্টেশনে পৌছলাম। স্টেশনে পৌছে দেখলাম সোহাগী স্টেশনের পাশের বটগাছের আড়ালে মলিন মুখে দাড়িয়ে আছে। আমি ওর কাছে গেলাম। বিদায় এবং আশীর্বাদ চাইলাম। অনেকক্ষণ নিরব থাকার পর সোহাগী বলল, “যেতে হলে আমকেও সাথে নিয়ে চলুন, আমিও যাব আপনার সাথে।” আমি আমার বুকের গভীরে জমে থাকা দুঃখটাকে ঈষৎ হাসির মাধ্যমে প্রকাশ করে বললাম, “পাগলামি করো না, বাড়ি ফিরে যাও। আমি আশীর্বাদ করছি তুমি সুখি হবে।” ট্রেন আসল। থামল! আমি ট্রেনে উঠলাম। ট্রেন আবার চলতে লাগল। সোহাগী আমার চলার পথে অশ্র“সিক্ত চোখ জোড়া দিয়ে অপলক তাকিয়ে থাকল। আমিও ট্রেনের জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকলাম যতক্ষণ পর্যন্ত ওকে দেখা গেল। আমার হৃদয় মন্দিরে ওর জন্য যে ভালোবাসা সঞ্চিত ছিল তা সেদিন আরাধনার অভাবে পূর্ণরুপে বিকোশিত হতে পারেনি। সেই ভালোবাসার জোর এত ক্ষীণ ছিল তা সেদিন ওকে আমার সঙ্গে সঙ্গী করে নিতে সাহস জোগায়নি।
সেদিনের পর ওর সঙ্গে আমার আর দেখা হয়নি। জীবন এবং জীবিকার তাগিদে এতটাই ব্যস্ত ছিলাম যে, সোহাগী কিংবা ওর পরিবারের কারো সঙ্গে আমার যোগাযোগ রাখা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। পরে অবশ্য জানতে পেরেছি যে ওর ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে হয়েছে। ওর স্বামীর অঢেল প্রতিপত্তি থাকলেও তার চরিত্রে কয়েকটা কালো দাগ ছিল।

সোহাগী শোয়া থেকে উঠে পিছনের দরজা দিয়ে দ্রুত দৌড়াতে লাগল। আমার হাতে রিভলবার ছিল। আমি রিভলবারটি ওর দিকে তাক করে ট্রিগারে চাপ দিতে গিয়েও পারলাম না। কী এক অস্বাভাবিক শক্তি আমাকে ওর দিকে গুলি ছুড়তে বাধা দিল। হয়ত এই শক্তিই ছিল ওর প্রতি আমার ভালোবাসা। সোহাগী পালিয়ে গেল। ঘন কুয়াশায় ওকে আর দেখা গেল না। আমরা আবার ওকে খুঁজতে লাগলাম।
পুলিশ হিসেবে আমার প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব সকল আবেগকে বিসর্জন দিয়ে অপরাধীকে খুঁজে বের করা। আমি কখনো আমরা কর্তব্যে অবহেলা করিনি। কিন্তু সেই দিন আমি আমার দায়িত্বে নৈতিক দুর্বলতা লক্ষ্য করলাম। নিজেকে আমি বড় অপরাধী মনে করতে লাগলাম। সোহাগীর এই অভিশপ্ত জীবনের জন্য আমি নিজেকে দায়ী করতে লাগলাম। হয়ত তাকে সেদিন আমার সঙ্গে চিরসঙ্গী করে নিলে তাকে আজ এ ফেরারী জীবন বেছে নিতে হতো না। আমি চাইনি সোহাগী ধরা পরুক। আমার সাথে ছিলো তিনজন কনস্টেবল। তারা যাতে ব্যাপারটা না বুঝতে পারে তাই আমি আরো কয়েক জায়গায় ব্যর্থ খুঁজে না পেয়ে গাড়ীতে করে পুলিশ স্টেশনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম। হঠাৎ আমাদের গাড়ির সামনে এসে সোহাগী দাড়াল। আতঙ্কে আমি শিউরে উঠলাম। অপরাধীকে হাতের এতটা কাছে পেয়ে কোন অজুহাতে তাকে আর রক্ষা করা আমার পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠলনা। আমি গাড়ী থেকে নেমে ওর কাছে গেলাম। ওর চোখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম। সেখানে দুঃচিন্তার লেশ মাত্র দেখতে পেলাম না। অধিকন্তু তার বাঁকা ঠোটের কোণে হাসির আভা দেখতে পেলাম। সোহাগী হয়তো প্রথমে আমাকে চিনতে পারে নি। তাই তখন পালিয়েছিল। পরে দূর থেকে চিনতে পেরে হয়ত স্বেচ্ছায় ধরা দিয়েছিল। আমি বুঝতে পারলাম না কেন সে এই বোকামীটা করল। হবে হয়ত আমার প্রতি ওর ভালোবাসার কারণে। আমি একজন কনষ্টেবলকে ঈশারায় ওর হাতে হাত করা কড়া পড়াতে বললাম। হাত কড়া পড়ানোর পর ওকে গাড়িতে উঠানো হলো। আমার তখন নিজেকে বড় স্বার্থপর মনে হচ্ছিল। মনে হলো আমি নিজেই যেন এক খুনি। একটি মেয়ের স্বপ্নকে খুন করেছি। যার ফলে সে একজন মানুষ খুন করেছে। সমাজের চোখে সোহাগী খুনী হলেও আমার হৃদয় চোখে ও ছিল নিরপরাধী। আমার হৃদয় আদালত ওকে বেকশুর খালাস দিয়ে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ যেন আমাকেই দিল।
ইন্সপেক্টর সাহেব থামলেন। কিন্তু আমার আগ্রহের শেষ নেই। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, “এর পর আপনি আর সোহাগীর কোন খবর নেননি”? ইন্সপেক্টর সাহেব দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিলেন।। অনেক্ষণ পর চুপ থাকার পর আবার বলতে লাগলেন, “সোহাগীকে গ্রেফতার করার পর পুরো পুলিশ মহলে আমার সুনাম ছড়িয়ে পড়ল। আমাকে প্রমোশন দিয়ে বদলি করা হলো। এর পর আর সোহাগীর কোন খবর রাখা আমার পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠেনি। কয়েক মাস আগে জানতে পারলাম ওর ফাঁসির আদেশ হয়েছে।
সমীর সাহেব এই হলো আমার জীবনের স্বরণীয় ঘটনা যা আমি এর আগে কাউকে বলিনি। এখন শুধু আপনাকে বললাম। এটা আমার জীবনের এক ব্যর্থতার অধ্যায়। আর ব্যর্থতা এবং পরাজয়ের কথা প্রকাশে নিশ্চই কোন গৌরব নেই। তাই কাউকে বলিনি। ভবিষ্যতে হয়ত কাউকে বলবও না। মাঝে মাঝে ঘুমের ঘরে আমি সোহাগীর সেই রহস্যময় হাসি খুব স্পষ্ট শুনতে পাই। এতটা স্পষ্ট যে মনে হয় ও আমার পাশে বসে হাসছে।
ছোট বেলা থেকেই আমি যা চেয়েছি তা-ই পেয়েছি। জীবন যুদ্ধের প্রায় ক্ষেত্রেই আমার পদাচরণ ছিল বীর নায়কের ন্যায় স্বার্থক। শুধু এই একটি ক্ষেত্রেই এই নায়কের পরাজয় হয়েছে।। পরাজয় হয়েছে আমার, আমার ভালোবাসার!

ভোর হয়ে এলো। পূব আকাশে কুয়াশার সাদা জাল ভেদ করে লাল সূর্যটা উঠতে লাগল।। ঝন ঝন করতে করতে দীর্ঘ প্রতিক্ষিত ট্রেন এসে স্টেশনে থামল। স্টেশনে অপেক্ষমাণ যাত্রীদের মধ্যে ট্রেনে উঠা নিয়ে প্রতিযোগীতা শুরু হলো। ইন্সপেক্টর সাহেবও ছুটলেন আগে ট্রেনে উঠতে। ট্রেনে উ^ঠার পর ভিড়ের মাঝে আর তাকে খুঁজে পেলাম না্ ।




০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কর কাজ নাহি লাজ

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ১৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪


রাফসান দা ছোট ভাই
ছোট সে আর নাই
গাড়ি বাড়ি কিনে সে হয়ে গেছে ধন্য
অনন্য, সে এখন অনন্য।

হিংসেয় পুড়ে কার?
পুড়েপুড়ে ছারখার
কেন পুড়ে গা জুড়ে
পুড়ে কী জন্য?

নেমে পড় সাধনায়
মিছে মর... ...বাকিটুকু পড়ুন

তাঁর বোতলে আটকে আছে বিরোধী দল

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:০৭



সেই ২০০৯ সালে তিনি যে ক্ষমতার মসনদে বসলেন তারপর থেকে কেউ তাঁকে মসনদ থেকে ঠেলে ফেলতে পারেনি। যারা তাঁকে ঠেলে ফেলবে তাদের বড়টাকে তিনি বোতল বন্দ্বি করেছেন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

নতুন গঙ্গা পানি চুক্তি- কখন হবে, গ্যারান্টি ক্লজহীন চুক্তি নবায়ন হবে কিংবা তিস্তার মোট ঝুলে যাবে?

লিখেছেন এক নিরুদ্দেশ পথিক, ১৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:২৬


১৬ মে ঐতিহাসিক ফারাক্কা দিবস। ফারাক্কা বাঁধ শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে খরা ও মরুকরণ তীব্র করে, বর্ষায় হঠাৎ বন্যা তৈরি করে কৃষক ও পরিবেশের মরণফাঁদ হয়ে উঠেছে। পানি বঞ্চনা এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

কেউ কি আমার বন্ধু শাহেদের ঠিকানা জানেন?

লিখেছেন জিএম হারুন -অর -রশিদ, ১৬ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:৩৪



কেউ কি আমার বন্ধু শাহেদের ঠিকানা জানেন?
আমার খুবই জরুরি তার ঠিকানাটা জানা,
আমি অনেক চেষ্টা করেও ওর ঠিকানা জোগাড় করতে পারছিনা।

আমি অনেক দিন যাবত ওকে খুঁজে বেড়াচ্ছি,
এই ধরুণ, বিশ-একুশ বছর।
আশ্চর্য্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

আজকের ব্লগার ভাবনা:কথায় কথায় বয়কট এর ডাক দেয়া পিনাকীদের আইডি/পেইজ/চ্যানেল বাংলাদেশে হাইড করা উচিত কি? ব্লগাররা কি ভাবছেন?

লিখেছেন লেখার খাতা, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ১২:১৩



অপূর্ব একজন চমৎকার অভিনেতা। ছোট পর্দার এই জনপ্রিয় মুখকে চেনেনা এমন কেউ নেই। সাধারণত অভিনেতা অভিনেত্রীদের রুজিরোজগার এর একটি মাধ্যম হইল বিজ্ঞাপনে মডেল হওয়া। বাংলাদেশের কোন তারকা যদি বিদেশী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×