somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অস্ট্রেলিয়ায় বিদেশী ছাত্ররা বর্ণবাদের শিকার

১৫ ই জুলাই, ২০০৯ দুপুর ১:০৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১।

মে মাসের শেষার্ধ আর গোটা জুন মাস জুড়ে অস্ট্রেলিয়ার ভারতীয় ছাত্ররা সাম্প্রদায়িক আক্রমণের শিকার হয়। পাগড়ি হ্যঁচকা টানে ফেলে চুল কেটে দিয়ে, কিছু অস্ট্রেলিয়ান তরুণ মেলবোর্নের রেলস্টেশনে এক শিখ ছাত্রকে হুমকি দেয়, 'তোরা ভারতীয়। আমরা তোদের ঘৃণা করি। আমরা তোদের খুন করবো'। রেলস্টেশনে ছুরিকাঘাত, বাসার জানালা দিয়ে পেট্রোল বোমা ঢেলে আগুন ধরানো, ছিনতাই, স্ক্রুড্রাইভার দিয়ে মাথায় আঘাত, বাড়ির উঠোনে রাখা ভারতীয় ছাত্রের গাড়ি রাতের অন্ধকারে জ্বালিয়ে দেয়া, শারীরিক আঘাত- এরকম নানা অপমান-আক্রমণের জের হিসাবে মেলবোর্নের রাজপথ কেঁপে উঠেছে বেশ ক’দিন। টিভি পর্দায় দেখেছি উপমহাদেশীয় স্টাইলে জ্বালাও-পোড়াও, অবস্থান ধর্মঘট, প্ল্যাকার্ড হাতে শ্লোগানমুখর মিছিল। ১৫০০০ ছাত্রের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হয়েছে বিশাল প্রতিবাদ মিছিল, যোগ দিয়েছে অন্য দেশের ছাত্ররাও। মেলবোর্নের পর সিডনিতেও জোটবদ্ধ ছাত্ররা মিছিল মিটিং করে। টেনে হিঁচড়ে পুলিশ কর্তৃক ছাত্রদের আহত করার দৃশ্য মিডিয়া খুব গুরুত্বের সাথে প্রচার করেছে। সিডনি, মেলবোর্ন, এডিলেডে এ পর্যন্ত প্রায় ১৪০০ বর্ণবাদজনিত ঘটনার কথা জানা গেছে।

বিদেশী ছাত্র ভর্তি করে গত বছর আয় হয়েছে ১৫.৫ বিলিয়ন ডলার। গোটা ছাত্রসংখ্যার সিকিভাগই বিদেশী। চীনের পরেই ভারতীয় ছাত্রদের সংখ্যাধিক্য। কয়লা আর লৌহখনির পর শিক্ষাখাত থেকে সবচেয়ে বেশি আয় করে অস্ট্রেলিয়া। ভিক্টোরিয়া প্রদেশের প্রধান আয়ের উৎস উচ্চশিক্ষা খাতে প্রাপ্ত অর্থ আর কিনা রাজধানী মেলবোর্নের বুকেই এত আক্রমণ! অস্ট্রেলিয়ার শিক্ষাবাণিজ্যের অন্যতম চালিকাশক্তি এই ভারতীয় ছাত্রদের উপর আঘাতকে কোন অবস্থাতেই এড়িয়ে যাচ্ছেনা সরকার। দু’দেশের উচ্চপর্যায়ে দফায় দফায় বৈঠক হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং সংসদে এধরণের আক্রমণের তীব্র নিন্দা জানিয়ে বলেছেন, সাম্প্রদায়িক পীড়নের ব্যাপারটা কোনভাবেই হেলাফেলা করা যাবেনা। অজি সরকার অবশ্য মিনমিন কন্ঠে বলতে চেয়েছে, এসবকিছুর সাথে সাম্প্রদায়িকতার সম্পর্ক নাও থাকতে পারে, তবে তারা কঠোর পদক্ষেপ নেবে ভবিষ্যৎ যেকোন ঘটনার ক্ষেত্রে। দু’দেশের সরকার ভারতীয় ছাত্রদের সনির্বন্ধ অনুরোধ জানাচ্ছে শান্ত থাকতে, প্রশাসনের উপর আস্থা রাখতে। প্রধানমন্ত্রী কেভিন রাড সহকর্মীদের মতামত চেয়েছেন কীভাবে ছাত্রদের উপর আক্রমণ প্রতিহত করে ভারতীয় সরকারকে আশ্বস্ত করা যায়।

ভিক্টোরিয়া পুলিশের সহকারী কমিশনার বলছেন, শুধু বর্ণবাদকেই মূল কারণ হিসাবে দেখা উচিৎ নয়। সাধারণত বিদেশী ছাত্ররা এমন সব পেশায় নিয়োজিত যেখানে খারাপ লোকের সংস্পর্শে আসা বা ঝামেলায় জড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাব্যতা বেশি। মাদকাসক্ত, বেকার অজি তরুণরা ছিনতাই বা শারীরিক আক্রমণ করছে। আবার অন্য দেশের লোকেরাও যে এসব ঘটনার পেছনে নেই, তাও নয়। তার এ বক্তব্যের যথার্থতা অবশ্য মেলে সিডনি হ্যারিস পার্ক এলাকার ঘটনায় যেখানে লেবানিজ ছাত্ররাই মূলত আঘাত হেনেছিলো ভারতীয়দের উপর। আইন শৃংখলা বাহিনীর কর্তাব্যক্তিরা বলছেন, গত বছর ভারত থেকে আগের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ ছাত্র এসেছে। একটা বড় শহরে এধরণের জনসমাগম নানা ধরণের সাংস্কৃতিক টানাপোড়েনের জন্ম দিতেই পারে। সরকার ২০১০ সালের জন্য ‘ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট স্ট্রাটেজি’ বাস্তবায়নের পরিকল্পনা করছে যার আওতায় বিদেশী ছাত্রদের ওরিয়েন্টেশন, মাল্টিকালচারের উপর স্কুল সিলেবাসে যথাযথ শিক্ষাদান, কলেজগুলোর শিক্ষার মান- এসব ব্যাপারে নজরদারি করা হবে। মেলবোর্নের রেলস্টেশনগুলোতে ‘স্টেশন সেফটি অপারেশন’ নামের বিশেষ বুথ চালু করা হয়েছে যেখান থেকে বর্ণবাদপ্রসূত যেকোন আঘাতের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। এছাড়াও সাদা পোশাকে পুলিশ বিভিন্ন এলাকায় টহল দিচ্ছে।


২।

সিডনি মরনিং হেরাল্ড- এর মত প্রথম সারির জাতীয় দৈনিকে যখন বিদেশী ছাত্রদের করুণ অবস্থাকে ‘দাসত্বের’ সাথে তুলনা করা হয়, তখন নড়েচড়ে বসতেই হয়। ভোকেশনাল কোর্সে আসে হাজারো বিদেশী ছাত্র একটা উদ্ভট ইমিগ্রেশন নীতির গ্যাঁড়াকলে পড়ে কীভাবে বিনা পারিশ্রমিকে ঘাম ঝরিয়ে যাচ্ছে, জানলাম। মজুরি তো মিলছেইনা, উল্টো মোটা অর্থের বিনিময়ে স্বল্পমেয়াদী চাকুরি নিচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন অস্ট্রেলিয়ান সরকার ইমিগ্রেশন আর শিক্ষা আইনের মোড়কে এই অর্থনৈতিক দাসপ্রথা চালু করেছে। বিনাবেতনের এই বিশাল কর্মীগোষ্ঠীর বিস্তার ২০০৫ সাল থেকে, যখন ভোকেশনাল ছাত্রদের জন্য ৯০০ ঘন্টা কাজের অভিজ্ঞতার একটা শর্ত জুড়ে দেয়া হয়। বলাবাহুল্য, পারিশ্রমিকের ব্যাপারে নিয়োগদাতাদের কোন বাধ্যবাধকতা রাখা হয়নি এ আইনে। বিদেশী ছাত্ররা অস্ট্রেলিয়ায় স্থায়ী আবাসনের সুবিধা পেতে ভোকেশনাল কোর্সগুলোকে প্রাধান্য দেয় কারণ দু’বছরের একটা কোর্স শেষ করলেই আবেদনের যোগ্যতা লাভ করবে। ৯০০ ঘন্টার পুলসিরাত পার হওয়া তাই বাধ্যতামূলক। শিক্ষাব্যবসায়ীদের আর পায় কে? ছাত্র নাও, বিনা মজুরিতে সেবা নাও, তৃতীয় পক্ষের কাছে সেবা বেচো আবার প্রাথমিকভাবে মোটা অঙ্কের অর্থ বাগিয়ে নাও গোবেচারা ছাত্রদের কাছ থেকে। ফলাফল, প্রাইভেট কলেজের সংখ্য বিস্ফোরণ। অধিকাংশই 'ভিসা মিল'। ২০০১ এ মাত্র ৬৬৪ টি থেকে কয়েক বছরের মাথায় কলেজ বেড়ে দাঁড়ালো ৪৮৯২ টি তে। ব্রাজিলের এক ছাত্রী জানালো PR এর আবেদন করতে সে ২২০০০ ডলার আর দু’বছর ঢেলেছে একটা হেয়ারড্রেসিং কোর্সে। কলেজের লাগোয়া একটা সেলুনে ৯০০ ঘন্টা বিনা মজুরিতে কাজ তো করেছেই, আবার নন-রিফান্ডেবল ১০০০ ডলার দিয়েছে সিকিউরিটি হিসেবে। এখানে আরেক ধরণের ধান্দবাজির মওকা মিলেছে। ভুরিভুরি বিনা পয়সার ‘দাস’দের কর্মবাজারে পরিচিত করিয়ে দেয়ার জন্য আবার ‘প্লেসমেন্ট ফি’ নামে মোটা অঙ্ক হাতিয়ে নিচ্ছে শাইলকরা। ইমিগ্রেশন বিভাগের এক কর্মকর্তার ভাষ্য, দুর্নীতি কীভাবে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেতে পারে তা দেখার জন্য এই খাতে একটু চোখ বোলালেই হবে।

কিছু এজেন্ট আবার ৯০০ ঘন্টার ভুয়া সার্টিফিকেট বিক্রি করছে দেদারসে, ১৫০০০ থেকে ২২০০০ ডলারের বিনিময়ে। এরকম এক চামারের কথা শুনুন, ‘ওরা তো চাকর। সকাল ১১ টা থেকে রাত ১১ পর্যন্ত বিনা পয়সায় খাটে। ওদের দরকার কাগজ, আমরা তা দিচ্ছি। কাগজের জন্য ওরা যেকোন কিছু করতে রাজি’। কলেজ আর নিয়োগদাতা মিলে এক দুষ্টচক্র গড়ে উঠেছে বিদেশী ছাত্রদের ঘাড়ে ভর করে। এরা অসম্ভব ক্ষমতা রাখে একজন ছাত্রের উপর। প্রতিবাদ করতে গেলে ভর্তি বাতিল করে সোজা দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করবে। কুকিং কোর্সের এক শিক্ষক জানালেন, ছাত্রদের দুরবস্থা দেখে প্রতিবাদ করতে যাওয়ায় মাইগ্রেশন এজেন্ট তাকে চাকুরি হারানোর ভয় পর্যন্ত দেখিয়েছে। এই এজেন্টের মাধ্যমে কলেজে কাজটা নিয়েছিলেন তিনি। তার জানামতে ভারতীয় রেস্টুরেন্টের অনেক মালিকই এ সুযোগে বিশাল বড়লোক হয়ে গেছে।

অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা এই ভ্রান্ত নীতির তীব্র সমালচনা করছেন। অস্ট্রেলিয়ানরা যেখানে স্বল্প পারিশ্রমিকেও কাজ খুঁজে পাচ্ছেনা, সেখানে বাজারে মজুরিবিহীন শ্রমিকের সহজপ্রাপ্যতা তাদের আরো চাপের মুখে ফেলছে। অভিবাসন নীতির নাম করে সরকার শিক্ষাব্যবসার দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছে। কুকিং আর হেয়ারড্রেসিং এ একসময় কর্মীস্বল্পতা ছিলো, তাই এ দু’টি বিষয়ে এখন কলেজগুলো অনেক বেশি ফি নিয়ে ছাত্র ঢোকাচ্ছে। এক ছাত্র ছয় মাস কুকিং কোর্স করার পরে জানতে পারলো, কাগজে-কলমে তাকে IT কোর্সের ছাত্র করে রাখা হয়েছে কারণ কুকিং এর আসন খালি ছিলোনা। এই মিথ্যাচারের প্রতিবাদ করতে গেলে তাকে দেশে পাঠিয়ে দেয়ার ভয় দেখানো হয়। অনেকের মতে, অস্ট্রেলিয়ায় ভারতীয় ছাত্রদের সাম্প্রতিক আন্দোলনের হেতু এরকম আরো অনেক বৈষম্য আর দমন-পীড়ন।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই জুলাই, ২০০৯ সকাল ৮:৫৭
৩০টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অহমিকা পাগলা

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১৪


এক আবেগ অনুভূতি আর
উপলব্ধির গন্ধ নিলো না
কি পাষাণ ধর্মলয় মানুষ;
আশপাশ কবর দেখে না
কি মাটির প্রণয় ভাবে না-
এই হলো বাস্তবতা আর
আবেগ, তাই না শুধু বাতাস
গায়ে লাগে না, মন জুড়ায় না;
বলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩




তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×