somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

"কে???"

১৯ শে মে, ২০১৩ রাত ১১:১১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

একবিংশ শতাব্দীতে কিছু মানুষের শোকের আয়ু বড়োজোর একবছর নয়, তারচেয়েও বেশি । ফারহানা মারা গেছে এক বছর হয়ে গেলো, আদিত্য এখনো ফারহানার মৃত্যুকে স্বাভাবিক ভাবে মেনে নিতে পারে নি । কখনো মেনে নেওয়া সম্ভবও ছিল না তারপক্ষে । অবর্ণনীয় সুখের সময় ছিল তাদের । আদিত্যের সকালটা শুরু হত ফারহানার ঠোঁটে চুমু খেয়ে । সপ্তাহে কমপক্ষে একদিন অফিস শেষ করে ফারহানার জন্য নিয়ে আসতো দামি চকলেটভর্তি বাক্স । চকলেট খেতে ভারী পছন্দ করতো ফারহানা । বাসায় ফিরতে সামান্য দেরি হলেই অভিমানে মুখটা টকটকে লাল হয়ে যেত । ফারহানার রাগ ভাঙানো সে আরেক বিপদ । কোনো কোনো রাতে ওরা জেগে থাকতো অনেকক্ষণ, ফারহানা আদিত্যকে কবিতা পড়ে শোনাতো । জীবনানন্দ, বুদ্ধদেব, সুনীল, শক্তি….ভার্সিটি পড়ার সময় থিয়েটারে কাজ করতো ফারহানা । কবিতা পড়ার সময় ওর মিষ্টি চিকন কণ্ঠটা আশ্চর্য রকম গমগমে হয়ে উঠত । আদিত্য মুগ্ধ শিশুর মতো চোখ বড় বড় করে শুনত ।
পাশে রাখা কেরুর বোতলটা খুলে একচুমুকেই অর্ধেকটা শেষ করে ফেলে আদিত্য । বুকের ভেতরে অজানা অগ্ন্যুৎপাতে যেন সব কিছু ছারখার করে দেয় । সামান্য মুক্ত বাতাসের জন্য ফুসফুসটা হাঁসফাঁস করে ওঠে, তবুও আরো যন্ত্রণা দিতে চায় সে নিজেকে । পাশে পরে থাকা বেনসনের প্যাকেটটা হাতড়ে কোনো সিগারেট খুঁজে পায় না । ব্যর্থ আক্রোশে প্যাকেটটাকে দলা করে সে পা দিয়ে পিঁষতে থাকে হিংস্র প্রাণীর মতো । প্রতিদিনের সকালটা এখন এভাবেই শুরু হয় তার ।
অফিস থেকে এক মাসের ছুটি পেয়েছে অসুস্থতার অজুহাতে । একজন সাইকিয়াট্রিস্ট এর কাছে চিকিৎসা নিচ্ছে, তারই পরামর্শে ছুটিটা নিতে হল । একাকিত্বের বিষাক্ত অবসরে সবকিছুই অসহ্য লাগে তার । ঝুলে থাকা দেয়াল ঘড়ির টিকটিক শব্দটা স্নায়ুতে গিয়ে বিধঁছে, যেন বুকের উপর কেউ চেপে বসে হাতুড়ি পিটাচ্ছে ! পার্থিব অস্তিত্বের প্রতিটি মুহূর্তই যেন ভুল নরকে বেঁচে থাকা !
সে সমস্ত স্মৃতি আর ঘরজুড়ে খুঁজে যাচ্ছে ফারহানার মৃত্যু রহস্য ! আর অন্য কয়টা সাধারণ দিনের মতোই ছিল সে দিন । ফারহানার জন্য কিনে নিয়ে গিয়েছিল দুই বাক্স চকলেট । ফারহানাও নিশ্চয়ই অপেক্ষা করছিল ওর জন্য, বুকে রক্ত ছলকে উঠছিল উষ্ণ আলিঙ্গনের আনন্দময় প্রতীক্ষায় ।
কিন্তু দরজা খুলতেই এলোমেলো হয়ে গেল সব সুখী সমীকরণ । ফ্যানের সিলিং এর সাথে ঝুলছে ফারহানার নিথর দেহ । চোখ দুটো আধবোজা, হাতের চুড়ি গুলো নুয়ে আছে অসহায় এর মতো ।
সে দিনটা এখনো ভোলে নি আদিত্য । ফারহানার মৃত্যু তাকে নরকের দুয়ারে নিয়ে গিয়েছে । আচ্ছন্নতা গ্রাস করে আদিত্যকে, কল্পনায় ফিরিয়ে নিয়ে আসতে চায় ফারহানার মুখটাকে । পারে না । আহ ! প্রিয় মানুষের মুখ কল্পনায় কেন এত দুর্লভ ! দুই চোখ থেকে অঝোরে পানি পড়ছে । দেখার কেউ নেই । মুছে দেওয়ার কেউ নেই ।
------------------------------------------------
ফারহানা আত্মহত্যা করেছে- এই কথাটাকে আদিত্য অসংখ্যবার অস্বীকার করে এসেছে বিগত এক বছরে । তার কাছে মনে হয়েছে ঠাণ্ডা মাথার খুন । বারবার নিজেকে বুঝিয়েছে, ফারহানা তাকে অনেক ভালোবাসতো, সে নিজেও । তাদের মধ্যে তো কোনো কোন্দল ছিল না, তবে কেন ফারহানা নিজের গলায় ফাঁস আটকে আত্মহত্যা করতে যাবে ! কিছুতেই সম্ভব নয় । ফরেনসিক রিপোর্টে এসেছে ভিক্টিমের মৃত্যু হয়েছে শ্বাসরোধে । কিন্তু আদিত্য এই সত্যকে স্বীকার করে নিতে কখনোই প্রস্তুত নয় । সে এটাই বিশ্বাস করে, ফারহানার মৃত্যু আত্মহত্যা না- ঠাণ্ডা মাথার খুন...
গত এক বছরে এই কল্পনার খুনিকে খুঁজে বেড়িয়েছে, প্রতিটি রাজপথে, প্রতিটি অলিতে-গলিতে । সাথে তার পুরোনো ডিএসএলআর । এটা দিয়ে সে একসময় ফারহানার ছবি তুলেছে অসংখ্য, যৌথ স্মৃতির অ্যালবাম ভারি হয়েছে সজীব আলোকচিত্রে । এখন তার ক্যামেরার লেন্সে খুঁজে বেড়াচ্ছে খুনির চেহারা । যাকেই সন্দেহভাজন মনে হয়, তারই ছবি তুলে রাখে সঙ্গোপনে । গত এক বছরে প্রায় এক হাজারের চেয়ে বেশি মানুষের ছবি তুলেছে সে, কিন্তু তাদের মধ্যে খুনিকে খুঁজে পায় নি এখনও । আধ-খাওয়া সিগারেটটা দূরে ফেলে দিয়ে আবার ছবি তোলায় ব্যস্ত হয় সে ।
বাসায় ফিরে দেয়ালটার দিকে একবার চোখ বোলায়, তার তোলা ছবি গুলোর উপর । অশান্ত চিত্তে সবাইকেই তার খুনি বলে মনে হয় । কোথায় ? কে সেই মসৃণ ঘাতক ? খুঁজে খুঁজে ব্যর্থ হয় প্রতিবারই । মাথার ভিতর যন্ত্রণার পোকাটা সচল হয়ে ওঠে, পাগলের মতো পুরো দেয়ালটা হাতড়ে বেড়ায় । আর সহ্য করতে পারে না, এক টানে পুরো ছবির বোর্ডটা দেয়াল থেকে খুলে ফেলে সে ! পকেটের লাইটারটা বের করে আগুন ধরিয়ে দেয় ছবি গুলোতে । পুড়ুক । এভাবেই সবকিছু পুড়ে যাক । পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাক এই অভিশপ্ত জীবন ।
-----------------------------------------
চোখ বন্ধ করে হেলান দিয়ে মেঝেতে বসে আছে আদিত্য, সিগারেট শেষ হয়ে আঙ্গুল ছুঁইছুঁই করছে অঙ্গার । কোন ভ্রূক্ষেপ নেই তার, মাঝে মাঝে চোখ দুটো খুলে দেয়ালের উপরে থাকা ফারহানার ফ্রেমে বাঁধানো ছবিটাকে দেখছে । ফারহানার লিপগ্লস মাখা ঠোঁটে কোনো পরিবর্তন নেই । ভীষণ চুমুর তৃষ্ণা পায় তার । আবার যদি ফিরে পাওয়া যেত ফারহানার ঠোঁটে চুমু খাওয়া সেইসব সোনালী সকাল ।
কতক্ষন এরকম তন্দ্রার মধ্যে সে ছিল ঠিক খেয়াল নেই । চোখ খুলে সে স্তম্ভিত হয়, পাশেই গা ঘেঁষে ফারহানা বসে আছে ! হুড়মুড় করে সে উঠে বসে, নাহ, ভুল দেখছে না ! ফারহানাই তার পাশে এসে বসেছে !
-এ কী, তুমি !
ফারহানার মুখে অসহায়ত্বের ছাপ, চুল গুলো এলোমেলো । বিধ্বস্ত অথচ সেই পরিচিত চিকন কণ্ঠে বলল, ‘আমি বেশিক্ষন থাকবো না। তোমাকে একটা সত্য জানাতে এসেছি ।‘
আদিত্য ধাক্কা সামলে উঠতে পারে নি এখনও । নির্বাক ভঙ্গিতে তাকিয়ে থাকে ফারহানা অথবা তার দৃষ্টিভ্রমের দিকে ।
সহসাই অসহিষ্ণু কণ্ঠে ফারহানা বলে ওঠে, 'না, আমি সুইসাইড করি নি । মনে করে দেখো, তোমার কোন সেন্স ছিল না । তুমি আমাকে এলএসডি খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছিলে । তারপর যেন মনে হল আমি ফ্যানের সাথে ঝুলছি । আমার গলায় ফাঁস আর তুমি আমাকে দেখে কীভাবে হাসছো...'
ফারহানা হারিয়ে যায় আদিত্যের স্বপ্নটা ভাঙ্গার সাথে সাথেই! মোহগ্রস্তের মতো আদিত্য উঠে দাঁড়ায় । কেরুর বোতলে পা কেটে রক্তের বেরিয়ে আসে, আদিত্য সামান্য টলে ওঠে, তবুও কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই সেদিকে । সে এখন অন্য জগতের মানুষ- যে মানুষটি আদিত্যের ভালোবাসাকে ঠাণ্ডা মাথায় খুন করেছে । যে ভালোবাসার মানুষটি আদিত্যকে সুস্থ করার জন্য এত কষ্ট করেছিল, তাকে সে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিয়েছে । আদিত্য এখন সম্পূর্ণ ভিন্ন একজন মানুষ, তার ঠোঁটের কোণে এক চিলতে জান্তব হাসির আভাস ।
১৫টি মন্তব্য ১০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অন্তর্বর্তী সরকারে উপদেষ্টা নিয়োগ কারা দেয় ?

লিখেছেন মেঠোপথ২৩, ১৩ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:০৩

বৈষম্যবিরোধি আন্দোলনের সফল পরিসমাপ্তির পর আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়কেরা ডক্টর ইউনুসকে দেশের ক্ষমতা গ্রহন করার আহবান সেই শহীদ মিনার থেকেই জানিয়েছিল। ডক্টর ইউনুস প্রথমে অরাজি হলেও পরে ছাত্রদের হাজারো অনুরোধের মুখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

গণমুখী একটি চাওয়া

লিখেছেন ডঃ এম এ আলী, ১৩ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:২০


মানুষের মুখে হাসি ফুটুক,
আঁধার মুছে আলোর ছোঁয়া,
ক্লান্তিহীন পথ চলুক,
নতুন স্বপ্ন আনবে জোড়া।

দিনবদলের শপথ নিয়ে,
কাঁধে কাঁধ মিলে কাজ করে যাই,
নদীর স্রোতে ভেসে ভেসে
একটি স্রোতে মিলিয়ে যাই।

সবার তরে সমান বিচার,
ধনীর দুঃখীর,... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলার একমাত্র অভিশপ্ত রাজনৈতিক দল আওয়ামীলীগ

লিখেছেন জ্যাকেল , ১৩ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:৫০

২৩শে জুন বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব জনাব সিরাজ উদ দৌলা ব্রিটিশদের কাছ হেরে যান কেবলমাত্র মীরজাফর, জগৎশেট, রাজভল্লভ, ঘষেটিদের কারণে। বাংলার ইতিহাসে এই দিনটি একটি অভিশপ্ত দিন। এর পর থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের গ্রামের বিয়ের বর দেখা

লিখেছেন প্রামানিক, ১৩ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ২:১৩


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

একদিন পরেই শুক্রবার। সকালেই বাবাকে ঐ বাড়ির ঘরবর (অর্থাৎ বর দেখা অনুষ্ঠানকে আঞ্চলিক ভাষায় ঘরবর বলে) উপলক্ষে ডাকা হয়েছে। বাবা সকালে গিয়ে বর দেখা উপলক্ষ্যে কি কি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ওবায়েদুল কাদের কি মির্জা ফখরুলের বাসায় আছেন?

লিখেছেন রাজীব, ১৩ ই নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৩৮

"পালাবো না, পালিয়ে কোথায় যাবো? দরকার হলে মির্জা ফখরুলের বাসায় আশ্রয় নেবো। কি ফখরুল সাহেব, আশ্রয় দেবেন না?" ওবায়েদুল কাদের একটি জনসভায় এই কথাগুলো বলেছিলেন। ৫ই আগষ্টের পরে উনি মির্জা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×