somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জীবন কীভাবে হয় গোলাপের মত সুন্দর!

২৪ শে আগস্ট, ২০১৩ সন্ধ্যা ৭:৫৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

(এক যুগ আগের লেখা একটি গল্প। জীবনের গল্প জীবনের জন্য। জীবনের গল্প থেকে যারা পেতে চায় জীবনের শিক্ষা, তাদের জন্য। কামনা করি, শুধু গল্প না হয়ে এটি যেন হতে পারে প্রতিটি জীবনের উদ্যানে একটি ‘রক্তজবা’।)
***
আমার ছোট্ট ছেলে, কতই বা বয়স, আটের একটু নীচে বা নয়ের একটু উপরে। আবার হতে পারে আট ও নয়ের মাঝখানে। দুঃখের বিষয়, ছেলের বয়সের সঠিক হিসাবটা আমার জানা নেই। নিজের বয়সের হিসাবটাই রাখতে পারি না ঠিকমত, অথচ একদিন হিসাব দিতে হবে জীবনের প্রতিটি দিনের, প্রতিটি সময়ের এবং প্রতিটি কর্মের!
ছেলের সঙ্গে আমার সম্পর্ক খুব অন্তরঙ্গ। আমাদের যেমন বড় বড় আনন্দ আছে এবং আছে বড় বড় দুঃখ, ছোটদেরও আছে ছোট ছোট আনন্দ এবং ছোট ছোট দুঃখ। এই যে বলছি ‘ছোট’ সেটা শুধু আমাদের দিক থেকে। ওদের দিক থেকে কিন্তু পাখীর বাসায় ডিম আবিষ্কারের আনন্দ এবং খাঁচার পোষা পাখীটা মরে যাওয়ার দুঃখ বড়দের বড় বড় দুঃখ-আনন্দের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। ছোটদের ছোট ছোট দুঃখ বা আনন্দ বড়রা যদি অন্তর দিয়ে অনুভব করতে পারে তখন ছোটদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। বহুদিন আগের একটি ঘটনা মনে পড়ে। কাছের একজন মানুষের সঙ্গে কথা বলছি। এমন সময় দেখি, তার ছোট্ট ছেলেটি বাবার কাছে দৌড়ে আসছে। ছোট্ট মুখের উদ্ভাস থেকেই বুঝতে পারলাম, রোমাঞ্চকর কিছু একটা ঘটেছে। ছেলেটি বাবার কাছে এসে বড় বড় চোখ করে বলতে লাগলো, জানো বাবা, আমার বড়শিতে না, এত্তো বড় একটা পুটিমাছ উঠেছে! কোথায় আমাদের জরুরি আলোচনা, আর কোথায় ছোট্ট একটা ‘বড়’ পুটিমাছ! বন্ধুটি বলে দিলেন, যাও তো! বিরক্ত করো না তো! দেখছো না আমরা কথা বলছি!
হায়রে মা‘ছুম বাচ্চা! কোথায় মুখের সেই উদ্ভাস, কোথায় তার অবুঝ মনের রোমাঞ্চ! একেবারে যেন চুপসে গেলো। ফরসা মুখটা যেন ছাইকালো হয়ে গেলো। মাথাটা নীচু করে অপরাধীর মত আস্তে আস্তে সেখান থেকে সরে গেলো।
পরে পুকুরপাড়ে গিয়ে দেখি, মুখ ভার করে বসে আছে। ছিপটা পাশে পড়ে আছে। মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম, কোথায় দেখি তোমার বড় পুটিমাছটা! আমি ওর বাবা নই, তবু মুখের উদ্ভাসটা ফিরে এলো, পাত্রের ঢাকনাটা সরিয়ে বললো, এই যে, কত্তো বড়, না! বললাম, তাই তো, অনেক বড় তো! চলো আমরা আরো মাছ ধরি! ছেলেটি সেদিন কী যে খুশী হয়েছিলো! এখন সে যথেষ্ট বড় হয়েছে, আর সেই ‘বড়’ পুটিমাছটার কথা বেমালুম ভুলে গেছে!
আমার ছেলের আনন্দের এবং কষ্টের আমি ভাগ নিতে চেষ্টা করি, তাই আমাদের সম্পর্কটা খুব অন্তরঙ্গ। ও যখন আরো ছোট্টটি ছিলো তখন অবশ্য মায়ের কোলই ছিলো ওর সবচে’ প্রিয়। বাবার কোলে খুব একটা আসতে চাইতো না। হাত বাড়ালে মায়ের কোলে আরো যেন গুটিয়ে যেতো। বাবার কোল কি আর হয় মায়ের কোলের মত!
তাই দূর থেকেই দেখতাম, মায়ের কোলে ওঠে কেমন মিষ্টি করে হাসে, আর মায়ের কোলে ওঠার জন্য কেমন মিষ্টি করে কাঁদে!
আমার সঙ্গে ওর বন্ধুত্বটা শুরু হলো যখন মায়ের কোল থেকে নেমে এলো, আর বাবার হাত ধরে বাড়ীর পিছনে ফুলবাগানে যাওয়া শুরু করল।
***
আমি যখন ছোট্ট ছিলাম, বাড়ীর পিছনের অংশে বড় একটা ফুলের বাগান ছিলো, এখনো আছে। তখন ছেলেটি ছিলো না। আমি ছিলাম, আর আমার আববা ছিলেন। এখন আববা নেই। আমি আছি, আর আছে আমার ছেলেটি। তখনো ছিলো যে দৃশ্য, এখনো আছে সেই একই দৃশ্য। তখনো একটি ছোট্ট ছেলে বাবার হাত ধরে ফুলবাগানে ঘুরে বেড়াতো, গাছের যত্ন নিতো। পাতাগুলো মুছে দিতো, গাছের গোড়ায় পানি দিতো। এখনো একটি ছোট্ট ছেলে বাবার হাত ধরে ফুলবাগানে ঘুরে বেড়ায়। গাছের যত্ন নেয়। পাতাগুলো মুছে দেয় এবং গাছের গোড়ায় পানি দেয়। একই দৃশ্য, কিন্তু সেদিনের সেই শিশুটির বাবা আজ নেই। পৃথিবীর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না তাঁকে। তিনি ঘুমিয়ে আছেন এই বাগানেরই এককোণে বকুল গাছের ছায়ায়, মাটির বিছানায়।
সেদিনের সেই শিশুটিও আজ আর শিশু নেই। আজ সে ‘বড়সড়’ এক বাবা। আমার ছোট্ট ছেলেটির বাবা!
এভাবেই চলছে পৃথিবীর শুরু থেকে। আজকের বাবা কোথায় যেন হারিয়ে যায়, আর আজকের শিশু অন্য শিশুর বাবা হয়ে যায়! এভাবেই চলবে পৃথিবীর শেষ পর্যন্ত। বাবারা চলে যাবে অনন্তযাত্রার মিছিলে, শিশুরা বাবা হবে, আর নতুন শিশুর আগমন ঘটবে পৃথিবীর ‘মিলন-বিচ্ছেদের’ মেলায়। ফুলবাগানে যেমন পুরোনো ফুলগুলো ধীরে ধীরে ঝরে যায়, আর নতুন কলিরা ফুল হয়ে ফোটে বৃক্ষশাখায়।
***
মন বিষণ্ণকরা এসব চিন্তা অকারণে ছিলো না। এই মাত্র ছোট্ট ছেলেটি বুকভরা উচ্ছ্বাস নিয়ে খবর দিলো, বাড়ীর বাগানে ওর লাগানো গোলাবগাছে গোলাব ফুটেছে! এই বাগানে সেই ছোট্টকালে আমিও একটি গোলাবচারা রোপণ করেছিলাম। ধীরে ধীরে তা বড় হয়েছিলো এবং একদিন তাতে একটি কলি এসেছিলো, কিন্তু ... থাক আমার শৈশবের কষ্টের কথা, তার চেয়ে ছেলেটির আনন্দের কথাই শুধু বলি।
আমার ছোট্ট ছেলেটি এবং তার মত ছোট ছোট যেখানে যত শিশু আছে, তাদের যেমন নিশ্চিন্ত জীবন, খেলাধূলা ও হাসি-আনন্দের জীবন, আমরা যারা বড়, আমাদের জীবন তো আর তাদের মত নয়। আমাদের জীবনে কত ঝড়ঝাপটা, কত আঘাত, সংঘাত! আমাদের জীবনে শুধু অশ্রু ঝরে না, রক্তও ঝরে। যখন আমরা কোন শিশুর সান্নিধ্যে থাকি, তাদের সঙ্গে কথা বলি তখন আমাদের জীবনটাও হয়ে যায় নির্মল আনন্দের। আসলে ওদের হাসি-আনন্দ আমাদেরও স্পর্শ করে। কিন্তু কতক্ষণ আমরা সময় দিতে পারি শিশুদের, কিংবা ওরা আমাদের! আসলে তখনই জীবনটা আমাদের হয়ে পড়ে বড় কষ্টের, বড় নির্দয়তা ও নির্মমতার!
সেদিন বাড়ীর বারান্দায় চেয়ার পেতে একলাটি বসেছিলাম, ছেলেরা মেয়েরা লুকোচুরি খেলছিলো। কে কোন্ বাড়ীর ছেলে বা মেয়ে, সবাইকে চিনিও না, তবু মনে হলো কত যেন আপন! কী নির্মল আনন্দের জীবন! যেন আমারই শৈশব অসংখ্য পাপড়ী মেলে আমার চোখের সামনে! ওদের আনন্দকলরোলে হারিয়ে কখন যেন আমি চলে গিয়েছিলাম নিজের শৈশবজীবনে। কেমন ছোট্টটি ছিলাম! আমারও হাসি-আনন্দ ছিলো! আমারও কান্না ছিলো, বায়না ছিলো, দোলনা ছিলো, খেলনা ছিলো! বাবার হাত ধরে ফুলবাগানে আমিও ঘুরে বেড়াতাম! ...
হঠাৎ চিন্তার জাল ছিঁড়ে গেলো একটি কচি কণ্ঠের উচ্ছ্বাসে! ‘আববু, দেখে যাও, দেখে যাও, আমার গোলাবগাছের সেই কলিটা না, আজ ফুটেছে! কী সুন্দর গোলাব হয়েছে!’
আমার ছোট্ট ছেলেটি পিছন থেকে এসে গলা জড়িয়ে ধরলো। ওর আনন্দ যেন আর ধরে না! হায়, ও কী করে বোঝবে আমার হৃদয়ে এখন কত রক্তক্ষরণ হচ্ছে! দেশে এখন কত জুলুম অত্যাচার! জীবন এখন কত নিরাপত্তাহীন! প্রতিদিন কত মানুষের রক্ত ঝরে! কত বুক ঝাঁঝরা হয়!
ছেট্ট ছেলের, ছোট্ট মেয়ের আনন্দঝলমল মুখমন্ডল কিছুক্ষণের জন্য হলেও সব কষ্ট- ব্যথা দূর করে দেয়; মনের আকাশের সব মেঘ-ছায়া মুছে দেয়। আমার ছেলেটির আনন্দ-ঝলমল মুখমন্ডল দেখে আমিও যেন সবকিছু ভুলে গেলাম। জীবনের কোথাও যেন হিংসা-বিদ্বেষ নেই, আছে শুধু স্নেহ-মমতা, আর ভালোবাসা! কোথাও গোলাগুলির আওয়ায নেই, মৃত্যুর আর্তনাদ নেই, আছে শুধু পাখীর গান! জীবন যেন শুধু ফুলবাগিচা, আর কলিদের ফুল হয়ে ফোটা! একটি শিশুর বাগানে গোলাবগাছে একটি কলি ফুল হয়ে ফোটা কত আনন্দের! আবার একটি কলি ফুল হয়ে ফোটার আগেই ঝরে যাওয়া কত বেদনার তা আমি বেশ অনুভব করতে পারি। কারণ আমিও একদিন ছোট্ট শিশুটি ছিলাম। আমি ছিলাম, আববা ছিলেন। আমার ছেলেটি ছিলো না, আর ঐ যে বকুলগাছটা, তখন এত বড়টি ছিলো না। আমি যেমন ধীরে ধীরে বড় হলাম এবং আমার শৈশব হারিয়ে গেলো, তেমনি বকুলগাছটাও ধীরে ধীরে বড় হলো, আর তার শৈশব হারিয়ে গেলো। তারপর একদিন আববা হারিয়ে গেলেন।
আমার গোলবগাছের কলিটা যেদিন ফুল না হয়েই ঝরে গিয়েছিলো সেদিন অনেক কষ্ট হয়েছিলো এবং অনেক কান্না পেয়েছিলো। লুকিয়ে লুকিয়ে অনেক কেঁদেছিলাম, কেউ দেখেনি, শুধু আববা দেখেছিলেন। আববা সেদিন সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলেন, ‘যারা অনেক বড় হবে তাদের এভাবে কাঁদতে নেই। দেখো, তোমার গোলাবগাছে আবার কলি আসবে, সেই কলি আর ঝরে যাবে না, ফুল হয়ে ফোটবে।’
আববা আরো বলেছিলেন, ‘সেদিন আমিও তোমার সঙ্গে যাবো। আমিও দেখবো তোমার গোলাবগাছের গোলাবফুল। আর দেখবো, কার হাসি বেশী সুন্দর, তোমার মুখের হাসি, না গোলাবফুলের হাসি!’
এভাবে বিভিন্ন কথা বলে আববা আমাকে অনেক সান্ত্বনা দিয়েছিলেন।
আববার যেদিন মৃত্যু হলো সেদিন অনেক কেঁদেছিলাম। শুভ্র-সুন্দর কাফনে আববাকে যখন শুইয়ে দেয়া হলো বকুলগাছের নীচে কবরের মাটিতে, আমার অনেক কান্না পেয়েছিলো, কিন্তু সেদিন আমাকে সান্ত্বনা দেয়ার কেউ ছিলো না।
দুপুরে সবাই যখন ঘুমিয়ে থাকতো, আমি চুপি চুপি বকুলগাছের নীচে আববার কবরের সামনে গিয়ে দাঁড়াতাম। আমার খুব কান্না পেতো। বকুলগাছটা মনে হয় আমার কান্না শুনতে পেতো। হয়ত বকুলগাছটারও মন কাঁদতো। একদিন ভোরে গিয়ে দেখি আববার কবর ছেয়ে আছে বকুল ফুলে। সেদিন থেকে আমার কান্না থেমে গেলো। বকুলগাছটি যেন আববার কবরে ফুল বিছিয়ে আমাকে সান্ত্বনা দিলো। আমি কৃতজ্ঞতার সঙ্গে বকুলগাছটির দিকে তাকালাম। ....
আবার চিন্তার জালটা ছিঁড়ে গেলো।
‘চলো না আববু!’ ছেলেটা হাত ধরে আমাকে চেয়ার থেকে টেনে তুললো। বললাম, ‘চলো যাই তোমার বাগানে তোমার গোলাবফুলের কাছে।’
আবার সেই একই দৃশ্য! একজন বাবার হাত ধরে ফুলবাগানে একটি ছোট্ট শিশুর হেঁটে চলার দৃশ্য! বহুবছর আগে এই বাগানেরই দৃশ্য! তখন আমি ছিলাম, আববা ছিলেন। আববার হাত ধরে ছোট্ট আমি হেঁটে গিয়েছিলাম বাগানের একই জায়গায় নিজের হাতে লাগানো আমার গোলাবগাছের কাছে, একটি ফুটন্ত গোলাবের সৌন্দর্য আববাকে দেখাবো বলে। কিন্তু ...
বাহ, বেশ সুন্দর গোলাবফুলটি তো! সত্যি অবাক হওয়ার মত সুন্দরই ছিলো গোলাবফুলটি। একবার আমি ছোট্ট ছেলেটির চিবুক ধরে আদর করি, একবার হাত বুলিয়ে গোলাবফুলটিকে আদর জানাই। একসময় ছোট্ট ছেলেটির উদ্ভাসিত মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম, দেখি তো, কার হাসি বেশী সুন্দর, তোমার মুখের হাসি, না গোলাবফুলের হাসি!
কথাটা বলেই চমকে উঠলাম। ঠিক একথাই তো বলেছিলেন একদিন একজন আববা একটি ছোট্ট শিশুকে! আমার আববা আমাকে!!
সেদিন গোলাবের কলিটি পড়ে ছিলো নীচে মাটিতে। সেই ঝরে যাওয়া গোলাব-কলিটির উপর আমার চোখ থেকে ঝরেছিলো দু’ফোটা অশ্রু। কেন ফুটেনি গোলাবের কলিটি?! আমার সঙ্গে কি তার কোন অভিমান ছিলো?! আমি তো অনেক যত্ন করে পানি দিতাম গাছের গোড়ায়, এখন যেমন আমার ছেলেটি রোজ সকালে পানি দেয় তার গোলাবগাছের গোড়ায়!
কল্পনায় চলে গিয়েছিলাম দূর অতীতে আমার শৈশবের সেই দৃশ্যগুলোর কাছে; মাটিতে পড়ে থাকা সেই গোলাব-কলিটির কাছে। ছেলের কথায় ফিরে এলাম বর্তমানে, বড় সুন্দর হয়ে ফুটে থাকা গোলাবফুলটির কাছে। ‘আববু, জীবন কীভাবে গোলাবের মত সুন্দর হয়?’
আবার অবাক হলাম, আশ্চর্য! আজকের শিশুটির মাঝে বারবার কীভাবে ফিরে আসছে চল্লিশ বছর আগের সেই শিশুটি!
বকুলগাছের ছায়ায় মাটির বিছানায় যিনি শুয়ে আছেন তাঁর হাত ধরে একদিন একটি ছোট্ট শিশু ঘুরে বেড়াচ্ছিলো এখানে এই বাগানে; আমি এবং আমার আববা। আমার চিবুক ধরে আদর করে আববা বলেছিলেন, ‘তোমার জীবন যেন হয় গোলাবের মত সুন্দর।’
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, আববা, জীবন কীভাবে গোলাবের মত সুন্দর হয়?
আববা বলেছিলেন, এককাজ করো; এখানে এই মাটিতে একটি গোলাবের চারা রোপণ করো। তারপর প্রতিদিন গাছটির যত্ন নাও; গাছের গোড়ায় পানি দাও। তোমার হাতে লাগানো গোলাবের ছোট্ট চারাটি ধীরে ধীরে বড় হবে। একদিন তাতে কলি আসবে। সেই কলি ফুল হয়ে ফোটবে। তখন তোমাকে বলবো, জীবন কীভাবে গোলাবের মত সুন্দর হয়।
আমি গোলাবের চারা রোপণ করেছিলাম। আমার যত্নে ধীরে ধীরে তা বড় হয়েছিলো এবং সত্যি সত্যি একদিন তাতে কলি এসেছিলো। গোলাবগাছের প্রথম কলিটি দেখে কী যে আনন্দ হয়েছিলো! মনে হয়েছিলো, গাছটি আমার খুব ভালো বন্ধু। আমি যে এত দিন গাছটির যত্ন নিয়েছি, গোড়ায় পানি দিয়েছি, তাই আমাকে সে একটি গোলাব ফুল উপহার দেবে।
একটি গোলাব কীভাবে ধীরে ধীরে ফুল হয়ে ফোটে, তা দেখার আমর খুব ইচ্ছে ছিলো। তাই সকাল-সন্ধ্যা কলিটিকে গভীরভাবে লক্ষ্য করতাম, কিন্তু বুঝতে পারতাম না, কলিটি কীভাবে বড় হচ্ছে। ভাবতাম, কলিরা হয়ত রাতে বড় হয়। কেউ যেন বলেছিলো, যখন রাত হয়, বাগানে অন্ধকার নামে তখন ফুলপরীরা আলোর ডানা মেলে আকাশে তাদের রাজ্য থেকে উড়ে আসে। বাগানে বাগানে ঘুরে বেড়ায়; ফুলকলিদের আদর করে, তাতে ফুলকলিরা ধীরে ধীরে জেগে ওঠে এবং ফুল হয়ে ফোটে। ফুলপরীরা ফুলকলিকে চুমু খায়, তাতে ফুলপরীদের শরীরের সুবাস ফুলকলিদের গায়ে মেখে যায়।
অবাক হয়ে ভাবতাম, আমাদের বাগানেও কি ফুলপরীরা আসে! আলোর ডানা মেলে উড়ে বেড়ায়! গোলাব-কলিদের আদর জানায়, চুমু খায়! রাতের অন্ধকারে লুকিয়ে লুকিয়ে ফুলপরীদের কি দেখা যায়!
একদিন দেখি, গোলাব-কলির সবুজ আবরণের ফাঁকে একটু লালের আভাস দেখা যায়! আমার তখন কী যে আনন্দ! আববাকে দেখালাম, আম্মাকে দেখালাম। আমার খুশিতে তারাও খুশী হলেন।
দু’দিন পর, সবুজের আবরণ আরো ফাঁক হলো; আরেকটু লাল দেখা গেলো। আমি যেন আর অপেক্ষা করতে পারি না; আর যেন দেরী সয় না। ফুলপরীরা এত ধীরে ধীরে কলিদের ফোটায় কেন?!
তারপর একদিন দেখি, গোলাবের কলিটি মুখ খুলেছে। আববা বললেন, আম্মা বললেন, আগামীকাল ভোরে কলিটি সম্পূর্ণ ফোটবে। আমি অস্থির মনে অপেক্ষা করছি ভোরের জন্য। কখন রাত হবে, কখন রাত ভোর হবে, আর আমার গোলাবগাছের প্রথম কলিটি গোলাব হয়ে ফোটবে! তখন আববা আমাকে বলবেন, জীবন কীভাবে গোলাবের মত সুন্দর হয়?!
সেদিন রাতে স্বপ্নে দেখি, আমি একা একা বাগানে গিয়েছি। বাগানে অন্ধকার। কিছুই দেখা যায় না। কেমন যেন ভয় ভয় করছে। হঠাৎ দেখি, বাগানে আর অন্ধকার নেই। চারদিকে কী ফকফকে আলো, কেমন মিষ্টি সুবাস! আর দেখি, আলোর ডানা মেলে আকাশ থেকে নেমে আসছে ফুটফুটে সুন্দর এক ফুলপরী! ফুলপরী আমার ঠিক সামনে এসে নামলো। আমাকে দেখে কী সুন্দর করে হাসলো! সে হাসিতে যেন মুক্তো ঝরে! পরীরা এত সুন্দর! পরীদের ডানায় এতো আলো! গায়ে এত সুবাস!! ফুলপরী আলোর ডানা দুলিয়ে আমাকে আদর জানালো, আর বললো, এসো খোকামণি, তোমার গোলাবগাছের কাছে এসো। দেখো, আলোর ডানা বুলিয়ে কীভাবে কলি থেকে ফুল ফোটাই।
ফুলপরীকে আমার খুব ভালো লাগলো। ফুলপরীর কথা শুনে খুব আনন্দ হলো। গোলাবগাছটির কাছে গেলাম। আমি শুধু দেখছি, ফুলপরী কী করে; কীভাবে কলি থেকে ফুল ফোটায়! যেই না ফুলপরী গোলাব-কলিটির গায়ে আলোর ডানা বুলিয়ে দিলো, অমনি গোলাব-কলিটি একটি বড় লাল গোলাব হয়ে গেলো! আনন্দে আমি চিৎকার করে উঠলাম, কী সুন্দর! কী সুন্দর!
চিৎকার শুনে আম্মা ছুটে এলেন, আববা ছুটে এলেন। তখন বুঝলাম, এ ছিলো সুন্দর এক স্বপ্ন! আমি বাগানে গিয়েছিলাম, তবে স্বপ্নে! ফুলপরী আমাদের বাগানে এসেছিলো, তবে স্বপ্নে! কিন্তু ফুলপরী যে আলোর ডানা বুলিয়ে গোলাবের কলি থেকে ফুল ফুটিয়েছে, সেও কি শুধু স্বপ্নে?! না, না এটা স্বপ্ন হতে পারে না। নিশ্চয় বাগানে গোলাবগাছে একটি বড় লাল গোলাব ফুটে আছে। গোলাবের পাপড়িতে নিশ্চয় শিশির পড়েছে। গোলাবের পাপড়িতে যখন শিশির পড়ে, দেখতে বড় সুন্দর হয়। আজ আমি জানবো, জীবন কীভাবে গোলাবের মত সুন্দর হয়?!
***
ভোর হলো; ফজরের আযান হলো। ভোরে ফজরের আযানের ধ্বনি শুনতে আমার খুব ভালো লাগে। আজকের ফজরের আযান আরো ভালো লাগলো। প্রতিটি শব্দে যেন গোলাবের সুবাস। ইচ্ছে হলো, এখনই ছুটে যাই বাগানে গোলাবগাছটির কাছে। কিন্তু না, আগে আমি আবার সঙ্গে মসজিদে যাবো। ফজরের নামায পড়বো। তারপর আববার হাত ধরে বাগানে যাবো। আজকের ফোটা লাল গোলাবটির সামনে দাঁড়িয়ে আববা আমাকে বলবেন, জীবন কীভাবে গোলাবের মত সুন্দর হয়!
ফজরের নামায হলো। আববার হাত ধরে ধীরে ধীরে মসজিদ থেকে বের হলাম এবং বাড়ীর পিছনে ফুলবাগানে গেলাম। যেখানে আমার এত আদরের, এত যত্নের গোলাবগাছটি সেদিকে এগিয়ে গেলাম। কিন্তু একি! কোথায় গোলাবের কলি! কোথায় আমার লাল গোলাব!!
আবার হাত ছেড়ে আমি দৌড়ে গেলাম গোলাবগাছটির কাছে। নীচে মাটিতে পড়ে আছে আধফোটা গোলাবের কলিটি! আমার ছোট্ট বুকটা তখন কেমন করে উঠলো। খুব কান্না পেলো। চোখ থেকে দু’ফোটা অশ্রু ঝরে পড়লো মাটিতে পড়ে থাকা আধফোটা গোলাব-কলিটির উপর।
আববা আমাকে সান্ত্বনা দিলেন। বললেন, দেখো, তোমার গোলাবগাছে আবার কলি হবে, সেই কলি অবশ্যই ফুল হয়ে ফোটবে।
আববা অনেক কথা বললেন, শুধু বলা হলো না, জীবন কীভাবে গোলাবের মত সুন্দর হয়!
***
আমি হারিয়ে গিয়েছিলাম দূর অতীতে আমার শৈশবের বেদনাময় স্মৃতির মাঝে। ভুলেই গিয়েছিলাম, আমি এখন সেই ছোট্ট শিশুটি নই। এখন আমি দাঁড়িয়ে আছি একটি শিশুর হাত ধরে একটি গোলাবগাছের সামনে, যার ডালে ফুটে আছে সুন্দর একটি লাল গোলাব! যে ফুল সেদিনের সেই শিশুটির গাছে ফুটেনি, আজ তা ফুটেছে আজকের শিশুটির হাতে লাগানো গাছের ডালে।
আবার সেই প্রশ্ন! আজকের বাবার উদ্দেশ্যে আজকের ছোট্ট শিশুটির প্রশ্ন! ‘বলো না আববু, জীবন কীভাবে গোলাবের মত সুন্দর হয়!
ছোট্ট ছেলেটিকে আদর করে কাছে টেনে নিলাম, চিবুক ধরে আদর করে বললাম, হাঁ, আজ আমি তোমাকে বলবো, জীবন কীভাবে গোলাবের মত সুন্দর হয়!
দেখো, তোমার বাগানে গোলাবের কলিটি ধীরে ধীরে বড় হয়েছে এবং আজ পূর্ণ একটি গোলাব হয়ে ফুটেছে। মানবশিশুও পৃথিবীর বাগানে গোলাবের কলি। সেও ধীরে ধীরে বড় হয় এবং একসময় একজন পূর্ণ মানুষ হয়। সবাই কেন ভালোবাসে গোলাবকে? কেননা গোলাব মানুষকে সুবাস দেয়। গোলাবের সুবাসে বাগানের মাটিও সুবাসিত হয়। একজন বড় জ্ঞানী ছিলেন শেখ সা‘দী। জ্ঞানী ছিলেন এবং কবি ছিলেন। তাঁর একটি কবিতা এরকম, ‘বাগানে একটি মাটির ঢেলা হাতে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, তুমি তো ফুল নও, তোমার এত সুবাস কেন? মাটির ঢেলা বললো, আমি তুচ্ছ মাটির ঢেলা, কিন্তু ছিলাম গোলাবের সান্নিধ্যে। তাই গোলাবের সুবাস এসেছে আমারও গায়ে।’
তুমি যদি সুন্দর চরিত্র অর্জন করতে পারো তাহলে তোমার সুন্দর চরিত্রের সুবাসে সারা পৃথিবী সুবাসিত হবে এবং মানুষ তোমাকে গোলাবের মত ভালোবাসবে। চরিত্রের সৌন্দর্য দ্বারাই তোমার জীবন হতে পারে গোলাপের মত সুন্দর।
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৮ ই মে, ২০২৪ ভোর ৬:২৬

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।
প্রথমত বলে দেই, না আমি তার ভক্ত, না ফলোয়ার, না মুরিদ, না হেটার। দেশি ফুড রিভিউয়ারদের ঘোড়ার আন্ডা রিভিউ দেখতে ভাল লাগেনা। তারপরে যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদ না কী মার্কেট!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৯

চলুন প্রথমেই মেশকাত শরীফের একটা হাদীস শুনি৷

আবু উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইহুদীদের একজন বুদ্ধিজীবী রাসুল দ. -কে জিজ্ঞেস করলেন, কোন জায়গা সবচেয়ে উত্তম? রাসুল দ. নীরব রইলেন। বললেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আকুতি

লিখেছেন অধীতি, ১৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০

দেবোলীনা!
হাত রাখো হাতে।
আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে বিষাদ নেমে আসুক।
ঝড়াপাতার গন্ধে বসন্ত পাখি ডেকে উঠুক।
বিকেলের কমলা রঙের রোদ তুলে নাও আঁচল জুড়ে।
সন্ধেবেলা শুকতারার সাথে কথা বলো,
অকৃত্রিম আলোয় মেশাও দেহ,
উষ্ণতা ছড়াও কোমল শরীরে,
বহুদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ক- এর নুডুলস

লিখেছেন করুণাধারা, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৫২



অনেকেই জানেন, তবু ক এর গল্পটা দিয়ে শুরু করলাম, কারণ আমার আজকের পোস্ট পুরোটাই ক বিষয়ক।


একজন পরীক্ষক এসএসসি পরীক্ষার অংক খাতা দেখতে গিয়ে একটা মোটাসোটা খাতা পেলেন । খুলে দেখলেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু

২-১ : আলিফ-লাম-মীম


আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

×