অরিন্দম এখন রাতের বেলাতেও সানগ্লাস পরে থাকে, কারন আলো অসহ্য লাগে ওর। হাতে পরে চামড়ার দস্তানা; কারন হাত পা প্রচন্ড কাঁপে তার। যতটুকু পারে ঢেকেই রাখে নিজেকে। পৃথিবী থেকে যতটা সম্ভব আড়াল থাকতে চায়। হাতে একটা চিকন ছড়িও থাকে। সন্ধ্যা সাতটায় এমন বেশ-ভুষা নিয়েই হাজির হল। লোকটা এখনো আসেনি। অপেক্ষা করতে হবে, কতক্ষন কে জানে। বেশীক্ষণ একটানা দাঁড়িয়ে থাকা যায়না। গাড়িটা দূরে রেখে আসতে হয়েছে, লোকটার নিষেধ আছে। নাহলে গাড়িতে বসা যেত। ফোন এল।ভাইস চেয়ারম্যান অফ দ্যা বোর্ড অফ ডিরেকটরস্ এর ফোন। কানে নিয়েই মোটামুটি অশালীন ভাষায় বলে দিল – আমি আর কিচ্ছু করতে পারবনা। কাগজপত্র যা করার সব আপনি, আই স্যায়্ এগেইন, ইউ মিস্টার আব্রাহাম... মেক রেডী এন্ড কাম টু মি অনলি ফর সাইনিং। বিফোর দ্যাট, ডোন্ট ডিসটার্ব মি। বাই...
নিজের স্বত্তাধিকার কোম্পানীর বোর্ড অফ ডিরেক্টরস্দের হাতে অর্পন করার ঘোষনাটায় সবাই মনে হয় খুব অবাক অথবা হতাশ হয়েছে। ভালই চলছিল সবকিছু তার দায়িত্বে। এখন দায়িত্ব ছেড়ে দেয়াটা সবার জন্যই অশুভ হয়ে দেখা দিয়েছে। পুরনো পার্টনার আর বিশ্বস্তরা চাচ্ছেনা অরিন্দম চেয়ারম্যান পদ থেকে চলে যাক।
একটা ছায়া দেখে চকিতে সজাগ হল অরিন্দম। নিশব্দে এগিয়ে এল ছায়া। পুরো মুখ আচ্ছন্ন অন্ধকার, চেহারা চেনার উপায় নেই; অবশ্য তেমনি কথা ছিল। উচ্চতায় প্রায় ৬ ফুট ২ ইঞ্চি হবে। সুঠাম স্বাস্থ্য। নিশ্চয়ই সুপুরুষ। আশ্চর্য! ভাবা যায় এই লোকটা একটা প্রফেশনাল কিলার! সে রাজনৈতিক হত্যাকান্ডগুলো অতি সুন্দরভাবে সম্পন্ন করে। কেউ ধরতেই পারেনা, পত্রিকাগুলো খুনের দায় ছিঁচকে সন্ত্রাসীদের উপরে চাপিয়ে দিয়ে শান্ত হয়ে যায়। সত্যিই জিনিয়াস।
“মিঃ এক্স...?” অরিন্দম জিজ্ঞেস করে।
“এফারমেটিভ।”
“অ্যানি আইডেন্টিফিকেশন...?”
“কাজের কথা বলুন। আমার সময় নেই।”
“আচ্ছা”, অরিন্দম নিশ্চিত হল, “একটা মানুষকে খুন করতে হবে। কোন ইভিডেন্স থাকবেনা, কোথাও খবর যাবেনা। আর সবচে বড় শর্ত, যাকে খুন করা হবে সে মৃত্যুর এক সেকেন্ড আগেও জানবেনা যে কি উপায়ে সে মারা যাচ্ছে।”
মিঃ এক্স মুহূর্তখানেক কি ভাবল। “টার্গেট কে?”
এই প্রশ্নটার উত্তর দিতে পৃথিবীর তাবৎ মানুষের আরো দীর্ঘক্ষণ লাগত যদি সে অরিন্দমের জায়গায় থাকত।
“মি”।
“হোয়াট! আর ইউ ইনসেইন?”
“নো, আই অ্যাম টোটালি কনশাস্। আমি পুরো পেমেন্ট আপনাকে এখনই দিয়ে যাব, আই বিলিভ আপনার প্রফেশনাল ইথিক্সে পালানোর নীতি নেই”।
“ল্যাংগুয়েজ প্লিজ...” মিঃ এক্সের নির্লিপ্ত গলা, “কবে?”
“কোন সময় নেই। আপনি আমার অজান্তে আসবেন। কখন আসবেন আমি জানবনা। তবে সেটা হতে হবে আগামী ছয় মাসের মধ্যে”।
“প্রশ্ন করা যদিও আমার কাজ না, কিন্তু এই প্রথম আমার খুব অবাক লাগছে একজন মানুষ কেন নিজেকে মারতে চাবে...!”
এই প্রশ্নের উত্তর অরিন্দমের কাছে আছে। কিন্তু সেটা হন্তাকারীকে বললনা। বরং আগের কথার সাথে আরো যোগ করল “আমার সাথে আপনার এটাই প্রথম এবং শেষ দেখা। এই চুক্তি বাতিল করার কোন উপায় রাখলাম না। আমার সাথে যোগাযোগ করারও কোন উপায় থাকবেনা।মানে ইউ হ্যাভ টু ডু ইট, অ্যানিহাউ। আমার ডেথের আগে যদি আপনাকে অনুনয় করি তাহলেও না।”
ছায়াশরীরের সাথে কথা হচ্ছে, কোন ভাব-অভিব্যক্তি বোঝা যাচ্ছেনা। অরিন্দম একটা খাম বের করে কাঁপা হাতে বাড়িয়ে দিল, ওটাতে একটা এক কোটি টাকার চেক। ছায়াশরীর নীরবে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। উল্টো ঘুরে চলে আসল অরিন্দম। ভয় ছিল, তখনি না পেছন থেকে গুলি করে মেরে ফেলে! মারেনি। কাজ হচ্ছে। ভয় থেকে একটা উত্তেজনা পাওয়া যাচ্ছে। আচ্ছা! কেমন করে মারতে পারে লোকটা? ভাবতে লাগল সে। অনেকদিন পর তাও কিছুটা অর্থবোধক মনে হচ্ছে জীবন।
* * *
দুইটা সপ্তাহ কিছুই ঘটলনা। তবে কি ছয় মাস মেয়াদের একদম শেষের দিকে কাজটা করবে? এসব ভাবতে ভাবতেই দিন যায়। তাও ভাল, অন্য চিন্তা মাথায় আসেনা। অরিন্দম তার প্রাসাদপ্রোদম বাড়িটা থেকে বের হতোনা। ভেবে দেখল, না বের হলে গুপ্তহন্তা কিভাবেই বা মারতে আসবে? নিজের বাড়িতে সে মরতে চায়না। কাজেই সে অল্প-বিস্তর বের হওয়া শুরু করল। পার্কে বা শপিং মলে, নিত্য সদাইগুলো করতে ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে। সবগুলো চাকর বাকরকে চিরজীবনের মত ছুটি দিয়ে দেয়া হয়েছে। শুধু আছে বিশ্বস্ত বৃদ্ধ শেখ।
এখন আর দিনক্ষন সে মনে রাখেনা। প্রায় দুই সপ্তাহ পর বলা চলে, ট্রলি নিয়ে বাজার করার সময় একটা মহিলা তার সাথে ধাক্কা খেল। ধাক্কায় হুমড়ি খেয়ে মেঝেতে আছড়ে পরে ‘মাগো মাগো’ করতে লাগল।অরিন্দমের প্রথমেই যে জিনিসটা ভাল লাগল তা হল মহিলার দীঘল লম্বা চুল, সে চুলে যেন বন্দীনি হয়ে আছে। মেঝেতে বেকায়দায় পরে থাকা দেহে অসংখ্য স্নিগ্ধ বক্রতা, নিখুঁত সব অঙ্গ। ভদ্রমহিলা চুলের শিকল ভেঙে, আঁচল ঠিক করে যখন ত্যাক্ত চোখে তাকালেন তখন বোঝা গেল বয়স যতটা ভেবে নেয়া হয়েছিল তার চেয়ে কম। ২৭-২৮ হবে, নতুন বিয়ে হয়েছে হয়ত।
“আরি কি অসভ্য! ধাক্কা দিয়ে ফেলেছে আবার উঠানোর কোন চেষ্টা নেই...”
সম্বিৎ ফিরল মুগ্ধ হয়ে যাওয়া অরিন্দমের। অনেকদিন এমন অকৃত্রিম সৌন্দর্য দেখেনা, কর্পোরেট সুন্দরীরাই ভিড় করে ছিল জীবনে। সে দুঃখিত বলে হাত বাড়িয়ে দিল, নরম ছোট্ট হাতটা ভরে দিল মহিলা।
খুঁটিনাটি অভিযোগ অনুযোগ মীমাংসা হলে মেয়েটা চলে গেল। এই প্রথম কোন একটা ব্যাক্তির কাছে সে ঘেঁষতে পারলনা। নিজের অর্থ-সম্পদ, ব্যাক্তিত্বের তীক্ষ্ণতা ভেদ করে ঢুকতে পারলনা। মেয়েটার উঁচু কপাল, টানা টানা চোখ আর অভিমানী গাল ক্রমাগত ভাবনার রেশ রেখে গেল। তন্ময় হয়েই যাচ্ছিল এমন সময় মোবাইল বাজল। দেখা গেল মেঝেতে বেশ দূরে একটা মোবাইল ফোন পরে আছে। নিশ্চয়ই মেয়েটার হবে। অরিন্দম তুলে হ্যালো বলার আগেই একটা মেয়ে কন্ঠ অনর্গল মোবাইলটা ফেরত দেয়ার জন্য অনুনয় করা শুরু করল। সে ভেবেছে চুরি হয়েছে। অরিন্দম ইচ্ছে করেই তার বাসার ঠিকানা জানতে চাইল ফেরত দিতে আসার জন্য, যদিও জানে মেয়েটা খুব বেশী দূরে নেই।
* * *
“ও, আপনি!” মেয়েটা অরিন্দমকে দেখে চিনে ফেলল। তবে মিথ্যা বলায় তেমন সমস্যা হয়নি। চায়ের প্রস্তাব দিল। ছোট্ট ছিমছাম একটা ফ্ল্যাটে থাকে, সাজানো গোছানো – এতই যে মনে হয় আর কোন মানুষ থাকেনা। কথায় সেটাই প্রতীয়মান হল। মহিলার স্বামী বিয়ের পরপরই তাকে রেখে চলে গেছে বিদেশে, চাকরীর প্রয়োজনে এক-দেড় বছরের জন্য। তাই সে একাই থাকে।
“আপনার নামটা জানতে পারি?” অরিন্দম জানতে চাইল।
“ও বলিনি! ঈশিতা।” চায়ে একটা চুমুক দিল, “আপনার?”
“অরিন্দম, অরিন্দম চৌধুরী।”
মেয়েটা হা হা করে হেসে উঠল। “কি হল?” অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল অরিন্দম।
“না, আমার হঠাৎ করে মনে হল আপনি আবার অরিন্দম গ্রুপ অফ কোম্পানীজের অরিন্দম না তো? হাস্যকর।”
“হাস্যকর কোনটা? আমি আসলেই সেই অরিন্দম সেটা?”
“হ্যাঁ!!!...” ঈশিতার চোয়াল ঝুলে পড়ল। হাঁ হয়ে গেছে মুখ। অরিন্দম গ্রুপ অফ কোম্পানীজের চেয়ারম্যান অরিন্দম চৌধুরী স্বয়ং তার সামনে বসে আছে বোধ হয় বিশ্বাস করতে পারছেনা। তার বাবা হাসান মাসুদ চৌধুরী যখন কোম্পানী প্রতিষ্ঠা করেন তখন ছেলের নামে নাম রাখেন ‘অরিন্দম’। উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত কোম্পানীকে অরিন্দম বিচক্ষণতায় বাড়িয়ে নিয়েছে কয়েকগুণ।
“সরি, সরি। আমি আপনার সাথে মিসবিহেইভ করেছি, সরি।” ঈশিতা পরিচয় পর্বের পর থেকে সবকিছুর জন্য ক্ষমা চাইল।
“ইটস্ ওকে। প্লিজ।”
এভাবেই পরিচয়। আরো অনেকক্ষন কথা হয়েছিল। যত কথা গড়িয়েছে তত অরিন্দম ঈশিতার গভীর থেকে গভীরতম মহিমার ফাঁদে পড়েছে। তার জন্য আর প্রেম নয়, কিন্তু জীবনের শেষ দিনটা পর্যন্ত এমন মোহে থাকলে ক্ষতি কি? কিছু জিনিস খটকা লেগেছে ওর ঈশিতার ব্যাপারে, কি সেটা ধরতে পারেনা কিন্তু তাতে কিছু আসেও যায়না।
ক’দিন পরেই ঈশিতার জন্মদিন ছিল। তারজন্য পুরো এক রুম ফুল পাঠাল অরিন্দম। বিনিময়ে একটা একান্ত ডিনারের দাওয়াতে সম্মতি পেল। অরিন্দম প্রস্তুতি নিতে শুরু করল। সেদিন হাত পা কাঁপা-কাঁপিটা মনে হয় ঈশিতা ধরতে পারেনি। কিন্তু ছোট্ট একটা টেবিলের ওপাশে, এত অল্প দূরত্বে ধরে ফেলবেই। হাত ও পায়ে যে সর্বক্ষন ব্যাথাটা থাকে সেটা হয়ত প্রকাশ পাবেনা তবে মাথা ব্যাথার কারণে চোখ টানা, অবসন্ন লাগা বোঝা যাবে। আরো বড় উপসর্গ আছে। মাঝে মাঝেই হাঁটতেই সমস্যা হয়, মাতালের মত পা ফেলে। শরীরের ভর বুঝে চলতে পারেনা। সাথে একটা ছড়ি থাকে তার, কিন্তু সেটা এবার কোন কাজে আসবেনা বলে মনে হয়। একটা সিদ্ধান্ত নিল অরিন্দম।
একটা জাঁকাল কালো শাড়ি পরে এল ঈশিতা, বক্র দেহে সেঁটে আছে। ছড়ানো আঁচল আর কমনীয় দেহ একটা লেলিহান আগুনের কথাই মনে করিয়ে দেয়।হীরার হালকা গয়নার ঝিলিকের চেয়ে তার নিষ্পাপ চোখগুলোর ঝিলিকই অনেক ঝলকাচ্ছে। মাতাল করা মেয়েলী সুগন্ধ ক্ষণে ক্ষণে দেয়া খোলা চুলের ঝাঁকি থেকে রাশভরে ছুটছে। এই উপস্থিতি অরিন্দমের স্বত্ত্বায় প্রচন্ড শান্তি এনে দিল।
মৃদু আলোর ডিনারে কথা কমই হল। কিছু মোমবাতি পেছনের মায়াবী মেয়েটাকে কোনভাবেই ম্লান করতে পারলনা। একটা সুযোগ খুঁজছে অরিন্দম, কথা বলার জন্য। কিন্তু প্রতিটা মূহুর্ত মেয়েটা যেন নতুন সময়ের জন্ম দিচ্ছে। ডুবে লীন হয়ে যাচ্ছে সময়ে। অবশেষে হালকা পানীয় পান করার সময় কথাটা পাড়ল অরিন্দম।
“আমি একটা কথা বলতে চাই ঈশিতা...”
“জ্বি, অবশ্যই। বলুন।”
“আমার জন্মের আগে থেকেই আমার মা পাগল ছিলেন।” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শুরু করল, “অনেক পাগল। শিকল দিয়ে বেঁধে রাখতে হতো। শেষের দিকে এসে তার হাত পা কাঁপত। প্রচন্ড মাথাব্যাথা থাকত, সাথে শরীর ব্যাথা। হাঁটতে পারতেন না, কয়েক পা গিয়ে পরে যেতেন। খালি চিৎকার করতেন তাকে মেরে ফেলার জন্য। আমার বাবা সেটা পারেননি। যেন সুইসাইড করতে না পারেন সে জন্য তাকে বেঁধে রাখতেন বাবা।”
“তারপর...?”
“আমাকে জন্ম দিতে গিয়ে মারা যান মা।”
“ও, সরি...”।
“১৯৬০ এর আগে পাপুয়া নিউগিনিতে একটা রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। কিছু উপজাতীয়রা মানুষের মস্তিষ্ক খাওয়া শুরু করে। তারা পরে একটা দূরারোগ্য রোগে ভুগতে থাকে যার নাম ‘কুরু’। যার লক্ষণগুলো ঠিক আমার মায়ের মত। এটা আমি পরে জানতে পারি। আমার বাবা মা বিয়ের পর একবার পাপুয়া নিউগিনিতে বেড়াতে গিয়েছিলেন। আমি ধারণা করি সেখান থেকেই কোনভাবে রোগটা চলে আসে আমার মায়ের মধ্যে। অনেকদিন সুপ্ত থাকে, একদিন প্রকাশ পায়। মায়ের মধ্যে কিভাবে এল তা আমি জানিনা, আপনাকে কোন সম্ভাব্য কারণও বলতে চাইনা। আমি নিজেই আশা করি সেটা যেন খারাপ কিছু না হয়।
যাই হোক। গত কয়েক মাস আগে কুরুর লক্ষণগুলো আমি হঠাৎ আমার মধ্যে আবিষ্কার করি। অনেক চিকিৎসা করিয়েছি, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সব বড় বড় ডাক্তার দেখিয়েছি। কিন্তু এই রোগের কোন প্রতিকার নেই। লক্ষণ দেখা যাবার বছর খানেকের মধ্যে মৃত্যু। আপনি কি বুঝতে পারছেন...?”
অরিন্দম যখন সবার শেষের কথাটা বলছিল, তখন ঈশিতার হাত থেকে কাঁচের গবলেটটা পড়ে যাচ্ছিল। শাড়ির উপর পড়ল। পানীয় ছলকে পড়ে শাড়ি ভিজে গেল।
হাত ধরে ফেলল অরিন্দম। “ঈশিতা। তোমাকে দেখার পর থেকে আমার অনেক শান্তি লাগছে। এমন শান্তি আমি গত কয়েক মাস ধরে পাইনি। আমি মৃত্যুপথযাত্রী। তোমার কাছে কিছু চাইবনা, করুণা ছাড়া। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তুমি আমাকে একটু করুণা করবে? যাতে আমি শান্তিতে মরতে পারি?” সাগ্রহে তুমি করে বলে ফেলেছে অরিন্দম। ঈশিতার চোখমুখ রক্তাভ, শক্ত দেখাচ্ছে।
“কি চান আপনি?”
“বন্ধুত্ব, অথবা করুণা। যেটাই বল।”
অনেকক্ষণ ভাবল মেয়েটা। অরিন্দম হাত ধরেই রেখেছে।
“ঠিক আছে। আমি বন্ধু হব। কিন্তু কথা দিন, আর কোন কিছু চাইবেননা।”
“প্রমিজ।”
* * *
প্রায় প্রতিদিনই দেখা হয় ঈশিতার সাথে। এখন অরিন্দমকে শুধু আর মৃত্যু নিয়ে ভাবতে হয়না। ঈশিতাকে নিয়ে ভাবতে ভাবতেই সময় কেটে যায়। সে বাঁচতে পারলে অবশ্যই ঈশিতাকে নিজের করে নিত, যেভাবেই হোক। কিন্তু এখন করূণা পাওয়া ছাড়া আর কিছু সম্ভব না। ঈশিতার করুণাতেই জীবনের এই শেষ লগ্নে এসেও কত অর্থবহুল মনে হয়, ভালবাসলে না জানি কি হত। খুব বাঁচতে ইচ্ছে করে এখন।
অরিন্দম ভুলেই গিয়েছিল তার মৃত্যু পরোয়ানার কথা। ভয়ানক খুনীকে হত্যার দায়িত্ব দিয়ে রেখেছে। কিন্তু এখন যে বাঁচা জরুরী! যে কটা দিন পারে ঈশিতাকে পাশে পেতে চায় সে। একটা মূহুর্ত হলেও। কিভাবে না করবে এখন? এই চুক্তি কোনভাবেই ফেরতযোগ্য নয়, কোনভাবেই যোগাযোগও করা যাবেনা। মারতে এলে তখনও অনুনয় বিনুনয় করে বললেও কাজ হবেনা। এই খুনীর ডিকশনারীতে ব্যার্থতা বলে কোন শব্দ নেই।
যার কাছ থেকে গুপ্তহন্তার কন্টাক্ট নেয়া হয়েছে তিনি সরকারের একজন বিশিষ্ট মন্ত্রী। অনেক অনুরোধের পর পাওয়া, এবং শর্ত ছিল আর কখনও তার কাছে একই ব্যাপার নিয়ে আসা যাবেনা। উফ্! কি ভুলটাই না হয়েছে। এখন কি উপায়? ভেবে পাচ্ছেনা অরিন্দম।
ঈশিতার কাছে মিঃ এক্সের কথা বলা যাবেনা। ওর সাথে শুধুই ভাল লাগা। মেয়েটা ওকে অনেক দিচ্ছে, পারতপক্ষে অরিন্দমের এখন মনেই থাকেনা। নিজেকে পূর্ণ মনে হয়। মনে হয় মহাকালে একটা জীবনকাল নেহাৎ কম নয়। তার জীবনের ক্ষুদ্র ব্যাপ্তি নিজেকে অন্যান্য মানুষ সম্পর্কে ঈর্ষান্বিত করে তোলে।
অরিন্দম ঈশিতার কাছ থেকে অনেক বড় একটা উপহার পেল – সময়। মাঝে মাঝে গোটা রাতটাই থেকে যায় ঈশিতা। ব্যালকনিতে বসে মেঘ দেখতে দেখতে রাত হয়ে যায়, তারা দেখা শুরু হয়। কত রাত ভোর হয়ে যায়। ক্লান্ত হয়ে ঈশিতা ঘুমিয়ে পরে যত্রতত্র, অরিন্দম তার উপর সজাগ নজর রাখে। মন থেকে সবটুকু ভালবাসা নিংড়ে দিতে চায় তাকে। কিন্তু একটা বাধা রয়ে গেছে যে, সে যে বন্ধু। তাকে আপন করে ছোঁয়ার অধিকার নেই। যতটুকু স্পর্শ হয় তা অরিন্দম যখন অনেক অসুস্থ বোধ করে তখন স্নেহার্ত ঈশিতার হাতের শশ্রুষা। খুব চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে তখন – তুমি আমার হও...। ভালবাসাটা বিশ্বাসের দেয়ালে বাধা পেয়ে আটকা পরে। এই নীলাভ বেদনা এখন অরিন্দম কে আরো দুর্বল করে তুলছে। সাথে একটা অজানা আর একটা জানা মৃত্যুর হাতছানি করে তোলে দুর্বিষহ।
ঈশিতার ঘুম ভাঙা গলাটা অসাধারন লাগে। চোখ খুলে ঈশিতা অরিন্দমকে দেখতে পায় অনেক মনোযোগ দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে, লজ্জা পেয়ে যায় সে।লজ্জা দেখে দেখে দিনগুলো কেটে যেতে থাকে। যত দিন যায় অরিন্দম তত উতলা হয়। ঈশিতা এখন এত আপন যে তার মনটাও ধরতে পারে। অনেক জিজ্ঞেস করে কিন্তু অরিন্দম কোন উত্তর দেয়না।
আজকের সন্ধ্যাবেলাটা অনেক স্তব্ধ। কে জানে তাই হয়ত দুজনের মনেই কিছুটা বিষণ্ণতা ভর করেছে। অস্ফুটে মুখ খুলল অরিন্দম। “ঈশিতা...”
“হুম...”
“আমি তোমার কাছে কোনকিছু চাইনা। তুমি আমাকে শেষ দিনগুলো অনেক সুন্দর করে কাটাতে দিয়েছ। এর বিনিময় আমি অবশ্যই দেব।”
“আমি কোন বিনিময়ের জন্য করিনি।”
“তাহলে?”
“মায়া।”
“আমার মৃত্যুর পর তুমি আমাকে মনে রাখবে?” কোন উত্তর দিলনা ঈশিতা। “আমি তোমাকে এই বাড়িটা দিয়ে যাব। বন্ধুত্বের উপহার হিসেবে। তাহলে আমি মরেও শান্তি পাব যে একজন আমাকে মনে করছে। এই জীবনে আমার আপনজন বলতে কেউ ছিলনা।”
মেয়েটা এরপরও চুপচাপ থাকে। “আমি সর্বশেষ একটা জিনিস চাই। যা চাই তা তোমাকে দিতে হবেনা। কিন্তু তবুও আমি শুধু বলতে চাই।”
এবার মুখ ফিরিয়ে তাকায় ঈশিতা। চোখে জিজ্ঞাসা।“কি?”
“ভালবাসা”
স্তব্ধ হয়ে যায় শ্রোতা। “হ্যাঁ, আমি শুধু বলতে চাই যে আমি তোমাকে ভালবাসি। কিন্তু ভালবাসা পেতে চাইনা, যেভাবে অন্য মানুষ চাইত। শুধু আমি ভাবতে চাই যে আমি তোমাকে ভালবাসি।”
ঈশিতা অনেক্ষন ঠায় থেকে ধীরে ধীরে অরিন্দমের মাথাটা বুকে রাখে। অঝর ধারা বয়ে চলে চোখ থেকে।
* * *
অরিন্দম ঠিকই অভিজাত এলাকার এই সুদৃশ্য বাড়িটা লিখে দিল। দেরী হলে সম্ভব হতোনা। কারন শেষের দিকে তার পাগল হয়ে যাবার কথা। প্রচন্ড যন্ত্রনায় উন্মাদ হয়ে যাবে সে। আর মিঃ এক্স তো আছেই। বাড়ি ফিরে দেখে ঈশিতা এসে বসে আছে। তার চেহারায় আজ একটু দুশ্চিন্তার ছাপ। জিজ্ঞেস করল অরিন্দম, উত্তরে জানাল তেমন কিছু না। ওর স্বামী ফোন দিয়েছিল, না পেয়ে রাগারাগি করেছে।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল অরিন্দম। সোফাতে হেলান দিয়ে বসে উপরে তাকিয়ে থাকল। মাথার যন্ত্রণাটা বেড়েছে। ঈশিতা এগিয়ে আসে। পাশে বসে নরম সুরে জিজ্ঞেস করে বেশী খারাপ লাগছে কিনা। উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে চুলগুলোতে হাত বুলিয়ে দেয়। “এক কাজ কর। আমি নিজের হাতে তোমাকে একটা লেবুর শরবত বানিয়ে দিই, ভাল্লাগবে।”
শরবত নিয়ে এলো ঈশিতা। ঢক ঢক করে খেয়ে ফেলল অরিন্দম, মুখ বিস্বাদ হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। তিতিকুটে লাগল পানীয়টা। মাথাটা আবার এলিয়ে দেয় সোফায়। ঈশিতা একনজরে তাকিয়ে ছিল ওর দিকে। ফোঁপানোর শব্দ শুনে মাথা তুলে দেখে ঈশিতা কাঁদছে।
“আমাকে ক্ষমা করে দিও অরিন্দম।” কাঁদতে কাঁদতে বলল ঈশিতা। কি হল বুঝতে পারছেনা অরিন্দম। জিজ্ঞেস করল “কেন? কি করেছ তুমি?” কিছু বলেনা ঈশিতা। অনেক খারাপ লাগা শুরু হয়েছে। হাত পা ভয়ানক কাঁপা শুরু হয়েছে। ছড়িটা ধরা ছিল, পরে গেল হাত থেকে।
“আমি তোমাকে বিষ দিয়েছি।”
একটা বাজের মত পরে প্রতিধ্বনীর মত বাজতে থাকল কথাটা, বিষ দিয়েছি...দিয়েছি...দিয়েছি...। শরীরের প্রতিটা অনু একত্রে প্রতিবাদ করে উঠল।
“তুমি বলেছিলে না, মৃত্যুর এক সেকেন্ড আগেও যেন তুমি না জানতে পার যে মারা যাচ্ছ... কিন্তু আমি জানিয়ে দিলাম তোমাকে। আমাদের এতোদিনের সম্পর্ক পুরোটাই সাজানো ছিল, একটা খেলা। আমিই তোমার মিস্টার এক্সের স্ত্রী। তোমাকে মারার দায়িত্বটা আমার উপরে দিয়েছে সে। আমার স্বামী বিদেশে থাকেনা, এগুলো অভিনয় ছিল।”
এজন্যই ঈশিতার ঘরে তার স্বামীর কোন ছবি দেখেনি সে। এটাই ছিল খটকা। কথা বলার শক্তি পাচ্ছেনা অরিন্দম। গলা দিয়ে ঘড় ঘড় আওয়াজ হচ্ছে।
“এটা সায়ানাইড। পাঁচ মিনিটের মধ্যে তোমার মৃত্যু হবে...”
কথা বলতে পারছিলনা অরিন্দম। সমগ্র শক্তি একত্র করে সে হাতটা বাড়িয়ে ঈশিতাকে ধরতে চেষ্টা করে। ঈশিতা ভয় পেয়ে ছিটকে সরে যায়, হয়ত ভেবেছে প্রতিশোধ নেবে। কিন্তু অরিন্দম বলতে চেষ্টা করছে “তুমি যেওনা ঈশিতা, আমি তবুও তোমাকে ভালবাসি। আমাকে তোমার কোলে মরতে দাও। প্লিজ প্লিজ প্লিইজ। ঈশিতা আমার বুকে একটু হাত রাখো। আমি মৃত্যুর ব্যাথাটা ভুলে থাকি। প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে...ঈ...শি...তা...”
ভাবনা শব্দ হয়ে বেরুলনা। ঈশিতা ভয় নিয়েই দূরে দাঁড়িয়ে রইল। মনের মধ্যে “ঈশিতা” আর স্পর্শের কামনা নিয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল অভাগা অরিন্দম। কে জানে, হয়ত শেষ স্পর্শটুকু অনেক বর্ধিত হয়ে ধরা দিত তার কাছে...
তৌহিদুর রহমান
[email protected]
http://about.me/tanimkg
Download this story as PDF at: http://www.box.net/shared/