একথা মেনে নিতেই হবে যে বাংলাদেশ এখনো রক্ষনশীল সমাজ। এতে দোষের কিছু নেই। বাংলাদেশের এই রক্ষণশীলতা এই সমাজটির একটি বৈশিষ্ট্য হয়ে গেছে; এবং যেকোন সমাজ তার আপন বৈশিষ্ট্য নিয়ে চলতেই পারে। অন্য কোন সমাজ ব্যবস্থার সাথে এর তুলনা করা যেতে পারে, যেমন পাশ্চাত্য সমাজ অথবা কঠোর ধর্মীয় অনুশাসনের আরবীয়/মধ্যপ্রাচ্যীয় সমাজ। কিন্তু তুলনা করা অযৌক্তিক। বরং আমাদের মনোনিবেশ করতে হবে নিজেদের সমাজের নেতিবাচক অথবা পশ্চাদপদ দিকগুলো নিয়ে গবেষণা এবং উন্নয়নে।
পাশ্চাত্য সমাজে নারী পুরুষ অনেকটাই অবাধ মেলামেশা করে থাকে। তারা দাবী করতেই পারে যে এই মেলামেশা তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নতিতে অবদান রাখে। এর সপক্ষে তারা অনেক যুক্তি প্রমাণও উপস্থাপন করতে পারে। তবে তার মানে ই না যে আমাদের উন্নতির লক্ষ্যে তাদের ধ্যান-ধারণা আমাদের সমাজেও হুবুহু কাল থেকেই চালু করে দেয়া উচিত। কিংবা অযথা সুশীল সেজে এর সপক্ষে গলাবাজি করাও উচিত না।
বর্তমান পৃথিবী একটা খোলা বই। যা কিছু অন্য সভ্য ও উন্নত দেশে সুফল দিচ্ছে আমরা তা সহজেই নিয়ে নিতে পারি, এটা কোন ধরনের চুরি নয়। কিন্তু আমাদের উচিত নিজেদের ঐতিহ্য, নিজেদের সংস্কৃতি ইত্যাদি মাথায় রেখে পরিবর্তন বা পরিমার্জন করে তারপর কোন ধ্যান-ধারণা চালু করা। আমাদের উদ্দেশ্য যদি হয় এমন এক সমাজ যেখানে নারী ও পুরুষের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ ও সুস্থ প্রতিযোগিতামূলক সম্পর্ক থাকবে, তাহলে সেটা আমাদের মত করেই প্রণয়ন করতে হবে। বাংলাদেশের রক্ষনশীল অভিভাবকেরা মেয়েদের অবাধে চলাফেরা করতে দেননা, মায়েরা সন্তানদের সন্ধ্যার পর বাসার বাইরে থাকতে দিতে চাননা - এই জাতীয় ফ্যাক্টর অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে।
এখন দেখা যাক, এই জাতীয় রক্ষনশীল ভাবনাগুলো মাথায় রেখে বাংলাদেশের নারী-পুরুষের সম্পর্ক কিভাবে উন্নয়ন করা যায়। তবে এজন্য প্রথমে বুঝতে হবে কেন সেটা প্রয়োজন।
বিগত কয়েক বছরে বাংলাদেশে ধর্ষণ, যৌন নির্যাতন, বিকৃত যৌনতা, পারিবারিক কলহ ও তার জের ধরে অপরাধ অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। বিশেষ করে শিশু ধর্ষণের মত ঘৃণিত ও হৃদয়বিদারক ঘটনাও অহরহ ঘটছে। এর বাইরে পরিলক্ষিত হয় নারী ও পুরুষের মধ্যে একটা দৃশ্যমান বিরোধ। বাসে মহিলাদের জন্য আলাদা সীট বরাদ্দ থাকে তাই কোন পুরুষ ঐ সীটগুলোর বাইরে কোন মহিলাকে নিজের জায়গা ছেড়ে দিতে চাননা। ইউরোপ আমেরিকায় এ ধরনের কোন বিভাজন নেই (শুধুমাত্র গর্ভবতী মহিলাদের জন্য থাকে), তাই তাদের সমাজে এটা চলেনা। কিন্তু বাংলাদেশে সামর্থ্যবান পুরুষেরা শিশু, বৃদ্ধ বা নারীদের জন্য সীট ছেড়ে দিবেন এটা কাম্য এবং এর একটা সৌন্দর্য আছে। যদি পরিপূর্ণভাবে তা পালন করা হত, তাহলে আমরা গর্বভরে বলতে পারতাম যে আমাদের দেশে আমরা মহিলাদের সীট ছেড়ে দিই। কিন্তু একটা সময়ে তা দেখা গেলেও, এখন অনেকাংশে আর দেখা যায়না। এটা নারী-পুরুষ বিভাজনের একটা ছোট্ট উদাহরণ। এমন আরো অনেক বিভাজনের দৃশ্য চোখে পরবে বাংলাদেশে।
বাংলাদেশে ধর্ষণ হলে এখনো মেয়েদের পোশাকের দোষ দেয়া হয়। কিন্তু বাইরের দেশগুলোতে লক্ষ্য করলে দেখেবেন সেসব দেশে আরো অনেক ছোট কাপড়-চোপড় পরে মেয়েরা রাস্তায় চলাফেরা করে, কিন্তু ধর্ষনের ঘটনা কি ঘটে? তাহলে এর কারন কি?
আমাদের চিন্তা ভাবনা হচ্ছে ধর্ষকের কঠিন শাস্তি দিলেই অপরাধের সংখ্যা কমে যাবে। এটা একদিক দিয়ে ঠিক। কিন্তু দেখা যাবে, ক'দিন পর ধর্ষকেরা ধরা না পরার জন্য নতুন স্ট্র্যাটেজি নিয়ে একই অপরাধ করে যাচ্ছে। যেকোন অপরাধ কমিয়ে আনার দুটো উপায় আছে - ১) শাস্তির মাত্রা বৃদ্ধি ২) অপরাধ না করার জন্য প্রণোদনা তৈরী। বাংলাদেশে শুধু শাস্তি বৃদ্ধি নয়, একই সাথে সমাজে এমন অবস্থা আনতে হবে যেন অপরাধ না করার দিকে প্রনোদনা সৃষ্টি হয়।
এবং এই প্রণোদনা সৃষ্টির জন্য সমাজ পরিবর্তনের কোন বিকল্প নেই। সরকার কখনো বলতে পারবেনা যে আপনার ধর্ষনের ইচ্ছা হলে আমাদের কাছে এসে টাকা নিয়ে যান, কিন্তু তাও ধর্ষণ করবেন না। এটা হাস্যকর। তাহলে পটেনশিয়াল ধর্ষক কিভাবে নিজেকে বিরত রাখবে এহেন অপকর্ম থেকে?
উত্তর হচ্ছে ধর্ষনের পেছনের কারণগুলো খতিয়ে দেখা এবং সমাজে সে জিনিসগুলো যেন সহজেই পাওয়া যায় তার ব্যবস্থা করা। অনেকে হয়ত মনে করছেন, ধর্ষনের পেছনে কারন হচ্ছে যৌন কামনা। আমাকে হয়ত চোখ রাঙিয়ে বলতে পারেন 'তাহলে আপনি কি বলতে চাইছেন? সমাজে উন্মুক্তভাবে যৌনতা ছড়িয়ে দেয়া?'
অবশ্যই না। ধর্ষনের পেছনে কারন কখনোই শুধুমাত্র যৌনতার লিপ্সা না। বাংলাদেশে ধর্ষণের পেছনে অনেক কারন আছে। এর মূল আরো গভীরে। তবে আমি এতো গভীরে বিশেষ ভাববাচ্যে না গিয়ে সরাসরি প্রতিকারের কথা বলব, তার ভেতর দিয়ে কিছুটা ধারণা করা যাবে পেছনের কারণগুলো।
প্রথমত মর্মান্তিক হলেও সত্য, আমাদের সমাজে বিয়েটাকে আমরা দিন দিন হাতের নাগালের বাইরে নিয়ে যাচ্ছি। বিয়ে - যা কিনা মানুষের একটা মৌলিক চাহিদা 'যৌনতা'র সমাজসিদ্ধ ও সর্বজনবিদিত উপায়, আমরা দিনকে দিন তাকে কঠিন করে ফেলছি। ধর্মীয় কারনে অথবা সমাজের ঐতিহ্যগত কারনে বিয়েটা বাংলাদেশে বরাবরই পুরুষ-নির্ভর ছিল, অর্থাৎ বিয়ের অনুষ্ঠান করা, দেনমোহর প্রদান ইত্যাদি। কোন এক অজানা কারনে অনুষ্ঠানের খরচ ও কলেবর এবং দেনমোহর দুটোই উর্ধমুখী, কখনো কখনো এতোটাই উঁচু যে নাগালের বাইরে। একটা পুরুষ যদি অনার্স, মাস্টার্স পড়ার পর এক দু-বছর চাকরি করে বিয়ে করতে চান, তখন সাধারনত তার বয়স হয় ২৪-২৮ এর মধ্যে। এই দেশে যখন চাকরীর বাজার এতো মন্দা, অল্প বেতনের চাকরী নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয় তখন দেনমোহর বা বিয়ের অনুষ্ঠান বাবদ পাঁচ-দশ লক্ষ টাকা খরচ করা দুই বছর চাকরী করা ঐ বয়সের একটা পুরুষের জন্য কতটা কঠিন তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। উচ্চমধ্যবিত্তের জন্যও কঠিন, মধ্যবিত্ত আর দরিদ্রের কথা তো বাদই দিলাম। পুরুষরা বা তাদের পরিবার তাই লাভ ক্ষতির চিন্তা করেন যে এতো টাকা বিয়েতে খরচ হল, মেয়ের বাড়ি থেকে তা উসুল করতে হবে। তখন চাপিয়ে দেয়া হয় যৌতুকের বোঝা। মধ্যবিত্ত সমাজে এটা এতোটা প্রকট না হলেও, দরিদ্রদের মাঝে উপদ্রবের মত। এবং শুধুমাত্র এই যৌতুকের কারনে যে তাদের কত ঘর ভাঙছে ইয়ত্তা নেই।
বিয়ের অনুষ্ঠানে আমরা নানা অপ্রয়োজনীয় আনুষঙ্গিক বিষয়াদি যুক্ত করেই যাচ্ছি। এক সময় শুধু বিয়ে এবং বৌভাত নামক দুটি অনুষ্ঠানের কথা শোনা যেত, হলুদ করা হতো বাড়ির অন্দর মহলে স্বল্প পরিসরে। কিন্তু এখন আকদ্, আংটি-বদল, মেহেদী, ছেলে ও মেয়ের আলাদা হলুদ, বিয়ে, রিসেপশান ইত্যাদি অনুষ্ঠান তো আছেই তার উপর যুক্ত হয়েছে প্রি-ওয়েডিং, পোস্ট-ওয়েডিং ফটোগ্রাফির মত মনগড়া বিষয়। যার সাধ্য আছে তার এগুলো করা সাজে। কিন্তু আমরা সমস্যাটা করে ফেলছি সেগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেদারছে ছড়িয়ে দিয়ে। বাবা হয়তো মেয়ের শখের কথা চিন্তা করে বিয়ের অনুষ্ঠানে সাধ্যের অতিরিক্ত খরচ করছেন, কিন্তু মেয়ের বান্ধবীটি এসব দেখে তারও শখ জাগছে নিজের ক্ষেত্রেও অনুরূপ অথবা তারচে বেশী করার। যদিও বান্ধবীর বাবার অবস্থা ততোটা ভাল নয়। এভাবে একটা বিয়ে থেকে আরেকটা বিয়ে হয়ে যাচ্ছে ক্রমশই খরুচে, অভিজাত। ফলে বিয়ে এখন যা দুটি মানুষের নতুন জীবন শুরু করার উপায় নয় বরং এক অসুস্থ প্রতিযোগিতা।
দেনমোহরের ব্যাপারটি হওয়া উচিত পুরুষের সাধ্যের মধ্যে। মহানবী (সাঃ) এর সময়ে সাহাবীদের খেজুর এমনকি কোর'আনের আয়াতের বিনিময়েও বিয়ে হয়েছে। কিন্তু আমাদের সমাজে আমরা সেটাকে বানিয়ে ফেলছি পুরুষের মাসিক উপার্জনের প্রায় ১০ থেকে ১০০ গুণ বেশী। মেয়ের অভিভাবকরা এটাকে স্ট্যাটাস বলে পরিচয় দেন এবং বলে থাকেন এটা মেয়ের রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করবে। অর্থাৎ বিবাহবিচ্ছেদ যেন না হয় সেজন্যই এতো উচ্চহার ধারন করা হয়। খেয়াল করুন, এভাবে এরকম একটা উচ্চ দেনমোহরের বিয়ে সুখের হলনা, কিন্তু বিচ্ছেদ হতে পারছে না দেনমোহরের বাধ্য-বাধকতার জন্য। ফলে স্বামী-স্ত্রী বিষাক্ত একটা সংসার করে যাচ্ছেন। তাদের মনে বাসা বাঁধছে যৌনতা বিষয়ক অপরাধ-প্রবণতার।
একই জিনিস বিয়ের আগেই অনেক পুরুষের মনে ভয় ধরিয়ে দিচ্ছে। দু'ভাবে - ১) আমি দেনমোহর বা বিয়ের খরচ বহন করতে পারবনা, ২) অল্প দেনমোহর বা বিয়ের খরচে আমি যেমন স্ত্রী পেতে চাইছি তাকে লাভ করা সম্ভব না। কাজেই সে যতদিন না পর্যন্ত টাকা জমাতে বা অন্যভাবে সংস্থান করতে পারছে, বিয়ে করছেনা। অথচ যৌনতা মানবদেহের একটা জৈবিক চাহিদা। এটা থেকে নিরস্ত হতে হতে সে রাস্তায় যত মেয়ে/নারী চলাচল করে সবাইকেই একটা সময়ে আর মানুষ হিসেবে না দেখে ভোগ্যপন্য হিসেবে দেখছে। নারী হিসেবে মর্যাদা দিচ্ছেনা। মানুষের চরিত্র স্খলনের একটা ক্রান্তিসীমা আছে - অনেকের সেটা কম, অনেকের বেশী। যারা ধর্ষণ করছেনা তাদের হয়ত বেশী, যারা করছে তাদের কম।
আমাদের রক্ষনশীল সমাজে বিয়ে হওয়া জরুরী। যেহেতু বারবার পাশ্চাত্য সমাজের কথা টানছি, তাই আবারো বলতে হয় - পাশ্চাত্য সমাজে বহু মেয়েরা অবাধ মেলামেশায় অনেক অল্প বয়সেই কুমারীত্ব হারায়। সেটা সাধারনত ঋতুবতী হবার কয়েক বছরের মধ্যেই অর্থাৎ নিম্নে ১৪ থেকে শুরু করে ১৮ বয়সের মধ্যেই। অর্থাৎ বোঝা যাচ্ছে মানুষের মধ্যে যৌনতার চাহিদা কতটা অল্প বয়সেই শুরু হয়। তবে এই প্রথা আমাদের সমাজে একেবারেই বেমানান এবং ঘৃণিত। কাজেই বিয়েই হতে পারে এর একমাত্র সমাধান। সরকার নির্ধারিত বিয়ের বয়স ১৮। কিন্তু আমাদের সমাজে দেখা যায় মেয়েদের বিয়ে পরিবার থেকে দিচ্ছে ২৩-২৪ অথবার তারচেয়েও বেশী পরে। এখানে মেয়ের পড়াশোনা শেষ করানোর একটা দোহাই থাকে। আবার অনেক মেয়ে স্বেচ্ছায় অনেক সময় নেয় নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য অথবা তার পছন্দের মানুষ যে কিনা এখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি তাকে সময় দিতে। যার ফলে একটা দীর্ঘ সময় নিষিদ্ধ যৌনতায় লিপ্ত হওয়ার অবকাশ থেকে যায়। কিন্তু যদি আমাদের সমাজ ব্যবস্থা এমন হতো যে, মেয়েরা একটা নিয়ন্ত্রিত বৈবাহিক অবস্থার মধ্য দিয়ে যাবে তাহলে কিন্তু এই সমস্যা অনেকাংশে কমে যেত। নিয়ন্ত্রিত বৈবাহিক অবস্থা বলতে বুঝাতে চাচ্ছি - বিয়ে হবে কিন্তু স্বামী বা স্ত্রী দুজনের কেউই প্রত্যক্ষভাবে সংসার বলতে যা বুঝি সেটা করবেনা, অর্থাৎ বাজার সদাই, ঘরকন্না করা, বাচ্চা জন্ম দেয়া, আলাদা বাসা নিয়ে থাকা ইত্যাদি করবেনা। বরং তারা তাদের প্রাথমিক কাজ - পড়াশোনা চালিয়ে যাবে, সেটা হতে পারে নিজেদের অভিভাবকের উপর ভর করে অথবা যে যার মত। ছেলে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে চট্টগ্রামে, মেসে থাকে আর মেয়ে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ে, হোস্টেলে থাকে। কিন্তু দুজনে বিবাহিত এবং তারা প্রতিমাসেই মিলিত হয়। এরকম হলে তরূণ বয়সী দুটি ছেলে মেয়ের জন্য মন্দ হতোনা। তবে খেয়াল রাখতে হবে এই সুযোগের অপব্যবহার যেন না ঘটে। ১৮ বছরের মেয়েকে যেন ৪০ বছরের পুরুষ বিয়ে না করতে পারে সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে, প্রয়োজনে এর জন্য সরকার কর্তৃক নজরদারি থাকতে হবে।
যেহেতু বিয়ের পরিমান বাড়বে, সেহেতু বিচ্ছেদের পরিমানও বাড়বে। তবে কেন জানিনা বাংলাদেশে বিচ্ছেদটাকে খুব খারাপ দৃষ্টিতে দেখা হয়। দুটো মানুষ একসাথে বসবাস করার পর আবিষ্কার করতেই পারে কিছু কারনে তাদের মধ্যে সামঞ্জস্য হচ্ছেনা এবং এতোটা ব্যতিক্রম নিয়ে একসঙ্গে বসবাস সম্ভব নয়। এমতাবস্থায় বিচ্ছেদ উভয়ের জন্য একটি ভাল সিদ্ধান্ত। অসুখী জীবন যাপন করার চেয়ে নতুন কাউকে খুঁজে নিয়ে ভুল শুধরে জীবন যাপন করা অনেক ভাল। একজন স্বামী তার বদমেজাজি স্ত্রীকে সহ্য করতে পারেন না, সেই স্ত্রী আবার বদমেজাজ দেখান স্বামীর বদ-অভ্যাসের জন্য। দুজন বিচ্ছেদ করে অন্যত্র বিয়ে করলেন এবং স্ত্রী আর বদমেজাজ দেখাননা কারন নতুন স্বামীর সেই বদ-অভ্যাস নেই। এভাবে একটা ঘটনা থেকে চারটা জীবন সুখী হতে পারল। কাজেই বিবাহ বিচ্ছেদ মোটেও হেয় বা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করার কোন বিষয় নয়। কিন্তু বাংলাদেশে অতি-রক্ষনশীলতার কারনে মাথায় ঢুকিয়ে দেয়া হয় যে বিচ্ছেদ একটি খুব নিন্দনীয় জিনিস। যার জন্য অনেক নারী ও পুরুষ শুধুমাত্র পরিস্থিতির স্বীকার হবে ভেবে অসুখী সংসারের ঘানি টেনে যাচ্ছেন। বলাই বাহুল্য যৌনতা বিষয়ক অপরাধের মাত্রাও এই ধরনের মানুষদের ক্ষেত্রে বাড়ে।
পুরুষেরা মনে করেন বিয়ে করা মানে বাসায় রান্না-বান্না আর ঘর সংসারের কাজের জন্য একটা মানুষ নিয়ে আসা। খুবই হতাশাজনক হলেও সত্যি, অনেক পুরুষের কাছে বিয়ের প্রশ্নটা আসে যখন তার বাসায় একা একা রান্না করতে হয়, কাপড় ধুতে হয় ইত্যাদি। ছেলেদের মায়েরা তখন একটা বউ খোঁজার জন্য উঠে পড়ে লেগে যান। আমাদের এই ধরনের মানসিকতা থেকে বেড়িয়ে আসতে হবে। বিয়ে করার মুখ্য উদ্দেশ্য হওয়া উচিত একটা মানুষের সাথে আরেকটা মানুষের আনন্দ-বেদনা ভাগাভাগি করা। নিজের কাজটা নিজেরই করার মন মানসিকতা থাকা উচিত। অর্থাৎ সঙ্গী যদি কাপড় ধুয়ে দেন, রান্না করে দেন তাহলে তার জন্য কৃতজ্ঞ থাকা উচিত; ভাবা উচিত নয় যে এটা করাই তার কাজ/দায়িত্ব। পাশ্চাত্য সমাজে বাইরে খেতে গেলেও অনেক সময় দেখা যায় স্বামী স্ত্রী যার যার বিল তিনি তিনিই দিচ্ছেন। আশার কথা হল, আমাদের রক্ষনশীল সমাজে মেয়েরা সংসারের কাজগুলো সানন্দে নিজদের দায়িত্ব মনে করেই করে থাকেন। কিন্তু পুরুষেরা এতে কৃতজ্ঞ না হয়ে বরং আরো চাপিয়ে দেন। ফলাফল অসুখী সংসার।
এ তো গেল নারী ও পুরুষের খুব অন্তরঙ্গ সম্পর্কের কথা। এর বাইরে যেসব সম্পর্ক আছে যেমন - সহকর্মী, ছাত্র - শিক্ষক, আত্মীয়, বন্ধু, সেগুলোতে নজরদারি বাড়িয়ে প্রতিকার কিভাবে সম্ভব?
দুর্ভাগ্যজনক হলেও বলতেই হয়, এই সমস্যা উত্তরনের জন্য আসলে ভুক্তভোগী অর্থাৎ নারীদেরই করণীয় বেশি। এলাকায় সিঁধেল চোরের উপদ্রব বেশী থাকলে যেমন ঘরের ভিটা পাকা করতে হয়, তেমনি নারীদেরকেই এই সমস্যা ঠেকাতে শক্ত হতে হবে। কারন বাংলাদেশের রক্ষনশীল সমাজ আপনাদের সাহায্য করতে এখনই প্রস্তুত নয়। যতদিন পৃথিবী সূর্যের চারপাশে ঘুরবে, নারীস্বত্ত্বা ততোদিনই পুরুষের চোখে আকর্ষণীয় থেকে যাবে - এটাই জগতের নিয়ম। বণ্যপ্রাণী জগতেও যদি এই নিয়ম হয়ে থাকে, মানুষের বেলায় বা ভিন্ন হবে কেন? কাজেই "আমার পোশাক ঠিক করতে বলার আগে আপনার ছেলেকে দৃষ্টি সংযত করতে বলুন" - এই জাতীয় কথা আবেগী হলেও তা খুব একটা কাজে আসেনা। আপনি আপনার রূপ-গুণ দেখাতে ভালবাসবেন, এটা যেমন স্বাভাবিক তেমনি ছেলেরা মেয়েদের প্রতি আকৃষ্ট হবে সেটাও স্বাভাবিক। তাই আপনার রূপ এবং গুণ ভুল জায়গায় দেখিয়ে বেড়ালে অবস্থাটা হবে অনেকটা সময়ের এক ফোঁড়, অসময়ের দশ ফোঁড়ের মত। ভুল মানুষের সামনে আপনার রূপ গুণ দেখাতে বিরত থাকুন, কষ্টকর হলেও এটা আপনার নিরাপত্তার স্বার্থে করতে হবে।
খেয়াল করুন, আমি কিন্তু রুপের সাথে 'গুণ' কথাটা লাগাচ্ছি। মানে শুধু রূপের কারণে ছেলেরা আকৃষ্ট হবে তা নয়। পুরুষদের একটা বড় অংশ গুনের কারনেও আকৃষ্ট হয়। তাই, আপনি হয়ত সংযত শালীন জামা কাপড় পড়ছেন ঠিকই, তার পরও আপনি অনেকের লক্ষ্যবস্তু হয়ে যেতে পারেন। এজন্যই আমি মনে করিনা, ধর্ষণ বা অন্যান্য যৌন-অপরাধের মূল কারণ শুধু পোশাকে। একটা নারী অনেকভাবে আকর্ষনীয় হতে পারেন। কোনটা যে ঠিক ধর্ষক টেনে আনছে বলা মুশকিল। তাই সাবধান হতে হবে সব দিক থেকে।
তার মানে কি মেয়েরা ছেলেদের সাথে একদমই মিশতে পারবেনা? কারন মিশলেই তো রূপ অথবা গুণ প্রকাশ হয়ে যাবে। এই ক্ষেত্রে অনেকেই ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলেন যা এই পরিস্থিতিতে সাহায্য করে। যারা ধর্মীয় অনুশাসনে অভ্যস্ত নন, তাদের ক্ষেত্রে এই রূপ-গুণ প্রদর্শনটা নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে হতে হবে। নিয়ন্ত্রিত পরিবেশটা বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন।
সহকর্মীদের ক্ষেত্রে সুশৃঙ্খল না হওয়ার বিকল্প নেই। যেমন নারী-পুরুষ সহকর্মীর কথাবার্তা যোগাযোগ যেন কেবল কাজের পরিবেশেই হয়, সেটা যেন কাজের সময়ের বাইরে না আসে। কি কি বিষয়ে কথা হবে, ব্যক্তিগত বিষয় কতটুকু বলা হবে এসব নিয়ে প্রতিটা মানুষের নিজের মধ্যে একটা সীমা থাকা উচিত, মেনে চলা উচিত এবং অন্যদেরও সেটা শ্রদ্ধা করা উচিত। নন্দিনী যদি মনে করে থাকে তার সহকর্মী মাহফুজ সাহেবের সাথে কোনদিনও তার বিয়ের সম্পর্ক হবার নয়, তাহলে ব্যক্তিগত কথা বলা থেকে বিরত থাকাই ভাল। একই সাথে মাহফুজ সাহেবেরও উচিত নন্দিনীর সাথে মনস্তাত্ত্বিক দূরত্ব রেখে চলা।
একটা বয়সে কিশোর কিশোরীদের আর নতুন করে বন্ধু হয়না, সাধারনত স্কুল কলেজেই বন্ধু হয়ে থাকে। এই সময়টার পর সবাই তাই বিপরীত লিঙ্গের সাথে কথা বলার আকর্ষণ অনুভব করে। অভিভাবক কিংবা সমাজের উচিত এই বিষয়টাকে মাথায় রেখে পরিবেশ সৃষ্টি করা। ছেলে-মেয়েকে বিপরীত লিঙ্গের সাথে মেশা যাবেনা এই ধরনের নিষেধ দিলে বরং তারা লুকিয়ে মেলামেশা করবে। তারচে বরং যদি বলা হয় - হ্যাঁ তুমি তোমার ছেলে/মেয়ে বন্ধুদের সাথে মিশতে পারবে তবে সেটা অবশ্যই হতে হবে বাসায়, বাইরে কোথাও নয় এবং শুধু একজন বন্ধু/বান্ধবী না, বরং এক গ্রুপ বন্ধু-বান্ধবী থাকতে হবে - তাহলে সেটা হবে তাদেরকে একটা নিয়ন্ত্রিত পরিবেশ দেয়া। বাসার পরিবেশে, বিশেষ করে যেখানে অভিভাবকদের উপস্থিতির ভয় থাকবে সেখানে বিপরীত লিঙ্গের বন্ধু-বান্ধবীদের মধ্যকার কথা প্ররোচনামূলক হতে পারবেনা বলে আশা করা যায়।
আত্নীয়-স্বজন ও ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কে অভিভাবকদের সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে এবং সেখানেও নিয়ন্ত্রিত পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
পরিশেষে এটাই প্রতীয়মান হয় যে সমাজে নারী-পুরুষের সৌহার্দ্যপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করাই দীর্ঘমেয়াদে ধর্ষণ বন্ধের জন্য উপযুক্ত পদক্ষেপ। এই সহাবস্থান আনতে হলে বিয়েকে আবার সহজলভ্য করতে হবে, যা সাধারণ জনগনের ওপর। শাসনতন্ত্র যদি সমাজ পরিবর্তন করতে চায়, তাতে প্রচুর সময় লাগে। কিন্তু সাধারন জনগন যদি সে দ্বায়িত্ব নেই তাহলে অনেক সহজে পরিবর্তন সম্ভব। সরকার বিয়ের অনুষ্ঠানে কর বসাতে পারে, কিন্তু তাতে কাঙ্খিত পরিবর্তন আসতে আসতে কেটে যাবে আরো পঞ্চাশ বছর। কিন্তু সাধারন মানুষ যদি একাত্ন হয় বিয়ের খরচ কমিয়ে আনার তাহলে সেটা কয়েক বছরেই সম্ভব। এখনকার বিয়েতে ৩/৪ টি অনুষ্ঠান হয়ে থাকে এবং প্রতিটিতেই প্রায় একই মেহমানের সমাগম হয় - যার এই জমানায় কোন যৌক্তিকতা নেই। এই ৩/৪ টি অনুষ্ঠান করার বদলে একটি অনুষ্ঠান করা যেতে পারে। দেনমোহর নির্ধারনে পাত্রের সামর্থ্য দেখা উচিত। বাবা মায়েরা বিচ্ছেদের ভয়ে নিজদের অভিজ্ঞতা দিয়ে বিচার করেন এবং ছেলে-মেয়েদের পছন্দের মূল্যায়ন করেন না। কিন্তু এই মানসিকতা পরিবর্তন করে বরং ছেলেমেয়ের পছন্দ অনুয়ায়ী বিয়ে ও সংসার করতে দেয়া উচিত। পরবর্তীতে সেই সংসার ভেঙে গেলেও এটাকে স্বাভাবিক ধরে নেয়ার মন মানসিকতা থাকতে হবে। সংসার যুক্তিযুক্ত কারনে ভেঙে যাওয়া মানে দুটি মানুষের এই ব্যাপারে পরিপক্ক হওয়া, যার ফলশ্রুতিতে তারা পরবর্তী সংসারে আরো সতর্ক হবে। স্বামী - স্ত্রী'র বাইরে অন্যান্য নারী-পুরুষ সম্পর্কগুলোকে নিয়ন্ত্রনের মধ্যে আনতে হবে।
এই সমাজ ধর্ষকদের জন্য কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করেনি, অদূর ভবিষ্যতে করবে আশা করাও ভুল। করলেও কয়টা ধর্ষককে বিচারের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করা হবে তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। কাজেই এখন আমাদেরই সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন এনে ধর্ষক গড়ে তোলা বন্ধের সহায়ক পরিবেশ তৈরী করতে হবে।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই জুলাই, ২০১৯ ভোর ৫:৩৯