(পাঁচ)
স্টেপ পেরেন্টস
নানীর রেখে যাওয়া সম্পত্তি থেকে প্রতি বছর অনেক ফসল হতো। ধান-নারিকেল-সুপারি। তাদের সারা বছর কেটে যাচ্ছিল। উপরন্তু বিক্রি করতো।অনেক টাকা পায়। আরাম আয়াসে দিন যাচ্ছিল। সোনালী,ব্যাংকে নিজের নামে টাকা গচ্ছিত করতো। নানীর সব জমির দলিল পত্র তার কাছে ছিল। দলিল পত্র উল্টিয়ে উল্টিয়ে বারবার দেখতো। লালসার স্বপ্নে চোখ দুটো বড় বড় হয়ে উঠেছিল। মনের গোপন ইচ্ছা একটু আশ্বাস পেয়েছিল। পাছে কেউ দেখলো তাই। এদিক ওদিক তাকায়। দরজা বন্ধ করে। চেহারায় তার গোপন হাসি।
এ এক ষড়যন্ত্র।গোপন ষড়যন্ত্র চলছিল।
আত্মগোপনে।
তার পাপী হৃদয় খোঁড়া যুক্তি দাড় করাতো।
নিজের মা আপন হয়।অন্যের মা নয়।সে তো সতমা।
বড়ছেলে পল্লব বছরে এক দু’দিন বাড়ী আসতো আবার চলে যেত কোথায়। পল্লব সোনালীকে সাবলীলভাবে মা বলতো না।
পল্লব তার মা’র ভাগ অন্য কাউকে দিতে নারাজ ছিল।তার মা একজন।
সে মারা গেছে। অনেক আগে। মা তো সে জন্মদায়িনী। অন্য কেউ নয়।
পাশা তার দিদি পিউর বাড়ী থাকতো।
পল্লল একটু অন্যরকম।
বদ মেজাজী। কারো কথা শুনতো না। রগচটা স্বভাব।
যখন যে দিকে মন চায় সে দিকে যেত। ঘরের বাহিরে বেশি থাকতো। মিছিলে গলা ফাটিয়ে শ্লোগান দিতো। মাঝে মাঝে রাতে বাড়ি ফিরতো। পলির অনেক দূরে বিয়ে হয়েছিল। ভাইদের জন্য ওর মনটা পোড়াতো।
সোনালীর নিজের ছেলে-মেয়েদের প্রতি বিশেষ নজর। পরাণ ও শিল্পীকে নিয়মিত স্কুলে পাঠাতো, জামা-কাপড়, খাওয়া-দাওয়া সব কিছুতে বাড়তি নজর ছিল। উজ্জলও তেমন।
উজ্জলের খুত খুতির ব্যামো ছিল। মার্কেটে গিয়ে যাচাই-বাছাই করা ছিল তার প্রথম কাজ। একবার চক্কর দিতো সব দোকানে। দোকানীরা উজ্জলকে আপ্যায়ন করতে ভুলতো না,রহমতের কাপড়ের দোকানে পা রাখতে পিচ্চিকে খবর,‘বল্টু,চা-বিস্কুট নিয়ে আয়। দেখিস না ধনলক্ষী এসেছে মন্দিরে।’ রহমান উজ্জলের দিকে মুখ করে জিজ্ঞাসে,‘আর কিছু আনবে বাবু।’
লিলির ছেলে পল্ললের মাঝে মাঝে ছোট-খাটো অভিযোগ ছিল সোনালীর ছেলেমেয়েদের প্রতি। বাবাকে সামনে দেখে রাগ করে বলে উঠতো,‘ওদের পছন্দ মত অনেক নতুন জামা-কাপড়,জুতা কিনে দেও। আমি চাইলে তোমার একটা দিতে কষ্ট হয়।’
রাজ্জাকের ছেলে-মেয়ে মিলের স্কুলে পড়তো। ক্লাস ফোরে। যা বেতন পেত ঘর ভাড়া, সংসার খরচ করে মোটামুটি চলছিল। একজন মাস্টার রাখা দায়ছিল। একজন মাস্টার দু’জনকে পড়ায় মাসে একশ টাকা ও একবেলা খাবার দিতো।
রাতে খেতে বসে রাজ্জাক মাস্টারের কাছে সব খবর শুনতো।
রাজ্জাক,‘কি মাস্টার,খবর কি?’
মাস্টার,‘ভালো,তয় মিলের আবহাওয়া ভালো না।
শুনলাম মিল নিয়ে রাজনীতি চলছে।মিল বন্ধ হয়ে যাবে।’
রাজ্জাক,‘কও কি মাস্টার কই শুনলা।’
মাস্টার,‘শুনলাম কি কানাঘুষা হচ্ছে।’
মাস্টার এদিক সেদিক যেত বাড়ী বাড়ী ছাত্র পড়াতো তাই খবর রাখতো।
রাজ্জাক,‘আমি একটু শুনলাম এমন কথা কিন্তু বিশ্বাস হলো না।আর হবে না কেন? মিলে লোকসান হচ্ছে প্রতিবছর।’খাবার চিবোতে চিবোতে রাজ্জাক আধা আধা ভাঙ্গা শব্দে দম নিয়ে বলছিল ‘রাজনীতিবিদ,শ্রমিক লিডাররা আর মিলের অসাধু উচ্চ কর্মকর্তারা নিজেরা লাভ করছে কিন্তু কাগজে-কলমে সরকারকে মিলের লোকসান দেখায় প্রতিবছর।’
ছেলে-মেয়েদের নিয়ে রাজ্জাক সকালে বের হতো ওদের স্কুলের গেটে ছেড়ে দিয়ে সে কাজে চলে যেত। আবার স্কুল ছুটি হলে মিলের গেট প্রর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে যাওয়া ছিল কাজ। ওরা হাটতে হাটতে বাড়ী চলে আসতো।
রাজ্জাকের মাথার ভিতর ঘুর পাক খাচ্ছিল মিল বন্ধ হলে কি করবে, কিভাবে চলবে সংসার। তাই কাজের ফাকে ফাকে কান খাড়া করে রাখতো। কোনো নতুন খবর পায় কি না। সুপারভাইজার এলে তার কাছে পাত্তা নিত।
ভাই,কি খবর শুনলাম?
সুপারভাইজার,‘সত্যি কথা।তবে কবে জানি না।কানাকানি চলছে।সরকার সব মিল-কারখানা বন্ধ করে দিবে।লোকসান হচ্ছে।’
‘তয় সেলিম ভাই, আমরা যাবো কোথায়,করবো কি,সংসার চলবে কিভাবে ? আমাদের কি ব্যাবস্থা হবে?’ রাজ্জাকের প্রশ্নগুলো থেকে যেতো এভাবে। সেলিম মুখ খুলল না।
কালার মা।তার চোখ যেন একটা দীর্ঘ ইতিহাস।
কত কিছুই দেখল। মানুষের জীবনের কত ঘটনা।
কোথা থেকে কোথায় চলে যাচ্ছিল।
রূপসা নদীর ওপারে তার বাড়ি এপারে ঘর ভাড়া করে থাকতো।
সোনাডাঙ্গা থেকে তের কিলোমিটার দূরে যৌবন রসে ভরা এ রূপসা নদী। রূপসা-রূপ লাল সাহার নাম থেকে রূপসা নদীর নামকরণ। কত রঙে আঁকা তার ছবি। উত্তাল ঢেউ তরঙ্গে দুকূল দাপিয়ে বেড়ায়। নগরীর পাশ ঘেঁষে খেলা খেলে। ছলে ছলে। জলে জলে বয়ে চলে। তার রূপে কেউ বিমোহিত। কেউ মূর্ছিত। কত জীবন করেছে ধন্য।এই রূপসা নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল শিল্প নগরী খুলনা। কত তার দান। জেলে মাছ ধরে রূপসার বক্ষে জাল ফেলে জীবন গড়ে দিন-রাত। পাল তোলা নৌকা বয়ে বেড়ায় একুল ওকুল। কত জমি করে উর্বর।
মাঝি দু’হাতে বৈঠা ধরে গান গায় তার আপন মনে -
‘নদী তোর দুকূল ধইর্যা,
জীবন তরী চলে বইয়্যা।
এ জীবন মন সাংঙ্গ হ’ল,
তোর ঐ রূপ রঙ্গে।
নদী তোর দুকূল ধইর্যা
জীবন তরী চলে বইয়্যা।’
চোখ জুড়ায় তার ঢেউয়ের নাচুনী দেখে। গাংচিল তার বক্ষে থাবা মেরে মাছ নিয়ে যায় চোখের নিমিষে,ফুরুৎ করে। মনের আনন্দে খেলা করে শিশু। স্রোতস্বিনী রূপসা নদী। এঁকে বেঁকে তার পথ চলা। চলা তার আনন্দ। দান তার মহত্ত্ব।
কালা,ছিপের লম্বা সুতায় বাধা বর্শিতে টোপ(মাছের খাবার) গেঁথে রূপসা নদীর কিনারায় ফেলে বসে থাকতো মাছের আশায়। সুতায় বাধা আধা ডুবন্ত সাদা টোনটা(মঁয়ূরের পাখনার সাদা অংশ) ভাসতেছিল নদীর স্বচ্ছ পানিতে। তার চোখ টোনটার দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতো। কখন মাছ এসে আদার(মাছের খাবার) গিলবে। মাছ খেলা করে খাবার নিয়ে। বর্শিতে বাধা খাবার খুটিয়ে খুটিয়ে খেয়ে দৌড় দিচ্ছিল। সাদা টোনটাতে টান পড়তে সে সজাগ হয়ে উঠতো। এইতো মাছ ধরার আনন্দ। মাছ খাবার খেতে খেতে যখন সম্পূর্ণ খাবারটা গিলে ফেলে টোনটা পানির নিচের দিকে ডুবে পড়লে বুঝে যেতো মাছ আদার গিলেছে। ওমনি ছিপ ধরে দিতো এক টান।
সেই সাথে বিকেলের হিমেল হাওয়া মনটাকে সতেজ করে তুলছিল।
কালা প্রতি শুক্রবার বিকেলে নদীতে বর্শি ফেলে বসে থাকতো রূপসা সেতুর পাশে।
কালার মা,অতীত বর্তমানে পার্থক্য বুঝতে পেরে ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দিতো। সোনালী,কালার মার সাথে ভাল ভাব রাখে। কথায় কথা মিলিয়ে চলতো।
কালার মা সব বুঝতো।
তারপরও।
কিছু বলতো না।
তার প্রতিবেশী। অন্য কিছু মনে করবে। সোনালীকে বলে,এ সংসার এক আজব কারখানা। কার মন কোন দিকে বোঝা দায় বলে হাঁফ ছাড়ে।
উপরে একজন আছে সব দেখে। সব বোঝে। আমরা চোখ বুজে কাজ করি। তার চোখ খোলা।
সোনালী বলে উঠতো,‘হ ,হ। দিদি, ঠিক কইছেন।’
ঠাওর পায় না,সোনালী।
সোনালীর ছেলে-মেয়েরা বাবার কাছে বায়না ধরতো। উজ্জল তা পূরণ করতো। আজ এটা। তো কাল সেটা। প্রতিদিন কোন না কোন জিদছিল ।না দিলে রক্ষা নাই বাবার।
এ এক আনন্দ! পরম আনন্দ।
উজ্জল আনন্দ পেতো।
কিন্তু তার মনটা ভারী হয়ে উঠতো।‘সোনালীর ছেলে মেয়েদের এতো আহ্লাদ,এতো জিদ,এতো বায়না। লিলির ছেলে-মেয়ের কখনো এতো আহ্লাদ,এতো জিদ,এতো বায়না দেখেনি,’ উজ্জল ভাবতো মনে মনে ‘কি যেন ভুল হয়েছে।’
মনটা তার খা খা করতো,‘ওদের মা নাই তাই শখ নাই।’ যেভাবে হোক দিন কাটছিল তাদের। বেচে ছিল এই বেশী। বাবা যা এনে দিতো তাই পেয়ে খুশি হতো ওরা। কোন দিন কখনও কোন বায়না ধরেছিল মনে নাই তার। মা নাই তাই বাবার প্রতি অধিকার নাই।
‘সতমা কি আর ওদের মনের কথা বোঝে।’ সে এক যন্ত্রনা নীরব কষ্ট।
এতগুলো বছর গেল। ছেলে-মেয়েরা বড় হল। চোখের সামনে। কখনো কারও মনের কথা শুনলাম না। বাবা হয়ে নিজেকে ধিক্কার দিল। লজ্জা হল। ওদের সামনে কথা বলতে কষ্ট হল। ওরা অবুঝ। নিজেকে ক্ষমা করতে পারলো না। কিন্তু পরোক্ষণে নীরব,নিঃতেজ,সব ভুলে গেলো। সময় সে তো বয়ে চলে গেছে বহুদূর। যোজন যোজন দূর। সে আর ফিরে আসবে না কখনো।
বাবা ও সন্তানদের দূরত্ব স্পষ্ট হয়ে উঠল। মা না থাকলে বাবাও পর হয়ে যায়। এ হলো সতবাবা।