রফিক সাহেবের জীবনে আজ চরম অপমানের দিন। সারাজীবন যার পিছন পিছন সৌভাগ্য নিজেই ছুটোছুটি করেছে,সাফল্য যার পায়ে লুটিয়ে পড়েছে সেই রফিক সাহেবকেই আজ অফিস থেকে অপমান করে বের করে দিয়েছেন কোম্পানির মালিকের জামাতা। শুধু অপমানই নয় আরও বলেছে এই জীবনে কোনদিন যেন এই কোম্পানিতে তোমার পা না পড়ে। অথচ রফিক সাহেবের জীবনের গল্পটা কিন্তু দারুণ সৌভাগ্যের।
তিনবার বিএ পরিক্ষা দিয়েও পাশ করতে পারেননি রফিক৷ । তার বাবা ধরেই নিয়েছিলেন এই ছেলেকে দিয়ে আর কিছুই হবে না। বেশ কয়েকবার সেনাবাহিনীর সেপাই পদে পরীক্ষা দিয়েও টিকতে পারেনি।পড়াশুনার মেধা কম হলেও ছেলেবেলা থেকেই রফিকের উপস্থিতি বুদ্ধি খুবই চমৎকার। এটাই তার একমাত্র সম্বল, তার ধারণা ছিল এই উপস্থিত বুদ্ধির জোরেই জীবনে অনেক বড় কিছু করে ফেলবেন । ধনী কিছু আত্মীয় স্বজনের কাছে হাত পেতে চতুর্থবার বিএ পরিক্ষার ফিস জোগাড় করে, পরিক্ষায় নকলের সুবিধাও পেয়ে যায়। ফলাফল বিএতে থার্ড ক্লাস পেয়ে পাশ করে যায় রফিক। রফিককে আর পায় কে? তার চোখে পৃথিবী জয়ের আনন্দ! মায়ের লাল মোরগটা বিক্রি করে আশপাশের মানুষকে মিষ্টি খাওয়ায়।
অন্যসব গ্রাজুয়েটদের মতই টাই পরে ঢাকায় আসে রফিক। কিন্তু ঢাকায় এসে বুঝতে পারে এত খারাপ রেজাল্ট দিয়ে চাকুরী পাওয়া সম্ভব নয়। পথে পথে ঘুরে জুতার তলা ক্ষয় করে যখন দেখলো চাকুরী পাওয়া সম্ভব হচ্ছে না তখন সিদ্ধান্ত নিলো, কিছুতেই গ্রামে ফিরে যাবে না,এই ঢাকাতেই তাকে কিছু একটা করতে হবে। একদিন ইত্তেফাকের পাতায় একটা বিজ্ঞাপনে রফিকের চোখ আটকে গেল, "অফিস পিয়ন আবশ্যক " শিক্ষাগত যোগ্যতা এস এস সি। রফিক তার বিএ থার্ডক্লাশের সার্টিফিকেটটা টিনের বাক্সে বন্দী করে থার্ড ডিভিশনে এস এস সি পাশের সার্টিফিকেটটা নিয়ে ছুটলো মতিঝিলে কোম্পানির অফিসে ইন্টারভিউ দিতে।
কোম্পানির অফিসে ভাইভা দিতে গিয়ে দেখলো মাত্র দুইশো স্কয়ারফিটের ছোট্ট একটা অফিস।কয়েকটা স্টিলের আলমিরা কিছু কাঠের চেয়ার টেবিল ছাড়া আর কিছুই নেই এই অফিসে। রফিককে জিজ্ঞাসা করা হল
- ঘর ঝাড়ু মোছার কাজ পারবা?
-পড়াশুনা জানো?
-বিভিন্ন অফিসে চিঠি দিয়ে আসতে পারবা?
রফিক সবগুলোতেই হা সুচক উওর দিল।
এরপর কিছু একটা লিখতে বললেন। রফিক নিজের ঠিকানা লিখে দিল, একবার বাংলায় একবার ইংলিশে। আরও বেশ কিছু লোক এসেছিল ইন্টারভিউ দিতে কিন্তু কোম্পানি এমডি জুলফিকার সাহেব রফিককেই পিয়ন পদে নিয়োগ দিলেন।
কোম্পানির নাম আফজাল এন্ড কোম্পানি, কোম্পানির মালিক আফজাল সাহেব চট্টগ্রাম থাকেন সেখানে উনার বিশাল ব্যবসা, সিলেটে কয়েকটা চা বাগানও আছে। তাই তিনি ঢাকার এই ছোট্ট কোম্পানিটি নিয়ে মোটেই মাথা ঘামান না,এটা দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়ে রেখেছেন তার ঢাকা অফিসের এমডি জুলফিকার সাহেবকে। জুলফিকার সাহেবও ব্যস্ত মানুষ,আফজাল সাহেবের অনন্য ব্যবসা দেখাশুনার পাশাপাশি এই ছোট অফিসটাতে সপ্তাহে একবার আসেন। আসলে কোম্পানিটি হচ্ছে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের একটা ব্রোকারেজ হাউজ। তখনও বাংলাদেশের মানুষ শেয়ার ব্যবসার কনসেপ্টটা বুঝে উঠতে পারেনি।
রফিক অফিস ঝাড়ু দেওয়া মোছার পাশাপাশি জুলফিকার সাহেব কি করেন সেটাও বোঝার চেষ্টা করে। রফিক যেহেতু বিএ পাশ কাজগুলো বুঝতে তার খুব বেশি বেগ পেতে হয়না। জুলফিকার সাহেবের সপ্তাহে একদিন আসেন রাকীদিনগুলোতে শেয়ার লেনদেনের কাজগুলো রফিককে দিয়েই করান। এদিকে একটা বিশেষ কাজে জুলফিকার সাহেবের ছয় মাসের জন্য দেশের বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু এই ছয়মাস যদি কোম্পানি বন্ধ রাখেন অথবা কোন ট্রানজেকশন না করেন তবে কোম্পানির লাইসেন্স বাতিল হয়ে যাবে। জুলফিকার সাহেব পড়লেন মহা বিপদে, রফিক বললো
-স্যার অভয় দিলে একটা কথা বলি
- বল রফিক
-স্যার আপনি নিশ্চিন্তে দেশের বাইরে যান, এদিকটা আমি সামলে নিতে পারবো।
বিস্মিত হন জুলফিকার সাহেব
-তুমি?
-স্যার আপনাকে একটা কথা বলা হয়নি আমি বি এ পাশ। তাছাড়া গত দুই বছরে আপনার কাজগুলো দেখতে দেখতে শিখে গেছি।
জুলফিকার সাহেব কোম্পানির মালিক আফজাল সাহেবের সাথে আলোচনা করে রফিক কোম্পানির দায়িত্ব দিয়ে দেশের বাইরে চলে যান। সেটা ছিল ১৯৯৬ সালর কথা, জুলফিকার সাহেব দেশের বাইরে চলে যাওয়ার পরই বাংলাদেশের শেয়ার মার্কেট ফুলেফেপে ওঠে। রফিক তখন ক্লাইন্টের শেয়ার বিক্রির কমিশনের পাশাপাশি এক্সচেঞ্জের বাইরেও শেয়ার কেনাবেচার দালালী করতে থাকে।
এই ছয় মাসে রফিক নিজে যেমন কোটিপতি হয়ে যায় পাশাপাশি আফজাল সাহেবের ৪ কোটি টাকার ব্রোকারেজ ফার্মকে একশ কোটির টাকার ফার্মে রূপন্তারিত করে। কোম্পানির মালিক আফজাল সাহেব রফিকের উপর এতটাই খুশি হন যে রফিককে কোম্পানির লাভের ত্রিশ পার্সেন্ট দিতে নিজেই প্রস্তাব দেন। রফিককে কোম্পানির সিইও পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। অফিস পিয়ন রফিক থেকে তিনি রফিকুল ইসলাম সাহেব হয়ে যান।
অল্প দিনেই গাড়ি,জমি, ফ্লাটের মালিক হয়ে যান রফিক সাহেব। দিনে দিনে কোম্পানিকে অনেক বড় করে ফেলেন। ঢাকাসহ অন্যান্য শহরে আফজাল এন্ড কোম্পানির আরও দশটা শাখা অফিস খুলে ফেলেন । টানা পনের বছর কোম্পানির সিইও পদে দায়িত্ব পালন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ ও অন্যান্য নামীদামী প্রতিষ্ঠান পাশ করে এসে অনেকেই রফিক সাহেবের অফিসে কাজ করেন, তাকে স্যার বলেন।
রফিক সাহেব দিন দিন অহংকারী হয়ে ওঠেন,নিজেকে কোম্পানির মালিক ভাবতে শুরু করেন। কোম্পানির পিয়ন অফিসার সবাইকেই তিনি তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে কথা বলেন। তুচ্ছ কারনেও অনেকের চাকুরী খেয়ে দেন, আবার কেউ স্বেচ্ছায় চাকুরী ছাড়তে চাইলে তাকেও অপমান করেন।
কোম্পানির পেইড আপ ক্যাপিটাল যখন দুইশত কোটি টাকার উপরে, কোম্পানির মালিক আফজাল সাহেব ভাবলেন
-যেহেতু এটা এখন আর ছোট কোম্পানি নেই তাই এদিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত। তিনি নিজের মেয়েকে এমডি এবং জামাইকে উপদেষ্টা পদে নিয়োগ দেন।
আফজাল সাহেবের জামাই রবিন সাহেব একজন পাকা ব্যবসায়ী মানুষ। যার কাছে কোন আবেগের স্থান নেই, কোম্পানির দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই কোম্পানির নিয়োগ আয় ব্যায়ের হিসেব নিজেই দেখেন। তার চোখে নানা অসঙ্গতি ধরা পড়তে থাকে। তিনি একটি নামকরা অডিট ফার্মকে দায়িত্ব দেন এবং কোম্পানির আয় ব্যায়ের হিসাব অডিট করান। আর সেখান থেকেই বেরিয়ে রফিক সাহেবের নানা অনিয়ম এবং দূর্নীতির চিত্র।
রফিক সাহেবকে সাসপেন্ড করা হয়, চরম অপমান করে বের করে দেওয়া হয়। যদিও রফিক সাহেব এখন যথেষ্ট সম্পদশালী তার জীবন চলার পথে বাকি দিনগুলোতে খুব একটা সমস্যায় পড়তে হবে না। রফিক সাহেব বুঝতে পারেন সম্পদ এবং ক্ষমতার মোহে অন্ধ হলে তার পরিনতি কোনদিনই সুখকর হয় না।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই মার্চ, ২০১৯ সকাল ৮:২৯