এক।
গ্রামের সবাই আমাকে ডানপিটে ছেলে বলেই জানতো। প্রতিবেশীদের গাছের ,আম, কাঠাল,ডাব কিংবা উঠানের মুরগির ঘর ভেঙ্গে মুরগী চুরি করে পিকনিক করা আমার এবং আমার বন্ধুদের নিয়মিত মজার অংশ। গ্রামের কারো গাছের ফল কিংবা মুরগী চুরি হলে প্রথম সন্দেহটা পড়তো আমার গ্রুপের উপর। বাবা গ্রামের মুটামুটি অবস্থাসম্পন্ন গেরস্ত, সবাই তাকে সম্মান করতো। আমার কারণে বাবাকে প্রায়ই নানা অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়তে হতো। বাবা নিজের পকেটের টাকা দিয়ে ফলের দাম কিংবা মুরগীর দাম পরিশোধ করতেন তবে আমাকে কখনোই বকতেন না।
আমার জন্ম বাবা মায়ের বিয়ের কুড়ি বছর পর। বাবা যখন ধরেই নিয়েছিলেন সারাজীবন তাকে নিঃসন্তান থাকতে হবে ঠিক সেই সময় সৃষ্টিকর্তার আর্শিবাদ হিসাবে মায়ের কোল জুড়ে আমার জন্ম। তাই বাবা মা কোনদিনই আমাকে বকেন না কিংবা আমার কোন আবদার অপূর্ণ রাখেন না। বাবা মায়ের অতি আদরে আমিও একটা বাদর হয়েছি।
একদিন বাবা তার ঘরে আমাকে ডেকে নিয়ে বললেন
-দেখো বাবা হাফিজ, আমার বয়স হয়েছে আমি আর কতদিন বাচবো? এই সংসারের হাল তোমাকেই ধরতে হবে। এসএসসি পাসের পর তুমি আর পড়াশোনা করলে না। তোমার দ্বারা হালচাষ করাও সম্ভব নয়। আগামীমাসে বিডিআর এ লোক নেবে,আমি চাই তুমি বিডিআর এ যোগ দাও, আমি মফিজ দালালের সাথে কথা বলে রেখেছি একলাখ টাকা দিলেই সে তোমার চাকুরির ব্যাপারে সাহায্য করবে।
সেদিন বাবার কথাগুলো প্রথমে আমলে না নিলেও পরে ঠিকই মনে ধরলো। আসলেইতো এটাতো জীবন না। আমি ফাতেমাকে ভালবাসি, ফাতেমার বাবা নিশ্চয়ই আমার মত উড়নচণ্ডীর সাথে তার মেয়ে বিয়ে দেবেন না। তাই আমি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম যে করেই হোক আমাকে বিডিআর এ যোগ দিতেই হবে।
আমার ফাতেমা। শ্যমলা বরণ গায়ের রঙ।যার হাসিতে আমার অপার বিস্ময়, উপন্যাসের নায়িকাদের মতো দুধে আলতা গায়ের রঙ না হলেও আমার চোখে ফাতেমাই পৃথিবীর সেরা সুন্দরী। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে আমি এলোমেলো হয়ে যাই। আমার মনের ভিতর অদ্ভুত এক অনূভুতি হয়। আমার মনে হয় ওকে না পেলে আমি মরেই যাবো। ফাতেমার সবই আমার ভাললাগে ওর নেভীব্লু স্কুল ড্রেস পরে বেনি দুলিয়ে গ্রামের পথে হেটে চলা কিংবা হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে কথা বলা। আমার মনে হয় ওকে না পেলে আমার জীবনটাই বৃথা।
এসএসসি টেনেটুনে পাস করে আমি স্কুলে যাওয়া ছেড়ে দিয়েছি কিন্তু স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে যাওয়া আসার পথে দুইবার ফাতেমাকে না দেখলে আমার দিনই কাটতো না। প্রথমে ওর সাথে কথা বলারই সাহস হতো না আমার শুধু দুর থেকে দেখতাম আর অনুসরণ করে বাড়ি পর্যন্ত দিয়ে আসতাম ব্যাস একটুকুই এর বাইরে কিছুই বলার সাহস হতো না । অনেকবার দুর থেকে খেয়াল করেছি আমাকে দেখেলেই ফাতেমার মুখে দুষ্টুমিমাখা একখানা হাসি লেগে থাকে। আমার বন্ধুরা বলতো ওটা প্রশ্রয়ের হাসি, কিন্তু তবুও ফাতেমাকে ভালবাসার কথা বলার সাহস কিছুতেই সঞ্চয় করতে পারতাম না। একদিন ফাতেমা স্কুল থেকে ফিরছিল বন্ধুরা আমাকে জোর করে ফাতেমার সামনে ঠেলে দিল শুনিয়ে শুনিয়ে বললো এত ভীতু হলে চলে? সেদিন সবার সামনেই বলে ফেললাম 'ফাতেমা তোমাকে ভালবাসি'।
ফাতেমার মুখে কোন কথা নেই বেশ কঠিন মুখ করে দ্রুত পায়ে হেটে চলে গেল। সারারাত উত্তেজনা আর টেনশনে আমার ঘুম হল না। পরদিন সকালে ফাতেমা তার ভাইয়ের হাতে একটা ছোট্ট চিরকুট পাঠালো, যাতে লেখা
'বিকেল ৪টায় আমাদের পুকুরের উত্তরপাড়ে আসবেন , আমি অপেক্ষা কবরো'
আমার শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেল, তবেকি ফাতেমাও আমাকে ভালবাসে?
ঘড়ির কাটা যেন থেমে গেছে কিছুতেই সময় পার হতে চাইছে না।উত্তেজনায় আমি কাপছি। অবশেষে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ উপস্থিত। আমার হাতে একটা লাল গোলাপ এবং ছেলেবেলায় নানীর দেওয়া একআনার একটা সোনার আংটি ফাতেমার দিকে বাড়িয়ে দিলাম। গোলাপটা ঠিকই নিলো কিন্তু সোনার আংটি নিতে রাজী হল না। বললো
- যেদিন নিজে রোজগার করে আংটি বানিয়ে দিতে পারবে সেদিনই আমি সোনার আংটি নেবো। সেইদিন থেকে ফাতেমা আমার ধানজ্ঞান। আমার শয়নে স্বপনে জাগরণে শুধুই ফাতেমা।
বাবার দেওয়া প্রস্তাবে রাজী হয়ে বিডিআর ভর্তির জন্য শহরে গেলাম। আমার সুঠাম দেহ আর উপস্থিত বুদ্ধিতে কর্ণেল স্যার আমাকে নিয়ে নিলেন। আমার ধারণা মফিজ দালালের কোন ভুমিকা নেই তবুও বাবা তাকে এক লাখ টাকা দিয়ে দিলেন। আমি একবুক আনন্দ আর উত্তেজনা নিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম। দশদিন পরই আমাকে জয়েন করতে হবে,তারই প্রস্তুতি নিতে লাগলাম। ফাতেমাদের পুকুরঘাটের উওর পাড়ে আবার দেখা হল আমাদের । ফাতেমা সেদিন আমাকে অশ্রুসজল চোখে বিদায় জানালো। আমার হাতে একটা খাম ধরিয়ে দিল, খামটা এখন খুলতে নিষেধ করলো।বাড়ি ফিরে খামটা আমার ব্যাগে পরম ভালবাসায় গুছিয়ে রাখলাম। যাওয়ার আগে মাকে বলে গেলাম ফাতেমাকে আমার চাই ই চাই। দুই বছর পর সরকার যখন আমাকে বিয়ের অনুমতি দেবে তখন আমি ওকেই বিয়ে করবো। মা মুচকি হেসে আশ্বাস দিলেন যেকরেই হোক তোর বাবাকে দিয়ে আমি ফাতেমার বাবাকে রাজী করাবো।
নির্ধারিত তারিখেই বিডিআর এ জয়েন করলাম। প্রথমেই আমার সুন্দর চুলগুলো প্রায় ন্যাড়া করে কেটে দেওয়া হল। এরপর শুরু হল কঠোর ট্রেনিং, প্রচুর পরিশ্রম করাতো ওরা, সঙ্গে প্রচুর গালিগালাজ। মাঝে মাঝে মনে হতো এরচেয়ে হালচাষ করাটাও ঢের ভাল। ধীরে ধীরে অস্ত্র চালনা শিখলাম। আমার ব্যাচের অনেকের চেয়েই আমার নিশানা নিখুঁত। হাইজ্যাম্প, রোপিং, ওয়াল পাসিংসহ সব ট্রেনিং এ আমি ভাল করতে লাগলাম তাই আমার ওস্তাদরা আমার প্রসংশা করতেন।
মাঝে মাঝে রাতের আধারে ফাতেমার দেওয়া খামটা খুলে পড়ি। কঠোর পরিশ্রমী সৈনিক জীবনে ফাতেমার চিঠিটাই আমার একমাত্র অনুপ্রেরণা। হাজার বার পড়া চিঠিটা যতবারই পড়ি ততবারই মনে হয় নতুন। সেদিন ফাতেমা লিখেছিল
প্রিয় হাফিজ
সেই ছোটবেলা থেকে তোমাকেই ভালবাসি কোনদিন মুখ ফুটে বলতে পারিনি। আর কি করে বলি আমিতো মেয়ে। তুমি যখন আমার স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে আমার অসম্ভব ভাল লাগতো। মনে হতো তুমি কবে আমাকে জানাবে ভালবাসার কথা, আর তুমিও একটা বোকা ছেলে ভালবাসার কথা বলতে কেউ এত দেরি করে? আগামী দুই বছর তোমার ফিরে আসার প্রতীক্ষায় আমি রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকবো।
ইতি
তোমার ফাতেমা।
ফাতেমার এই ছোট্ট চিঠি একদিকে যেমন আমাকে আনন্দ দেয় আবার কাদায়। মাঝরাতে ঘুম থেকে উঠে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাদি। কতদিন দেখিনা আমার ফাতেমাকে। এতটাই কড়াকড়ি ট্রেনিং যে প্রিয়জনদের চিঠিও আমাদের কাছে পৌছানো হয় না। প্রতিদিন ফজরের আযানের সাথে সাথে ঘুম থেকে উঠে আমাদেরকে লাইন ধরে মসজিদে যেতে হয়। নামাজের পরপরই পিটির পোশাক পরে তৈরি হতে হয় দশ মাইল দৌড়ের জন্য। তারপর ক্যাম্পে ফিরে গোসল করে ফ্রেস হয়ে সৈনিকের পোশাক পরে একমগ চা এবং একটা লুচি দিয়ে নাস্তা সারতে হয়। নাস্তার পরই অস্ত্রাগার থেকে অস্ত্র নিয়ে প্যারেডের জন্য যেতে হয়। সকাল সাড়ে আটটা থেকে সাড়ে দশটা পর্যন্ত টানা দুই ঘন্টা অস্ত্রসহ প্যারেডের অনুশীলন। এরপর একঘন্টা নাস্তার বিরতি। নাস্তায় থাকে লাল আটার মোটা রুটি সঙ্গে ডাল অথবা সবজি এবং গুড়ো দুধের চা। এরপর আবারও দুইঘন্টা ওয়াল পাসিং, দড়ি বেয়ে উপরে ওঠা কিংবা ফারারিং প্যাকটিস একটার পর একটা অনুশীলন। দুপুর আড়াইটা থেকে চারটা দুপুরের খাওয়া ও বিশ্রামের বিরতি। দুপুরের খাবারে মোটা চালের ভাত আর ডালের সাথে মাছ মাংস ডিম যেকোনো একটা থাকে। আসরের নামাজের পর গেম। ফুটবল, বাস্কেটবল, ভলিবল, হকি যে খেলায় পারদর্শী তাকে সেটাই খেলতে দেওয়া হয়। আমি বাস্কেটবল খেলি মাঝে মাঝে ভলিবলও খেলি। মাগরিবের নামাজের পর সৈনিক লাইনের সামনে সবাইকে সারিবদ্ধভাবে দাড়াতে হয়, এখানে রোলকল করা হয় এবং আমাদের ওস্তাদরা আমাদের সারাদিনের পারফর্মেন্স মূল্যায়ন করেন। মুটামুটি দিনের কর্মসূচি এখানেই শেষ হয়। কেউ চাইলে ঘন্টাখানেক টিভি দেখতে পারে তবে আমার ওসব ধৈর্য হয় না। আমি নয়টার দিকে রাতের খাবার খেয়েই ঘুমিয়ে পড়ি।এটাই কঠোর পরিশ্রমী সৈনিক জীবনের আমার নিয়মিত রুটিন।
আমার ট্রেনিং পিরিয়ড শেষ হয়েছে, এখন কিছুটা আগের চেপে রিল্যাক্স। দুই বছর পার হলেই আমি একজন পরিপূর্ণ সৈনিক হবো। এখন মাঝে মাঝেই ফাতেমার হাতে লেখা গোটা গোটা অক্ষরের গভীর আবেগময় ভালবাসার চিঠি পাই। যেদিন ফাতেমার চিঠি আসে সেদিন সারাদিন অদ্ভুত এক ভাললাগায় আচ্ছন্ন থাকি আমি। মনে মনে স্বপ্নের জাল বুনতে থাকি, কবে ফাতেমা আমার হবে? কবে আমি ফাতেমাকে নিয়ে সৈনিকদের কোয়ার্টারে উঠতে পারবো। ইতিমধ্যেই মা আমাকে চিঠিতে জানিয়েছেন ফাতেমার বাবার কোনো অমত নেই তাই আমি যেন এটা নিয়ে চিন্তা না করে নিজের কাজে যেন মনোযোগী হই।
আমার চাকুরীজীবনের দুই বছর পূর্ণ হয়েছে।ইতিমধ্যেই ঢাকার পিলখানা বিডিআর ক্যাম্পে আমাকে বদলী করা হয়েছে। সরকার আমাকে অনুমতি দিয়েছে বিয়ে জন্য। দুই বছর চাকুরী করে আয় করা অধিকাংশ টাকাগুলোই আমি জমিয়ে রেখেছি একটা সুন্দর সংসার জীবন শুরু করার জন্য। সেখান থেকে কিছু টাকা মায়ের কাছে পাঠিয়েছি ফাতেমার শাড়ি গহণা কেনার জন্য। আর মাত্র দশদিন পরই আমাদের বিয়ে সবপ্রস্ততিই সম্পন্ন।
চলবে...
বিঃদ্রঃ সৈনিকের জীবন সম্পর্কে আমার ধারণা খুবই কম তাই তথ্যগত ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন, বাকী পর্ব গুলো এখনো লেখা হয়নি তাই দিতে দেরী হতে পারে, চেষ্টা করবো ভালবাসা দিবসের আগেই শেষ করতে।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২০ সকাল ১১:৩৩