somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

...এবং একজন আমি

০২ রা সেপ্টেম্বর, ২০১৮ দুপুর ১:০৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আজ আমার জন্মদিন। না না আসল জন্মদিন নয়, সার্টিফিকেট। তবুও আমার কেন জানি মনে হয় এইদিনেই আমার জন্ম। আমার পরিবার, আমার বাবা আজ কত উৎফুল্ল; আর আমার খেলার সাথী, আমার আদরের বোন আশা। আশার সত্যিকারের ‘আশা’ হয়ে ওঠার গল্প না হয় পরেই বললাম। তবুও আমার এই নামটা ভাল লাগেনি, আমি তাকে সাথী বলেই ডাকতাম। হয়ত বা আমার একমাত্র সুখ-দুঃখের সাথী বলেই আমার এই নামটি ভাল লেগেছিল! এখানে একটা কথা বলে রাখা ভাল যে সে আমার নিজের বোন না, সাথীর বাবা আমাকে রাস্তা থেকে তুলে এনে তার পরিবারের একজন করে নিয়েছিলেন। তার ঠিক এক বছর পরে, হয়ত কিছুদিন আগেই আমাদের সবার একমাত্র আশা হিসেবে সাথীর আগমন। প্রথমবার পৃথিবী দর্শনেই সাথী এই মহৎ বাবাটিকে ভুল বুঝেছিল। আমাদের মা তখন সাথীকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে, আর আমাদের অকাল বৃদ্ধ বাবাটি?? তার বিস্তর ধান ক্ষেতের অবারিত সোনালি ধানের মোহে আর আমাকে নিয়েই তার ছোট পৃথিবীটা আরও সংকুচিত হয়ে পরে যেন। মায়ের কোলে একটু একটু করে বড় হতে থাকে সাথী, সেই সাথে একটু একটু করে সাদা হতে থাকে আমার প্রাকৃতিক নির্মল বাবাটির অনিন্দ্য সুন্দর চুলগুলো। আর তাতে যেন আমিও একটু একটু করে অভিমানী হয়ে পড়ি এই অবুঝ কোমল মেয়েটির উপর। প্রত্যেক সূর্যোদয় যতটা ভালোবাসা নিয়ে আসে ঠিক ততটাই কেড়ে নেয় প্রতিটি সূর্যাস্ত! তাই তার দিকে ফিরে তাকানোর সময় কিংবা ইচ্ছা আমার কিংবা বাবার কারও হয়ে ওঠেনি। তারপরেও আমার অবোধ বাবাটির নির্ভেজাল হৃদয়টিতে আমার ডালপালা শাখা থেকে প্রশাখায় বিস্তৃত হচ্ছিল; ততোটাই গভীরে যতোটায় সাথীর আনাগোনা ছিল নিষিদ্ধ।

সেই নিষিদ্ধ নগরীতে আমার একাকী বসবাস। তবুও বাবা তার এই মেয়েটিকে ভালবাসতে চেয়েছিলেন, হৃদয় থেকেই চেয়েছিলেন। কিন্তু হায় বিধাতার কোন সে নিয়মে মেয়ে বলেই হয়ত সাথীকে তিনি ক্ষমা করতে পারেননি। পারেননি মুখ ফুটে একটু মা বলে ডাকতে, পাছে সমাজ তাকে দেখে মুখ লুকোয়! তবুও তিনি চমকে উঠেছিলেন যেদিন খুব করে সেজে সাথী দাঁড়িয়েছিল তার বাবার সামনে। মূর্খ বাবাটি বুকের বাম পাশে হালকা ব্যথা অনুভব করলেন কি; হয়ত কোনোদিন জানা হবে না। তখনও তিনি সাথীকে সম্বোধন না করেই বললেন ‘চল’। বাবা সেদিন প্রথম মেয়ের হাত ধরলেন; হয়ত সেদিনই খুঁজে পেয়েছিলেন তার এতদিনের আরাধ্য আরাধনা! খুঁজে পেয়েছিলেন কারণ এরপর থেকে দেখতাম বাবা তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করে ঘরে চলে আসতেন, আর সাথীকে নিয়ে মেতে থাকতেন। তার এই হঠাৎ বদলে যাওয়াটা বোধহয় আমার ভাল লাগেনি, বাবা এখন আর আমার কাছে আসেন না আমাকে মনে হয় তিনি ভুলেই গেছেন! অবশ্য তিনি যে আমায় ভোলেননি তার প্রমাণ পরের রাতেই পেয়েছিলাম। তবুও সাথীর প্রতি আমার আগের অভিমানটা আরেকটু যেন বেড়ে যায়।

এই সাথী কী করে আমার ‘সাথী’ হয়ে উঠল; এখনও তা যেন অনন্ত বিস্ময়। হঠাৎ করেই ওর সাথে আমার আনুষ্ঠানিক পরিচয়! একদিন স্কুল থেকে এসে আমার সামনে এসে দাঁড়াল; যেন তার দাঁড়ানোর ভঙ্গিমায়ই আমাকে বলে দিচ্ছে সব। তাও সে আমায় ভাইয়া বলে ডাকে নি। তারপরও তার সেই সহজাত ব্যকুল কন্ঠ আর আমার প্রতি তার অনন্ত সহমর্মিতা (হয়ত আমার কল্পনা) আমাকে তার বন্ধুতে রুপান্তরিত করেছিল। এরপর থেকে সাথীই হয়ে ওঠে আমার একমাত্র জগৎ, চারপাশের দৃশ্য ধীরে ধীরে কোথায় যেন মিলিয়ে গেল! দৃশ্যগুলো যেখানে মিলিয়ে গিয়েছিল সেখান থেকেই যেন আবার আবির্ভূত হয়; যখন সাথী আমাকে রশিদদের কথা শোনায়। গ্রামের সর্বময় ক্ষমতার উৎস রফিক আহমেদ এর ছেলে এই রশিদ; আমি দুই তিনবার দেখেছি ওকে গ্রামের সালিশ সভায়। রশিদ খুবই ভদ্র ছেলে বলেই জানতাম, দেখা হলে মুরুব্বীদের সালাম দিতে তার এতটুকু কার্পণ্য কিংবা বিলম্ব দেখি নি। তারপরেও সালিশ এর বিচারক হিসেবে নয়; অভিযুক্ত হিসেবেই তার দেখা আমি পেয়েছিলাম বেশ কয়েকটি সভায়। কাউকে দেখে এগিয়ে যাওয়া তার স্বভাব আর সে জন্যেই নাকি সে মেয়েটির কাছে এগিয়ে গিয়েছিল...আর স্বভাবতই মেয়েটিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। এর মাঝে অপরাধ কি আছে, আমি ভেবে না পেয়ে সালিশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলাম। সেদিন রশীদের অপরাধ বুঝতে না পারলেও, বুঝেছিলাম একদিন কিন্তু সেদিন বড্ড দেরী করে ফেলেছিলাম... সেদিন সারাদিন ধরে মেঘলা আকাশে প্রকৃতির মাঝে চঞ্চলতা দেখেছিলাম, হৃদয় সামান্য হলেও পুলকিত হয়েছিল প্রকৃতির নিলাম্বরি সাজ দেখে! সাথী সেদিন মেঘলা আকাশের সাথে একাকার হয়ে যেতে চেয়েছিল; হয়ত মনের কোনে যেটুকু দাগ লেগেছিল তা মোছার জন্য বের হয়েছিল খোলা প্রান্তরে এক ফোঁটা বৃষ্টির আশায়। কিন্তু সে কি সেদিন জানতে পেরেছিল; প্রকৃতি সব সময় সবাইকে দেয় না...কারও কারও কাছ থেকে হয়ত নিতেই বড় ভালবাসে। সাথীর কাছ থেকেও নিয়েছিল বড্ড বেশীই নিয়েছিল বোধহয়। আমি জানতে পারি নি সাথীর জানতে পেরেছিল কিনা হয়ত কোনোদিনও জানা হবে না; তবুও আমি যা জানার জেনে ফেলেছিলাম যে 'প্রকৃতি'ও চাওয়া পাওয়ার উপরে নয়...

অঝর ধারায় প্রকৃতির পাপমোচনের সাজানো নাটক দেখতে আমিও সেদিন হাজির হয়েছিলাম আমারই বেড়ে ওঠার রঙ্গমঞ্চ আমার বাড়ির উঠোনে...শুধু আমি নই; দেখছি সবাই আছে...করিম চাচা, রাবেয়া বুবু, হাওলাদার দাদা...আর সাথী; তার বন্ধুদের মাঝে সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে। নাটকে আমার বাবাটি খলনায়ক আর রশীদ নায়ক আর সাথী? হ্যা, সাথী এই নাটকের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ হয়েও পাট পায় নি এখনও। রঙ্গমঞ্চে বরাবরের মতো খলনায়কের কান্না উপেক্ষিত; খুবই স্বাভাবিক। তারপরেও কারিম চাচা কিংবা রাবেয়া বুবুর চোখে কি সামান্য অশ্রুর আভা দেখলাম না? আরে না, খলনায়কের জন্য কেউ কাঁদে নাকি...সেদিন সেই পাট থেকে বাবা দশ হাজার টাকা পেয়েছিল...আরে টাকা দেওয়ার সময় না সাথীর নাম শুনলাম...হু সাথীর নাম করেই তো টাকাটা দিল রফিক আহমেদ। আরে দাঁড়ান দাঁড়ান শুধু টাকা না আরো আছে...ওরা সাথী কে নাটকে একটা পাটও দিল; অসতী। গর্বে তো আমার পা মাটিতে পড়ছে না, আমার বোন এত বড় একটা সম্মান পেল। আমি সাথীর কাছে ছুটে যাই; তার পরনে মার শাড়ি। শাড়িতে তাকে বড় বড় আর অনেক সুন্দর লাগছে, ঠিক যেন শহরের কলেজ পড়ুয়া মেয়ে। কিন্তু একি! তার পরনের শাড়িটি এমন অগোছালো কেন। সে আমায় দূর থেকেই দেখতে পায়; তার মুখের হাসিটা যেন আমাকে ভাইয়া বলে ডাকছে। আমি কাছে যাই; সাথী আরো সরে যায়, যেন আমার সাথে কানামাছি খেলছে! তার পিছনে ছুটতে ছুটতে আমি বাড়ির পিছনে চলে আসি, বকুল গাছটার নিচে অনেক জটলা। আরে গাছে সাথীর শাড়িটা ঝুলছে, কেউ নামাচ্ছে না কেন। আমি ধরে নামাতে যাই বড্ড ভারী লাগল কেননা সাথীও ছিল যে শাড়ির মোড়কে। সাথী আমার কোলে নেমে আসে লক্ষী মেয়ের মত। সাথীর মুখে তার স্বভাবসুলভ হাসিটি লেগে ছিল...তাকে কোলে করেই আমি বাবার কাছে নিয়ে যাই। বাবা সামনের ঘরে শীতল পাটিতে বসে আছে; তার মুখখানা আজ যেন আরও পবিত্র লাগছে! তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে তাকে ধরতেই শুয়ে পড়ল! এতই ঘুমকাতুরে হলে তুমি বাবা? নিজের মেয়ের সবথেকে বড় বিজয়টা তুমি দেখবে না বাবা? আমি বাবার পাশে সাথী কে শুইয়ে দিয়ে চলে আসি...আবার রাস্তায়।

আজ পঁচিশে বৈশাখ। মাঝে অনেকগুলো বছর কেটে গেছে, অনেক ঘাট পেরিয়ে...আমারও একটা মেয়ে হয়েছে। নাম রেখেছি সাথী; অনেক আদরের মেয়ে আমার। হয়ত আশার জন্য রাখা ভালবাসাটুকুও ও পায় বলে...কী জানি। আজ সাথীও আশার মতো স্কুলে যায়; তবে তার মার হাত ধরে। সাথীর কথা বাবার কথা আমি আমার মেয়েকে বলি, সে শোনে আর বিস্মিত হয়। আমার সাথীও কী আশার মতোই হারিয়ে যাবে...কী জানি। এখন অনেক রাত, আমি ছাদে...বিস্তৃত আকাশে অনেক তারার উদ্ভাসিত হওয়া আর মিইয়ে যাওয়া দেখা আমার অভ্যাস। তার মাঝেই আশার কথা মনে পরে...যার চোখের দিপ্তি রাতের মনেও স্বপ্ন দেখায়............।।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা সেপ্টেম্বর, ২০১৮ দুপুর ১:০৩
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

লবণ্যময়ী হাসি দিয়ে ভাইরাল হওয়া পিয়া জান্নাতুল কে নিয়ে কিছু কথা

লিখেছেন সম্রাট সাদ্দাম, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১:৫৪

ব্যারিস্টার সুমনের পেছনে দাঁড়িয়ে কয়েকদিন আগে মুচকি হাসি দিয়ে রাতারাতি ভাইরাল হয়েছিল শোবিজ অঙ্গনে আলোচিত মুখ পিয়া জান্নাতুল। যিনি একাধারে একজন আইনজীবি, অভিনেত্রী, মডেল ও একজন মা।



মুচকি হাসি ভাইরাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

মিল্টন সমাদ্দার

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৩:০৬

অবশেষে মিল্টন সমাদ্দারকে গ্রেফতার করেছে ডিবি। এবং প্রেস ব্রিফিংয়ে ডিবি জানিয়েছে সে ছোটবেলা থেকেই বদমাইশ ছিল। নিজের বাপকে পিটিয়েছে, এবং যে ওষুধের দোকানে কাজ করতো, সেখানেই ওষুধ চুরি করে ধরা... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন চলবেই ... কারো জন্য থেমে থাকবে না

লিখেছেন অপু তানভীর, ০২ রা মে, ২০২৪ সকাল ১০:০৪



নাইমদের বাসার ঠিক সামনেই ছিল দোকানটা । দোকানের মাথার উপরে একটা সাইনবোর্ডে লেখা থাকতও ওয়ান টু নাইন্টি নাইন সপ ! তবে মূলত সেটা ছিল একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। প্রায়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ ঠেকাতে পুলিশি নির্মমতা

লিখেছেন এমজেডএফ, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১১



সমগ্র যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে বিক্ষোভের ঝড় বইছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ কর্মসূচী অব্যাহত রয়েছে। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিক্ষোভ দমনের প্রচেষ্টা চালালেও তেমন সফল... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ ০১

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×