বানানের ভুল-ভ্রান্তি আমাদের নিত্যসঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভুল বানানের ছড়াছড়ি সবখানে- খবরের কাগজের পাতায়, বিজ্ঞাপনে, সাইনবোর্ডে, টেলিভিশনের নিউজ টিকারে, চিঠি-পত্রে, দলিল-দস্তাবেজে, ব্লগে। নির্দ্বিধায় বলা যায়, অজ্ঞতা ও ভাষার প্রতি অবহেলাই এর প্রধান দুটি কারণ। উপরন্তু, বাংলা বানান খানিকটা জটিলও বটে। বাংলা যুক্তাক্ষরগুলোর বিভ্রান্তি-সৃষ্টিকারী চেহারা-সুরত ও উচ্চারণ বাড়িয়ে তুলেছে এই জটিলতার মাত্রা। এমনই কয়েকটি সন্ত্রাসী যুক্তাক্ষরকে এখানে চিহ্নিত করা হলো:
ক্ক বনাম ক্ব
ক্ক হলো ক+ক। পক্ষান্তরে, ক্ব হলো ক+ব-ফলা। কখনো কখনো এই দুটি যুক্তাক্ষরকে এক করে ফেলা হয়, কেননা যুক্তাক্ষর দুটির উচ্চারণ যেমন একই, তেমনি চেহারাতেও ভারি মিল। ক্ক যুক্তাক্ষরটি ব্যবহার করে আমরা লিখি: মক্কা, অক্কা, চক্কর, বৃক্ক, ধাক্কা, ছক্কা, ভারিক্কি। ক্ব যুক্তাক্ষরটি ব্যবহার করে লেখা হয়: নিক্বণ, পক্ব, ক্বচিৎ।
ক্ষ বনাম হ্ম
ক্ষ যুক্তাক্ষরটি গঠিত হয়েছে ক ও ষ-এর সমন্বয়ে। শব্দের শেষে ক্ষ-এর উচ্চারণ ক+খ-এর মতো। যেমন: পরীক্ষা, শিক্ষা। শব্দের শুরুতে থাকলে ক্ষ-এর উচ্চারণ খ-এর মতো। যেমন: ক্ষতি, ক্ষমা। অন্যদিকে, হ্ম হলো হ+ম। এর উচ্চারণ অনেকটা ম+ম+হ-এর মতো। যেমন: ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ব্রহ্মাণ্ড।
ক্ষ্ণ বনাম ক্ষ্ম
ক্ষ্ণ হলো ক+ষ+ণ, ক+ষ+ন নয়। যেমন: তীক্ষ্ণ। পক্ষান্তরে, ক্ষ্ম হলো ক+ষ+ম-ফলা। যেমন, লক্ষ্মীপুর।
ক্র বনাম ত্রু
ক্র হলো ক+র-ফলা। যেমন: শুক্রবার, আক্রমণ। পক্ষান্তরে, ত্রু হলো ত+র-ফলা+হ্রস্ব উ-কার। যেমন: শত্রু, ত্রুটি।
ণ্ড বনাম ন্ড
ণ্ড হলো ণ+ড। যেমন: কাণ্ড, খণ্ড। অন্যদিকে, ন্ড হলো ন+ড। ণ-ত্ব বিধানের নিয়ম অনুসারে, বিদেশী শব্দে ণ ব্যবহৃত হয় না। ফলে লন্ডন, ল্যান্ড ইত্যাদি লিখতে ন্ড যুক্তাক্ষরটি ব্যবহার করতে হবে।
ত্থ
কম্পিউটারে বাংলা টাইপ করার সময় অনেকেই ত্থ লিখতে গিয়ে সমস্যায় পড়ে যান। যুক্তাক্ষরটির চেহারা দেখে মনে হতে পারে ত্থ=থ+থ। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ত্থ যুক্তাক্ষরটি গঠিত হয়েছে ত-এর সঙ্গে থ যুক্ত হয়ে। যেমন: উত্থান, উত্থিত, উত্থাপন, অভ্যুত্থান।
ষ্ণ বনাম ঞ্চ
ত্থ-এর মতো ষ্ণ যুক্তাক্ষরটি টাইপ করতে গিয়েও অনেকে হিমশিম খান। ষ্ণ যুক্তাক্ষরটি দেখে মনে হয় এতে ষ-এর সঙ্গে ঞ যুক্ত হয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ষ্ণ হলো ষ+ণ। যেমন: তৃষ্ণা, কৃষ্ণ। ষ্ণ-এর সাথে ঞ্চ যুক্তাক্ষরটির চেহারায় খানিকটা মিল থাকায় কখনো কখনো বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়। ঞ্চ হলো ঞ+চ। যেমন: বঞ্চনা, অঞ্চল।
হ্ন বনাম হ্ণ
হ্ন হলো হ+দন্ত্য-ন। যেমন: মধ্যাহ্ন, সায়াহ্ন। পক্ষান্তরে, হ্ণ হলো হ+মূর্ধন্য-ণ। যেমন: অপরাহ্ণ, পূর্বাহ্ণ।
ভ্রু বনাম ভ্রূ
ভ্রু হলো ভ+র-ফলা+হ্রস্ব উ-কার। যেমন: বভ্রু। পক্ষান্তরে, ভ্রূ হলো ভ+র-ফলা+দীর্ঘ ঊ-কার। যেমন: ভ্রূণ।
স্থ
দেখে মনে হতে পারে স-এর সঙ্গে হ যুক্ত হয়ে স্থ গঠিত হয়েছে। কিন্তু স্থ যুক্তাক্ষরটি সৃষ্টি হয়েছে স ও থ-এর সমন্বয়ে। যেমন: স্থান, অবস্থা।
গ্ন বনাম গ্ণ
গ্ন হলো গ ও ন-এর সমন্বয়ে গঠিত যুক্তাক্ষর। যেমন: অগ্নি। কিন্তু গ-এর সঙ্গে ণ যুক্ত হলে হয় গ্ণ। যেমন: রুগ্ণ।
ঞ্জ বনাম জ্ঞ
জ ও ঞ মিলে হয় জ্ঞ। যেমন: বিজ্ঞান, জ্ঞান। অন্যদিকে, আগে ঞ ও তারপর জ মিলে হয় ঞ্জ বা ইঁয়োয়-জ। যেমন: গুঞ্জন, মঞ্জরি।
স্ক বনাম ষ্ক
স্ক হলো স+ক। যেমন: পুরস্কার, তিরস্কার, মনস্কামনা, ভাস্কর, নমস্কার। অন্যদিকে, ষ্ক হলো ষ+ক। যেমন, পরিষ্কার, আবিষ্কার, নিষ্কৃতি, চতুষ্কোণ, দুষ্কৃতি, নিষ্কাশন, নিষ্কলঙ্ক।
হৃ বনাম হ্র
হৃ গঠিত হয়েছে হ ও ঋ-কারের সমন্বয়ে। যেমন: হৃদয়, হৃত। কিন্তু হ্র=হ+র-ফলা। যেমন: হ্রদ, হ্রাস।
ন্ন বনাম ণ্ন
ন্ন হলো ন+ন। যেমন: অন্ন, ভিন্ন। পক্ষান্তরে, ণ্ন গঠিত হয়েছে ণ-এর সাথে ন যুক্ত হয়ে। যেমন: ক্ষুণ্ন, বিষণ্ন।
তথ্যসূত্র:
বাংলা বানানের নিয়ম, মাহবুবুল হক, জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনী।
বাংলা ভাষার প্রয়োগ ও অপপ্রয়োগ, শিবপ্রসন্ন লাহিড়ী ও অন্যান্য সম্পাদিত, বাংলা একাডেমী।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্য জিজ্ঞাসা, সৌমিত্র শেখর, অগ্নি পাবলিকেশন্স।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই জুলাই, ২০১০ সকাল ১০:০৪