এখন রাত তিনটা বাজে। চারদিকে সুনসান নিরবতা। আশপাশের বাতিগুলো নিভিয়ে দেয়া হয়েছে। জায়গাটা বেশ অন্ধকার। দূর থেকে ভেসে আসা বৈদ্যুতিক বাতির মৃদু আলোয় পথ খুঁজে হাঁটছি আমি। যেখান থেকে অতিক্রম করছি এটা হচ্ছে সন্ধানী। মৃদু বাতাসের সাথে ভেসে আসা পরিত্যক্ত রক্তের উৎকট গন্ধে দম আটকে আসছে। ভয়ানক এক নিরবতা বিরাজ করছে এখানে। মাঝে মাঝে দু' একটি নাম না জানা পোকা চি চি করে আওয়াজ তুলছে। এরই মাঝে এগুচ্ছি আমি। পায়ের গতিটা বাড়ানোর চেষ্টা করছি। কিন্তু........ পা দুটি হঠাৎ অতিমাত্রায় ভারী হয়ে গেছে। বুকের মধ্যে কে যেন হাতুরি দিয়ে ঘন্টাধ্বনি বাজাচ্ছে। দাঁতে দাঁত আটকে গেছে। ভিজে গেছি আমি। সমস্ত শরীরে ঘামের স্রোত বইছে। চোখ দু'টি আর সামনে তাকাতে চাচ্ছে না। কারন আমি এখন মর্গের সামনে। যেদিকেই তাকাই মনে হয় মানুষের মাথার খুলিগুলো আমার দিকে তাকিয়ে খিলখিল করে হাসছে। পিছু ফেরার উপায় নাই। আমি টের পাচ্ছি অসংখ্য মুর্দা আমার পিছু নিয়েছে। এখনি বুজি ছুঁয়ে দিবে ওরা। নাহ, আমি আর পারছি না। শরীরটা নিথর হয়ে আসছে। আমি কি তাহলে বিলিন হয়ে যাচ্ছি ?
এখন আমি কোথায়? একি! এটা তো হিমঘর। আজ সন্ধ্যায় ক্লাস সিক্সের যেই ছেলেটি মারা গেল ওতো এখানেই আছে। ওর শেষ কথাটি শুনেছিলাম, "আমি চলে যাচ্ছি মা, বাবা আমি মরে যাচ্ছি। তোমরা আমাকে ক্ষমা কর।" সত্যিই ও চলে গেছে অনেক দূরে। বাবা, মা, আত্মীয়স্বজন সকল কে রেখে আজ এই ভয়াল হিমঘরে ও একা!! কি অবস্থায় আছে ও? চিংড়িকে বরফে রাখলে তার এন্টেনাগুলো বের হয়ে থাকে। ওর হাত, পাগুলোও কি বের হয়ে আছে সেভাবে? নাহ, আমি আর ভাবতে পারছি না। আজ বিকেলের সেই ফুটফুটে ছেলেটি রাত্রিবেলায় যে এত ভয়ানক হয়ে উঠবে ভাবতেই পারিনি। এখন ও-ই তো আমাকে তাড়া করছে। ওর নখগুলো এত বড় কেন? ওর দাঁতগুলোও কি বিশাল! এমন করে তাকিয়ে আছে কেন আমার দিকে?? এখানে আর থাকা যাচ্ছে না। যাব কোথায়? ওদিকের দরজাটা কি খোলা? হ্যা খোলাই তো মনে হচ্ছে। খোদা বাঁচালেন।
এখন আমি খোলা আকাশের নিচে হাঁটছি। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। আশপাশের বাগানগুলো বেশ নিস্তব্ধ। মাঝে মাঝে শুকনো পাতার মধ্যে কিসের যেন খচমচ শব্দ শোনা যায়। হাসনাহেনার ঘ্রান পাচ্ছি। কিন্তু আজকের হাসনাহেনার ঘ্রান অন্যান্য দিনের চেয়ে বেশ তীব্র মনে হচ্ছে। মৃদু বাতাসে গাছের শাখাগুলো কাঁপতেছে। সাহস নিয়ে তাকালাম ওদিকে। ওকি! গাছের মাথায় ওরা কারা? তোরা তাহলে এখনো আমার পিছু ছাড়িসনি? এই ধরে ফেলবি না তো আমাকে? আমি সামনে দৌড়াচ্ছি। দূরে ল্যাম্পপোস্টেরর আলোতে একটি ভবন দেখা যাচ্ছে। ওটা প্রশাসনিক ভবন। এতবড় ভবনের সামনে একমাত্র প্রানী আমি। আমার চোখ এখন আর সামনে তাকাতে সাহস পায়না। কারন, আমি জানি ওরা এখনো আমার পিছু ছাড়েনি। সুতরাং ল্যাম্পপোস্টেরর বাতির দিকে তাকিয়ে হাঁটাই এখন উত্তম কাজ। হাঁটছি আমি। গা ছমছম করছে। ভয়ে শরীর শীতল হয়ে আসছে। আমি যাকে বাতি ভেবেছি ওগুলো আসলে বাতি নয়। ওগুলো কার যেন রক্তাক্ত দুটি চোখ। হ্রৎপিন্ডের ভিতর ধপাস ধপাস শব্দ হচ্ছে। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। আমি এখন চোখ বন্ধ করে দৌড়াচ্ছি। আমার সাথে শা শা করে দৌড়াচ্ছে কতগুলো জন্তু। ঘেউ ঘেউ শব্দে ওরা পুরো এলাকা মাতিয়ে তুলেছে। ওদের সাথে প্রতিযোগিতা করা অসম্ভব। আমার এখন একমাত্র আশ্রয় সামনের এই মসজিদটি। উঠে পড়লাম মসজিদে। আমার সাখে মোবাইল এবং মানিব্যগ যা পরবর্তী দিনগুলোর সম্বল। সুতরাং নিচতলার বারান্দায় থাকা ঠিক হবে না। সিড়ির মাঝ বরাবর মুর্দা খাটটি শোয়ানো। জীবনে বহুবার মুর্দা খাট দেখেছি, ধরেছি। কিন্তু আজকের মত এত ভয়ংকর মনে হয়নি কখনও। মনে হচ্ছে খাটের মাঝে কেউ শুয়ে আছে। আমি উঠছি দোতলায়। ও উঠছে আমার সাথে সাথে। শুয়ে পড়ছি আমি উপুড় হয়ে। হাতে মোবাইল নিয়ে টিপতেছি। পিছু ফেরার সাহস নেই। কারন ওরাও আমার পিছু নিয়েছে।
আজ আর আমার ঘুম হবে না। গোটা হাসপাতালটা একটা মরণকূপে পরিণত হয়েছে। সকাল থেকে ১০/১২ জন মানুষকে মরতে দেখেছি। এমন মরনকূপে কেউ ঘুমাতে পারে না।
১২/৬/১৫ ইং
রাত ৪.০০ টা।