চোখ বন্ধ করে লোকটা বিড়বিড় করে বলে উঠলো, আপনি কত ছোট বেলার কথা মনে করতে পারেন? প্রতিদিন অফিস থেকে বেড়িয়ে জয়িতা পার্কে একবার চক্কর মারে। তারপর এসে বসে শেষ মাথার এই বেঞ্চটাতে। সচারচর এই দিকটায় কেউ আসে না। সন্ধ্যার দিকে হয়তো কোন যুগল এখানে আসে, বর্তমানের কথা বলে, ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখে। হয়তো সন্ধ্যার পরে স্বার্থণ্বেষী কোন মধ্যবয়েসী পুরুষ এখানে অর্থের বিনিময়ে যৌণতৃপ্তি খোঁজে, তৃতীয় লিঙ্গের কিছু লোক এখানে ঈশ্বরপ্রদত্ত নারী অবয়বের সর্বোচ্চ ব্যবহার করে পেটের তাগিদে, জয়িতা শুনেছে। হয়তো পত্রিকাতেও দেখেছে কয়েকবার। কিংবা কোন গৃহহীনের সারারাত পিঠ ঠেকাবার জায়গা হতে পারে এই বেঞ্চি। ঘামে, বীর্যে কিংবা শিশিরে মাখামাখি হয়ে থাকা এই সিমেন্টের পাকা বেঞ্চটাও বিকেলের শুরুতে কেমন পবিত্র হয়ে ওঠে, সূর্য্যের দীপ্তকিরণ সমস্ত পাপবোধকে শুষে নিয়ে যায়, বাষ্প হয়ে ঊড়ে যায় আকাশে। এরপর রোদ কমে এলে ঝিমিয়ে পড়তে শুরু করে ইট বালু সিমেন্টের এই মানবধারক। তখন হয়তো একটা দোয়েল এসে বসে এখানে। হয়তো রেইন্ট্রি গাছের কয়েকটা পাতা এসে পড়ে এখানে সেখানে। জয়িতা আসে তখন। বিকেলের শুরুতে। রোদ তখন আমুদে মিষ্টি উষ্ণতা সর্বত্র ছড়িয়ে রেখে বলতে থাকে, এবার তবে যাই! জয়িতা এই বিদায়পূর্ব দিবালোকের আকুঁতি বুঝতে পারে। বাতাসের সাথে সাথে সেই আকুঁতি ছড়িয়ে পরে সর্বত্র। চুল ওড়ে তার। কখনো হয়তো আচঁল খসে পরে কাধ থেকে। বড্ড ক্লান্তি লাগে ওর। মনে হয়, দিনের এই সময়টাতে সহস্রমানুষের মধ্যকার এই এক-টুকরো নির্জনতার মধ্যে আলুথালু হয়ে হাত পা ছড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়তে পারলে কি ভালোই না হতো। মাটি থেকে লতানো ফুলের গাছ বেয়ে উঠতো শরীরে। চুলের ফাকে ফাকে, ভ্রুতে, বুকেতে কিংবা যোণিতে ফুটে উঠতো অজস্র ঘাসফুল! নাম না জানা পাখিরা এসে বসতো বাহুতে, তারা যে যার মতো গেয়ে বেড়াতো বিষাদের গান। হয়তো একটা ভ্রমর এসে বসতো চোখে, কিংবা মৌমাছি এসে মধু নিয়ে যেতে ঠোট থেকে। পিঁপড়ার দল পায়ে উঠে এলেও সে অনড় পরে থাকতো। তারা বাসা বাধতো তলপেটে। তারা চোরা গলি তৈরী করতো শরীরের ভাজে ভাজে। তা তো আর হওয়ার নয়, তবু ভালো লাগে জয়িতার। হয়তো একটা দোয়েল ডেকে ওঠে, হয়তো লিলুয়া বাতাসে আঁচল খসে পড়ে কাধ থেকে, হয়তো সূর্য্যালোক চিৎকার দিয়ে কেঁদে ওঠে, বলে, এবার আমি সত্যিই যাচ্ছি; আমাকে আটকাও।
প্রথম দিকে লোকটা আসতো। পায়েচারী করতো এলোপাথাড়ি। জয়িতার অস্বস্তি হতো। দিন দুয়েক উঠে চলেও এসেছে। তবু লোকটা আসতো। এরপর আর জয়িতা ওঠেনি। লোকটা তবু বড্ড নির্লজ্জের মতো পার্কের এই দিকটাতেই আসতো রোজ। দেখে হঠাৎ করেই বয়েস আন্দাজ করা যায় না, কানের দুপাশের চুলে পাক ধরেছে। কাচা পাকা দাড়িভর্তি মুখে রাজ্যের গাম্ভীর্য। ফর্সা মুখ, চওড়া বুক, সাধারণ বাঙালীর তুলনায় একটু বেশিই লম্বা। কিজানি আফগানী বা পাকিস্তানি হলেও হতে পারে। জয়িতার মনে হতো, দিনের এই বিশেষ সময়টাতে, পার্কের এই বিশেষ জায়গাটা শুধুমাত্র তার। ব্যাক্তিগত আসর। সেখানে হঠাৎ অচেনা পুরুষের আগমন অনেকটা অন্দরমহলে ঢুকে পড়া অচেনা লম্পটের গতিপথের মতই। তবু জয়িতা মেনে নেয়। একদিন, দু দিনের অচেনা মুখ দিনে দিনে পরিচিত হয়ে উঠতে থাকে। তবু তাদের কথা হয়না। লোকটা পায়চারি করে এলোপাথাড়ি। এরপর, একদিন এসে বসে বেঞ্চটিতে। বসেই থাকে। তবু কথা হয়না। হয়তো একটা দোয়েল ডেকে ওঠে, হয়তো অঝড়ে ঝড়তে থাকে মৃত পাতারা, দিনের আলো চিৎকার দিয়ে জিজ্ঞেস করে, আমি তো চললাম কিন্তু তোমার পাশে এই লোকটা কে জয়িতা? জয়িতা উত্তর দেয় না। যেই হোক, তার কি যায় আসে। আসে, নারীসুলভ ব্যক্তিত্ত্বের এখানে অবশ্য কিছুটা আসে যায়। তার আঁচল চাইলেই এখন খসে পড়ে না দমকা বাতাসে। কিংবা সর্বাঙ্গে ঘাসফুলদের ফুটে ওঠার পবিত্র অনুভূতি সে উপভোগ করতে পারে না, কোথায় একটা আটকে যায় তার নিষ্পাপ ভাবনারা। ভাবনার অন্দরমহলেও একটা অচেনা পুরুষ এসে বসে থাকে। নির্বাক। কোন কথা হয় না, না ভেতরে, না বাহিরে।
দিন যেতে থাকে। দুম করে বর্ষার মৌসুম চলে এলে মাঝে মাঝে এইদিকে আসা হয়না জয়িতার। লোকটা কি তখনও আসে? জানার তীব্র আকাঙ্ক্ষা থেকে যার ওর। একদিন চলেও আসে ছাতি মাথায়। একহাতে শাড়ির কুচি ধরে সাবধানে পা ফেলে। দূর থেকে দেখে, লোকটা বসে আছে। নির্বিকার ভাবে ভিজছে। কোন তারা নেই তার আচরনে। কোন কথা নেই মুখে, চোখে কিংবা হাতের আঙুলে। বৃষ্টি বিহীন দিনগুলোতে তারা পাশাপাশি বসে থাকে। মেঘে ঢাকা আকাশে চাপা পড়ে যায় সূর্য্যের মুখ, তবু সেই আকাশ কেটে বিকেলের সূর্য্য একটা দুটো সূর্য্যালোকের থাম পাঠায়। ন্যাড়া কদমের ছড়িয়ে রাখা চুলের হলুদ আভায় তার আঁকুতি লেগে থাকে, আমি চললাম, আমাকে আটকাও। কে কাকে আটকাবে? কার কিসে কি এসে যায়। তবু তাদের কথা হয় না। লোকটা বসে থাকে নির্বাক। হয়তো একটা পিঁপড়া উঠে আসে শরীরে, হয়তো ঠান্ডা বাতাসে শিহরণ জাগে শরীরে, কিন্তু কোন কথা ফোটে না কারো মুখে। না জয়িতার। না লোকটার।
হঠাৎ করেই আজকে লোকটা মুখ খুললো। প্রথমবার। যেন বহুদিনের চেনা, এমন স্বরে বিরবির করে জিজ্ঞেস করলো সামনের দিকে তাকিয়ে, আপনি কত ছোট বেলার কথা মনে করতে পারেন? জয়িতা চমকে ওঠে। আমাকে কিছু বললেন? মৃদ্যু হেসে লোকটা আবার জিজ্ঞেস করে, কত ছোট বেলার কথা আপনার মনে আছে? এটা কি ধরনের প্রশ্ন! চেনা নেই, জানা নেই, হুট করে এই প্রশ্ন ক্যানো কোন ভদ্রলোক করবে? তবু জয়িতা ভাবতে শুরু করে দেয়। আবছা কত স্মৃতি। ফ্রক পড়ে সে দৌড়ুচ্ছে মাঠের মধ্যে, দীগন্তজোড়া ধানের ক্ষেত, হলুদে হলুদে সয়লাব। তখন কত বয়েস? আট-নয়! ভাবনায় দৃশ্যপট বদলায়, সে লাফিয়ে পরে পুকুরে। উত্তর পাড়ার ডাক্তার জ্যাঠার ছেলে ডুব দেয়, টেনে ধরে তার পা, জলের নিচে! হাবুডুবু খায় সে, ডুবু যেতে থাকে। আবার ভেসে ওঠে। আবার ডুবে যায়। কিংবা, তারো আগে, ঝাপসা সাদা, ঘোলাটে। মা কোলে তুলে নিয়েছে জয়িতার ছোট্ট শরীর। হাতে কিছু একটা প্রাণপনে আটকে রেখেছে সে। উহু, কাউকে দেবে না সেটা। কি ছিলো সেটা। চকলেট? কোন খেলনা? কি জানি! জয়িতা ভাবে। কত ছোট বেলা আছে তার স্মৃতিতে? কত আগের ছবি এখনো ঘাটলে দেখা যায়!
লোকটা আবার কথা বলে ওঠে। আমি আমার জন্মের মুহূর্তও মনে করতে পারি। মানে পারতাম। এতোদিন। হঠাৎ করে একদিন আমার মনে হলো, আমি তারও আগেকার কিছু একটা দেখতে পাচ্ছি। স্পষ্ট। আমার হাতে শেষ জীবনকার কুচকানো চামড়ায় পচন ধরেছে। বুকের বা দিকটা থেকে কোমড় পর্যন্ত নিঃসাড়। আমি অনুভব করতে পারতাম। এমনকি চামড়া পচা দুর্গন্ধটাও যেন আমি পাচ্ছিলাম। কিন্তু এতো ছোট বেলার স্মৃতিতে সেই কুঁচকানো, পচা চামড়া, অথর্ব দেহের উটকো স্মৃতিরা কোথা থেকে এলো আমি ভেবে পেলাম না। আমি বোকা বনে গেলাম প্রথমদিন। এরপর আরো, আরো অনেক অনেক ছবি, অনেক ধারাবাহিক স্মৃতিরা ফিল্মের মতো আমার চোখে ভেসে এসেছে জানেন! আরো আগের, আমি বৃদ্ধ থেকে মাঝবয়েসী, মাঝ বয়েসী থেকে যৌবনের স্মৃতি খুঁজে পেতে শুরু করলাম, অথচ ওসব তো আমার নয়! কিন্তু এরা আমার স্মৃতিকোটরে কিভাবে বসে গেলো, কি অদ্ভুত না বলুন?
পাগল নাকি লোকটা? জয়িতার একটু আধটু ভয় হয়। কথা নেই, বার্তা নেই আষাঢ়ে গল্প জুড়ে বসেছে। জয়িতার খানিক মনে হয়, লোকটা অপ্রকৃতস্থ, আবার পরক্ষনেই মাথায় আসে, কোন খারাপ মতলব নেই তো লোকটার? কি জানি কোথাকার কোন বাজে লোক, হয়তো খুনে, হয়তো ধর্ষক! জয়িতার শরীর শিউরে ওঠে। তবু সে নিজেকে সামলায়। কেননা তখনও বিকেল জেগে আছে, তখনও দিবালোক বলছে, আমি চললাম, আমাকে আটকাও; নতুবা এই লোকটা তোমাকে ছিবলে খাবে দেখো। তখনও দু একটা দোয়েল ডেকে উঠছে এখানে সেখানে, কিছু মৃত পাতারা তখনও আসেপাশে উড়ে বেরায়। প্রকৃতিকে খুব ভরসা করে সে। জয়িতা সাহস পায়, মুখে বলে ওঠে, আমাকে ক্যানো বলছেন এসব!
লোকটা মৃদ্যু হাসে। বলে, আপনাকে আমি দেখেছি।
আমার স্মৃতিতে।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


